#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-১৬
★নিলা একটু ফ্রেশ হওয়ার জন্য উপরে নিজের রুমে এসেছিল। তখনই হঠাৎ ওর রুমে শরিফা বেগম হনহন করে ঢুকে পড়লো। শরিফা বেগমকে নিজের রুমে দেখে নিলা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। আমতা আমতা করে বললো।
–জ্বি আপনি এখানে? কোন দরকার ছিল?
শরিফা বেগম নিলার দিকে এগিয়ে এসে তিরস্কার স্বরূপ হাসি দিয়ে বললো।
–তোমার মতো দুই টাকার মেয়ে আমার কি হেল্প করবে?
শরিফা বেগমের এমন তিরস্কার মূলক কথা শুনে নিলা একটু আঘাত। ওর জীবনে আজ পর্যন্ত কেও ওর সাথে এভাবে কথা বলেনি। নিলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শরিফা বেগম আবারও বলে উঠলো।
–তোমরা তো দেখছি একদম গভীর জলের মাছ।দুই বোন ভালোই প্ল্যান করে এসেছ তাইনা?
–কি বলছেন এসব? এভাবে বলছেন কেন?
–একদম ন্যাকামি করবে না। তোমাদের এসব মাছুম চেহারা বানিয়ে অন্যকে ভোলাতে পারবে।আমাকে না। তোমরা কি ভেবেছ, তোমাদের এসব প্লটিং আমি বুঝবো না। এক বোন তো পাগল সেজে আদিত্যকে হাত করে ফেলেছে। আর এখন আবার তুমি আমার ছেলের পেছনে পরেছ, ওকে নিজের জালে ফাসানোর জন্য তাইনা? তোমাদের মা বাবা দেখছি ভালোই ট্রেনিং দিয়েছে তোমাদের। কিভাবে বড় ঘরের ছেলেদের বস করতে হয়। এইসব ভালোই শিখিয়েছে তোমার বাবা মা।
নিলা এতক্ষণ মুখ বুজে সব সহ্য করলেও। বাবা মাকে নিয়ে এতো খারাপ কথা আর শুনতে পারলোনা নিলা। শরিফা বেগমের সামনে আঙুল তুলে অগ্নি চোখে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো।
–ব্যাস, অনেক বলেছেন আপনি। আর অনেক শুনেছি আমি। আমি মুখ বুজে দাঁড়িয়ে আপনার এইসব জঘন্য কথা শুনছি। তারমানে এই নয় যে আমি দূর্বল। আপনি শুধু জিজুর চাচী দেখে আমি কিছু বলছি না। তবে আপনি আমার মা বাবাকে নিয়ে কোন বাজে কথা বললে,আমি সেটা কিছুতেই সহ্য করবো না। নিজেকে কি মনে করেন আপনি হ্যাঁ? আরে আমার মা বাবার ওপর কথা বলার আগে নিজেকে দেখুন। আপনার মতো মহিলারা যার উপরে এক রুপ আর ভেতরে আরেক রুপ।তারাই হলো সমাজের প্রকৃত জং। আরে এতই যখন অসুবিধা আপনার তাহলে আপনার ছেলেকে গিয়ে আমার পেছনে ঘুর ঘুর করা বন্ধ করতে। আমি যাইনি ওর পিছে, ওই এসেছে আমার পিছে। পারলে নিজের ছেলেকে শাসন করুন। তারপর অন্যকে শুনাতে আসবেন। আমার বয়েই গেছে আপনার ছেলের পেছনে যেতে। আশা করি বুঝে গেছেন। এখন আপনি যেতে পারেন।
এইটুকু পুচকে মেয়ের কাছে এতগুলো কথা শুনে শরিফা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিলা হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো।
–আর একটা কথাও না। নাহলে কিন্তু আমি এক্ষুনি জিজুর কাছে গিয়ে আপনার এই ভালো রুপটার জানিয়ে আসবো।তখন দেখবো আপনি কি সাফাই দেন আপনার এই অতি সুন্দর কথাবার্তার।
শরিফা বেগম এবার একটু দমে গেল। আদিত্য জানলে ব্যাপার টা ভালো হবে না। তাই শরিফা বেগম নিজের রাগকে হজম করে ওখান থেকে চলে গেলেন। শরিফা বেগম চলে যেতেই নিলা দরজা বন্ধ করে, দরজায় সাথে ঘেঁষে বসে পড়লো। মুখে দুই হাত চেপে ধরে কেঁদে উঠলো নিলা। তার জীবনে সে এতো অপমান কখনই হয়নি। আবিরের প্রতি ওর মনে মনে যে একটা সুপ্ত অনুভূতির জন্ম হয়েছিল। তাও আজ গলা টিপে মেরে ফেললো নিলা। নিলা একবার ভাবলো সে এখানে আর থাকবে না। কাল সকালেই সে চলে যাবে। তারপর আবার ভাবলো, ও চলে গেলে নূর আপু একা পড়ে যাবে। জিজু আপুর জন্য আমাকে এখানে কতো রিকুয়েষ্ট করে রেখেছে। আমার ওপর ভরসা করে আপুকে রেখে জিজু অফিসে যায়। আর আমি কিনা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা ভাবছি। না না এমন করা যাবে না। জিজু আপুর জন্য কতো কিছু করে। আর আমি তার বোন হয়ে তার জন্য এতটুকু করতে পারবো না? আমাকে স্ট্রং হতে হবে। এইসব সামান্য ব্যাপারে ভেঙে পড়লে চলবে না। এখন থেকে আমি শুধু আপুর জন্যই এখানে থাকবো। অন্য কোন কিছু নিয়ে ভাববো না। একদম না।
___
পূর্নিমার চাঁদের মোহময় আলোর ঝরনাধারার নিচে জোছনা বিলাস করছে আদিত্য নূর। প্রকৃতির হিমেল বাতাসে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে ছাদের দোলনায় বসে আছে। পার্টি শেষে নূরের আবদারেই আদিত্য নূরকে এখানে নিয়ে এসেছে। নূর আদিত্যের কোলে বসে উপর দিকে তাকিয়ে একটা একটা করে তাঁরা গুনছে আর নানান কথার অঞ্জলি সাজাচ্ছে। আর আদিত্য শুধু মুগ্ধ নয়নে ওর নিজের চাঁদকে দেখছে। চাঁদের আলোয় তার প্রিয়তমাকে আরও মায়াবী লাগছে। চেহারায় যেন নূরের আলো ঝলকে পড়ছে। এই অসামান্য সৌন্দর্যের কাছে দুনিয়ার সব সৌন্দর্যই বৃথা।
নূর কথা বলতে বলতে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে দেখলো। আদিত্য কোন কথাই বলছে না।শুধু ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। এটা দেখে নূর ফট করে আদিত্যের নাকের ডগায় আলতো করে একটা কামড় দিয়ে দিল। এই কাজটা প্রায়ই করে থাকে নূর। আদিত্য ঘোর কাটিয়ে উঠে নাকে হাত ঘষে বললো।
–বারবার নাকে কেন কামড়াও এঞ্জেল? বেচারা নাকটার কি দোষ?
নূর একগাল হেঁসে বললো।
–তো কি করবো? কখন থেকে শুধু আমি কথা যাচ্ছি। তুমি কিছু বলছই না। তাইতো এমন করলাম। আর তাছাড়া তোমার নাকটা না অনেক কিউট লাগে।একদম রসগোল্লার মতো। তাইতো শুধু কামড় দিতে ইচ্ছে করে হি হি,,
–তাই না? আমার নাক রসগোল্লা? আমার নাক কামড় দিতে অনেক মজা তাইনা? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।
কথাটা বলে আদিত্য নূরকে শুরশুরি দিতে লাগলো। আর নূর হেঁসে উঠে ছটফট করতে করতে বললো।
–হি হি আর করবোনা। ছেড়ে দাও,ছেড়ে দাও হি হি,,,
আদিত্য নূরকে ছেড়ে দিয়ে নূরের গালে হাত বুলিয়ে বললো।
–এঞ্জেল তুমি তোমার বার্থডে গিফট নিবেনা?
–গিফট তো দিয়েছ। এত্তো কিছু তো দিলে।
–উহুম,এগুলো না। তোমার আসল গিফট এখনো বাদ আছে।
নূর চোখ দুটো টানটান করে বললো।
–তাইই? কি গিফট? দেখাও না হিরো?
আদিত্য পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করলো। বক্স খুলে তার ভেতর থেকে অপূর্ব সুন্দর একটা ব্রেসলেট বের করলো। ব্রেসলেট টা প্লাটিনামের তৈরি, তার ওপর দিয়ে ডায়মন্ড স্টোন বসানো। ব্রেসলেটের নিচের অংশে আদিত্য আর নূরের নামের ফাস্ট অ্যালফাবেট এ আর এন ঝুলানো আছে। আদিত্য ব্রেসলেট টা নূরের হাতে দিয়ে বললো।
–এটা কখনো হাত থেকে খুলবে না। সবসময় পড়ে থাকবে বুঝেছ?
নূর ঘাড় কাত করে বললো।
–আচ্ছা। এটা অনেক সুন্দর। আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। তুমি সত্যিই অনেক গুলো ভালো হিরো।
কথাটা বলেই যথারীতি নূর আদিত্যের গালে একটা চুমু দিয়ে দিল। এতেই যেন আদিত্যের সব সাফল্য পূর্ণতা পেয়ে গেল।
ওরা আরও কিছুক্ষণ ছাঁদে থাকলো। নূর কথা বলতে বলতে একসময় আদিত্যের বুকে মাথা রেখে ওর কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো। আদিত্য মুচকি হেসে নূরের কপালে চুমু খেয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের রুমে গেল।
_____
তারপর আরও এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এই কয়দিনে নিলা যতটা পেরেছে আবিরের থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে। আবির যখনি এই বাসায় আসে, নিলা প্রায় সময়ই নিজের রুমেই দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো। আর কোন কারণে সামনে থাকলেও কোন কথা বলতো না। আবির কিছু বললেও চুপ করে থাকে।কোন প্রতিত্তোর দেয়না।
প্রথম প্রথম আবির ব্যাপার টা এতো খেয়াল না করলেও। আজকাল ও ভালোভাবেই বুঝতে পারছে যে, নিলা ওকে ইচ্ছেকৃতভাবে এভয়েড করছে। কিন্তু এমন করার কারণ টা বুঝতে পারছে না ও। মেয়েটার হঠাৎ কি হয়ে গেল? সবই তো ঠিক ছিল। তাহলে হঠাৎ করে এমন ইগনোর করছে কেন? মেয়েটার ইগনোর যে,আমাকে পোড়াচ্ছ সেটা কি সে বুঝতে পারছে না? মেয়েটা যে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এখন তাকে ছাড়া সবকিছু কেমন বিষাদ মনে হচ্ছে।
আয়াতের কাহিনিতেও কোন উন্নতি হয়নি। হাজার চেষ্টার পরেও বিহানের কোন পরিবর্তন হয়নি। সে এখনো আয়াতের প্রতি অনূভুতি শূন্য।
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারকে রাতের গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। ঘরির কাটা নয়টায় গিয়ে ঠেকেছে। তবুও এখনো আদিত্যের আসার কোন খবর নেই। নূর কখন থেকে আদিত্যের জন্য অপেক্ষা করছে। বারবার দরজার কাছে ছুটে যাচ্ছে,ওর হিরো এসেছে কিনা দেখার জন্য। প্রতি বারই নিরাশ হয়ে ফিরছে নূর। আদিত্য কখনো এতো দেরি করেনা। রোজ পাঁচটা বা ছয়টার দিকে চলে আসে। কিন্তু আজ এখনো আসছে না দেখে নূর অস্থির হয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না নূরের। সবকিছু অসহ্য লাগছে। কেমন যেন কান্না পাচ্ছে ওর। হিরো কোথায়? হিরো আসছে না কেন?
নূরের অস্থিরতা দেখে নিলা কয়েকবার আদিত্য আর বিহানের নাম্বারে ফোন দিল। কিন্তু কেওই ফোন ধরছে না। নিলারও এবার একটু চিন্তা হচ্ছে। এভাবে একসময় দশটা বেজে গেল।
নূর ধীরে ধীরে কান্না শুরু করে দিল। কাঁদছে আর বলছে।
–হিরো কোথায়? হিরো এনে দাও। হিরো চাই আমার।
নিলা নূরকে সামলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পেরে উঠছে না। ধীরে ধীরে সময় যত বাড়ছে নূরের কান্নার গতিও বাড়ছে। আর কান্নার সাথে নূন ধীরে ধীরে হাইপার হয়ে উঠছে। নিলার একার পক্ষে ওকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।ঘরির কাটা এবারে বারোটায় গিয়ে ঠেকলো। তবুও আদিত্যের আসার কোন খবর নেই এখনো।
নূর এতক্ষণে আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছে। প্রচুর পরিমাণে হাইপার হয়ে গেছে নূর। সমানে কেঁদে যাচ্ছে আর হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুড়ে মারছে। শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে।
–আমার হিরো এনে দাও। হিরো চাই আমার। হিরোওওওও,,,
কাঁদতে কাঁদতে গলার স্বর ভেঙে গেছে ওর। চেহারা পুরো লাল হয়ে গেছে। বেশিক্ষণ এভাবে চলতে থাকলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে নূর। নিলা প্রচুর ঘাবড়ে গেছে। কি করবে এখন বুঝতে পারছে না। ওদিকে আদিত্যেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আর এদিকে নূরের এই অবস্থা। সবমিলিয়ে নিলা এক অথই সাগরে পড়ে গেল। নিলা আর উপায় না পেয়ে এবার আবিরকে ফোন লাগালো। কিন্তু না আবিরের ফোনও লাগলো না। নিলা আরও হতাশ হয়ে গেল। কি করবে বুঝতে পারছে না।নিলা আর সার্ভেন্টরা মিলে কোনরকমে নূরকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
রাত একটার দিকে বাসার কলিং বেল বেজে উঠল। একটা সার্ভেন্ট দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। তখন আবির আর বিহান মিলে আদিত্যকে ধরে ধীরে ধীরে ভিতরে নিয়ে আসলো। আদিত্যের মাথায় ব্যান্ডেজ করা। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হালকা সিলে গেছে। আদিত্যের এই অবস্থা দেখে সার্ভেন্ট টা বলে উঠলো।
–স্যার কি হয়েছে আপনার?
আদিত্য ভাঙা স্বরে বলে উঠলো।
–তেমন কিছুনা।সামান্য একটা এক্সিডেন্ট হয়ে,,,,
বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিত্য নূরের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। আদিত্য চমকে গিয়ে সার্ভেন্টের দিকে তাকাচ্ছে বললো।
–নূর, কি হয়েছে নূরের?
সার্ভেন্ট টা মাথা নিচু করলো ভীতু স্বরে বলে উঠলো।
–স্যার ম্যাম প্রচুর হাইপার হয়ে গেছেন। আপনাকে না দেখতে পেয়ে উনি আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছেন। উনার অবস্থা অনেক বেগতিক হয়ে গেছে। উনাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না।
নূরের অবস্থার কথা শুনে আদিত্য মুহূর্তেই নিজের কথা ভুলে গেল। আবির আর বিহানকে ছাড়িয়ে, আঘাত পাওয়া শরীরেই দৌড়ে যেতে লাগলো ওর এঞ্জেলের কাছে। এখন আর ওর নিজের কোন হুঁশ নেই। নূর ঠিক আছে কিনা সেই চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে ও। আবির আর বিহান আদিত্যকে ডাকতে ডাকতে ওর পেছনে দৌড়ালো।
আদিত্য এলোমেলো পায়ে দৌড়ে ওর রুমে এসে দেখলো, নূরের অবস্থা খুবই খারাপ।নিলা আর সার্ভেন্টরা মিলে ওকে ধরে আছে। আরেকটু হলেই ও জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত ভাবে এখনো বলেই যাচ্ছে।
–হিরো এনে দাও। আমার হিরো চাই।
আদিত্যে শরীরের আঘাতও এতোটা কষ্ট পাইনি। যতটা এখন ওর নূরের এমন অবস্থা দেখে কষ্ট হচ্ছে। নূরকে এভাবে দেখে বুকটা কেঁপে উঠল ওর।
আদিত্য আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে ছুটে গেল নূরের কাছে। আদিত্যকে আসতে দেখে সবাই নূরকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল। আদিত্যর এমন অবস্থা দেখে নিলা অনেক চমকে গেল। তবে এমুহূর্তে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না ও।আপাতত নূরকে শান্ত করা দরকার। আর সেটা জিজুই করতে পারবে। তাই নিলা আর বাকিরা সবাই রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।
আদিত্য নূরের সামনে বসে দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো।
–এই নূর, মাই এঞ্জেল কি হয়েছে আমার কলিজাটার?এই দেখ আমি এসে গেছি। তোমার হিরো এসে গেছে। চোখ খোল সোনা।
আদিত্যের কন্ঠ শুনে ক্লান্ত চোখ দুটো খুলে তাকালো নূর। আদিত্যকে চোখের সামনে দেখে ভালো চোখ খুলে কতক্ষণ তাকিয়ে দেখলো নূর। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আদিত্যকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। আদিত্যর শরীরে একটু ব্যাথা পেলেও সেটা মালুম না করে, আদিত্য নিজেও তার প্রাণভোমরাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে নূরকে শান্ত করতে লাগলো। একটু পর নূর আদিত্যকে ছেড়ে দিয়ে আদিত্যর বুকে এলোমেলো ভাবে চাপড় মেরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগলো।
–কোথায় চলে গিয়েছিলে? কোথায় চলে গিয়েছিলে? কেন আসছিলে না তুমি?আমি কতো ডাকলাম তাও এলেনা তুমি? আমার কতো কষ্ট হচ্ছিল যানো? পঁচা একটা। আর কথা বলবো না তোমার সাথে। কাট্টি তোমার সাথে। কাট্টি কাট্টি কাট্টি,,
নূরের এভাবে মারায় আদিত্যর আঘাত পাওয়া জায়গায় ব্যাথা পেয়ে হালকা আওয়াজ করে উঠলো।
–আহহ,,
সাথে সাথে নূরের হাত থেমে গেল। নূর আদিত্যের দিকে এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। আদিত্যর মাথায় ব্যান্ডেজ, শরীরের নানান জায়গায়ও কেমন ছিলে গেছে। আদিত্যর এমন অবস্থা দেখে নূর এবার বিচলিত হয়ে পড়লো। দুই হাতে আদিত্যের মুখটা ধরে বলে উঠলো।
–এই হিরো, কি হয়েছে তোমার?এসব লাগিয়েছ কেন? তুমি ব্যাথা পেয়েছ বুঝি? কিভাবে ব্যাথা পেলে বলোনা? কেউ ব্যাথা দিয়েছে তোমাকে? আমাকে বলো,আমি তাকে ঢিসুম ঢিসুম করে মেরে দিব। আমার অনেক শক্তি আছে।
নূরের এমন বাচ্চামো কথা শুনে আদিত্য এমন একটা সিচুয়েশনেও হেঁসে দিল। তারপর নূরের গালে হাত রেখে বললো।
–থাক কাওকে আর মারতে হবে না। আর এটা তেমন কিছুই না। তুমি না আমাকে হিরো বলো।আর হিরোদের তো এমন একটু আধটু ব্যাথা পেতেই হয়।
নূর প্রতিবাদ করে বলে উঠলো।
–না হয় না। তুমি ব্যাথা পাবে না একদম। হিরো কোন ব্যাথা পাবে না। হিরো ব্যাথা পেলে নূরের একদম ভালো লাগে না। অনেক পঁচা লাগে। এত্তো গুলো কষ্ট হয়।
নূর নিজের বুকের বামপাশে আঙুল ঠেকিয়ে বললো।
–এইখানে অনেক ব্যাথা হয়। তাই তুমি কোন ব্যাথা পাবে না।
নূরের কথায় আদিত্য অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। নূরের কথার মর্ম নূর না বুঝলেও আদিত্য ঠিকই বুঝতে পারছে। আজ তার বউটার চোখে সে নিজের জন্য আকুলতা দেখতে পাচ্ছে। স্বামীর কষ্টে সে নিজেও ব্যাথিত হচ্ছে। এযে এক পরম পাওয়া আদিত্যের জন্য। সে তার নিষ্পাপ বউয়ের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে, আর কি লাগে তার। আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–ব্যাথা পেয়েছি তো কি হয়েছে? আমার এঞ্জেল টা তো যাদু জানে। সে তার যাদু দিয়ে আমার সব ব্যাথা দূর করে দিবে তাইনা?
–হ্যাঁ দিব তো যাদু করে।
কথাটা বলে নূর আদিত্যের মুখটা ধরে শুধু কপালে না,সারামুখে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল। আদিত্য তার বউয়ের স্নিগ্ধ পরশে কোনো এক সুখের মহাসমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। নিজের সব ব্যাথা মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নূর চুমু দেওয়া শেষে বলে উঠলো।
–দেখেছ অনেক গুলো যাদু করে দিয়েছি। আর কোন ব্যাথা থাকবে না।
আদিত্য প্রশান্তির হাসি দিয়ে নূরকে আবার বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল।
একটু পরে নিলা ট্রেতে করে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো। নিলাকে আসতে দেখে আদিত্য বলে উঠলো।
–তুমি একটু ওর কাছে থাক।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
নিলা মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। আদিত্য ওয়াশরুমে যেতেই নিলা খাবারের ট্রে টেবিলের ওপর রেখে নূরের সামনে এসে বসলো। নিলা নিচে বিহানের কাছ থেকে সব বিস্তারিত শুনেছে। আদিত্য আর বিহান বাসায় আসার সময় ওদের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়। ভাগ্যক্রমে কারোরই তেমন গুরুতর কিছু হয়নি। তবে আদিত্যের জ্ঞান ছিলোনা।তাই বিহান তাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল। আবিরকেও ফোন করে ডেকে নিয়েছিল। বাসায় কাওকে জানায়নি যাতে কেও চিন্তা না করে।
নিলা নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আপু শোন, ভাইয়া কিন্তু আজকে অনেক ব্যাথা পেয়েছে। তাই তুমি তাকে একদম জ্বালাবে না কেমন? নাহলে কিন্তু ভাইয়া আরও ব্যাথা পাবে।
নূর দ্রুত মাথা নেড়ে বললো।
–না না আমি হিরোকে একদম ব্যাথা পেতে দেবনা। আমি একদম গুড গার্ল হয়ে থাকবো।
নিলা মুচকি হেসে বললো।
–ঠিক আছে তাহলে আজকে আমি তোমাকে খাইয়ে দেয়। ভাইয়া তোমাকে খাওয়াতে গেলে তার কষ্ট হবে। তাই আজকে আমার কাছেই খাও।
নূর মুখটা মলিন করে বললো।
–আচ্ছা।
তারপর নিলা নূরকে খাইয়ে দিল। একটু পরে আদিত্য ওয়াশরুম থেকে বের হলে।নিলা নিজের রুমে চলে গেল।
আদিত্য নূরের সামনে এসে বসে বললো।
–তুমি নিশ্চয় না খেয়ে আছ।চলো আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
নূর বলে উঠলো।
–না না তার দরকার নেই। নিলা আমাকে মাত্রই খাইয়ে দিয়ে গেছে। তুমি ব্যাথা পেয়েছ তো,তাই আমি আজ নিলার কাছেই খেয়ে নিয়েছি। আমি তোমাকে একদম জ্বালাবো না।
আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–কে বলেছে তুমি আমাকে জ্বালাও? তোমাকে খাইয়ে দিতে আমার অনেক ভালো লাগে। তাই কখনো এ কথা বলবে না। আজ খেয়েছ ঠিক আছে। কিন্তু এরপর থেকে তোমাকে শুধু আমিই খাইয়ে দেব বুঝেছ?
নূর ঘাড় কাত করে বললো।
–আচ্ছা। তাহলে এখন তুমি খেয়ে নেও কেমন?
আদিত্য হালকা মাথা ঝাকিয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে খেতে শুরু করলো। কিন্তু হাতে একটু ছিলে যাওয়ায় ঠিকমতো খেতে পারছেনা আদিত্য। হাত নাড়ালে ব্যাথা পাচ্ছে। নূর আদিত্যের দিকেই তাকিয়ে ছিল। তাই বিষয় টা খেয়াল করলো। নূরের অনেক খারাপ লাগছে। নূর আদিত্যের কাছে এগিয়ে গিয়ে আদিত্যের হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে বলে উঠলো।
–আসো আমি তোমাকে খাইয়ে দেয়।তোমার তো কষ্ট হচ্ছে তাইনা?
আদিত্য অবাক নয়নে নূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। যে মেয়ে নিজেই হাতে খেতে পারেনা সে কিনা আমাকে খাইয়ে দিতে চাচ্ছে? নূরের এমন কেয়ার দেখে আদিত্যের চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। তবুও মুচকি হেসে বললো।
–থাক দরকার নেই আমি খেতে পারবো।তোমার কষ্ট করতে হবে না।
নূর বলে উঠলো।
–আমি বললাম না খাওয়াবো মানে আমিই খাওয়াবো। তুমি না খুব দুষ্টু হয়ে গেছ, আমার কথা একটুও শোন না। এখন চুপচাপ মুখ খোল।
নূরের এমন শাসন দেখে আদিত্য নিঃশব্দে হাসলো। তারপর নূরের কথামতো হা করলো।নূর এক লোকমা ভাত নিয়ে আদিত্যের মুখে দিতে গেলে অর্ধেক ভাত নিচেই পরে যায়। কিছু অংশ আদিত্যের মুখে দিতে সক্ষম হয় নূর। এতেও যেন পরম সুখ আদিত্যের। আজ তার এঞ্জেল টা সত্যিকারের বউয়ের মতো তার কেয়ার করার চেষ্টা করছে। আর কি চাই আদিত্যের। নূর ঠিকমতো পারছে না দেখে আদিত্য নূরের হাতের ওপর হাত রেখে নূরের হাত ধরে খাবার নিজের মুখে আনতে সাহায্য করলো। আজকের মতো তৃপ্তি যেন আদিত্যের কখনোই হয়নি। আদিত্যের মা মারা যাওয়ার পর আর কেউ কখনো আদিত্যকে খাইয়ে দেয়নি। তবে আজ তার এঞ্জেল এই সুখটাও এনে দিল।
খাওয়া দাওয়া শেষে একটু পরে আদিত্য নূর শুয়ে পড়লো। আদিত্য চিত হয়ে শুয়ে আছে। আর নূর নিজের বালিশে কাত হয়ে আদিত্যের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। মুখটা কেমন ছোট করে আদিত্যের দিকে একবার তাকাচ্ছে আবার চোখ নামিয়ে ফেলছে। নিলা বলেছে আদিত্য ব্যাথা পেয়েছে। তাইতো সে আজ আদিত্যের বুকে শুচ্ছে না। যদি হিরো ব্যাথা পায় এটা ভেবে। তবে আদিত্যের বুকে না শুতে পেরে নূরের কেমন যেন ভালোও লাগছে না। আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি হলো এঞ্জেল, আজকে আমার বুকে ঘুমাবে না?
নূর মুখটা ছোট করে বললো।
–না, তুমি তো ব্যাথা পেয়েছ। আমি তোমার বুকে শুলে তোমার কষ্ট হবে।
–কে বলেছে তোমাকে?বরং তুমি আমার বুকে ঘুমালে, আমার ব্যাথা আরও তাড়াতাড়ি সেরে যাবে জানো? কারণ তুমি যে আমার যাদুকর।
আদিত্য নূরের দিকে হাত মেলে দিয়ে বললো।
–এসো আমার কাছে।
নূর এতক্ষণ ইতস্তত করলেও আদিত্যের কথায় হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে আদিত্যের বুকে আস্তে করে শুয়ে পড়লো। আদিত্য শরীরে হালকা ব্যাথা পেলেও তার মনের প্রশান্তির কাছে এই ব্যাথা কিছুই না। এঞ্জেল টাকে বুকে না নিলে যে তার নিজেরও ঘুম আসবেনা। আদিত্য দুই হাতে নূরকে জড়িয়ে ধরে প্রশান্তিতে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল।
চলবে……