মম চিত্তে পর্ব-৭

0
3284

#মম_চিত্তে
#পর্ব_৭
#সাহেদা_আক্তার

কোটের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, জানি না। তুই তো জানিস আমার এস্ট্রোফোবিয়া আছে। ডিভোর্সের দিন আসার সময় বৃষ্টি হয়েছিল। সেই সাথে বজ্রপাত। আমি তো ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম। তারপর সব বন্ধ হতেই কোনোমতে বাসায় এসে পৌঁছালাম। গোসল করতে এসে দেখি গায়ের উপর এই কোটটা। কার কে জানে। কে যে দিলো তারও খেয়াল নেই। মনে পড়ছে না কারো সাথে দেখা হয়েছে কি না। আদ্রিতা মুচকি হেসে বলল, কোটের মালিককে পেলে দিবি কোটটা? মম জোর দিয়ে বলল, অবশ্যই দেবো। কেন দেবো না?

– জানিস আমার না একটা রোগ আছে। জামাইর সব জামা কাপড় পরে বসে থাকি। চাইলেও দিতে ইচ্ছে করে না।

– সেটা স্বাভাবিক। বউ হিসেবে জামাইর জামা কাপড় ডাকাতি করাই যাই।

– বলছিস? তাহলে এই কোটও তোর।

– মানে?

আদ্রিতা কিছু বলার আগেই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, আলিফ এসেছে রে। নিচে অপেক্ষা করছে। যাই। মম বলল, আরে খেয়ে যাবি তো। প্রিয়ান্তুকে কোলে নিয়ে বলল, আরেকদিন। আজকেও তেমন কথা হলো না। তবে বৃষ্টি আপুর থেকে সবটা শুনেছি। শক্ত থাকিস। সব কাটিয়ে নিজের জীবনটাকে আবার সুন্দর করে গুছিয়ে নিস। খুব শীঘ্রই আবার দেখা হচ্ছে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আদ্রিতা বেরিয়ে গেল। মম ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না। রুম থেকে বেরিয়ে মাধুরী খালাকে বলল, নিনিকে দেখিনি যে। কোথায় ও? খালা বললেন, সাহেবের রুমে ঘুমাইতেসে।

– ও আচ্ছা। খালা, খাবার দিয়ে দাও। বর্ষাপুর সময় মতো খেতে হবে।

বর্ষা আর বৃষ্টি বসার রুমে টিভি দেখছে। ওর কথা শুনে বলল, খালু আসুক তারপর খাবো। হঠাৎ মনে পড়ায় ফোনটা হাতে নিল মম। রায়হান সাহেব কেন এত দেরি করছে আজ ভেবে চিন্তা হচ্ছে। কল ডায়াল করার আগেই কলিংবেল বাজল। বৃষ্টি দরজা খুলতেই রায়হান সাহেব আর জাবেদ খালু ঘরে ঢুকলেন। হাতে কিসের প্যাকেট। মাধুরী খালা গিয়ে প্যাকেটটা নিল। মম এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল, এত দেরি করলে যে আব্বু? তিনি গ্লাসটা নিতে নিতে বললেন, দেরি না। আমি তো আরো আগেই এসেছিলাম। মেহমান দেখে ভাবলাম একটু দই আনি। তা মেহমান কোথায়?

– চলে গেছে।

– এত রাতে বাচ্চা নিয়ে চলে যেতে দিলি!?

– মানা করেছিলাম। শুনেনি, ওর জামাই এসে নিয়ে গেছে আব্বু। তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।

– হুম।

সবাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেল। বিছানায় পিঠ লাগতেই বৃষ্টির ঘুম। মমরও চোখ লেগে এসেছিল ক্লান্তিতে। বর্ষার একটা কথায় ঘুম পালিয়ে গেল। বর্ষার দিকে তাকাতেই সে আবার বলল, কি করে মেনে নিচ্ছিস? মম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অতীতকে অতীত রাখাটাই ভালো। না হলে বর্তমানটা এলোমেলো হয়ে যায়।

– আলিফকে দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। তুই যেমন ছবি দেখিয়েছিলি তেমন চেহারাই আছে এখনো।

– হুম।

– আদ্রিতাকে তো চিনি না তাই ভেবেছিলাম বউ দেখাতে এসেছে। পরে বুঝলাম আদ্রিতা তোর বান্ধবী।

বর্ষার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল মম। হাসি থামিয়ে বলল, ভালো বলেছো। বউ দেখাতে এসেছে। এই সাহসটুকু থাকলে আরো আগেই আসতো। নেহাত আদ্রিতা আমার বান্ধবী নাহলে ও আমার ছায়াও মাড়াতো না। চলো ঘুমাই। অনেক রাত হচ্ছে। কালকেও অফিস আছে। মম অপরপাশে ফিরে গেল। বর্ষা জানে এখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও ওর চোখে পানি আসবে। তারপর নতুন শক্তি সঞ্চয় করে ঘুমিয়ে পড়বে। যেমনটা এই এক বছর করে আসছে।

বাড়িতে এসেই সোজা রান্নাঘরে গিয়ে কাজে হাত লাগালো আদ্রিতা। ফেরদৌসি বেগুন ভর্তা বানাচ্ছিলেন। ও গিয়ে বলল, চাচি আমি করে দেই? তিনি একবার তাকিয়ে ফের কাজে মন দিয়ে বললেন, প্রায় শেষ। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছিল। টেবিলে সবাইকে ডাক তো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আদ্রিতা কিছু বলবে বলবে করেও বলতে পারল না। এভাবে একলা না বলে সবাই যখন গল্প করবে তখন কথা তুলতে হবে। এগারটার মধ্যে খেয়ে বসার রুমে আরাম করে বসল সবাই। কে কি করল সারাদিন সেটা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। ছেলেরা সবাই ব্যবসার কথা আলোচনা করছে। আর বাকিরা তাদের নিজস্ব কথা বলছে। আদ্রিতা মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে একটা হাঁক ছেড়ে বলল, আমার কাছে একটা সুখবর আছে। সবাই ওর কথা শুনে তাকালো। অনি নীলি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি কি?? আদ্রিতা গলা পরিষ্কার করে বলল, ভাইয়ের কোটের খোঁজ পাওয়া গেছে। রিতু এক লাফে আদ্রিতার কাছে গিয়ে বলল, কে সে? দেখতে কেমন? কোথায় থাকে? ভাইয়ার সাথে কেমন লাগবে? আদ্রিতা ওকে শান্ত করে বলল, আরে বোস বোস। সব বলব বলেই তো এখন কথাটা তুললাম। আমার এক কলেজ ফ্রেন্ড আছে যে মনে আছে মম নামে? নাহার চাচি বললেন, ঐযে তোর থেকে একটু বাট্টি ছিল যে ঐ মেয়েটা?

– ও এখন বাট্টি নেই। যথেষ্ট লম্বা হয়ে গেছে। আমার থেকে যদিও আধা ইঞ্চি কম। আজকে মমর আলমারিতে ভাইয়ের কোটটা দেখেছি।

রিতু অস্থির হয়ে বলল, আরে আমার প্রশ্নগুলোর তো উত্তর দিচ্ছো না আদ্রিপু। বল না, কেমন দে…। নিক্বণ পেছন থেকে চাটি মেরে বলল, অপেক্ষা কর না। বলতে দে ওকে। আগে থেকে পকপক করলে বলবে কি করে? কনক চাচি জিজ্ঞেস করলেন, আসলেই বল না মেয়েটা দেখতে কেমন? আদ্রিতা ফোন বের করে বলল, দাঁড়াও দেখাচ্ছি। ও একটা ছবি দেখালো। মম প্রিয়ান্তুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলমারির কাছে। সবাই ছবিটা দেখতে লাগল। বোনেরা কাড়াকাড়ি লাগিয়ে দিল ছবি দেখতে গিয়ে। আদ্রিতা বলল, ছবিতেই দেখো। আলমারিতে কোটটা দেখা যাচ্ছে। কোট পকেটে বড় চাচির সেলাই করে দেওয়া ছোট ‘আর’ অক্ষরটা দেখেই চিনেছি। মমর রিসেন্টলি বিয়ে হয়েছিল একমাস হবে। কিন্তু জামাইর অন্য জায়গায় সম্পর্ক থাকায় ক’দিন আগে ডিভোর্স হয়ে যায়। নাহার চাচি আফসোসের সুরে বললেন, আহারে! মেয়েটা দেখতে তো বেশ ভালোই। কে বলবে তার জীবনে এমন হয়েছে!? ডিভোর্সের কথাটা শুনে সবার উচ্ছ্বাস যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রিতু কেমন দমে গিয়ে বলল, আর আমি ভাবছিলাম…। বলে চুপ করে গেল। আদ্রিতা বলল, তোমরা যদি রাজি থাকো তো আমার একটা প্রস্তাব আছে। মমকে আমি যতটুকু চিনি ও খুবই ভালো মেয়ে। ঘরোয়া মেয়ে বলা চলে। তবে রিসেন্টলি ডিভোর্স হওয়ার পর একটা জব করছে। কোথায় করছে সেটা অবশ্য জানা হয়নি। আমার প্রস্তাব এই যে আমি চাই তোমরা ভাইয়ের জন্য ওকে পছন্দ করো।

সবাই চুপ করে রইল। দাদি রওশন আরা মুখে পান নিয়ে বললেন, দাদুভাই, একবার এনো তো ওকে। আমি দেখবো। যদি আমার মন জয় করতে পারে তবে ওকেই আমি নাতবৌ বানাবো। কেউ কিছু না বলে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। মমকে দেখার আগে কেউ আর কথা বাড়াতে চায় না। দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে তাদের জীবন কোন দিকে মোড় নেবে।

রাতে প্রিয়ান্তুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আদ্রিতা পোশাক বদলাতে গেল। আলিফ এসে বিছানায় বসল মেয়ের সাথে খেলা করতে। হঠাৎ প্রিয়ান্তুর গলায় চেইনটা দেখে চমকে উঠল। চেইনটা চিনতে অসুবিধা হলো না ওর। কারণ লকেটের উপরে খচিত নকশাটা আলিফ নিজে হাতে একে কারিগরকে দিয়ে বানিয়েছিল। আর এই চেইনই সে মমকে দিয়েছিল। আলিফের চিন্তার ছেদ ঘটিয়ে আদ্রিতা এসে বসল পাশে। আলিফ জিজ্ঞেস করল, এই চেইনটা কে দিয়েছে?

– মম। সুন্দর না?

– তার ব্যবহৃত জিনিস আমার মেয়েকে দিয়েছে কেন?

– তো কি হয়েছে? তুমি কি করে জানলে ব্যবহৃত?

– সেটা দেখেই বোঝা যায়। আর তাছাড়া তুমি তো হুট করে গেছো। এর মাঝে সে নতুন চেইন কোথা থেকে কিনবে? যাও এটা খুলে নাও।

– থাকুক না। দেখো প্রিয়া এটা নিয়ে খেলা করছে। ওরও পছন্দ হয়েছে। মানিয়েছে ওকে খুব।

আলিফ বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। কড়া গলায় বলল, তাড়াতাড়ি লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। আর কাল যেন ওর গলায় চেইনটা না দেখি। ওর এখনো এসব দেওয়ার বয়স হয়নি। বলেই চোখের উপর হাত দিয়ে চুপ করে রইল। আদ্রিতা মন খারাপ করে চেইনটা খুলে আলমারিতে রেখে শুয়ে পড়ল। আলিফ দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে চেনা মানুষ অচেনা হলে সহ্য হয় না কেন কে জানে।
.
.
.
.
মিনহাজ একজন থেকে একটা ফাইল বুঝে নিচ্ছিল তখনই মম সালাম দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। ও মমকে দেখে চিন্তা করতে লাগল ওকে কোথায় যেন দেখেছে দেখেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। ওর দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মনে পড়ল কালকে আদ্রিতার ফোনে মমর ছবি দেখেছে। নামটাও মিলে গেছে। তাহলে মম ওদের কোম্পানিতে কাজ করে! মিনহাজ কাজ থেকে ফ্রি হয়ে আদ্রিতাকে ফোন করে বলল, তোর বান্ধবী তো আমাদের কোম্পানিতে কাজ করে।

– তাই নাকি!? তো কাল বললে না যে।

– মাথা থেকে ছুটে গিয়েছিল।

– দরকারি জিনিসই তুমি ভুলে যাও ভাইয়া। যা হোক, তাহলে আমি দুপুরে ব্রেকে ওকে নিয়ে আসবো বাসায়। তুমি বড় চাচার থেকে পারমিশন নিয়ে নাও।

– দেখি।

– দেখি না। আমি আসছি ওকে নিতে।

বলে আদ্রিতা ফোন কেটে দিল। মিনহাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফাইল নিয়ে দরজায় নক করল। ভেতরে রাকিব হাসান বসে কাজ করছেন। ও ঢুকে বলল, ফাইলগুলোয় সিগনেচার লাগবে। তিনি ওর দিকে না তাকিয়ে বললেন, রেখে যাও। ফাইল রাখতে রাখতে বলল, মেয়েটা আমাদের কোম্পানিতে জব করে। কথাটা শুনে তিনি স্বপ্রশ্নে তাকিয়ে বললেন, কোন মেয়ে?

– আদ্রি যার কথা বলল কালকে। এখন ও আসছে মমকে বাড়িতে নিয়ে যেতে লাঞ্চের পরে। তাই বলছে ওকে ছুটি দিয়ে দিতে।

রাকিব হাসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ওকে। বলে দিস। মিনহাজ চলে গেলে উনি চেয়ারে হেলান দিলেন। রওশন আরার কথা উনি ফেলতে পারেন না। বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে অনেক আগলে রাখেন তিন ভাই। মমকে যদি পছন্দ হয়ে যায় তবে কেউ না করবে না সেটা জানা কথা।

দুপুরের ব্রেকটাইম শুরু হয়ে গেছে কিন্তু মম এখনো চেয়ার থেকে ওঠেনি। কাজ শেষ হচ্ছে না। খেতে যে যাবে সেই সময়ও হয়ত পাবে না। ক্লান্তি আর খিদেয় আপনিই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল। ওর ডেস্কের সামনে কে এসে বলল, কিরে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে গেলি নাকি!? মম তাকিয়ে দেখল আদ্রিতা ওর সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ও একটু অবাক হওয়া সুরে বলল, তুই? এখানে কি করে? ঢুকলি কিভাবে? বাইরের মানুষ তো তারা এলাও করে না।

– আরে ওকে, বাবা। এত চাপ নেওয়ার কিছু নেই। এখানে কেউ কিছু আমাকে বলবে না।

– কেন?

– এটা আমার বড় চাচার কোম্পানি তাই। এখন ওঠ।

– আগে বলিসনি তো।

– আমি কি জানতাম নাকি তুই আমার চাচার কোম্পানিতে জব করিস!? যাহোক ভালোই হয়েছে। এখন চল।

– কোথায়?

– আমার বাসায়। চাচাকে বলে ছুটি নিয়েছি তোর জন্য।

– আমার অনেক কাজ…

– ধুর চল তো। কাজ আমি ভাইয়াকে বলে কমিয়ে দিবো।

– ভাইয়া?

– মিনহাজ আমার বড় ভাই। এখন চল।

আদ্রিতা ওর ব্যাগ গুছিয়ে হাত ধরে হাঁটা দিল। মমকে বেগ পেতে হচ্ছে। ও কিছু বলার আগেই ওকে নিয়ে অফিসে বাইরে চলে এল। গাড়ির দরজা খুলে ওকে ঢুকতে ইশারা করে নিজেও উঠে বসল। গন্তব্য আদ্রিতাদের বাড়ি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here