#মম_চিত্তে
#পর্ব_৮
#সাহেদা_আক্তার
আদ্রিতা মমকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই একই রকম দেখতে দুটো মেয়ে ওদের দিকে দৌঁড়ে এল। মম একটু চমকে উঠে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়ে দুটো একই সাথে বলল, আমি অনিমা ও নীলিমা। তোমার নাম? মম আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, কোনটা কে? আদ্রিতা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে কেটে পড়ল। মম কিছু বলতে গিয়েও পারল না। একটা নকল হাসি দিয়ে বলল, ফারিহা আফরিন মম। দুইজনেই আবার একসাথে বলল, মমআপু, বলতো কে অনি আর কে নীলি। না বলতে পারলে কিন্তু ফেল। মম দুইজনের দিকে তাকিয়ে কনফিউজড হয়ে গেল। সে এমনিতেও জানে না কে অনিমা কে নীলিমা। পাশ ফেল তো পরের কথা। কিন্তু উত্তর না দিলে এভাবে দোরগোড়ায় দাড় করিয়ে রাখবে মনে হচ্ছে। মম আন্দাজে বলল, তুমি অনিমা আর তুমি নীলিমা। দুইবোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দৌঁড় দিতে দিতে বলল, তুমি পাশ তুমি পাশ। মম বুঝল না কিসের পাশ। ওরা চলে যেতেই আদ্রিতার আবার আবির্ভাব হলো। এবার একলা না। কোলে প্রিয়ান্তু আছে। হাত বাড়াতেই মমর কোলে চলে এল।
– বাব্বা, কোল বাছা মেয়ে আমার তোর সাথে তো একদিনেই ভাব হয়ে গেছে।
– আগে তুই বল তুই এভাবে চোরের মতো পালিয়ে গেলি কেন?
– আমার দুইটা বোন ফাজিলের হাড্ডি। যারে সামনে পায় তারেই খালি প্রশ্ন করে কে অনি কে নীলি। না পারলে এমন শাকচুন্নির মতো হাসি দেয়! তুই কেমনে পারলি?
– আন্দাজে বলে দিয়েছি। আচ্ছা কি পাশ করার কথা বলছিল?
– পরে জানবি। চল সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
ওরা রান্নাঘরে গেল। সেখানে মা চাচিরা রান্নার কাজ করছেন। ওকে দেখে এগিয়ে এলেন। মম সবাইকে সালাম দিলো। এ কথায় ও কথায় সবাই বুঝে নিলেন মম বেশ ভালোই রান্না পারে। বসার ঘরে আসতে আসতে আদ্রিতা বলল, অনি আর নীলি আমার ছোট চাচির মেয়ে। ক্লাস এইটে পড়ে দুজনেই। একটু আগে বোধহয় স্কুল থেকে এসেছে। আমার ছোট চাচা ইন্জিনিয়ার। উনি নিজের কাজে ব্যস্ত। আমার বড় চাচা মানে যার কোম্পানিতে তুই কাজ করিস। তার দুই ছেলে মেয়ে। আমার ভাইটা কোম্পানিতে এমডি হিসেবে আছে যদিও ওর ব্যবসার প্রতি ইন্টারেস্ট কম। তবুও চাচারা অবাধ্য হতে পারে না। তাই কাজ করছে। আর বোন রিতু কলেজ থেকে আসেনি মেবি। আমার বোন নিক্বণ কার্ডিওলজিস্ট। আমার আব্বুর পথ অনুসরণ করেছে বোনটা। আব্বু নিক্বণ দুজনেই এখন হসপিটালে মেবি। বাসায় আসতে আসতে রাত। আর আমার আপন ভাইকে তো চিনিস৷ মিনু ভাই বলে যে সবাই।
– উনি তোর আপন ভাই?
– হুম আমার বড় ভাই। আর…
সোফায় রওশন আরা বসে ওদের দেখছিলেন। চোখ পড়তেই কাছে ডেকে বললেন, এদিকে আয় তো দিদিভাই। মম গিয়ে সোফায় বসল। আদ্রিতা ওয়াশরুমে যাওয়ার বাহানা দিয়ে আবার কেটে পড়ল৷ রওশন আরা মমকে বললেন, দিদিভাই, পান বানাতে পারিস? মম হেসে বলল, পারি। তিনি পেছনে ইশারা করে বললেন, দেখতো ঐ যে ছোট টেবিলটার উপর পানের বাটা আছে কি না। থাকলে নিয়ে আয় তো। মম গিয়ে নিয়ে এসে বসল পাশে।
– বানা দেখি একটা পান। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
মম পান বানাতে লাগল। তিনি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, আগে কখনো বানিয়েছিস? মম হালকা হেসে বলল, দাদু থাকতে কয়েকবার বানিয়েছিলাম। প্রায়ই দেখতাম দাদু নিজে পান বানিয়ে খেতো। বানানোর সময় তাকিয়ে থাকতাম। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাদু শিখিয়ে দিয়েছিল। তখন বানিয়েছিলাম। তারপর অনেকবার বানিয়ে দিয়েছিলাম। দাদু মারা গেছে আজ দশ বারো বছর।
– আহাগো। কে কে আছে তোমার?
– আম্মু নেই। ছোটবেলায় মারা গেছে। দাদুর কাছেই মানুষ হয়েছি। দাদু মারা যাওয়ার পর মাধুরী খালা আমার দেখাশোনা করতো। আব্বু তো কাজে বাইরে থাকতেন সারাদিন৷ রাতের সময়টুকু দেখা হতো। ছুটির দিনে ঘুরতে নিয়ে যেত আমাকে আব্বু। দাদু তোমার পান…
বলেই মম থেমে গেল। ভুলে মুখ ফোসকে দাদু শব্দটা বেরিয়ে গেছে। রওশন আরা হেসে বললেন, দে দিদিভাই। তোর মুখে দাদু ডাকটা শুনে মনটা ভরে গেল। পুরানো মানুষ থেকে দিদুন শুনতে শুনতে কান পঁচে গেল।
– তাই না দিদুন?
দুইজনেই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল রিতু দাঁড়িয়ে আছে। রওশন আরার কাছে এসে বলল, তাহলে এবার থেকে ফোকলা বুড়ি ডাকবো। ভালো লাগবে শুনতে? তিনি হাসলেন। রিতু মমর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ছবি থেকে আসলেই অনেক সুইট দেখতে। শুনে মম অপ্রস্তুত হয়ে গেল। রিতু পানি নিতে নিতে বলল, আমার থেকে তুমি এক পয়েন্ট পেয়ে গেলে। রওশন আরাও মাথা উপর নিচে দুলিয়ে বলল, আমারও পছন্দ হয়ে গেছো দিদিভাই। আমাকে এভাবে প্রতিদিন পান বানিয়ে খাওয়াতে হবে কিন্তু। মম আগামাথা কিছু বুঝলো না। এদিকে সবাই খাবার টেবিলে এনে রাখতে লাগল। আড়াইটা বাজতে চলল। ফেরদৌসী তাড়া দিয়ে বলল, রিতু, চট করে গোসল সেরে আয়।
– যাই……, তোমার সাথে আরো কথা হবে। ঠিক আছে?
রিতু চলে গেল। মম কি করবে বুঝতে পারল না। সব মিলিয়ে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।
দুপুরের খাওয়াটা এখানেই হলো। খাওয়া শেষে তুলির সাথে কথা হলো। বেশ মিশুকে। ওর সাথে চট করে মিশে গেল। এ কথায় ও কথায় অনেক গল্প হলো। নাবিলও মমর পিছনে পিছনে ঘুরল যতক্ষণ ছিল। কেউ ছাড়তে চাইছিল না। সন্ধ্যার আগে আগে কোনোমতে কাজের বাহানা দিয়ে বেরিয়ে এসে হাফ ছাড়ল। বাইরে এসে হঠাৎ মনে পড়ল আলিফকে দেখতে পায়নি আজ। হয়তো বাড়িতে নেই। থাকলে খাবার টেবিলে হলেও দেখতে পেতো। ভালোই হয়েছে। যা অস্বস্তির মধ্যে দিয়ে গেছে এই কয়েক ঘন্টা। ও থাকলে অতিষ্ঠ হয়ে যেতো। মম গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতেই একটা কালো গাড়ি ঢুকলো।
বাড়ির সবাই আলোচনা করছে মমকে নিয়ে কার কেমন লেগেছে। সবাই সবার কথা শুনে বুঝতে পারল সবারই ওকে পছন্দ হয়েছে। ফেরদৌসী একটু সংকোচ করে বললেন, ডিভোর্সি মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে লোকে কি বলবে? রওশন আরা তাঁর কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমাদের মেয়ে লাগবে। আমরা ওর সাথে থাকবো। লোক তো আর থাকবে না। তাহলে ওদের কথা শুনে এমন ভালো মেয়ে হাত ছাড়া করব কেন? এখন কথা হলো দাদুভাইয়ের পছন্দ হয় কি না।
– কে দাদুমনি?
সবাই তাকিয়ে দেখল রিয়ান এসেছে। সাথে আলিফ। আদ্রিতা জিজ্ঞেস করল, তোর না কাল আসার কথা? রিয়ান ঘড়ি খুলতে খুলতে সোফায় বসে বলল, কাজ শেষ, ফ্লাইট পেলাম তাই চলে এলাম। তা এত কি নিয়ে বৈঠক বসালে এই সন্ধ্যা বেলা? রিতু দৌঁড়ে এসে বলল, ভাইয়া আরেকটু আগে আসতি! কি যে মিস করলি! তুলি ভাবি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। ও গ্লাসটা নিয়ে বলল, কি মিস করলাম?
– তোর বউকে।
শুনেই রিয়ানের নাকে মুখে পানি উঠে কাশতে লাগল। ফেরদৌসী এসে হালকা করে ওর পিঠে চাপড় দিতে দিতে রিতুকে বললেন, এখন এসব কথা না বললেই নয়? ছেলেটা মাত্র এল জার্নি করে। কাশি থামার পর রিয়ানকে বললেন, যা ফ্রেশ হয়ে আয়। ফুলি সবার চা নাস্তা আনল। সবাই নাস্তা করতে করতে আলোচনা করতে লাগল কে মমকে দশে কত দিল। কার কোন জিনিস ভালো লাগল। রিয়ানের মাথায় কিছু ঢুকছে না। কিছু বুঝতে না পেরে ও উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আলিফও কিছু বুঝতে পারছে না কাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাই আদ্রিতাকে আলোচনার বিষয় বস্তু জিজ্ঞেস করতেই বলল, ও… তোমাকে তো কিছু বলাই হয়নি। কালকে তো ছিলে না। আমি কালকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। রিয়ানের বিয়ে নিয়ে।
– তাই নাকি! তাহলে তো মিস করে গেলাম। কালকে হঠাৎ এত মাথা ব্যাথা করল! তা কি প্রস্তাব দিলে শালা বাবুর বিয়ে নিয়ে?
– আমার ফ্রেন্ড মমকে দেখেছো না? ওকে আমার ভাইয়ের বউ করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। সবাই দেখতে চেয়েছিল তাই নিয়ে এসেছিলাম ওকে। সেটা নিয়েই এখন আলোচনা চলছে।
মমর কথা শুনে আলিফের মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। কালকে রাতে মাথাব্যাথা ওঠায় রুমে চলে গিয়েছিল। রিয়ান ফোন দিয়ে বলেছিল ওকে গিয়ে রিসিভ করতে। কাউকে যেন না বলে। তাই দুপুরের আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল রিয়ানকে আনতে। বাড়িতে থাকতেও এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। আর এত কিছু হয়ে গেল! সবার কথা শুনে যা বোঝা গেল, মমকে সবারই কম বেশি পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আলিফের ভেতরে অশান্তির ঝড় আরো বেড়ে গেল। নাস্তা না করেই রুমের দিকে হাঁটা দিল।
যেহেতু অফিস থেকে ছুটে দিয়ে দিয়েছে তাহলে আর এই সন্ধ্যাবেলা ওখানে গিয়ে কোনো কাজ নেই। মম সোজা বাসায় চলে গেল। দরজা খুলে বর্ষা বলল, কিরে আজ এত তাড়াতাড়ি!? মম ঢুকে সোফায় হেলান দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টি এসে বলল, কিছু হয়েছে নাকি!? এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?
– কিছু না। ক্লান্ত লাগছে। আজকে জানলাম আমার ফ্রেন্ডের চাচার কোম্পানিতে কাজ করছি।
বর্ষা একগ্লাস পানি এনে বলল, কে? আদ্রিতা? মম পানি খেয়ে বলল, হুম। আজকে আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তাই এত তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছি।
নিনিটা এসে পায়ে পায়ে ঘুরতে লাগল। ওকে কোলে নিয়ে রুমে চলে এল। ফ্রেশ হয়ে নিনিকে জড়িয়ে ধরে ঘুম দিল। বিড়ালটাও মালিকের মতিগতি বুঝতে পেরে আরাম করে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
.
.
.
.
অফিসে গিয়ে মমর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। দশটা মোটা ফাইল ওর টেবিলের উপর। ব্যাগটা চেয়ারে আটকে রেখেই ফাইল খুলে বসল। আজকে কখন কাজ শেষ হয় কে জানে। দুই ঘন্টা পর একটা ফাইল শেষ করে আরেকটা নিতেই ফারিজাকে বাঁকা হাসি দিয়ে ওর সামনে দিয়ে যেতে দেখল। তৌসিফা ওকে পাশ থেকে ডেকে ফিসফিস করে বলল, তোর সাথে কি ফারিজার কোনো সমস্যা হয়েছে? মম ফাইল দেখতে দেখতে বলল, অযথা আমার সাথে ঝামেলা করলে কি করা?
– এই মেয়ে এই নিয়ে দুটো মেয়েকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছে। সবাই জানে কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খোলে না।
তৌসিফার কথা শেষ হতেই প্লাবন এসে বলল, মম, তোমাকে বড় স্যার ডাকছেন। মম আর তৌসিফা একে অপরের দিকে তাকালো।
চলবে…