#মম_চিত্তে
#পর্ব_৩
#সাহেদা_আক্তার
কালকে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে। কাঁদা কাঁদা হয়ে আছে চারপাশ। কি ভেবে আজকেই সাদা সেলোয়ারটা পড়তে গেল! হয়ত ডিভোর্সের পর নিজেকে বিধবা বিধবা লাগছে। তাই মন চাইলো এটা পরতে। হাতের ঘড়িটার রঙ উঠে গেছে। কিনেছে অনেক দিন হলো। চট করে কখন বন্ধ হয়ে যায় দরকারের সময়। এখনকার দিনে তো ফোনেই সময় দেখার কাজ চলে। কিন্তু মমর ঘড়ি না হলে ভালো লাগে না। তাতেই সময় দেখতে ভালো লাগে।অনেকটা যার যে কাজ তাকে সে কাজেই মানায় এমন।একটা কেনা লাগবে। আগে ফোন কেনাটা স্থির করলো। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ডিভোর্সের আগে ভাইভা দিয়ে এসেছিল অনেক লুকোচুরি করে। টের পেলে যাওয়ার সুযোগ দিতো না। যদি কপালে থাকে তবে সেখান থেকে ম্যাসেজ আসতেও পারে। অবশ্য চারদিন হয়ে গেছে। এখনো ডাক আসেনি। তাও আশা। বলে না আশায় বাঁচে চাষা। স্যামসাংয়ের একটা দোকানে গিয়ে পছন্দমতো ফোন, প্রটেক্টর গ্লাস, কভার সব কিনে সিম ঢুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল।
ফোনটা ওপেন হতে কিছু সময় নিল। নেট কিনে ডাটা খুলতেই হাজারটা ম্যাসেজ জমা হল। স্বাভাবিক; কাল যে মেয়ের ডিভোর্স হয়েছে। সমবেদনার ঢল বইছে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ইনস্টাগ্রাম সব জায়গায়। যাদের বিয়ের পর একদিনের জন্যও খবর নিতে দেখেনি তারাও কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেছে৷ খারাপ খবর কেন বাতাসের আগে ছড়ায় সেটা এখনো বুঝতে পারে না মম। ও ডাটা অফ করে দিল। ম্যাসেজের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। রিকশায় বসে বাসার দিকে রওনা দিতে দিতে ফোন ম্যাসেজে ঢুকল। একগাদা ফোন কোম্পানির ম্যাসেজ। অল্প দিনের জন্য গাদা গাদা টাকা দিয়ে অফার কেনার ইচ্ছে নেই আপাতত৷ মমর ইচ্ছে করছে সব একসাথে ডিলেট দেয়। নিচে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ একটা ম্যাসেজে নজর পড়ল। সাথে সাথে রিকশাওয়ালাকে বলল, চাচা, রিকশা ঘুরান। মম উল্টা পথ ধরল। এখন সাড়ে আটটা বাজে। নয়টায় পৌঁছাতে হবে অফিসে। আজ ওর চাকরির প্রথম দিন।
মম সোয়া নয়টায় এসে পৌঁছালো। ও আসতে আসতে ছোটখাটো সমবর্ধনা শেষে সবাই নিজের কাজে জয়েন হয়ে গেছে। গেটে ঢুকতে গিয়ে দারোয়ানের বাঁধার মুখে পড়ল। অপরিচিত কাউকে সে ঢুকতে দিতে রাজি নয়। মম বলল, দেখুন আজ আমি নতুন জয়েন হয়েছি।
– কাগজ দেখান।
মম তো কোনো কাগজ আনেনি। ম্যাসেজে উল্লেখ ছিল কিন্তু ওর কাছে সময় ছিল না। ও অনেক অনুরোধ করে বলল, চাচা, বিশ্বাস করেন কালকে আমার ফোনটা ভেঙে গিয়েছিলো তাই ম্যাসেজ দেখতে পারিনি। ফোন কেনার পর যখন ম্যাসেজ দেখলাম সাথে সাথে রওনা দিয়েছি। তাই কাগজ আনার সময় পাইনি। দারোয়ান কোনোভাবেই মানতে চাইলো না। সময় পার হয়ে গেছে। এখন আর ঢুকতে দেওয়া যাবে না। মম তাও অনুরোধ করতে লাগল। দারোয়ান তার অবস্থানে অনড়। ও কি করবে বুঝতে পারছে না। এমনিতেও পনের মিনিট পর এসেছে। এখন আধাঘন্টা হতে চলছে।
মিনহাজ একটা দরকারে বেরিয়েছিল। ঢুকার সময় দারোয়ান সালাম দিল। দারোয়ানকে সালাম দিতে দেখে মম তাকে ডেকে বসল। মিনহাজ দাঁড়িয়ে বলল, বলুন। মম তার পরিস্থিতির কথা বোঝানোর চেষ্টা করল।নিজেকে লজ্জিত লাগছে। সব ফোনের দোষ৷ হাত থেকে ছাড়লেই নিচে পড়ে ভাঙতে হবে!? ভাগ্য ভালো সকাল সকাল ফোন কিনতে বেরিয়ে ছিল। ম্যাসেজটাও চোখে পড়ল৷ মিনহাজ জিজ্ঞেস করল, আপনি নতুন?
– জ্বি।
– আচ্ছা আপনি আমার সাথে আসুন।
মিনহাজ তার আইডি কার্ড দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। মমও ওর সাথে অফিসে ঢুকল। ঢুকতেই দেখল সবাই ব্যস্ত। মিনহাজ বলল, এখানে আসার পরই সবাইকে একটা করে আইডি কার্ড দিয়ে দেওয়া হয়। তবে পজিশন ভেদে আইডি কার্ড ভিন্ন হয়। সবার সব জায়গায় যাওয়ার পারমিশন নেই। ফারিজা এসে বলল, আপনাকে রিয়ান স্যার ডাকছেন।
– ওকে, তুমি ওকে… কি নাম তোমার?
– মম, ফারিহা আফরিন মম।
– মিস মমর আইডি কার্ড সংগ্রহ করে সিটটা দেখিয়ে দাও। আর মিস মম।
– জ্বি।
– কালকে কাগজ জমা দিয়ে দেবেন। নাহলে আপনার পজিশন বাতিল হয়ে যাবে। ওকে?
– ওকে স্যার।
– এখানে সবাই আমাকে মিনু ভাই ডাকে। তুমিও ডাকবে।
– আচ্ছা।
মিনহাজ চলে গেল। ফারিজা ওকে একটা খালি ডেস্ক দেখিয়ে বলল ওখানে বসতে। ও ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ডেস্কের খালি চেয়ারে বসে পড়ল। চারপাশে সবাই ব্যস্ততার সাথে কাজ করছে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও ফারিজা ওর আইডি কার্ড নিয়ে এল না। ও বসে আছে কোনো কাজ ছাড়াই। রায়হান সাহেবকে খবরটা জানানো হয়নি। ও একটা ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিল চাকরির কথা। ফোন স্ক্রিন অফ করতেই ফারিজাকে দেখা গেল। সে কফি খেতে খেতে ফোনে হেসে কথা বলছে। ও ভাবল হয়ত ভুলে গেছে। মম ওর দিকে হেঁটে গেল সেটি ফারিজা খেয়াল করেনি। সে কথা বলায় মগ্ন। তাই ফারিজা পেছন ফিরতে ধাক্কা খেল মমর সাথে। কফি পড়ে মমর পেটের দিকের সাদা সেলোয়ারটা কফির রং ধারণ করল। কফি গরম থাকায় তার তাপটা ঠিকই ও অনুভব করল। ফারিজা চেঁচিয়ে উঠল, হাও ডেয়ার ইউ? চোখ কি ব্যাগে রেখে হাঁটো? দিলে তো আমার কফিটা অপচয় করে।
– মিনু ভাই আপনাকে আমার আইডি কার্ড দিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিতে বলেছিল।
– তো? সামান্য আইডি কার্ড নিজে সংগ্রহ করে নিতে পারো না আবার এই কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছো?
মম প্রতিউত্তরে কিছু বলবে ভেবেছিল কিন্তু আজকে নতুন বলে কিছু বলল না। সোজা হাঁটা দিল। ফারিজা পেছন থেকে ডাকছিল কিন্তু ও পাত্তা দিল না। ওয়াশরুম যাওয়া লাগবে। সেলোয়ারটা নষ্ট করে দিল।
.
.
.
.
ফারিজা রুমে ঢুকতেই রিয়ান বলল, জানো না একটু পর আমার ফ্লাইট? কোথায় ছিলে এতক্ষণ? সে ধানাই পানাই করে বলল, সরি স্যার। আসলে নতুন ইমপ্লয়ইগুলো এতোটা ইরেস্পন্সিবল! রিয়ান ফাইল টেবিলে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ভুলে যেও না তুমিও একজন ইমপ্লয়ই। আমার পিএ। সো ঠিকমতো নিজের কাজের দিকে কনসেন্ট্রেট করো।
– ইয়েস স্যার।
– চেক করে দেখো যে যে ফাইলগুলো নিতে হবে তা নেওয়া হয়েছে কি না।
– ওকে স্যার।
ফারিজা বের হতেই মিনহাজ রুমে ঢুকল। রিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর কোট ঠিক করছিল৷ সে এসে কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল, কোটটার খবর পেলি? ও সরে গিয়ে চেয়ারে বসে বলল, দিলে তো কাল সবাইকে বলে? ঘুমটাও ঠিকমতো যেতে পারিনি। মিনহাজ পাশে দাঁড়িয়ে চেয়ার ওর দিকে ফিরিয়ে ঝুঁকে বলল, মিস করছিস নাকি? রিয়ান ওকে সরিয়ে চেয়ার আবার টেবিলের দিকে ফিরিয়ে বলল, ফালতু কথা বলিস না তো। ভুল করে কোটটা দিয়ে ফেলেছি এটা নিয়ে বাড়িতে প্যারা। এখন আবার এক সপ্তাহের জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হবে।
– ভাই, এই ডিলটা যাতে কোনোভাবেই হাতছাড়া না হয়। চাচা অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছে। একবার ফসকে গেলে অন্য কোম্পানি নিয়ে যাবে।
– তাই বলে হুট করে বলবে? নাস্তার টেবিলে বসতে না বসতেই এক সপ্তাহের ট্যুর। তুমি সব দেখে দিয়েছো কি কি নিতে হবে?
– হুম, সব রেডি। ফারিজাও তো যাচ্ছে তোর সাথে। ওকে বলে দিয়েছি, কোথাও না বুঝলে ও সব বুঝিয়ে দেবে। দেড়টায় ফ্লাইট। এখনই বেরিয়ে পড়।
– ওকে। ড্যাডকে বোলো বেরিয়ে গেছি।
– বলব।
রিয়ান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মিনহাজ ওকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
মম ওয়াশরুমটা খুঁজে পাচ্ছে না। একজনকে বলে কোনোরকম খুঁজে নিল। বেসিনের কাছে এসে পানি দিয়ে কফি পড়া অংশ ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলো কিন্তু দাগ বসে গেছে। পেটের কাছটা কেমন জ্বালা করছে। গায়েও লেগেছে কফি। লাল হয়ে গেছে পেটের সাইডটা। এখানে বার্ণ ক্রিম পাওয়া যাবে কি না কে জানে। ভাবতে ভাবতেই ফারিজাকে ওয়াশরুম ঢুকতে দেখলো। ওকে দেখে মুখ বাঁকা করে হেসে ফ্রেশ হতে গেল। মমর ভীষণ রাগ উঠছে। কিছু বলতে পারছে না প্রথম দিন বলে। ও নিজের কাজে মনযোগ দিল। কিছুতেই যাচ্ছে না দাগটা। শেষে হতাশ হয়ে চেষ্টা ছেড়ে দিল। ফারিজা বের হয়ে বেসিনে হাত ধুচ্ছে। মম বের হওয়ার সময় ফারিজা বলে উঠল, নিজের কাজ এবার থেকে নিজে করবে। আমাকে কাজে লাগাতে চাইলে চাকরি জীবন শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। ও মম কাছে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, তুমি জানো আমি কে? এই কোম্পানীর হবু বস। রিয়ান স্যারের হবু বউ। আমার সাথে তেরামি করলে বা কথা না শুনলে চাকরি নট করে দেবো। ফারিজা ওর সেলোয়ারে হাত মুছে চলে গেল। ভাবতেই ঘেন্না লাগছে। ও পানি দিয়ে জায়গাটা মুছে আয়নার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, তোমার কপালে যদি শনি না নাচিয়েছি তবে আমার নাম ফারিহা আফরিন মম নয়।
ফারিজা গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, সরি স্যার লেট হয়ে গেছে। রিয়ান ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ছিল। জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, তুমি কবে ফাস্ট কাজ করেছো? গাড়ি ছাড়ো সিরাজ। সিরাজ গাড়ি স্টার্ট দিল।ফারিজা অভিযোগ দেওয়ার সুরে বলল, একটা নিউ ইমপ্লয়ই খুব বিরক্ত করছে স্যার। নিজের কাজ নিজে না করে আমাকে দিয়ে করাচ্ছে। রিয়ান বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে বলল, এক সপ্তাহ পরে এসে দেখছি। এখন চুপচাপ বসো। ফারিজা কথাটা শুনে বেশ খুশি হলো। রিয়ান নিজের ভাবনায় হারিয়ে গেল। ওর চোখে কেবল কানের দুলটা থেকে পড়া পানির ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে।
চলবে…