মন_পাড়ায় পর্ব_৫৭

মন_পাড়ায়
পর্ব_৫৭
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

জীবনটাও ভীষণ অদ্ভুত। কার সম্পর্ক কখন পাল্টে যায় কেউ ধারণাও করতে পারে না। মুহূর্তে কেউ আপন হয়ে যায় আর কেউ পর।

রাতে প্রভা ও অর্ক হাস্পাতালে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। তাই সৈকত, ঝিনুক ও ঝিনুকের খালামণি বাসায় গেল। বাসায় ঢুকে ঝিনুকের খালামণি সৈকতকে বলল,
“বাবা তুমি যেয়ে একটু আরাম করো। গতরাতে অনেক জার্নি করেই এসেছ।”
ঝিনুক বলল,
“খালামণি কিছু রান্না করব?”
“না তুইও যেয়ে আরাম কর। তোর উপর কম তুফান যায় নি।”
সৈকত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল কথাটা শুনে। তার সন্দেহটা আরও গাঢ় হয়ে গেল। ঝিনুক কাওকে বাঁচানোর জন্যই মিথ্যে বলেছে।
অবশ্য সে মানুষটা কে তা জানার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হলো না। হঠাৎ এক রুম থেকে পরিশ বের হলো। তাকে দেখেই ঝিনুক চমকে উঠলো। ভয়ে পিছিয়ে গেল। সৈকতের পিছনে লুকিয়ে তার শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরে।
সৈকত অনেকটা বিস্মিত হয় পরিশের মাতাল অবস্থা দেখে। সে ধারণা করতে পারছে ঝিনুকের সাথে পরিশ কিছু একটা করেছে। যা সে কখনো ভাবেও নি। সে জানতো পরিশ তাকে ও ঝিনুককে আলাদা করতে চায় কিন্তু এর মধ্যে সে ঝিনুকের ক্ষতি করতে পারে সে কখনো ভাবেও নি।

পরিশ এসে ঝিনুকের সামনে দাঁড়িয়ে কান ধরে বলল,
“সরি সোনা কাল আমি তোকে কষ্ট দিয়েছি। আমি ইচ্ছা করে দেই নি সত্যি। তোর কী অনেক বেশি ব্যাথা লেগেছে?”
পরিশের মা তাকে দেখে দৌড়ে এলো তার সামনে। তার হাত ধরে বলল,
“তোকে না বলেছি তুই বাসার বাহিরে যা। তুই এখানে কী করছিস? তুই আবার নেশা করেছিস? গতকালে ঘটনার পরও….”
পরিশ তার মা’য়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে ঝিনুককে বলল,
“দোষ তো তোরও আছে সোনা। তুই যদি আমার সাথে বিয়ে করতি তাহলে কী আমি এমনটা করতাম বল?” সে ঝিনুকের হাত ধরতে চাইলেই সৈকত তার হাত শক্ত করে ধরে ঝিনুক থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমার বউকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে এখানে খুন করে কবর দিয়ে দিব। তোর সাহস কীভাবে হয় ওকে কষ্ট দেওয়ার?”
পরিশ সৈকতের কলার ধরে বলে,
“কুত্তা, সব তোর দোষ। তুই আসছিস আমাদের মাঝে, নাহয় আমরা কখনো আলাদাই হতাম না।”
সৈকত পরিশের রাগের মাথায় গায়ে হাত তুলতে যাবে আর পরিশের মা বলল,
“বাবা…বাবা ও নেশায় আছে। প্লিজ এমন কিছু করো না। মাফ করে দেও ওকে বাবা।”
সৈকত পরিশের মা’য়ের অসহায় দৃষ্টি দেখে থেমে গেল।
কিন্তু পরিশ ঠিকই সজোরে ঘুষি মেরে বসে সৈকতের মুখে। পরিশের মা তাকেও থামাল। লাভ হলো না। সে আরেকবার মারল সৈকতকে। পরিশের মা তাকে থামাতে গেলে তাকেও ধাক্কা দিলো।
পরিশের মা’য়ের চোখের জল দেখে সৈকত নিজেকে শান্ত রেখেছিলো বটে কিন্তু পরক্ষণেই এমন বেমানান দৃশ্য দেখে তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সে পরিশকে এমন এক ঘুষি দিলো যে সে মেঝেতে পড়ে গেল। তারপর সে রাগান্বিত স্বরে বলল,
“তুই যে ঝিনুকের জন্য এতকিছু করছিস না সে ঝিনুককে তুই কখনো ভালোই বাসিস নি।”
পরিশ চিৎকার করে উঠে,
“তুই বেশি জানিস?”
“হ্যাঁ জানি। কারণ যে মানুষ তার জন্মদাত্রীকে ব্যাথা দিতে একবারও ভাবে না সে মানুষ অন্যকারও কথাও ভাবতে পারে না। আর আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে নিজ ইচ্ছায় ব্যাথা দিতে পারি না। কোনো ভাবেই না।”
সৈকত একই সুরে উওর দিলো।
তারপর পরিশের মা’কে মেঝের থেকে উঠিয়ে সোফায় বসালো। তার চোখের জল মুছে। দুইহাত ধরে বলল,
“খালামণি সকল মা তাদের সন্তানকে সব কষ্ট থেকে রক্ষা করতে চায়। মা’য়ের মনটাই যে এমন। নিজের থেকে বেশি সন্তানের জন্য ভাবে। কিন্তু যখন সে সন্তান নিজের জন্য, অন্যের জন্য এবং সমাজের জন্য ক্ষতি হয়ে দাঁড়ায় তখন সে মা’কেই তার সন্তানকে কষ্ট দিতে হয়। কখনো কখনো কষ্টতেও মুক্তি থাকে।”
বলেই সৈকত চলে গেল ঝিনুকের রুমের দিকে। ঝিনুক সে রুমে নীরব দর্শকের দায়িত্ব পালন করল শুধু।
.
.
একইদিন পরই প্রভা ও অর্ক রওনা দেয় তার বাসার উদ্দেশ্য। যেহেতু বিনু এবং অদিন সেখানে একা। কাজের খালা তাদের দেখে রাখলেও তাদের সামলাতে পারছে না। তারা এখনো সেদিন রাতের ঘটনা জানে না। কিন্তু পরিশের ড্রিংক ও ড্রাগস নেওয়ার কথা জেনেছে। তাকে রিহ্যাবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রভার মা-বাবা।

বাসায় এসে আরেক সমস্যার সম্মুখীন হয় অর্ক। বিনু থাকতে চাইছে না অর্কের সাথে। তার মনে হচ্ছে অর্ক তার মা’কে ছিনিয়ে নিচ্ছে তার থেকে। এইসব যে বিনয়ের মা এই পিচ্চি মেয়েটাকে বুঝাচ্ছে তা বুঝতে বাকি রইলো না কারও। নাহয় এত শান্ত একটা মেয়ে এভাবে ব্যবহার করবে তা অকল্পনীয়।

ক্রোধ নিয়েই অর্ক বাড়ির বাহিরে এলো। ফোন বের করে কল দিলো বিনয়ের মা’কে। ওপাশ থেকে কিছু বলার পূর্বেই অর্ক বলল,
“নিজেকে ভীষণ চালাক মনে করেছেন তাই না?”
“মনে করার কি আছে বাবা? চালাক না হলে কী এত কিছু অর্জন করতে পারতাম?”
অর্ক তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আপনি মোটেও চালাক না খালা। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আপনার সংসার চালানোর টাকাটা আমি দিতাম। আপনার ছেলের যে চাকরিটা আছে না? যেটা আমি যোগাড় করে দিয়েছিলাম তা কাল সকালের মধ্যে চলে যাবে। আপনি আমার সংসারে অশান্তি করে সুখে থাকবেন? অসম্ভব।”
“তুমি….. ”
“হ্যাঁ আমি বিনুর বাবা ওর স্কুলেও আপনার যাওয়াও বন্ধ করিয়ে দিব। তখন কীভাবে দেখা করবেন বিনুর সাথে? ওর কান ভরবেন কীভাবে? আর আপনি অতিরিক্ত করলে পুলিশের কাছে যেতেও দ্বিধা করব না আমি। শেষ ওয়ার্নিং দিচ্ছি, যদি আপনার এইসব ফাইজলামি বন্ধ না করেছেন তাহলে আপনার জন্য অনেক খারাপ হবে। এমন খারাপ যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আমার পরিবার ও বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকবেন।”
ওপাশ থেকে কিছু বলতে নিলো বিনয়ের মা। সে শুনলো না। কল কেটে দিলো। এরপর গাড়িতে উঠে রওনা দিলো কোথাও।

ইকবালের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো অর্ক। কলিংবেল চাপ দিলো। দরজাটা খুলল ইকবালের বোন। সে কতক্ষণ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারলো না। অতঃপর সে বলল,
“স্যার আপনি! আমিও পাগল আপনাকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আসুন বাসায় আসুন।”
আবার উঁচু স্বরে বলল,
“মা দেখ কে এসেছে?”
অর্কের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি আবার বলল,
“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না আপনি আমাদের বাসায় এসেছেন।”
অর্ক মৃদু হেসে বলল,
“আরেকদিন বাসায় ঢুকবো, আজ নয়। আজ একটু জরুরী কাজে এসেছি। তোমার আন্টিকে একটু ডাক দেও।”
বলার সাথে সাথেই মেয়েটি দৌড়ে গেল। কিছু মুহূর্ত পর নিয়ে এলো সৈকতের মা’কে। সেও অর্ককে দেখে হতবাক। কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না অর্ক থেকে।
অর্কও কিছু বলল না। ফোনটা হাতে নিয়ে কাওকে কল দিলো শুধু,
“হ্যালো সৈকত…..”
“জি ভাইয়া বলো।”
“আমি আমাদের মা’কে আমার সাথে নিয়ে গেলাম। তোর সমস্যা আছে?”
কথাটা শুনতেই রোমা বেগম চমকে উঠে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় অর্কের দিকে। হঠাৎ করেই তার চোখদুটো সিক্ত হয়ে আসে।
ফোনের ওপাশ থেকে অনেকসময় কোনো শব্দ আসে না। এরপর বিস্মিত কন্ঠ ভেসে উঠে,
“তুমি আমাদের মা বলেছ!”
“হ্যাঁ।”
“তোমার মা তুমি সেখানে নিয়ে যেতে চাও যেতে পারো। আমার তোমার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া মানায়। তোমার আমার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়াটা বেমানান।”
সৈকতের কন্ঠে খুশি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
অর্ক রোমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মা, আপনার বাসায় যাওয়া যাক?”
রোমা বেগম ভেজা নয়নজোড়া নিয়েই প্রশস্ত হাসি দিলেন।

গাড়িতে উঠে বসলো দুইজন। অর্কের মনে পড়ে বিনুর কথা এবং তার সাথের স্মৃতিগুলো। অবশেষে মনে পড়লো প্রভার সেরাতের কথাটা। ভুল বলে নি প্রভা। সে কিছুমাস চেষ্টা করে এত ক্লান্ত হয়ে পড়লো আর মা তো এত বছর ধরে চেষ্টা করছে। তার কষ্টটাই কখনো দেখা হলো না। কিছু কষ্ট যতদিন নিজের উপর দিয়ে না যায় ততদিন অন্যের বেদনা বুঝা যায় না। আর কখনো কখনো বুঝতে দেরি হয়ে গেলে অনেক পাওনা হারিয়ে যায়।
গাড়িতে কেউ কোনো কথাই বলল না। এত বছরের অস্বস্তি তো আর একদিনে যায় না।

বাড়ি আসার পর দরজা খুলল প্রভা। তার শাশুড়ীকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তাকে ছেড়ে অর্কের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির হাসি দিলো।

ভেতরে ঢুকার সময় অর্কের বাবা বের হচ্ছিল তার রুমের থেকে। তার স্ত্রী দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“শেষমেশ এসেই পরলে। তোমার ছেলে যেভাবে বের হয়েছিলো মনে হচ্ছিলো আর আসবেই না এ বাড়িতে।”
অর্ক মা’য়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি এনেছি। এটা তারও বাড়ি।”
অর্কের বাবা কোনো উওর দিলেন না। সোজা গেলেন ড্রইংরুমে। ভেতরে ঢুকে মৃদু হাসলেন। তার মনটাও হঠাৎ ভালো লাগছে। সোফায় বসে হাতের ফাইল খুলে দেখতে শুরু করলেন। তখনই ফোন এলো তার। ফোন কার তা না দেখেই রিসিভ করে কানের কাছে নিলেন। কাজে ব্যস্ত থেকেই বললেন,
“কে?”
“স্যার আমি নুরুলদীন।”
“হ্যাঁ বলো, কী কাজ?”
“স্যার ওই অঞ্জলির আর ভাদ্র বাবার বিয়ের কথাটা বলার জন্য কল দিয়েছিলাম।”

চলবে…….

[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]

পর্ব-৫৬ঃ https://www.facebook.com/828382860864628/posts/1278770445825865/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here