মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-১৪
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
উৎস পৃথুলাকে দেখে একটা হাসি দিল।
বলল,
“সত্যিই তো। ভাবি তো আসলেই অনেক সুন্দরী। ইশ্ ভাইয়ার আগে যদি ভাবির দেখা পেতাম, তবে আমিই তাকে বিয়ে করে ফেলতাম। ইশ্ কেন যে আগে দেখা হলো না।”
শেষটুকু আফসোসের সঙ্গে বলল উৎস। তারপরেই ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিল পৃথুলার।
অর্থি বলল,
“সমস্যা নাই। তোর জন্যও আমি অলরেডি মেয়ে পছন্দ করছি। ভাবীর পাশে প্রত্যাশা আপুকে দেখ, সুন্দর না? পছন্দ হইছে?”
উৎস প্রত্যাশার দিকে তাকালো। এতক্ষন সে খেয়ালই করেনি প্রত্যাশাকে। প্রত্যাশার দিকে তাকাতেই উৎস’র ভ্রু’দ্বয় কুঁচকে গেল। প্রত্যাশা উৎস’র দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে। উৎস কয়েক সেকেণ্ড প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“এই ঝগড়াটে রানী কটকটি এইখানে কী করে?”
প্রত্যাশা ফণা তোলা সাপের মত করে বলল,
“আমাদের বাড়িতে আমি থাকব না তো কি আপনার মত জল্লাদ থাকবে?”
“তার মানে তুমি ভাবির বোন? ও মাই গড! আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, আমার ভাবির মত এত মিষ্টি, লক্ষী একটা মেয়ের বোন এরকম কটকটি মার্কা মেয়ে হইলো ক্যামনে?”
“আমিও ভেবে অবাক হচ্ছি, অভ্র ভাইয়ার মত এমন ভদ্র আর অর্থির মত মিষ্টি মেয়ের ভাই এমন ইবলিশ মার্কা হইলো ক্যামনে? অর্থি, এই ত্যাঁদড়টা নিশ্চয়ই তোমাদের কুড়িয়ে পাওয়া ভাই। ঠিক বলছি না?”
অর্থি কিছু বলল না। বলা ভালো, বলার মত কিছু খুঁজেই পেল না সে।
উৎস ভ্রুকুটি করে বলল,
“এই অর্থি, তুই এই ডাইনিটাকে পছন্দ করেছিস আমার জন্য! ছেহ! এই পৃথিবীর সব মেয়ে যদি মরে যায়, আর এই একটা মাত্র মেয়ে যদি থাকে তবুও আমি এর মত ডাইনির দিকে ফিরে তাকাব না।”
প্রত্যাশাও সমানতালে বলল,
“ও হ্যালো, নিজেকে কি ভাবেন হ্যাঁ? আয়নায় মুখ দেখছেন? ক্যাঙারুর মতোন দেখতে৷ যত্তসব।”
ওদের ঝগড়া শুনে সবাই হতভম্ব। কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে। ওরা কাউকে পরোয়া করছে না। নিজেদের মত ঝগড়া করে যাচ্ছে। যেন এখানে ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই৷ অর্থি বোকার মত একবার উৎস’র দিকে তাকাচ্ছে একবার প্রত্যাশার দিকে তাকাচ্ছে।
প্রত্যাশার কাজিন জারিন বলল,
“প্রত্যাশা থামবি? কখন থেকে ঝগড়া করে যাচ্ছিস৷ উনি আমাদের মেহমান। মেহমানদের সাথে এমন করতে হয়!”
উৎস জারিনের সাথে তাল মেলাল। বলল,
“ঠিক বলেছেন৷ এই মেয়ে ভদ্রতার ‘ভ’ ও জানে না। গেস্টদের সাথে কেউ এমন বিহেভ করে!”
প্রত্যাশা চোখ রাঙিয়ে উৎস’র দিকে তাকালো। তারপর তাকাল জারিনের দিকে। বলল,
“শুধু আমাকেই দেখছিস? এই অসভ্য ছেলেটা যে তখন থেকে আমার সাথে ঝগড়া করে যাচ্ছে সেটা দেখছিস না?”
এবার পৃথুলা মুখ খুলল।
“আহ প্রত্যাশা! কি শুরু করলি!”
প্রত্যাশা বোনের ধমকে চুপ মেরে গেল।
অর্থি বলল,
“ভাইয়া কি হয়েছে তোদের মধ্যে? তোরা আগে থেকেই দুজন দুজনকে চিনিস?”
উৎস বলল,
“চিনব না আর! এই কটকটি রানী সেদিন রেস্টুরেন্টে আমাকে জুস দিয়ে গোসল করাইছে। তার উপর স্যরি না বলে উল্টো ঝগড়া শুরু করলো।”
“বাজে কথা বলবেন না৷ আমি মোটেও আপনার গায়ে জুস ফেলিনি৷ ওটা একটা এক্সিডেন্ট। আমি দুষ্টামি করে আমার বান্ধবীর গায়ে জুস ফেলছিলাম৷ কোথা থেকে আপনি সামনে এসে পড়লেন আর জুসটা আপনার গায়ে পড়ল। আর আমি তো বলেছিলাম আমি বুঝতে পারিনি৷ কিন্তু আপনি আমার কথা শুনলেন ই না। শুরু করলেন ঝগড়া। তো আপনি আমার সাথে ঝগড়া করলে আমি কি মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকব?”
উৎস কিছুক্ষন নিরব থেকে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। যা হবার হয়ে গেছে। ওসব কাটাকাটি৷ নাও উই আর ফ্রেণ্ডস?”
বলে হাত বাড়িয়ে দিল প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“আমার বয়েই গেছে আপনার মত ঝগড়ুইট্টার সাথে বন্ধুত্ব করতে। যত্তসব।”
প্রত্যাশা রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেল। উৎস করুণ মুখ করে তাকিয়ে রইল।
পৃথুলাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে সোফায় বসানো হলো। তার উল্টোদিকের সোফায় বর সেজে বসে আছে অভ্র। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে মৃদু হাসির রেখা। কাজী বিয়ে পরানো শুরু করলেন। আর পৃথুলা হারিয়ে গেল পুরনো স্মৃতিতে।
পৃথুলার বান্ধবী তিষামের ইন্টারমিডিয়েটে থাকাকালীনই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তিষামের অনুরোধে বিভোরও গিয়েছিল বিয়েতে। কাজী যখন তিষামের বরকে কবুল বলতে বললেন, তখন বিভোর পৃথুলার কানে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘ইশ্ কবে সেই মাহেন্দ্রক্ষন আসবে বলোতো, যেদিন কবুল বলে তোমাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নেব।’
বিভোরের কথা শুনে পৃথুলা লাজুক হেসেছিল সেদিন। আজ সে কথা মনে পড়তেই নোনাজলে ওর চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো। সেই এত চেনা মানুষটা এক মুহূর্তেই পাল্টে গেল৷ রঙ পাল্টাতে মানুষ গিরিগিটিকেও হার মানাতে পারে।
অবশেষে তিন কবুলের মধ্য দিয়ে অভ্র-পৃথুলা বাঁধা পড়ল এক পবিত্র বন্ধনে, বিয়ের বন্ধনে।
আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করে এবার কনে বিদায়ের পালা। পুরো বাড়িতে যেন কান্নার রোল পড়েছে। মেয়ের বিদায় বেলায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে মাহিমা বেগমের। তার কলিজাটা চলে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে। আনিসুল ইসলাম পৃথুলার হাতটা অভ্রর হাতে রাখলেন৷ কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু কান্নার জন্য বলতে পারছিলেন না। তার গলা কাঁপছে, শরীর টলছে। তবুও ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,
“আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা। তুমি আমার মেয়েটা কে দেখে রেখ।”
আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার।
অভ্র আনিসুল ইসলামের পা ছুঁয়ে সালাম করল। বলল,
“রাখব বাবা। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”
পৃথুলা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বাবার বুকে, তারপর মা, তারপর বোন।
সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথুলা রওনা হলো তার নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। একে একে সবগুলো গাড়ি পৃথুলাদের বাড়ি ছাড়ল, এগিয়ে চলল অভ্রদের বাসার দিকে।
পৃথুলা কাঁদছে। অভ্র পকেট থেকে টিস্যু বের করে পৃথুলার চোখ মুছে দিল। তারপর পৃথুলার মাথাটা টেনে নিজের কাঁধে রাখল। পৃথুলা সাথে সাথে সরে গিয়ে জানালার সাথে মাথা ঠেকাল৷ অভ্র পৃথুলার হাত ধরলো। পৃথুলা হাত সরিয়ে নিতে চেয়েছিল কিন্তু পারল না। অভ্র খুব শক্ত করে পৃথুলার হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে চেপে রাখল।
পৃথুলাদের বাসার থেকে অভ্রদের বাসা প্রায় দেড়ঘণ্টার পথ। ওরা যখন অভ্রদের বাসায় পৌঁছালো তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। বধূবরণের সমস্ত আনুষাঙ্গিক কাজ সেরে অর্থিসহ ওর কয়েকজন কাজিন পৃথুলাকে নিয়ে গেল অভ্রর বেডরুমে।
রুমে ঢুকতেই গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুবাস এসে ঠেকল নাকে। ধবধবে সাদা বেডশিটের উপরে গাঁঢ় খয়েরী রঙের গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। পৃথুলাকে নিয়ে বিছানায় বসানো হলো। ওর ট্রলিটা এনে রুমের একপাশে রাখা হলো।
মিনিট পাঁচেক পর উৎস একজন বৃদ্ধাকে ধরে রুমে নিয়ে এলো। বৃদ্ধা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
“কই গো, আমার নাতবউ কই?”
উৎস বলল,
“এইতো নিয়ে এসেছি তোমাকে তোমার নাতবউ এর কাছে। এবার মন ভরে দেখ।”
অর্থি উঠে বৃদ্ধাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। পৃথুলাকে বলল,
“ভাবি, এই হচ্ছে আমাদের বাড়ির মোস্ট ইম্পর্টেন্ট মেম্বার। আমার দাদী দিলারা বেগম৷ দাদী জার্নি করতে পারে না বলে তোমাদের বাসায় যেতে পারেনি। তবে বুড়ি হলে কি হবে, উনার ঝাঁজ কিন্তু বেশি।”
বৃদ্ধা বললেন,
“হইছে হইছে এ্যালা সর৷ আমি আমার নাতবউ এর মুখখানা দেইখ্যা লই।”
পৃথুলা সালাম করল বৃদ্ধাকে৷ বৃদ্ধা পৃথুলার মুখটা দুহাতে আঁজলা করে ধরে বললেন,
“মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। আমার অভ্রের বউডা তো এ্যাক্কারে পরীগো মতন।”
এরপর উৎস’র দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমার ছোডো নাতবউ ও কিন্তু এমন ডক সোন্দর হওন লাগব, কইয়া দিলাম।”
উৎস পেছন থেকে দিলারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার জন্য তো তুমিই আছো সুইটহার্ট। ঘরে এই সুন্দরীকে রেখে বাইরে সুন্দরীদের খুঁজতে যাব কোন দুঃখে?”
দিলারা বেগম মুখ ঝামটা মেরে বললেন,
“হইছে হইছে ঢং মারাইস না। বউ পাইলে আর এই বুড়িডারে মনে থাকবো না।”
“কি যে বলো ডার্লিং! তোমাকে কি কখনো ভুলতে পারি!”
.
চলবে_____