#মম_চিত্তে
#পর্ব_৯
#সাহেদা_আক্তার
মম দরজায় নক করে বলল, আসবো স্যার? ভেতর থেকে পারমিশন পেয়ে ঢুকল। এই একসপ্তাহে কখনো রাকিব হাসান ডাকেননি। যত কাজ করেছে হয় মিনহাজ দিয়েছে না হয় অন্য কেউ দিয়ে গেছে। এই প্রথম তার সাথে সরাসরি কথা হবে। রাকিব হাসান রিয়ানকে কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন এক বছর হবে। ছেলে কাজের যোগ্য হয়ে যাওয়ায় তার উপর ভার দিয়েছেন। তবুও মাঝে মধ্যে রিয়ান উপস্থিত না থাকলে বা বড় কোনো ডিল আসলে তিনিই সামলান। এখনও তাই। গতকাল মাত্র রিয়ান এসেছে বিদেশ থেকে; ভেবেছিলেন বাসায় বসে ক্রিকেট ম্যাচটা দেখবেন। কিন্তু ফেরদৌসী তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন জোর করে। বিয়ের ব্যাপারে সবাই বেশ উত্তেজিত। তাই রিয়ানের সাথে সবাই কথা বলতে চায়। অনেকটা বিয়ের কারণ দেখিয়ে পাঠিয়ে দিলেন রাকিবকে অফিসে এটা তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া তাঁরও মমকে দেখা দরকার। সবাই কেমন মেয়ে ছেলের জন্য পছন্দ করছে। গতকালকে দেখতে পারেননি অফিসে থাকার কারণে। যেহেতু মম তাঁরই কোম্পানিতে জব করে; এক ছুতোঁয় যাচাই করে নেওয়া যাবে মম কেমন, তার কাজ কেমন। তাই আর ফেরদৌসী অফিস আসার জন্য করা জোরাজুরিতে না করেননি। এমনিতে ভালোই জেনেছে খোঁজ খবর নিয়ে। কাজে পটু। এখন তিনি দেখতে চান কতটা কাজে পটু এবং কতটুকু ভার সে নিতে পারে।
মম ঢুকতে একবার আগাগোড়া দেখলেন তিনি। বেশ ছিমছাম। একটা সাধারণ হালকা নীল রঙের সেলোয়ার পরে আছে। মাথায় খোঁপা করা। হাতে একটা ঘড়ি পরে আছে। বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো হয়েছে৷ গলায় আইডি কার্ড ঝুলছে। ওকে দেখে রাকিব হাসানের ভালোই পছন্দ হল। তিনি বললেন, এখানে ন’টা ইম্পটেন্ট ফাইল আছে। কালকের মধ্যে লাগবে। সবকিছু চেক করে কালকে রিপোর্ট জানাবে। মম কিছু বলতে পারল না। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ফাইল নিয়ে বেরিয়ে এল। বেশ ভারি ফাইলগুলো। সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। টেবিলে যাওয়ার আগে একটা ফাইল পড়ে গেল। ও কি করবে বুঝতে পারল না। ফাইলটা নিতে গেলে আরো ফাইল পড়ে যাবে আবার রেখেও যেতে পারছে না৷ ওর ভাবনার মাঝেই রাসেল এসে ফাইলটা তুলে দিয়ে বলল, বেশ ভারি মনে হচ্ছে। আমাকে দাও। রাসেল মম থেকে অনেক সিনিয়র। দু একবার দেখেছিল৷ কিন্তু কথা হয়নি। ও না চাইতেও রাসেল জোর করে ফাইলগুলো নিয়ে নিল। নেওয়ার সময় সে মমর হাতের উপরে হাত রেখে ফাইলগুলো নিল। ওর খেয়াল হতেই দ্রুত হাত সরিয়ে নিল ফাইল থেকে। রাসেল একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে ওর টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ফাইল নিয়ে মমর টেবিলে রাখতেই বুঝতে পারল সে ওর টেবিলের অবস্থান জানে। টেবিল দেখে বলল, বাব্বা কত ফাইল জমেছে তোমার টেবিলে। আমি কি কিছু করে দেবো? মম ভদ্রভাবে বলল, আমি পারব। সমস্যা নেই। রাসেল ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, গুড, তোমার মতো একটিভ নিউ মেম্বারই দরকার। বলে একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। রাসেলের স্পর্শ মোটেই ভালো লাগেনি মমর। কাঁধটা কেমন চেপে ধরেছিল। কথা বলার সময় তার চোখও মমর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছিল। এর থেকে দূরে থাকতে হবে ভাবতে ভাবতেই কাজে বসে পড়ল।
মোট উনিশটা ফাইল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এক একটা ফাইল মোটা। হাজার একটা হিসেব নিকেশ। মম পাগলের মতো কাজ করছে। দুপুরের খাবারটাও স্কিপ করল কাজের জন্য। এর মধ্যে কয়েক কাপ কফি খেয়ে পেট ভর্তি করে ফেলেছে। আরেককাপ কফি নিতে গিয়ে ফারিজার মুখোমুখি হয়ে গেল। মেয়েটার মুখ দেখলেই রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয়৷ মম কফি মেকারে কফি বানাতে দিতেই সে বলে উঠল, কেমন আছেন মিস মম?
– ভালো।
– শুনলাম আপনি অনেক কাজের মেয়ে। চারদিকে অনেক সুনাম উড়ে বেড়াচ্ছে।
– সব আপনার জন্যই। আপনি না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।
ফারিজা তৈরী হয়ে যাওয়া মমর কফির কাপটা হাতে নিয়ে বলল, তাই নাকি!? তা কিভাবে? মম হেসে বলল, আপনি ঐদিন অপমান না করলে আমার জেদ চাপতো না আর আমিও কঠোর পরিশ্রম করার শক্তি পেতাম না। এক কাজ করবেন, আমাকে আপনার একটা ছবি বাঁধাই করে দেবেন। আপনার চাঁদমুখ দেখলে আমার কাজের স্পৃহা জন্মাবে। নতুন উদ্যমে কাজ করতে পারবো। বাই দ্যা ওয়ে, কফিটা আমার ছিল। বলে ফারিজার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে চলে গেল। ও অপমানে রাগে অপমানে দাঁড়িয়ে থেকে মমর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
কফি নিয়ে বসতেই তৌসিফা ওকে বলল, ফের কফি!? মম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি করবো বলো? দুপুরে লাঞ্চ করতে পারিনি। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে তাই কফিটাই এখন সঙ্গী। তৌসিফা কম্পিউটারের কাজ করতে করতে বলল, তুমি তো তাও কফি খেয়ে ঘুম তাড়াতে পারছো। আমার তো উল্টোটা হয়। কোথায় কফি কোথায় কি। এক মগ কফি খাওয়ার দশ মিনিট পর দেখবে বিছানায় আরাম করে ঘুম দিচ্ছি। মম হাসল। ফাইলের দিকে মনোযোগ দিতে দিতে বলল, আচ্ছা, আমাদের কোম্পানির মালিকের বয়স হয়েছে আর বিবাহিত। তাই না?
– তুমি কার কথা বলছো? বড় স্যার?
– হুম। তাহলে মিস ফারিজা কি করে তার হবু বউ হয়!?
তৌসিফা বিষম খেল। সে এমন ভাবে তাকালো যেন মমর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ও অবিশ্বাসের সুরে বলল, তোমাকে এ কথা কে বলল? মম কম্পিউটার আর ফাইলের হিসাব মিলাতে মিলাতে বলল, সে নিজে বলেছে সে নাকি রিয়ান স্যারের হবু বউ। তৌসিফা কথাটা শুনে হেসে বলল, তাই বলো। তুমি ছোট স্যারের কথা বলছো! ওয়েট, কি বললে? হবু বউ!? কে? মিস ফারিজা! আমি তো জানি সে স্যারের কোন এক কালের বান্ধবী ছিল। হবু বউ হলো কখন?
– আমি কি করে বলব? আচ্ছা ছোট স্যার আর বড় স্যার মানে?
– তুমি জানো না? বড় স্যার মানে রাকিব হাসান যিনি তোমাকে ডেকেছেন। আর ছোট স্যার মানে রিয়ান হাসান হচ্ছে তাঁর ছেলে যে বর্তমানে কোম্পানির দায়িত্বে আছে। ছোট স্যার শুনলাম একটা ডিল করার জন্য সিঙ্গাপুর গেছেন এক সপ্তাহের জন্য।
– ও আচ্ছা। আমি তো ভাবলাম……
মম একটা হাসি দিল। কি বেকুবের মতো ভাবনা তার! ভাবতেই নিজেকে হাস্যকর লাগল। তৌসিফা হঠাৎ মমর কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, আমি শুনেছি মিস ফারিজা নাকি রিয়ান স্যারের উপর ক্রাশ। তাই এই কোম্পানিতে যত সুন্দরী মেয়ে আছে সবার পিছে পড়ে থাকে তাদের বের করার জন্য। যদি তার ব্যাঙের মতো চেহারা ফেলে অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ করে ফেলে! তৌসিফা এমন ভাবে হাসল যেন সে একটা মজার কৌতুক বলেছে। মমও নকল হাসি দিয়ে কাজে মন দিল। মাথায় একটা কথা ঘুরতে লাগল। যদি তৌসিফার কথা সত্যি হয় তবে সে মমর পিছনে কেন পড়ল!?
.
.
.
.
রিয়ান বসে আছে ওর রুমে বেশ বিরক্ত নিয়ে। দুপুরের খাবারটা খেয়ে মাত্র শান্তিতে আরাম করতে এসেছিল। ভাই বোন গুলো তাও দিচ্ছে না। এসেই বানরের মতো ক্যাঁচ ক্যাঁচ করছে। দুই মিনিটেই মাথা ধরে গেল ওর কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। ওরা নিজেদের মধ্যে কি যেন আলোচনা করছে। সারমর্ম হিসেবে বুঝলো কারো বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। তাদের সলাপরামর্শ শেষ হওয়ার পর সবাই একসাথে রিয়ানের দিকে ঘুরে বসল। ও হতভম্বের মতো সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কি? রিতু বলল, তোর বিয়ে। রিয়ান অবিশ্বাসের সাথে বলল, দেখ রিতু, খুব ঘুম পাচ্ছে, ক্লান্ত লাগছে। ফাজলামি ভালো লাগছে না।
– ফাজলামি কোথায় করল?
ফেরদৌসী রুমে ঢুকলেন। মায়ের কথা শুনে রিয়ান বলল, জানা নেই শোনা নেই হুট করে বলছো আমার বিয়ে? নাহার চাচি বললেন, তো দেখে নে। তোদের কোম্পানিতেই তো কাজ করে। আমাদের সবার ভালো লেগেছে।
– মানে কি? কার কথা বলছো?
অনি বলল, তোমার হবু বউ। আমার তো খুব ভালো লেগেছে। কত কিউট দেখতে। সারাটা সময় হেসে হেসে কথা বলছিল। নীলিও ওর সাথে তাল মিলালো। রিয়ান বলল, তাই বলে হুট করে বিয়ের কথা বলবে? রওশন আরা ওর সোফায় বসে পান চিবুচ্ছিলেন। ওর কথা শুনে বললেন, দাদুভাই, আমার ঐ নাতবৌই চাই। এনে দিবি না? আদ্রিতা রিয়ানের কানে কানে বলল, তোর কোটের সন্ধান পাওয়া গেছে। রিয়ান আবার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায়? নিক্বণ দাদির পাশে বসে বলল, কোটের কথা বলছিস তো? তোর হবু বউয়ের কাছেই পাওয়া গেছে।
– কি হবু বউ, হবু বউ করছো। তোমরা কি পাগল হয়ে গেছো? এক কোট দিয়ে মনে হচ্ছে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেলেছি।
রিয়ান রেগে গিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। গিয়ে বসল বারান্দায়। তুলি ভাবি ওর রুমের দিকেই যাচ্ছিল। ওকে বারান্দায় দেখে এসে বলল, কি গো ভাই, এখানে যে? রিয়ান একটু নরম হয়ে বলল, সবাই কি শুরু করল বলো তো ভাবি!? বিয়ে বিয়ে করে মাথাটা খাচ্ছে ঐদিনের পর থেকে। কথা নেই বার্তা নেই বলছে বিয়ে। এভাবে হুট করে হয় সবকিছু? তুলি ভাবি ওর পাশের চেয়ারটা টেনে বসে বলল, ভাই, বিয়ে তো হয়ে যাচ্ছে না। আমরা মেয়েকে দেখেছি শুধু। কথাবার্তা কিছুই হয়নি। তোমার পছন্দ হলে তারপর কথা বলবে। তা ভাই তোমার কি পছন্দ আছে? তুলি ভাবির এমন প্রশ্নে হঠাৎ ও প্যান্টের পকেটে হাত দিল। কেন যেন দুলটা সব সময় ও সাথে নিয়ে ঘোরে৷ উত্তরে ও না বলল৷
– তাহলে আর কি। দেখে নাও। সবাই সত্যিই পছন্দ করেছে ওকে।
ভাবি উঠে গেলেন। রিয়ান চুপ করে বসে রইল। হাতে দুলটার স্পর্শ পাচ্ছে। ও দুলটা বের করে দেখতে লাগল। দুলের মালিককে পাওয়া গেল; তার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্যও সবাই উঠে পড়ে লাগল। ভেতরে কেমন মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। রাগকে ছাপিয়ে এক অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে। এটার নাম কি মায়া!?
চলবে…
নতুন পাঠকরা Next part পড়ার জন্য পেজে Follow দিয়ে রাখুন, তাছাড়া Next Part খুঁজে পাবেন না