মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-৬
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
জ্ঞান ফিরল পৃথুলার। চোখ মেলে বাংলাতো একা আবিষ্কার করল নিজেকে। রাফসান আশেপাশে কোথাও নেই। তার কামনা মিটিয়ে চলে গেছে ইতিমধ্যে। পৃথুলা তার নিরাবরণ দেহটার দিকে তাকাল। রক্তের ছোপ ছোপ দাগ শরীরে লেপ্টে আছে। মনে পড়ল কিছুক্ষন আগের কথা। রাফসান দানবের মত তাণ্ডব চালিয়েছিল তার গোটা শরীরের উপর। আর সেই প্রলয়ের দাপট সইতে না পেরে সেন্স হারিয়েছিল সে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
অন্য কেউ দূরে থাক, বিভোর.. যাকে সে এত ভালবাসে, সেই বিভোরের কাছ থেকেও সে নিজেকে সংযত রেখেছে। বিভোরকেও কাছে ঘেষতে দেয়নি। আর আজ ……..তার শরীরটা অপবিত্র হয়ে গেল। বুক ফেটে কান্না আসছে পৃথুলার। নিজেকে নোংরা কীট মনে হচ্ছে। পৃথুলা উপরে তাকাল। মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। আচ্ছা এই ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস দিলে কেমন হবে? এখন যদি সে সুইসাইড করে তাহলে কেউ কি এখানে আসবে? খুঁজে পাবে তার লাশটা? ভাবল পৃথুলা।
একটু পরেই আবার ভাবল, নাহ, সে কেন মরবে? তাকে বাঁচতে হবে। মা, বাবা, প্রত্যাশার জন্য বাঁচতে হবে। আর বিভোর.. যার ভালবাসা ছাড়া সে অসম্পূর্ণ! সেই বিভোরকে রেখে সে কি করে মরে যাওয়ার কথা ভাবছে! বিভোর মাঝে মাঝেই বলত, বিয়ের পর পরই তারা বাচ্চা নেবে। ফুটফুটে একটা মেয়ে পুতুল হবে তাদের। সেই পুতুলটা ঘরময় দৌড়াদৌড়ি করবে। বিভোরকে বাবা বলে ডাকবে আর পৃথুলাকে মা। একটা সাজানো গোছানো সুন্দর সংসার হবে তাদের। পৃথুলা নিজ হাতে সাজাবে তার সংসারটা। হ্যাঁ, তাকে বাঁচতে হবে।
পৃথুলা মনে সাহস সঞ্চয় করল। উঠে দাঁড়াল সে। যদিও শরীরে এক ফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই। সমস্ত শরীর ব্যথা হয়ে আছে। খাটের নিচে পড়ে থাকা কাপড়গুলো গায়ে জড়াল। ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো বাংলো থেকে। হাঁটতে হাঁটতে লোকালয়ে এলো। আশেপাশে যারাই ওকে দেখছে ড্যবড্যাব করে তাকিয়ে থাকছে। পৃথুলার শরীর চলছে না৷ পা টলছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বসে পড়ল। বসে পড়তে দেখে অনেকেই এসে ভীর জমাল ওর আশে পাশে। ওকে দেখে মোটামুটি সবাই বুঝে গেছে ওর সাথে কি হয়েছে৷ বুঝেও অনেকে কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইল ওর কি হয়েছে! পৃথুলা কেবল বলল,
“আমি মায়ের কাছে যাব। বাবার সাথে কথা বলব।”
একজন লোক মোবাইল এগিয়ে দিল। কিন্তু নাম্বার টাইপ করার শক্তিটুকুও ওর অবশিষ্ট নেই। তাই লোকটা নিজেই মোবাইল হাতে নিয়ে পৃথুলাকে নাম্বার বলতে বলল। পৃথুলা অস্ফুট স্বরে প্রত্যাশার ফোন নাম্বারটা বলল। ওর চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে। সম্মুখে সব ঘোলাটে, অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখছে। আর বসে থাকতে পারল না। ওপাশ থেকে প্রত্যাশা ফোন রিসিভ করার আগেই পৃথুলা দ্বিতীয়বারের মত জ্ঞান হারায়।
দুই হাত মুঠো করে কপালে ঠেকিয়ে থম ধরে সোফায় বসে আছে বিভোর। একটু আগে রাফসান ফোন করেছিল তাকে। বিভোর কিছু বলার আগেই রাফসান বলল,
“তোকে একটা গুড নিউজ দেয়ার জন্য ফোন করেছি ভাই। সেদিন বলেছিলাম না আমার গায়ে তোলার শাস্তি তোকে দেব। আজ আমি আমার অপমানের বদলা নিলাম।”
রাফসানের মুখ দিয়ে জয়ের হাসি ফুঁটছে। হো হো করে হেসে যাচ্ছে সে। বিভোর থমকাল৷ বলল,
“কি করেছিস তুই?”
“তোর পৃথুলার সাথে বিছানা গরম করেছি। যদিও ওর পারফর্ম খুব একটা ভালো না। একদম আনাড়ি বুঝলি! তবুও আমি বেশ এনজয় করেছি।”
বিভোরের চোখ বিষ্ফোরিত৷ কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। রাফসান বলেই চলল,
“আমার ইউজ করা জিনিস তুই ইউজ করবি। আর এটাই তোর উপযুক্ত শাস্তি।”
দরজা খোলার শব্দে ভাবনার রাজ্য থেকে বেড়িয়ে এলো বিভোর। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল আসাদ হক কে। আসাদ হক ধীরপায়ে বিভোরের পাশে এসে বসলেন। বিভোরের কাঁধে হাত রাখলেন। বিভোর নড়ল না। স্থির হয়ে বসে রইল। আসাদ হক তার হাতের মোবাইলটা বিভোরের সামনে ধরলেন। স্ক্রীণে পৃথুলার ছবি। রাস্তায় যখন পৃথুলা সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল তখন কয়েকজন ছবি তুলেছে এবং সেটা ফেসবুকেও দিয়েছে। সেই ছবি আসাদ হক দেখাচ্ছেন বিভোরকে। বিভোর চোখ সরিয়ে নিল। আসাদ হক বললেন,
“সেদিন যখন জানলাম পৃথুলার বাবা সামান্য একজন শিক্ষক তখনি আমার আপত্তি হয়েছিল তোমার আর পৃথুলার সম্পর্ক নিয়ে। একজন শিক্ষক কখনো আমার লেভেলে আসতে পারেনা আর একজন শিক্ষকের মেয়ে কখনো আমার ছেলের বউ হতে পারে না। আমি তোমাকে জানিয়েও ছিলাম আমার আপত্তির কথা৷ কিন্তু তুমি গুরুত্ব দাওনি৷ তুমি ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আমি মেনে নিয়েছিলাম তোমার কথা। তুমি আমার মতামতের গুরুত্ব না দিলেও আমি তোমার মতামতের গুরুত্ব সমসময় দিয়েছি। আজও দেব। কারণ জীবনটা তোমার। তবে তার আগে কিছু বলার আছে আমার। সবকটা সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে মেয়েটার রেপ হবার খবরটা। সকলের মুখে মুখে একই কথা। পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই খবরটা। এখন তুমি যদি একটা রেপড মেয়েকে বিয়ে করে নিজের সম্মান, তোমার বাবার এতদিনে গড়া সম্মান সব ধূলিসাৎ করে দিতে চাও তাহলে বিয়ে করো ওই ধর্ষিতা মেয়েকে৷ আর যদি মাথায় একটুও সুবুদ্ধি থাকে তবে সরে এসো ওই মেয়ের কাছ থেকে।”
বিভোর চুপ। মাথা নিচু করে বসে আছে৷ তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। আসাদ হক বিভোরের মাথার গুছানো চুলগুলো হাত দিয়ে আরেকটু গুছিয়ে দিয়ে বললেন,
“একটা কথা মনে রেখ, একজন ধর্ষিতা মেয়ে বড়জোর মানুষের করুণার পাত্রী হতে পারে। কিন্তু কারো প্রেমিকা বা স্ত্রী হবার যোগ্যতা রাখেনা।”
আসাদ হক আর কিছু বললেন না। ধীরপায়ে হেঁটে চলে গেলেন বিভোরের ঘর ছেড়ে। বিভোরের কানে আপাতত দুটি কথাই বাজছে। রাফসানের বলা কথা, ‘আমার ইউজ করা জিনিস তুই ইউজ করবি। আর এটাই তোর জন্য উপযুক্ত শাস্তি।’
আর বাবার বলা কথা, ‘একজন ধর্ষিতা মেয়ে বড়জোর মানুষের করুণার পাত্রী হতে পারে৷ কিন্তু কারো প্রেমিকা বা স্ত্রী হবার যোগ্যতা রাখে না।’
বিভোরের ফোন বাজছে৷ ফোন হাতে তুলে দেখল প্রত্যাশা কল করেছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল বিভোর। বেশ কয়েকবার রিঙ বেজে কল কেটে গেল। পঞ্চমবারের সময় ফোন রিসিভ করল বিভোর।
সে তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন কেবল সেটা প্রত্যাশাকে জানাতে হবে।
হুশ ফিরে নিজেকে হাসপাতালের কেবিনে আবিষ্কার করে পৃথুলা। চোখ খুলে প্রথমেই মায়ের কান্নারত মুখটা নজরে পড়ে। পাশের চেয়ারে মলিন মুখে বসে থাকতে দেখা যায় পৃথুলার সবসময় হাসিখুশি থাকা বাবাটাকে।
জ্ঞান ফেরার কিছুক্ষন পর দুজন পুলিশ আসে পৃথুলার কেবিনে। তারা পৃথুলার কাছ থেকে ঘটনার অদ্য প্রান্ত জানে। অপরাধীকে গ্রেফতার করার আশ্বাস দেয় পৃথুলার পরিবারকে।
কেটে যায় পুরো একটি দিন। এতটা সময়ে একবারের জন্যও বিভোরের দেখা পায়নি পৃথুলা। পৃথুলা ভাবে, বিভোর কি কিছু জানেনা? জানেনা তার পৃথুলার সাথে কত জঘন্য ঘটনা ঘটে গেছে? বিভোর কেন এলোনা? নিশ্চয়ই বিভোর ওকে ফোন করেছে। কিন্তু ফোন কোথায়? পরক্ষনেই মনে পড়ল, ফোনটা সেদিন ব্যাগের ভেতর ছিল। আর রাফসানের সাথে ধস্তাধস্তির সময় ব্যাগটা ওখানেই ফেলে দিয়েছিল। ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পৃথুলা।
প্রত্যাশা বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসে। কিছুসময় পর প্রত্যাশা মাহিমা বেগমকে বলল,
“তুমি বাবাকে নিয়ে বাসায় চলে যাও মা। আপির কাছে আমি থাকি।”
মাহিমা বেগম সেটা মানতে নারাজ। গোঁ ধরে বললেন,
“নাহ। আমি আমার মেয়ের কাছেই থাকব।”
“জেদ করো না তো মা। আমিতো আছি আপির কাছে। তুমি চেহারার কি হাল বানিয়েছো, দেখেছো? যাও বাসায় যাও। এ দুদিন তো দু চোখের পাতা এক করোনি। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছো। বাসায় গিয়ে গোসল করে ভাত খেয়ে একটা ঘুম দাও।”
মাহিমা বেগম তবু রাজি হলোনা। তিনি পুথুলার কাছ থেকে নড়বেন না। এবার পৃথুলা বলল,
“প্রত্যাশা ঠিকই বলছে মা। সবাই মিলে এখানে ভীড় জমানোর কোনো মানে হয়না। বাবারও এ’দুদিনে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। তুমি বাবাকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। প্রত্যাশা থাকুক আমার কাছে।”
পৃথুলার কথায় টনক নড়ল মাহিমা বেগমের। এবার তিনি না করতে পারলেন না। পৃথুলার মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে আনিসুল ইসলামকে নিয়ে বাসায় চলে গেলেন। প্রত্যাশা কেবিনের দরজা আটকে স্যুপের বাটিটা নিয়ে পৃথুলার পাশে বসে। হাতে ধরে পৃথুলাকে ওঠায়। চামচ কেটে স্যুপ মুখের কাছে ধরতেই পৃথুলা মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“এখন খাব না। রেখে দে। তোর ফোনটা একটু দিবি?”
“এখন ফোন দিয়ে কি করবি? স্যুপটা খেয়ে নে।”
“আগে ফোনটা দে। বিভোরকে ফোন করব। বিভোর নিশ্চয়ই এই ঘটনার কথা জানেনা। জানলে ও অবশ্যই আমার কাছে ছুটে আসত।”
.
চলবে___