#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-১০
★সকালের মিষ্টি রোদটা একটু গরম হতে শুরু করেছে।বেলা গরিয়ে আট টায় ঠেকেছে।কম্বলের ভেতর নূরের গরম লাগতে শুরু করলো। অস্বস্তিতে নূরের ঘুম ভেঙে গেল। নূর কম্বল টা মাথার ওপর থেকে সরিয়ে মাথাটা বের করলো। চোখ কচলিয়ে সামনে তাকালো নূর।সামনে তাকিয়ে দেখলো আদিত্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছে।
আদিত্য মাত্রই শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। পরনে শুধু একটা টাওয়াল।দুধফর্সা শরীরে মুক্ত দানার মতো বিন্দু বিন্দু পানির কনা জমে আছে। লোমহীন সিক্স প্যাক বডি দৃশ্যমান হয়ে আছে। নূর চোখ পিটপিট করে বিস্ময় নিয়ে একধ্যানে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ভেতর কেমন কেমন যেন লাগছে কিন্তু অবুঝ নূর সেটা বুঝতে পারছে না। শুধু মনে মনে ভাবছে,হিরোটা কতো সুন্দর। চকলেট আর রসগোল্লার চেয়েও বেশি সুন্দর। একদম ইয়াম্মি ইয়াম্মি দেখতে। আচ্ছা মানুষও কি ইয়াম্মি হয়? তাহলে কি মানুষকেও খাওয়া যায়?
নূরের আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই আদিত্য জামা কাপড় পড়ে নিল। তারপর বেডের দিকে চোখ পরতেই দেখলো নূর ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আদিত্য মুচকি হেসে নূরের কাছে গিয়ে বেডের ওপর বসে হালকা ঝুকে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–বাহ্ আজতো আমার এঞ্জেল টা সকাল সকালই উঠে পরেছে।
নূর কিছু না বলে এখনো আদিত্যের দিকে কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি হয়েছে এঞ্জেল? এভাবে কি দেখছ?
নূর বলে উঠলো।
–তোমাকে?
–আমাকে?
–হ্যাঁ তোমাকে। তোমাকে না আজ অনেক ইয়াম্মি লাগছে। আচ্ছা তোমাকে কি একটু খাওয়া যাবে?
আদিত্য অন্য দিকে মাথা ঘুড়িয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে খানিক হাসলো। তারপর নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ যাবেতো। তবে এখন না। সেই সময় এখনো আসেনি। সময় আসলে তুমি আমাকে খেতে পারবে।
নূর বাচ্চাদের মতো করে বললো।
–কখন আসবে সেই সময়।
আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–সেটাতো জানিনা। তবে যখন আসবে তখন তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। এখন তাড়াতাড়ি উঠে পরো। একটু পরে আমরা ডক্টরের কাছে যাবো।
নূর মুখ গোমড়া করে বললো।
–আমি যাবোনা। ডাক্তার অনেক পঁচা। শুধু আমাকে শুই দেয়।আমার ব্যাথা লাগে। আর এত্তো এত্তো ঔষধ দেয়। আমার ভালো লাগে না।
নূরের কথায় আদিত্যর মনটা হু হু করে উঠলো। মেয়েটাকে নিশ্চয় কত কষ্ট করতে হয়েছে নিজের অসুস্থতার জন্য। আদিত্য মায়া ভরা কন্ঠে বললো।
–আমি আছি না। আমি থাকতে আমার এঞ্জেল কে কেউ ব্যাথা দিতে পারবে না। আমরা শুধু যেয়ে ডাক্তারের সাথে একটু কথা বলবো ব্যাস। আর কিছুই না। আর তারপর তোমাকে অনেক গুলো রসগোল্লা খাওয়াবো। ঠিক আছে?
নূর খুশি হয়ে বললো।
–সত্যিই? ঠিক আছে, তাহলে আমি যাবো।
___
নিলা ছাদে এসেছে নিজের কিছু ভেজা কাপড়চোপড় নেড়ে দেওয়ার জন্য। হাতের বালতিটা নিচে রেখে একটা করে কাপড় বের করে ঝাকি দিয়ে তারের সাথে নেড়ে দিতে লাগলো। পাশেই আবির পুশআপস করছিল। তবে কাপড়চোপড়ের আড়ালে থাকায় নিলা খেয়াল করেনি। নিলা এবার কাপড় তোলার সময় একটার সাথে আরেকটা চলে এসেছে। নিলা সেটা খেয়াল না করেই কাপড় টা উঁচু করে জোরে ঝাকি দিল। আর কাপড়ের সাথে থাকা অযাচিত একটা কাপড় গিয়ে পড়লো আবিরের ওপর।
আবির ভ্রু কুঁচকে পুশআপস বন্ধ করে উঠে বসলো। কাপড় টা দুই আঙুল দিয়ে উঁচু করে সামনে ধরলো। কাপড়ের মালিক কে খোঁজার জন্য কাপড়চোপড়ের ফাঁক দিয়ে সামনে তাকিয়ে নিলাকে দেখতে পেল। আবির বাঁকা হেসে নিলার কাছে এগিয়ে গেল। নিলার সামনে গিয়ে দুষ্টু হেসে বললো।
–এইযে বিয়াইন সাহেবা। বয়সে যেহেতু ছোট তাই তুমি করেই বলছি।তো বলছিলাম যে, এতো ডেস্পারেট হওয়া টা কিন্তু ঠিক না।আই মিন একটু সময় তো দিবে। সকাল সকালই শুরু করে দিয়েছো?
আবিরের কথার আগাগোড়া কিছু বুঝতে না পেরে, ভ্রু কুঁচকে বললো।
–আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? সকাল সকাল কি আবোল তাবোল বলছেন?
–বারে, নিজেই আমাকে ইঙ্গিত করে ডাকছ। আবার আমাকেই পাগল বলছ? দ্যটস নট ফেয়ার।
–আমি আবার কখন আপনাকে ডাকলাম? আমার কি খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই?
–ওও তাহলে এটা বুঝি আমার কাছে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলে এসেছে।
কথাটা বলে আবির ওর হাতে থাকা কাপড় টা নিলার সামনে ধরলো।
আবিরের হাতে কাপড় টা দেখে নিলার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। নিলা এক ঝটকায় আবিরের হাত থেকে কাপড় টা নিয়ে পেছনে লুকিয়ে ফেললো। লজ্জায় নিলা আবিরের দিকে তাকাতে পারছে না। নিলার এই লজ্জারাঙা চেহারাটা আবির খুব উপভোগ করছে। আবির টেডি স্মাইল দিয়ে তাকিয়ে আছে নিলার দিকে। নিলা মাথা নিচু করে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো।
–এ এএটা ভুলে চলে গেছে সরি।
আবির বাঁকা হেসে বললো।
–আরে থাক থাক আমার সামনে আর লুকানোর দরকার নেই। আমি সবই বুঝি। আসলে আমি এতটাই চার্মিং যে মেয়েরা আমাকে দেখলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তোমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য তুমি একদম উতলা হয়ে গেছ।তাইতো এসব আকার ইঙ্গিত করে আমাকে বুঝাতে চাইছ।
নিলা রাগে কটমট করে আবিরের দিকে আঙুল তুলে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আবির হাত তুলে নিলাকে থামিয়ে দিয়ে বললো।
–আরে থাক থাক আর কিছু বলতে হবে না। আমি সব বুঝে গেছি।
আবির এবার একটু ন্যাকামি করে লাজুক ভঙ্গিতে বললো।
— তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য সরি। তবে এবার আমি আগেই ফিজিক্যাল হতে চাচ্ছিনা। আসলে এবার আমার কেমন যানি টুরু(ট্রু) লাভ,টুরু লাভ ওয়ালা ফিলিং হচ্ছে। তাই আমরা আগে একটু প্রেম করি,তারপর নাহয় এসব করবো ঠিক আছে?
নিলার মাথা ঘুরে ওঠার উপক্রম। ইচ্ছে করছে এখনি একে ছাদ থেকে ফেলে সোজা পটল ক্ষেতে পাঠিয়ে দিতে। নিলা দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–আপনি যে হাই লেভেলের মেন্টাল তাকি আপনি জানেন? আপনার ইমিডিয়েটলি চিকিৎসার দরকার। আপনি এটা ভাবলেন কি করে যে,আমি আপনার সাথে প্রেম করবো? আমাকে কি আপনার ওইসব মেয়েদের মতো মনে হয়, যারা আপনার পিছে পিছে ঘুরে? আমি ছোট হতে পারি, কম সুন্দর হতে পারি তাই বলে বেকুব না। আপনি কি ভেবেছেন, অন্য মেয়েদের মতো আমার সাথেও টাইম পাস করবেন,আর আমিও ধেইধেই করে আপনার সাথে ঘুরবো। সেটা কখনোই হবে না। কান খুলে শুনে রাখুন, আপনার এসব ট্রিকস আমার সামনে চলবে না। সো ইউ স্টে এওয়ে ফ্রম মি। নাহলে আমি জিজুকে জানাতে বাধ্য হবো।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নিলা ধপাধপ পা ফেলে ছাদ থেকে নেমে গেল।
পেছন থেকে আবির বাঁকা হেসে মনে মনে বললো।
–হায় আমার ধানি লঙ্কা, পাগল হই আর যাই হইনা কেন। সব রোগের চিকিৎসক তুমিই হবে মিস নিলা।
__________
ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে আদিত্য আর নূর। দেশের নামকরা নিউরো ডাক্তারের কাছে নূরকে নিয়ে এসেছে আদিত্য। ডাক্তার এখনো আসেনি। ওরা বসে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছে। নূর টেবিলের উপর থাকা স্টেথোস্কোপ টা হাতে নিয়ে, তার দুই মাথা কানে ঢুকিয়ে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করলো।তারপর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এই হেডফোনটা তো নষ্ট। এটাতে তো কোন গানই শোনা যায়না।
আদিত্য একটু মুচকি হেসে বললো।
–এটা হেডফোন না।এটাকে স্টেথোস্কোপ বলে। এটা দিয়ে হার্টবিট শোনা যায়।
আদিত্য স্টেথোস্কোপের মাথাটা নিজের বুকের ওপর রেখে বললো।
–এই দেখ এইভাবে। শুনতে পাচ্ছ আমার হার্টবিট?
নূর উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো।
–আরে হ্যাঁ, তোমার বুকের ভেতর থেকে তো ঢোল বাজার মতো শব্দ শোনা যাচ্ছে। তোমার বুকের ভেতর কি ঢোল আছে?
–এটা ঢোলের শব্দ না এঞ্জেল। এটা হৃদয়ের স্পন্দন। একটু মন দিয়ে শোন।
আদিত্যের কথামতো নূর ভালো করে মন দিয়ে শব্দটা শুনতে লাগলো। ওর কাছে মনে হলো শব্দটা খুবই সুমধুর। যেন এটা কোন মনোমুগ্ধকর মেলোডি। হঠাৎ করে নূরের মনে হলো,ওর বুকের বামপাশেও কিছু একটা অনেক দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। নূর এবার স্টেথোস্কোপর মাথাটা নিজের বুকের বামপাশে ধরলো। তখন ও নিজের বুকেও একিই রকম শব্দ শুনতে পেল। নূর খুশী হয়ে একবার নিজের তো একবার আদিত্যের হার্টবিট শুনছে। আর আদিত্য মুগ্ধ নয়নে ওর এঞ্জেল কে দেখছে। মেয়েটা কি বুঝতে পারছে যে, আমার প্রতিটা স্পন্দন শুধু ওর নামই জপছে।
ডাক্তার আসার শব্দে আদিত্য সোজা হয়ে বসলো।নূরের কাছ থেকে স্টেথোস্কোপ টা নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিল।
ডাক্তার এসে আদিত্যের সাথে কুশল বিনিময় করা শেষে নূরের ফাইল চেক করতে লাগলো। ফাইল চেক করা শেষে নূরকেও চেক করলো। সব দেখা শেষে ডাক্তার আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–মিষ্টার আদিত্য আমি সব দেখলাম। তো আপনার সাথে একটু একা কথা বলতে পারলে পুরো হতো।
আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে।
–ওকে ডক্টর আমি নূরকে বাইরে বসিয়ে আসছি এখুনি।
ডক্টর মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো।
আদিত্য নূরের হাত ধরে উঠিয়ে যেতে নিলেই নূর স্টেথোস্কোপের দিকে আঙুল তুলে অনুরোধের সুরে বললো।
–আমি একটু এইটা নিয়ে যাই?
আদিত্য ডক্টরের দিকে তাকালে ডক্টর মুচকি হেসে নিয়ে যাওয়ার পারমিশন দিল। নূর খুশী হয়ে স্টেথোস্কোপ নিয়ে আদিত্যের সাথে বাইরে এলো। নিলাও ওদের সাথে এসেছে। আদিত্য বাইরে এসে নূরকে একটা সিটে বসিয়ে, নিলাকে ডাক দিয়ে বললো।
–আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলছি, তুমি ওর দিকে খেয়াল রেখ।
নিলা মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–ঠিক আছে জিজু। আমি আছি আপুর কাছে।
আদিত্য নূরকে রেখে আবার কেবিনে চলে গেল।
নূর সিটে বসে স্টেথোস্কোপ দিয়ে খেলতে লাগলো। নূর যেখানে বসেছে তার সামানসামনি একটা ডক্টরের কেবিন আছে। কেবিনের দরজাটা খোলা। কেবিনের ভেতর ডাক্তার কিভাবে রোগী দেখছে কিভাবে কথা বলছে। নূর সেগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছে। নূরেরও মনে মনে ডাক্তার ডাক্তার খেলতে ইচ্ছে করছে। ওরও ডাক্তারের মতো রোগী দেখতে ইচ্ছে করছে।
এরই হঠাৎ নিলার ফোনে ওর মায়ের ফোন এলো। নিলা রিসিভ করে কথা বলতে গিয়ে দেখলো এখানে নেটওয়ার্ক নেই। নিলা নেটওয়ার্ক পাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুটা দুরত্বে গিয়ে নিলা ফোনে কথা বলতে লাগলো।
নূর এদিকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে হাঁটতে লাগলো। ওর এখন ডাক্তার হওয়ার শখ জেগেছে। তাই ও রোগীদের কাছে যাচ্ছে।
নূর হাঁটতে হাঁটতে একটা ওয়ার্ডের সামনে এলো।ওয়ার্ড টা ছিল পুরুষ ওয়ার্ড। এখানে অনেক গুলো রোগী ভর্তি আছে। নূর মনে মনে ভাবলো এখানেই ও ডাক্তার ডাক্তার খেলবে। নূর ধীরে ধীরে ওয়ার্ডের ভেতর ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে পাশে তাকিয়ে একটা হ্যাঙ্গারের সাথে ডাক্তারের এপ্রন ঝুলানো দেখলো। নূর খুশী মনে পা টিপে টিপে গিয়ে এপ্রন টা নিয়ে গায়ে পড়ে নিল। একটা মাস্ক ও পরে নিল। তারপর স্টেথোস্কোপটা গলায় ঝুলিয়ে ডাক্তারের মতো এটিটিউট নিয়ে রোগীদের দিকে এগিয়ে গেল।
নূরকে আসতে দেখে সবাই ডাক্তার ভেবে একটু নড়েচড়ে বসলো। মুখে মাস্ক থাকায় নূরকে ভালো করে চেনা যাচ্ছেনা তাই সিস্টার আর ওয়ার্ড বয়গুলোও নূরকে দেখে সালাম দিল। এসব দেখে নূর মনে মনে আরও খুশী হয়ে গেল। নিজেকে সত্যি সত্যিই ডাক্তার মনে হতে লাগলো ওর।
নূর হেঁটে প্রথম বেডের রোগীর কাছে গেল। রোগীর দিকে তাকিয়ে গলার স্বর ভারি করে জিজ্ঞেস করলো।
–হুমম তো কি হয়েছে আপনার? সমস্যা কি?
বেডে থাকা রোগীটা কোন গ্রাম থেকে এসেছে। লোকটা কাতর কন্ঠে বলে উঠলো।
–ডাক্তার সাব, আর কিতা ওইসে আই জানিনো। আর মাথার ভিতরে চরকির লাহান ঘুরে। ওয়াক ওয়াক কইরা বমি হইরা হালাই। আর হরান ডা ছলাৎ ছলাৎ হরে।আরে বাচান ডাক্তার সাব।
(ডাক্তার সাব,আমার কি হয়েছে আমি জানিনা।আমার মাথার ভেতর ঘুরে। বমি হয়।আমার পরানটা ছলাৎ ছলাৎ করে।আমাকে বাচান ডাক্তার সাব।)
নূর কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা করার মতো করে বললো।
–হুমমম,, এবার আপনি বাংলায় বলুন।
নূরের কথায় লোকটি আবালের মতো তাকিয়ে রইলো। নূরের পাশে থাকা ওয়ার্ড বয়টা বলে উঠলো।
–ম্যাডাম, উনি বলতে চাচ্ছেন যে,উনার মাথা ঘোরে আর বমি হয়।
নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–ওও আচ্ছা। ঠিক আছে আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আছি না।আমি শুধু রোগকেই না রুগীকেও সাফ করে দেই। আমি এখুনি আপনাকে চেক করছি।
কথাটা বলে নূর লোকটিকে চেকআপ করতে লাগলো। প্রথমে চোখ দেখলো, তারপর জিহ্বা, তারপর নাক,তারপর কানের ভেতরও টর্চ মেরে দেখতে লাগলো। তারপর নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখা স্টেথোস্কোপটা কানে লাগিয়ে, স্টেথোস্কোপের মাথাটা রোগীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ধরে ধরে চেক করতে লাগলো। নূরের এমন অত্যাধুনিক চেকআপ করা দেখে রুগী সহ বাকি সবাই বেকুবের মতো তাকিয়ে আছে। এমন আজব ভাবে চেকআপ করতে ওরা দাদার জন্মেও দেখেনি।
নূর এবার স্টেথোস্কোপ টা দিয়ে রুগী লোকটার মাথায় চেপে ধরে চেক করতে লাগলো। কতক্ষণ চেক করার পর কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো।
–হুমম,বুঝতে পেরেছি। আপনার তো অনেক বড় রোগ হয়েছে।
রোগী লোকটা ভীতু স্বরে বললো।
–আর কিতা ওইছে ডাক্তার সাব?
(আমাকে কি হয়েছে?)
নূর বলে উঠলো,
–আপনার তো মাথায় ডায়রিয়া হয়েছে।
নূরের কথায় রুগী সহ বাকি সবাই তব্দা খেয়ে গেল। সবাই হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। মাথায়ও কারো ডায়রিয়া হতে পারে এতবড় একটা জিনিস ওদের জানাই ছিলনা।
নূর একটা সিস্টারের দিকে তাকিয়ে বললো।
–শোন ওনার মাথায় বেশি বেশি স্যালাইন ঢালো।আর কান দিয়েও স্যালাইন ঢুকাও। তাহলেই উনি সুস্থ হয়ে যাবেন।
বেচারি সিস্টার টার জ্ঞান হারানোর উপক্রম। মাথায় স্যালাইন ঢালা? লাইক সিরিয়াসলি? সিস্টার টা কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–ওকে ম্যাম।
নূর এবার অন্য বেডের আরেকটা রুগীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রুগীটা ২৩/২৪ বছরের একটা ছেলে।বেডের পাশে বসে আছে তার গার্লফ্রেন্ড। নূর তাকে জিজ্ঞেস করলো তার কি সমস্যা। ছেলেটা বলে উঠলো।
–ম্যাডাম অনেকদিন ধরে আমার পেটে অনেক ব্যাথা। আর পেটটাও একটু ফুলে গেছে।
নূর আবার গম্ভীর ভাব ধরে স্টেথোস্কোপ টা দিয়ে ছেলেটার পেটের ওপর দিয়ে সব জায়গায় চেক করতে লাগলো। চেক করা শেষে নূর হাসিমুখে বললো।
–আরে অভিনন্দন, অভিনন্দন আপনার পেটে বাচ্চা। আপনি তো মা হতে চলেছেন।
ছেলেটার যেন হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম।হা হয়ে মূর্তির মতো তাকিয়ে রইলো। কি বলছে এই ডাক্তার? আমার পেটে বাচ্চা? এটা কিভাবে সম্ভব? ছেলেটা পুরো শক খেয়ে শক্ত হয়ে গেছে। কোন নড়াচড়াই করছে না। তবে ছেলেটার পাশে বসে থাকা তার গার্লফ্রেন্ড চেতে উঠলো। ছেলেটার কলার চেপে ধরে রাগী কন্ঠে বললো।
–কিহ, এতো বড় ধোঁকা? বলো কার সাথে মুখ কালা করেছ? কার বাচ্চা এটা? ছিহ ছি ছি এই ছিল তোমার মনে? বদমাইশ,ইতর, লম্পট,,
আরো যা যা আছে সব ধরনের গালি দিতে লাগলো মেয়েটা। আর ছেলেটা তো ওইভাবেই এখনো মটকা মেরে আছে। কোন নড়নচড়ন নেই।
নূর এসবে পাত্তা না দিয়ে অন্য আরেকটা রুগীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে জিজ্ঞেস করলো তার কি সমস্যা। রুগীটা বললো।
–আমার ডান পায়ের সমস্যা। অনেক দিন ধরে ডানপায়ে শক্তি কম পাচ্ছি। হাঁটতে গেলেও জোর পাইনা। আর পা টা অনেক শুকিয়েও গেছে।
নূর এবার স্টেথোস্কোপ দিয়ে রুগী লোকটার পায়ের ওপর চেপে ধরে চেক করতে লাগলো। নূরের কান্ড দেখে রুগীটা বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো। জীবনে এই প্রথম কাওকে পায়ে স্টেথোস্কোপ লাগাতে দেখছে লোকটা।ব্যাপার টা তার হজম হতে একটু সময় লাগছে। নূর কিছুক্ষণ চেক করার পর চেহারায় গাম্ভীর্য এনে বললো।
–আপনার পায়ে তো হার্টবিট নেই। আপনার পা তো মারা গেছেন। আপনার এই পা এখুনি কেটে ফেলে একে কবর দিতে হবে। নাহলে আপনার এই পায়ের সাথে সাথে শরীরের অন্য সব পার্টস ও মরে যাবে। তাই এখুনি আপনার পা কেটে ফেলতে হবে।
রুগীটা নূরের কথা আর নিতে পারলোনা।বেচারা ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
এদিকে নিলা কথা বলা শেষ করে এসে দেখলো নূর ওর সিটে নেই। নিলা ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ পুরুষ ওয়ার্ডে নূরকে দেখতে পেল। ওয়ার্ডে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে ফেলেছে নূর। এতক্ষণে সবাই জেনে গেছে যে নূর কোন ডাক্তার না।আর সেটা নিয়েই হৈচৈ বেধে গেছে। এটা দেখে নিলার মাধায় হাত। নিলা কি করবে বুঝতে পারছে না। এই মুহূর্তে নূরের কাছে গেলে নূর কিছুতেই নিলার কথা শুনবে না। নিলা তাই দৌড়ে গেল আদিত্যকে ডাকতে। এই মুহূর্তে জিজুই একমাত্র আপুকে সামলাতে পারবে।
আদিত্য ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে কেবিনের বাইরে এসে নূরকে না দেখে কপাল কুঁচকে এলো ওর।তখনই নিলা দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।
–জিজু জলদি চলুন।অনেক বড়ো ভেজাল বেঁধে গেছে।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–মানে কি হয়েছে? আর নূর কোথায়?
–বলছি, আপনি আগে আমার সাথে আসুন।
কথাটা বলে নিলা আদিত্যকে নিজের সাথে নিয়ে গেল।
মেইল ওয়ার্ডের ভেতর আসতেই আদিত্যের চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। এতটুকু সময়ের মধ্যে নূর এখানে কি গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছে। এই মেয়েটাকে একা ছাড়াই রিস্ক।আদিত্য আর এক সেকেন্ডও দেরি না দ্রুত নূরের কাছে গিয়ে কোন কিছু না বলে সোজা নূরকে কোলে তুলে নিল। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললো।
–আম রিয়েলি সরি ফর দিস ডিস্ট্রাবেন্স, অন বিহাফ অফ মাই ওয়াইফ।
কথাটা বলে আদিত্য আর এক মুহূর্তও দেরি না করে নূরকে নিয়ে ওখান থেকে বেড়িয়ে এলো। নূর শুধু নামার ছটফট করতে লাগলো। ও কিছুতেই যাবেনা। ওর আরও খেলতে ইচ্ছে করছে।
আদিত্য নূরকে নিয়ে এসে সোজা গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িতে নূর মুখ গোমড়া করে জানালা ঘেষে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো। আদিত্য সেটা দেখে মুচকি হাসলো।এঞ্জেল টাকে এভাবে একদম কিউটের ডিব্বা লাগছে। আদিত্য বললো।
–কি হয়েছে? এভাবে গাল ফুলিয়ে আছ কেন?
নূর আদিত্যের দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বললো।
–তুমি আমাকে নিয়ে এলে কেন? আমি খেলছিলাম না?
–ওখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে, তোমার সাথে সাথে আমাকেও মার খেতে হতো।
–আমি এতকিছু জানিনা।আমি ডাক্তার ডাক্তার খেলবো। আমাকে ওখানে দিয়ে এসো।
–আচ্ছা আচ্ছা তুমি বাসায় গিয়ে ডাক্তার ডাক্তার খেল ঠিক আছে।
–সত্যি তো?
–হ্যাঁ বাবা সত্যি।
আদিত্য সোফায় গালে হাত দিয়ে বসে সামনে তাকিয়ে আছে। নূর তার কথামতো বাসায় এসেই ডাক্তার ডাক্তার খেলা শুরু করে দিয়েছে। আর তার সাথে যোগ দিয়েছে আরেক পাগল আবির। আবিরটার নূরের সাথে অনেক ভাব হয়ে গেছে। নূর ডাক্তার,আর আবির হলো কম্পাউন্ডার। বেচারা সার্ভেন্ট আর গার্ডস গুলো হলো নূরের পেসেন্ট। নূর তাদের দেখে আজব আজব রোগ ধরছে আর আজব সব চিকিৎসা দিচ্ছে। আদিত্য শুধু বসে বসে দেখছে। আর কিইবা করার আছে বেচারার।
চলবে….