মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-১০
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
“তুমি কি সবসময়-ই এরকম?”
খেতে বসে প্রিয়া জিজ্ঞেস করল বিভোরকে। বিভোর প্লেটে মাংস নিতে নিতে প্রিয়ার দিকে তাকাল।
“কী রকম?”
“এইযে সবসময় কেমন গম্ভীর হয়ে থাকো।তোমাকে দেখলে মনে হয়, কোনো মেয়ের বিরহে দেবদাস হয়ে আছ।”
বিভোর কিছু বলল না। চুপচাপ খেতে লাগল। প্রিয়া বলল,
“গার্লফ্রেণ্ড আছে?”
কয়েক সেকেণ্ড চুপ থেকে বিভোর বলল,
“এখন নেই।”
“তাহলে আমি ঠিকই ধরেছি। গার্লফ্রেণ্ডের বিরহে তোমার এই হাল।”
“আমাকে তোমার গম্ভীর মনে হয়?”
“হুম। কিছুটা তো হয়-ই। শোনো, জীবনটা সুন্দর। সুন্দর জীবনটাকে সুন্দর মতন উপভোগ করো। যে গেছে সে তো গেছেই। তাকে নিয়ে না ভেবে যে জীবনে আসবে বা আসতে যাচ্ছে তাকে নিয়ে ভাবাটাই শ্রেয়। তাই না?”
বিভোর তাকাল প্রিয়ার দিকে। সে প্রিয়াকে কিভাবে বলবে যে, পৃথুলা তাকে নয় বরং সেই পৃথুলাকে ছেড়ে দিয়েছে! আর প্রিয়া যে বলল, যে জীবনে আসতে চাচ্ছে তাকে নিয়ে ভাবা উচিত, এটা দ্বারা প্রিয়া কি বোঝাতে চাইল?
.
কলিং বেল বাজার শব্দ পেয়ে দরজা খুললেন মাহিমা বেগম। পাংশুটে মুখ নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন আনিসুল ইসলাম। তার মুখটা ফ্যাকাসে। ভেতরে ঢুকে সোজা চলে গেলেন নিজের ঘরে। পিছুপিছু গেলেন মাহিমা বেগম।
“চা খাবে?”
“নাহ।”
বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন আনিসুল ইসলাম। চোখে তার একরাশ হতাশা। মাহিমা বেগম স্বামীর গা ঘেষে বসলেন। বললেন,
“কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
জবাব দিলেন না আনিসুল ইসলাম। তার সাড়া না পেয়ে মাহিমা বেগম বললেন,
“কি হয়েছে বলবে তো। চোখ মুখের এমন অবস্থা কেন?”
আনিসুল ইসলাম ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“থানায় গিয়েছিলাম কিছুক্ষণ আগে। আসাদ হক মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তার ভাতিজাকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। আমাদের মেয়েটার অপরাধীর শাস্তি কি হবে না?”
মাহিমা বেগম কিছু বললেন না। কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কষ্ট পেলেও সেটা প্রকাশ করলেন না। কি লাভ প্রকাশ করে? টাকা আর ক্ষমতার কাছে তারা যে অসহায়, বড্ড অসহায়।
কেবিনের দরজায় টোকা পড়ল। ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই বিভোর বলল,
“কামিং।”
হাই হিলে গট গট শব্দ তুলে ভেতরে প্রবেশ করল কেউ। বিভোর চোখ তুলে প্রিয়াকে দেখল। হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটের কোণে।
“আরেহ তুমি! আমাদের অফিসে!”
“বসতে পারি?”
“বসো বসো।”
প্রিয়া সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল,
“কেন? আসতে পারি না?”
“নিশ্চয়ই।”
“কাজ করছিলে? ডিস্টার্ব করলাম।”
“একদমই না। এমনিতেও এখন উঠতাম। লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে। কী খাবে বলো? চা নাকি কফি?”
“কোনোটাই না। আমিও লাঞ্চ করিনি। চলো খেয়ে নিই।”
“হুম ঠিকাছে। ওঠো।”
অফিস থেকে বেরিয়ে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল ওরা। বিভোরের আর অফিসে ফেরা হলো না। দুপুর থেকে সন্ধ্যে অবধি প্রিয়ার সাথেই কাটল ওর পুরোটা সময়।
…
রাতে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়ার পর থেকে এলোমেলো ভাবনাগুলো ঘূর্ণিচক্রের মতো অনবরত ঘুরছে বিভোরের মাথায়। সন্ধ্যের ঘটনাটা ভাসছে চোখের সামনে।
দিনের আলো কেটে গিয়ে প্রকৃতির বুকে অন্ধকার যখন চাদর বিছাতে শুরু করল, ঠিক তখনই হুট করে প্রিয়া চুমু খেল বিভোরকে। বিভোর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল প্রিয়ার দিকে। প্রিয়া বিভোরের চোখে চোখ রেখে বলেছিল,
“ভালবাসি তোমায় বিভোর। সারাজীবন ভালবাসার অধিকারটুকু দেবে আমায়?”
তাৎক্ষণিক বিভোর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। কেবল বলেছিল,
“আমার একটু সময় লাগবে।”
প্রিয়া সাথে সাথেই বলেছিল,
“তুমি সময় নাও। আমি অপেক্ষায় থাকব।”
বাসায় ফেরার পর থেকে প্রিয়াকে নিয়েই ভেবে যাচ্ছে বিভোর। একটা কথা আছে, ‘প্রকৃতি শূণ্যস্থান রাখে না’। প্রকৃতি কি তাহলে পৃথুলার শূণ্যস্থানটা প্রিয়াকে দিয়ে পূরণ করতে চাইছে?
পৃথুলার পড়াশুনা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক স্বপ্ন ছিল সে একজন ডাক্তার হবে। দেশের সেবা করবে। দিবানিশি খেটে পড়াশুনা করে মেডিকেলে চান্স পেয়েছিল। দিনরাত এক করে পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছিল। তার সেই সাধের ডাক্তারি পড়া শেষ করা হলো না। ভেঙে গেল ওর সব স্বপ্ন। পৃথুলার বাবা মা অনেক জোর করেও তাকে পড়াতে পারল না। পৃথুলার কাছে এখন নিজের জীবনটাই অভিশপ্ত মনে হচ্ছে। তার এই অভিশপ্ত জীবনে নেই আশা, নেই কোনো স্বপ্ন।
ব্রেকফাস্ট সেড়ে আসাদ হক ও বিভোর একসাথে বের হলো অফিসের উদ্দেশ্যে। বিভোর ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে বসেছেন আসাদ হক।
“প্রিয়া মেয়েটা কেমন?”
বিভোর একবার আসাদ হকের দিকে তাকাল। তারপর সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলল,
“ভালোই।”
“আমার মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে। দেখতেও সুন্দরী। সব দিক দিয়েই পারফেক্ট। আমি জানি না তোমাদের মধ্যে আদৌ সে রকম কোনো সম্পর্ক হবে কীনা। যদি হয়, আমি এতে খুব খুশী হব।”
বিভোর কিছু বলল না। চুপচাপ ড্রাইভিং করতে থাকল।
..
কিছুদিন পরের ঘটনা। পৃথুলা আনিসুল ইসলামকে নিয়ে হসপিটালে গেল৷ পৃথুলার সাথে ওই ঘটনার পর থেকে আনিসুল ইসলাম হুটহাট অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয়। যদিও অসুস্থতা তেমন গুরুতর নয়।
আনিসুল ইসলামকে ডাক্তার দেখিয়ে বাইরে আসতেই পৃথুলার নজর পড়ে রাফসানের উপর। একজন মহিলা আর একজন পুরুষ রাফসানকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসাচ্ছেন।
রাফসানের দুই হাঁটুর পরবর্তী অংশুটুকু নেই। সে একা একা কি যেন বিড়বিড় করছে। রাফসানকে এ অবস্থায় দেখে পৃথুলা, আনিসুল ইসলাম দুজনেই বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা হুইল চেয়ার টেনে রাফসানকে হসপিটালের ভেতরে নিয়ে গেছেন।
পৃথুলা কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সেই গাড়িটার কাছে গেল। আনিসুল ইসলাম পৃথুলার পিছু পিছু গেলেন। গাড়িতে একজন মধ্যেবয়স্ক ড্রাইভার বসে মোবাইল চাপছেন আর একমনে গুনগুন করে গান গাইছেন।
“চাচা, একটু শুনবেন?”
পৃথুলার ডাকে লোকটা মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে তাকাল। কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“কী হইছে?”
“মাত্র যে ছেলেটিকে হুইল চেয়ারে করে হসপিটালের ভেতরে নেওয়া হয়েছে ওনার ব্যাপারে জানতে চাচ্ছি৷ মানে কী হয়েছে ওনার?”
“কি হইছে দেখেন নাই? এক্সিডেন্ট কইরা পায়ে মেলা আঘাত পাইছে। ডাক্তার পা দুইডাই কাইট্টা ফালায়া দিছে।”
“এক্সিডেন্ট করেছে কবে?”
“একমাসের মতন হইব।”
“কীভাবে করেছে?”
“রাইত দুইটায় মদ খায়া বাড়িত ফিরতাছিল। নেশাডা বেশিই করছে। নেশার চোডে উল্ডাপাল্ডা গাড়ি চালায়া গাড়িসহ এক্কারে খাদে গিয়া পড়ছে।”
আনিসুল ইসলাম বললেন,
“ছেলেটাকে দেখে তো মানসিক রোগী মনে হচ্ছিল। কেমন হাত এদিক ওদিক ছুঁড়ছিল! একা একা কিসব বিড়বিড় করছিল!”
ড্রাইভার একটা পান মুখে দিয়ে আয়েশ করে চিবোতে চিবোতে উত্তর দিল,
“হুদা পাও ই যায়নাই। মাতায়ও জটিল আঘাত খাইছে। এহন মাথা খারাপ হয়া গ্যাছে। কাওরে চিনে না। হারাদিন বিড়বিড়ায়া কি আবোলতাবোল কইতে থাহে। পুরাই পাগল হয়া গ্যাছে। হেরে নিয়া পরিবারের সবাইর জ্বালা এহন। এই পাগল ছাগল ঘরে না রাইখা মানসিক হাসপাতালে পাডায়া দিলেই তো অয়।
একটা রিকশা নিয়ে সেটায় উঠে পড়ল দুই বাপ মেয়ে।
“টাকা দিয়ে মানুষের শাস্তি থেকে বেঁচে গেছে কুলাঙ্গারটা। কিন্তু আল্লাহর হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। আল্লাহ ওর প্রাপ্য শাস্তি ঠিকই দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা সবচেয়ে বড় বিচারক। তার বিচারে কোনো অপরাধীই রেহাই পাবে না। আল্লাহ সত্যিই মহান।”
বাবার কথায় তার দিকে তাকাল পৃথুলা৷ আনিসুল ইসলামের চোখে নোনাজল চিকচিক করছে। এই জল কিসের সেটা পৃথুলা জানে না৷ কিন্তু এই মুহূর্তে পৃথুলার কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে, প্রকৃতি কখনো প্রতিশোধ নিতে ভোলে না। সময়মত যার যা পাওনা তাকে সেটা ফেরত দেয়।
.
চলবে___