মন_বাড়িয়ে_ছুঁই পর্ব-৯ লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা

মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-৯
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
প্রবাল আহমেদ আসাদ হকের বিজনেস পার্টনার। ব্যবসায়ের খাতিরে দুই পরিবারের মধ্যে বেশ ভালোই সখ্যতা গড়ে উঠেছে। প্রবাল আহমেদ খুব স্নেহ করেন বিভোরকে। সকালে তিনি বিভোরকে ফোন দিয়ে হলুদের জন্য ইনভাইট করেছেন। বিভোর তখন প্রবাল আহমেদকে ‘দেখি’ বলে পাশ কাটিয়ে গেলেও সে মূলত যাবে না বলেই সিদ্ধান্তে ছিল। কিন্তু এখন বাবার কাছে না বলতে পারল না বিভোর। বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলে অফ হোয়াইট রঙের ফরমাল ড্রেস বের করল।

আটটা নাগাদ প্রবাল আহমেদের বাসায় পৌঁছে গেল আসাদ হক ও বিভোর। হলুদের আয়োজন করা হয়েছে বাসার ডানপাশের লনে। বিভোরের ফোন বেজে উঠল। সে আসাদ হককে বলল,
“তুমি যাও, আমি ফোনে কথা শেষ করে আসছি।”
“ঠিকাছে।”

আসাদ হক এগিয়ে গেলেন সামনে। বিভোর ফোনে কথা শেষ করে এগোলো আর্টিফিশিয়াল ফুল, বেলুন, রঙিন কাপড় আর লাইটিং করে ডেকোরেট করা স্টেজের দিকে। যেখানে হলুদের পাঞ্জাবি পরে বসে আছে প্রিয়ম। বিভোর সেদিকে যেতেই আচমকা পেছন থেকে ধাক্কা দিল কেউ একজন। বিভোর পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। বিরক্তি ভঙ্গিতে পেছনে তাকাল। সোনালি পেড়ে হলুদ লেহেঙ্গা পরিহিতা সুন্দরী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লেহেঙ্গার ওড়নাটা বাম কাঁধের উপর রাখা। ফর্সা পেটটা পুরোটাই দৃশ্যমান।

মেয়েটি বলল,
“স্যরি স্যরি! আমি খেয়াল করিনি।”
বিভোর হালকা হেসে বলল,
“কোনো ব্যাপার না। ইট’স ওকে।”
মেয়েটা হেসে চোখের উপর এসে পড়া চুলগুলো কানের পাশে গুঁজল। তারপর চলে গেল স্টেজের দিকে৷ বিভোর মেয়েটির অনুসরণে স্টেজের দিকে গেল।

প্রিয়ম বিভোরকে দেখে হাত বাড়িয়ে বলল,
“হেই ব্রো, এসেছ তুমি?”
বিভোর প্রিয়মের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল,
“কনগ্রাচিউলেশনস।”
“থ্যংকস।”

বিভোর তাকাল মেয়েটির দিকে। হলুদে একেবারে হলুদ পরীর মতন লাগছে। ডাক পড়ল বিভোরের। আসাদ হক ডাকছেন তাকে। বিভোর সেদিকে পা বাড়াল।
প্রিয়া হলুদের বাটি থেকে একটুখানি হলুদ নিয়ে প্রিয়মের গালে মাখিয়ে দিয়ে বলল,
“ছেলেটা কে ভাইয়া?”
“আব্বুর বিজনেস পার্টনার আসাদ আঙ্কেল আছে না? ওনার ছেলে বিভোর।”
“হি ইজ সো হ্যাণ্ডসাম।”
প্রিয়ম হাসল।

বিভোর আসাদ হকের কাছে গেল। সেখানে আছেন প্রবাল আহমেদও৷ বিভোর সহাস্যে সালাম জানালো তাকে।
“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”
প্রবাল আহসেদ বললেন,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। বসো বাবা।”
বিভোর সোফায় বসল, বাবার পাশে। আসাদ হক বললেন,
“প্রিয়া এসেছে নাকি ইউ এস এ থেকে। সে কোথায়?”
প্রবাল আহমেদ স্টেজের দিকে তাকিয়ে উচ্চশব্দে ডাকলেন প্রিয়াকে।
“প্রিয়া আম্মু, এদিকে এসো।”
“আসছি আব্বু।”

প্রিয়া স্টেজ থেকে নেমে বাবার সামনে এসে দাঁড়াল৷ প্রবাল আহমেদ আসাদ হককে দেখিয়ে বললেন,
“ইনি তোমার আসাদ আঙ্কেল।”
প্রিয়া মিষ্টি হেসে সালাম দিল আসাদ হককে।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
প্রবাল আহমেদ এবার বিভোরকে দেখিয়ে বললেন,
“আর ও হচ্ছে…”
প্রিয়া হাত উঁচিয়ে বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“জানি। উনি বিভোর। আঙ্কেলের ছেলে।”
তারপর বিভোরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি বড়দের মধ্যে কী করছেন মশাই? উঠুন উঠুন, আসুন।”

হাত ধরে বিভোরকে টেনে স্টেজের দিকে পা বাড়াল প্রিয়া। বিভোর কিছুটা বিব্রত হলেও কিছু বলতে পারল না। প্রবাল আহমেদ হেসে বললেন,
“আমার মেয়েটা এমনই, পাগলি টাইপের।”

আসাদ হক সে কথা কানে নিলেন না। তিনি তাকিয়ে রইলেন বিভোর ও প্রিয়ার দিকে। প্রিয়াকে বিভোরের সাথে খারাপ লাগছে না৷ বরং দুটিতে মানিয়েছে বেশ। আসাদ হক বেশ ভালো মতই জানেন, বিভোর মুখে প্রকাশ না করলেও তার মনটা এখনো পড়ে আছে পৃথুলার কাছে। আর ওই মেয়েটার কাছ থেকে বিভোরের মন অন্যদিকে ফেরানোর জন্য অন্য কাউকে বিভোরের মনে জায়গা করে নিতে হবে। সেটা প্রিয়া হলে মন্দ কি? নাহ, মন্দ নয়। বরং ভালোই।

বিভোরদের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। আসার সময় প্রবাল আহমেদ বারবার বলে দিয়েছেন আগামীকাল তারা যেন বিয়েতে উপস্থিত থাকে।

জামা পাল্টে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল বিভোর। ভাবতে লাগল প্রিয়ার কথা। মেয়েটা একদম নিঃসংকোচ। কোনো কিছু নিয়ে জড়তা নেই, নেই কোনো সংকোচ। বিভোর তো বলতে গেলে প্রিয়ার জন্য একদমই অপিরিচিত একজন। সদ্য পরিচিত হওয়া মেয়েটা কত সুন্দরভাবে মিশেছিল বিভোরের সাথে। বিভোর সবসময় চাইত পৃথুলাও এমন হোক। অন্তত তার সাথে ফ্রি হোক৷ কিন্তু না। পৃথুলা তো পৃথুলাই। জড়তা, সংকোচ, সেকেলেপনা যেন তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। অন্যদিকে প্রিয়া! সে পুরোই অন্যরকম। পরিষ্কার খোলামেলা মনের একটা মেয়ে। বিভোর স্বীকার না করে পারবে না, আজ প্রিয়ার সঙ্গ ভীষণ এনজয় করেছে সে। এলোমেলো ভাবনাগুলো মাথায় নিয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল বিভোর।
.
আজ প্রিয়মের বিয়ে। বিভোরের ইচ্ছে ছিল যাবে না। কিন্তু কাল বাড়ি ফেরার সময় প্রিয়া পইপই করে বলে দিয়েছিল কাল যেন বিভোর অবশ্যই যায়। বিভোর একটু গাঁইগুই করে বলেছিল,
“শিওর বলতে পারছি না। আচ্ছা দেখি।”
“দেখাদেখির কিছু নাই। আপনি আসবেন মানে আসবেন। আসতেই হবে।”
বিভোর হেসে ফেলল। বলল,
“কেন আসতে হবে?”
প্রিয়া বুকের উপর দু’হাত ভাঁজ করে বলল,
“কারণ আমি বলছি।”

বিভোর অবাক হয়েছিল। স্বল্প পরিচয়ে তার উপর প্রিয়ার এমন অধিকার ফলানো দেখে। যাক, তবুও তো কেউ অধিকার ফলাল তার উপর।

বিভোর উঠে ফ্রেশ করে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। আসাদ হক পাউরুটিতে জেলি মাখাতে মাখাতে বিভোরকে বললেন,
“প্রিয়মের বিয়েতে যাবে?”
“হ্যাঁ।”

আসাদ হক চোখ তুলে তাকালেন বিভোরের দিকে। বিভোর ‘না’ বলবে এটাই ভেবেছিলেন তিনি। যাক, ভালোই হয়েছে ছেলে যেতে রাজি হয়েছে। বিভোরের মুভ অন করাটা দরকার, খুব দরকার। সেই পরিবর্তন টা প্রিয়ার হাত ধরেই আসুক। আসাদ হক খুব করে চান, তার ছেলে পৃথুলাকে ভুলে যাক। ওই ধর্ষিতা মেয়ের ছায়াও না পড়ুক তার ছেলের উপর। বাবা হিসেবে এটা তার কাম্য।

তিনি বললেন,
“আজ আমি যেতে পারব না। অফিসে একটা জরুরি মিটিং আছে।”
“সেকি! তুমি না গেলে প্রবাল আঙ্কেল কি ভাববেন?”
“একটু আগে ওনাকে ফোন দিয়ে বুঝিয়ে বলেছি। এটাও বলেছি বিয়েতে না থাকতে পারলেও রিসেপশনে থাকব। উনি মেনে নিয়েছেন।”
বিভোর কিছু বলল না। চুপচাপ ব্রেকফাস্ট করে নিল।

বেলা দুইটায় বিভোর হাজির হলো কমিউনিটি সেন্টারে। দু পরিবারের মেহমান সবাই হাজির। প্রিয়া বিভোরকে দেখে বলল,
“আপনি এতক্ষণে এলেন? আমি কখন থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।”
বিভোর ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কেন?”
প্রিয়া মুখ গোমড়া করে বলল,
“বলব না। একেতো লেট করে এসেছেন৷ এখন আবার কৈফিয়ত চাইছেন।”
প্রিয়ার মুখভঙ্গি দেখে হেসে বলল বিভোর। বলল,
“চলুন, এবার ভেতরে যাই।”

সিঁড়ি ভেঙে দু”তলায় উঠতে উঠতে বিভোর তাকালো প্রিয়ার দিকে। প্রিয়া আজ শাড়ি পরেছে। গাঁঢ় গোলাপি রঙের শাড়ি। চুলের খোঁপা ধরে ঝুলছে একগুচ্ছ রজনীগন্ধার ঝালর। দেখতে বেশ লাগছে।

“ইউ আর লুকিং টু মাচ বিউটিফুল।”
বিভোরের কথায় প্রিয়া হাসল। প্রত্যুত্তরে বলল,
“সেম টু ইউ। একটা কথা বলব?”
“হুম বলুন।”
“আমি অতো আপনি আপনি করে কথা বলতে পারি না। আপনাকে তুমি সম্বোদন করতে পারি?”
“কেন নয়? অবশ্যই।”
“থ্যাংক ইউ। তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে কিন্তু।”
বিভোর হেসে বলল,
“ঠিক আছে।”

বিয়ে পড়ানো শেষে নব বর-বধূকে পাশাপাশি সোফায় বসিয়ে বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলছে ফটোগ্রাফার। কনের পরনে ব্রাইডাল লেহেঙ্গা। মুখে লাজুক ভাব।

প্রিয়া বিভোরের হাত ধরে স্টেজে নিয়ে গেল। তারপর ধপ করে বসে পড়ল কনের পাশে। প্রিয়ম হাত টেনে বিভোরকে বসালো। প্রিয়া ফটোগ্রাফারকে বলল,
“আরে ভাইয়া, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ছবি তোলেন।”

ফটোগ্রাফার ক্লিক ক্লিক শব্দে একটার পর একটা ছবি তুলছে। বিভোর তার জায়গাতেই বসে আছে। কিন্তু প্রিয়া বসে নেই। সে একবার বসে ছবি তুলছে, আবার দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে তুলছে। বিভিন্ন ভাবে পোজ দিয়ে ফটোগ্রাফারকে নির্দেশ দিচ্ছে ছবি তুলতে। বিভোর প্রিয়ার ছবি তোলার স্টাইল দেখে না হেসে পারল না।
.
চলবে__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here