মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-১৫
.
দিলারা বেগম আরো কিছুক্ষন বকবক করলেন। অভ্রর কাজিনরা কিছুক্ষন নিজেদের মত আড্ডা দিল৷ হাসাহাসি করলো। কিছুসময় পর অভ্রর ফুপি আদিনা রহমান এসে ওদের ডেকে নিয়ে গেল। সবাই বেরিয়ে গেলে পৃথুলা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষন এই জবরজং শাড়ি গয়না আর মেকআপ পরে বসে থাকতে বেশ অস্বস্তি লাগছিল ওর।
পৃথুলা বিছানা থেকে নেমে ট্রলি খুলে একটা কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি বের করল। শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। প্রথমেই মুখের মেকআপ তুলে নিল। তারপর শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে দাঁড়ালো, দাঁড়িয়েই রইল।
আধঘণ্টার মত সময় ধরে ভিজল। তারপর শাড়িটা চেইঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। বের হয়ে দেখল অভ্র তার শাড়িগুলো ট্রলি থেকে বের করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখছে। গুছানো শেষে অভ্র পেছনে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। পৃথুলা বিব্রত হয়ে চোখ সরিয়ে নিল। অভ্র মৃদু হেসে পৃথুলার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“থ্যাংকস।”
পৃথুলা ভ্রু কুঁচকাল। থ্যাংকস দেওয়ার কারণ সে বুঝল না। অভ্র নিজেই বলল,
“মেকআপ এর কারণে তোমার আসল সৌন্দর্যটা ঢাকা পড়েছিল। কেমন কৃত্রিম কৃত্রিম মনে হচ্ছিল। মেকআপ এর আড়ালে এই পৃথুলাকে বড্ড মিস করছিলাম। রুমে ঢুকেই প্রথম দেখা সেই স্নিগ্ধতায় ভরা পৃথুলাকে দেখলাম। থ্যাংকস ফর দিজ।”
পৃথুলা কিছু বলল না। চুপচাপ বিছানার একপাশে বসল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখ দুটো সমানতালে জ্বলছে। এই অসময়ে এতটা সময় ধরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল, বোধহয় সে কারণেই এমনটা হচ্ছে।
অভ্রর এতক্ষনে চোখ গেল পৃথুলার ভেজা চুলের দিকে। অবাক হয়ে বলল,
“তুমি এত রাতে গোসল করেছো!”
পৃথুলা কিছু বলল না। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে ওর। বেজায় খারাপ লাগছে। অভ্র পৃথুলার পাশে বসল। বলল,
“তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
“ঘুমাব।”
“আচ্ছা ঘুমাও।”
পৃথুলা উঠে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল। অভ্র বিছানা ছেড়ে শেরোয়ানি পালটে ফ্রেশ হয়ে নিল। ততক্ষনে পৃথুলা ঘুমিয়ে কাদা। অভ্র লাইট নিভিয়ে বিছানার অপরপাশে শুয়ে পড়ল। তাকালো পৃথুলার মুখপানে। ড্রীম লাইটের মৃদু আলোয় অসম্ভব সুন্দর লাগছে পৃথুলাকে।
চেয়ে থাকতে থাকতে চোখটা খানিকটা লেগে আসছিল অভ্রর। তখুনি শুনলো গোঙানির আওয়াজ। অভ্র চকিতে চোখ খুলল। পৃথুলা কাঁপছে আর কি যেন বিড়বিড় করে বলছে। অভ্র উঠে বসলো। পৃথুলাকে ডাকতে ওর শরীরে হাত দিয়ে অনুভব করল পৃথুলার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কখন এলো জ্বর?
অভ্র বারকয়েক পৃথুলাকে ডাকল। পৃথুলার চোখ বন্ধ। শরীর কাঁপছে। বিড়বিড় করছে কিন্তু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অভ্র দ্রুত বিছানা ছাড়ল। ড্রয়ার থেকে প্যারসিটামল বের করল। সেন্টার টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঐ অবস্থায়ই পৃথুলাকে ওষুধ খাইয়ে দিল।
পৃথুলার শরীর ভীষন কাঁপছে। অভ্র এসিটা অফ করে বিছানায় গিয়ে পৃথুলাকে কাছে টেনে নিল। জড়িয়ে ধরল আষ্টেপৃষ্টে। পৃথুলা বাচ্চাদের মত গুটিসুটি মেরে রইল অভ্রর বুকে আর কি যেন বিড়বিড় করছে। কি বলছে শোনার জন্য পৃথুলার মুখের কাছে কান পাতল অভ্র। তেমন কিছু বুঝা গেল না। তবে ‘বিভোর’ নামটা স্পষ্টই অভ্রর কানে পৌঁছালো। বিভোর এর আগের বা পরের শব্দগুলো ওর বোধগম্য হলো না।
অনেকক্ষন পর পৃথুলার কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে। তবে জ্বর কমেনি। অভ্র পৃথুলাকে বুক থেকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে দিল। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গেল। মগে পানি নিয়ে আবার রুমে ফেরত এলো। পৃথুলার শিয়রের কাছে বসে পানিতে একটা ছোট্ট কাপড় ভিজিয়ে পৃথুলার মাথায় পানিপট্টি দিল।
.
খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙে পৃথুলার। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। খুব কাছেই কারো নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। পিটপিট করে চোখ মেলল পৃথুলা। চোখ মেলে অভ্রকে পাশে আবিষ্কার করল সে। অভ্রর নিঃস্বাস পৃথুলার মুখের সাথে বারি খাচ্ছে।
পৃথুলা হকচকিয়ে গেল। ওঠার চেষ্টা করল৷ পৃথুলার নড়াচড়াতে ঘুম ভেঙে গেল অভ্রর৷ উঠে বসে পৃথুলার কপালে হাত রাখল। জ্বর নেই। অভ্র বলল,
“কাল অত রাতে গোসল করতে গেলে কেন? জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল।”
“জ্বর এসেছে?”
“জ্বি ম্যাডাম৷ আর এই আমি বাসর রাতে পত্নীসেবায় নিয়োজিত ছিলাম।”
বলেই হেসে ফেলল অভ্র। পৃথুলা লজ্জা পেল। উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। শরীরটা টলছে। ভীষন দুর্বল লাগছে। অভ্র বলল,
“হেল্প লাগবে?”
“না।”
“ঠিকাছে। সাবধানে যেও।”
পৃথুলা ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল অভ্র বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেন্টার টেবিলের উপর পানিভর্তি একটা মগ রাখা, তার মধ্যে একটা কাপড়। পৃথুলা অভ্রর দিকে তাকালো। অভ্রর চোখগুলো তখন লাল টকটকে ছিল। তাহলে কি অভ্র না ঘুমিয়ে সারারাত ওর সেবা করেছে?
পৃথুলা ওর মোবাইলটা হাতে নিয়ে প্রত্যাশাকে ফোন করল। প্রত্যাশা পৃথুলার পার্সের মধ্যে পৃথুলার মোবাইলটাও ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
কয়েকবার রিং বাজার পর ফোন ধরল প্রত্যাশা। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“শুভ সকাল আপি।”
“কেমন আছিস?”
“আই মিস ইউ।”
“মিস তো আমিও করছি। বাবা, মা ঘুম থেকে উঠেছে?”
“উঠেছে। নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে।
“আচ্ছা ঠিক আছে, তুই ঘুমা। পরে ফোন দেব।”
পৃথুলা ফোন কেটে বারান্দায় গেল। এখনো পুরোপুরি অন্ধকার কাটেনি। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিচিরমিচির করে ডেকে যাচ্ছে নাম না জানা পাখিরা। পৃথুলা বারান্দায় পাতা রকিং চেয়ারে বসে বাইরে তাকিয়ে রইল। শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল লাগছে।
সকাল সাড়ে নয়টায় অভ্রর ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে অর্থি।
“ভাইয়া, এখনো ঘুমোচ্ছ?”
সাড়া নেই। অর্থি আবারও দরজায় বারি দিল।
“ভাইয়া, সাড়ে নয়টা বাজে। আর কতক্ষন ঘুমাবা? ব্রেকফাস্ট করবা না?”
অভ্রর ঘুম ভাঙল। চোখ কচলে উঠে দরজা খুলল।
“কি সমস্যা? সকাল সকাল চিল্লাচ্ছিস কেন?”
বাঁজখাই গলায় বলল অভ্র। অর্থি কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
“তুমি আমার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছো ভাইয়া!”
অভ্র হেসে অর্থির নাক টিপে দিয়ে বলল,
“স্যরি লক্ষী।”
“হইছে। স্যরি বলতে হবে না। কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”
অভ্র ঘড়ি দেখল৷ সাড়ে নয়টা বাজে। অর্থি বলল,
“ভাবিকে নিয়ে নিচে আসো। নাশতা করবে।”
বলে চলে গেল অর্থি। অভ্রর আচমকা মনে পড়ল পৃথুলার কথা। পৃথুলা তো রুমে নেই। ওয়াশরুমের দরজা খোলা৷ তারমানে ওয়াশরুমেও নেই। মনে পড়ছে ভোরে পৃথুলা ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়েছিল।
রাতে না ঘুমানোর কারণে সমস্ত ঘুম এসে চোখে ভর করেছিল অভ্রর। বিছানায় পিঠ রাখতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেছে। কিন্তু পৃথুলা কোথায়? রুমের বাইরে যায়নি। কারণ, দরজা বন্ধ ছিল।
অভ্র তড়িৎ গতিতে বারান্দায় গেল। গিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ম্যাডাম। অভ্র পৃথুলাকে ডাকতে নিয়েও ডাকল না। ঘুমন্ত এই মায়াপরীকে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। কোলে তুলে নিল পৃথুলাকে। বিছানায় এনে শুইয়ে দিল। কপালে ছোট্ট একটা ভালবাসার পরশ এঁকে দিল। তারপর ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো।
অভ্রকে একা নামতে দেখে আদিনা রহমান বললেন,
“একা কেন? পৃথুলা কোথায়?”
“ঘুমাচ্ছে, ফুপি।”
“এখনো ঘুমাচ্ছে? ব্রেকফাস্ট করবে না?”
অভ্র কিছু বলার আগে ওর কাজিনরা ওকে টেনে নিয়ে গেল। তুষার বলল,
“ভাবি এখনো ঘুমাচ্ছে কেন? সারারাত ঘুমাতে দিসনি নাকি?”
ইফতি বলল,
“আহরে, ওই বেচারি ভাবিটাকে সারারাত জ্বালিয়ে মেরেছে।”
অভ্র বিরক্ত গলায় বলল,
“আহ্ কি শুরু করলি তোরা?”
জিসান বলল,
“বাসর রাত কেমন কাটছে? প্লিজ বল না, হাউ ফিলিং ব্রো?”
তুষার বলল,
“কী কী করলি বল না ভাই।”
অভ্র কোমড়ে দু হাত রেখে বলল,
“তোদের কি আমার হাতে থাপ্পড় খাওয়ার শখ হইছে?”
সবাই সমস্বরে বলল,
“না।”
আঞ্জুমান কিচেন থেকে বেরিয়ে হাতের বাটিটা ডাইনিং টেবিলে রাখতে রাখতে অভ্রকে ডাকলেন। অভ্র এগিয়ে গেল মায়ের দিকে।
“বলো আম্মু।”
“পৃথুলা কোথায়? দেখছি না যে?”
“ও ঘুমাচ্ছে।”
“ওমা! সে কি কথা! বেলা দশটা বাজে। এখনো ঘুমাচ্ছে! শরীর টরীর খারাপ হলো নাকি?”
“হ্যাঁ, আসলে কাল রাতে জ্বর এসেছিল। শরীরটা বোধহয় দুর্বল।”
আঞ্জুমান হতভম্ব গলায় বললেন,
“মেয়েটার জ্বর হয়েছে তুই আমাকে এখন জানাচ্ছিস! কি কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলে রে তুই!”
বলে পা পাড়ালো সিঁড়ির দিকে। অভ্র মায়ের হাত ধরে তাকে থামাল। বলল,
“আহ্ আম্মু, তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন? রাতে জ্বর এসেছিল। আমি ওকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি৷ এখন জ্বর নেই। তবে শরীরটা দুর্বল। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। এখন জাগানোর দরকার নেই৷ নিজ থেকে উঠলে তখন নাশতা খাবে। আপাতত ঘুমাক। এখন আমাদের খেতে দাও। আ’ম সো হাঙরি।”
“ঠিকাছে। সবাই একসাথে বোস।”
.
চলবে______