#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-৬
★আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে এলো। নূর আদিত্যের কোলে থেকেই রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। এই বাসার সবকিছু ওর কাছে বিস্ময়কর লাগছে। এতো বড়ো কারও রুম হতে পারে তা জানা ছিলনা ওর।
আদিত্য নূরকে এনে আস্তে করে বেডের ওপরে বসিয়ে দিল। এই বেডটাতো সোফার চেয়েও নরম। নূরের মনে হচ্ছে ও কোন স্পঞ্জ কেকের মাঝে ডুবে যাচ্ছে। নূর দুই হাত দুইপাশে বেডের ওপর রেখে হাতে ভর দিয়ে বসা অবস্থায় হালকা ওঠানামা করতে লাগলো, আর হাসতে লাগল।
আদিত্য শুধু মুগ্ধ নয়নে ওর নিষ্পাপ বউটাকে দেখছে। এই পরিটা এখন ওর বউ।এখন থেকে সবসময় ওর কাছে থাকবে।সবসময় এই হাসিমুখ টা দেখতে পাবে। ভাবতেই নিজেকে কেমন সুখি সুখি মনে হচ্ছে। আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এটা এখন থেকে তোমার ঘর। তুমি এখন থেকে এখানেই থাকবে। পছন্দ হয়েছে তোমার?
নূর কিছু না বলে শুধু ড্যাবড্যাব করে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে আছে।
আদিত্য আবার বললো।
–কি হলো কথা বলছ না কেন?
নূর এবার বলে উঠলো।
–আরে আম্মু বলেছে, তোমার সবকথা যেন আমি ভালোওওও করে শুনি। তাইতো আমি ভালো করে শুনছিলাম তোমার কথা।
নূরের এমন বেকুবের মতো কথা শুনে, আদিত্য নিজের মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে একটু হেঁসে নিল। তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আচ্ছা শোনা হয়ে গেছে? এখন তাহলে উত্তর দাও। রুম পছন্দ হয়েছে?
নূর দুই দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে পরিমাপ দেখিয়ে বললো।
–হ্যাঁ,, এত্তগুলা পছন্দ হয়েছে।
–আচ্ছা, তোমার নিশ্চয় শাড়ী গহনা পরে অনেক আনইজি লাগছে তাইনা। তুমি এককাজ করো, এগুলো খুলে হালকা কিছু পরে নেও। আমি তোমার জামা কাপড় বের করে দিচ্ছি কেমন?
–আচ্ছা।
আদিত্য আগে নূরের গহনা গুলো আস্তে করে খুলে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নূরের বাসা থেকে দেওয়া ব্যাগ থেকে নূরের জামাকাপড় বের করতে লাগলো। তারাহুরো করে বিয়ে করায় নূরের জন্য ভালো করে শপিং করতে পারেনি।তাই আপাতত বাসা থেকে আনা জামাকাপড়ই পড়তে দিচ্ছে। পরে শপিং মলে গিয়ে নূরের জন্য সবকিছু কিনে নিয়ে আসবে। আদিত্য জামাকাপড় নিয়ে পেছনে ফিরতেই ওর চোখ কপালে উঠে গেল।
নূর বেড থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ঘরেই কাপড় খোলা শুরু করে দিয়েছে। আঁচল অনেকক্ষানি নামিয়ে ফেলেছে। কাঁধের কাছে সেফটিপিন লাগানো জায়গায় আঁচল ধরে টানাটানি করছে। আদিত্য জামাকাপড় বেডের ওপর রেখে তড়িঘড়ি করে নূরের কাছে যেয়ে ওকে আটকে দিয়ে বললো।
–আরে আরে কি করছ তুমি?
–কেন,তুমিই তো বললে শাড়ি খুলতে। তাইতো শাড়ি খুলছিলাম।
–আরে আমি তোমাকে এখানে রুমেই খুলতে বলিনি।
–তো কোথায় খুলব? বাইরে যেয়ে? আচ্ছা বাইরে যেয়ে খুলছি।
কথাটা বলেই নূর দরজার দিকে যেতে লাগলো।
আদিত্যর এবার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। কি বলে এই মেয়ে? বাইরে গিয়ে শাড়ি খুলবে?আদিত্য আবারও নূরকে আটকে দিয়ে বললো।
–আরে বাবা আমি তোমাকে বাইরে যাওয়ার কথা বলিনি।
–তাহলে?
–আমি বলতে চাইছিলাম যে,তুমি ওয়াশরুমে যেয়ে কাপড় চেঞ্জ করো। এইযে এখানে ওয়াশরুম।
আদিত্য নূরের হাত ধরে ওয়াশরুমের দরজার সামনে এনে দেখিয়ে দিল।
নূর মাথা ঝাকিয়ে ওয়াশরুমের ভেতরে গেল। তবে ওয়াশরুমের দরজা আটকালোনা। অগত্যা আদিত্য নিজেই দরজাটা একটু চাপিয়ে দিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। ক্ষানিক পরে নূর দরোজা আবার খুলে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো।
–আমি খুলতে পারছিনা। আম্মু এত্তগুলা পিন লাগিয়ে দিয়েছে। তুমি খুলে দাওনা হিরো।
আদিত্য একটা শুকনো ঢোক গিলে করুন কন্ঠে বললো।
–আমি?
–হ্যাঁ তুমি। আসোনা খুলে দাও।
আদিত্য পরে গেল এক মহামুশকিলে। নিজের বউ হলেও, নূর অনেক অবুঝ। আর এই অবস্থায় নূরকে চেঞ্জ করাতে গেলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে। আদিত্য কিছু একটা ভেবে বললো।
–তুমি একটুখানি দাঁড়াও। আমি এখুনি আসছি।
কথাটা বলেই আদিত্য বেড়িয়ে গেল।
একটু পরে একজন বয়স্ক মহিলাকে সাথে নিয়ে রুমে এলো আদিত্য। মহিলাটি অনেক বছর ধরে আদিত্যের বাসায় কাজ করছে। আদিত্যর অনেক বিশ্বস্ত। আদিত্য নূরের কাছে এসে বললো।
–উনি মিনু আন্টি। উনি তোমার সাহায্য করবে ঠিক আছে?
–আচ্ছা।
মিনু আন্টি ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তারপর নূরকে চেঞ্জ করিয়ে দিল। একটু পরে মিনু আন্টি দরজা খুলে বেড়িয়ে এসে আদিত্যকে বললো।
–আদি বাবা হয়ে গেছে। আমি বউমনির কাপড় পাল্টে দিয়েছি। আমি এখন আসি।
–আচ্ছা ঠিক আছে। আর হ্যাঁ আমাদের খাবার রুমে পাঠিয়ে দিয়েন।
মিনু আন্টি ঠিক আছে বলে চলে গেলেন।
একটু পরে নূর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো।পরনে একটা ঢিলা টিশার্ট আর স্কাট পরা। হাত মুখ ধোঁয়ার কারণে সামনের চুলগুলো ভিজে কপালে লেপ্টে আছে। এই অতিসামান্য রুপটাও যেন আদিত্যের কাছে অলৌকিক লাগছে। আদিত্য মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। তার বউটা সত্যিই একটা এঞ্জেল। আদিত্যের এঞ্জেল। আদিত্য একটা তোয়ালে হাতে নিয়ে নূরের কাছে গিয়ে নূরের মুখটা আলতো করে মুছে দিল। তারপর নূরের হাত ধরে এনে বেডের বসিয়ে দিয়ে বললো।
–তুমি এখানে একটু বসো।আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি কেমন?
নূর ঠোঁট উল্টিয়ে বললো।
–কিন্তু আমরতো একা একা ভয় লাগে।
আদিত্য টিভি চালু করে দিয়ে বললো।
–তুমি ততক্ষণ টিভি দেখ। নাহলে আমার মোবাইল দেখ। ভয় নেই আমি এক্ষুনি চলে আসবো।
–আচ্ছা।
আদিত্য নিজের মোবাইলে ইউ টিউব চালু করে দিয়ে নূরের হাতে দিল। তারপর তাড়াতাড়ি কাবার্ড থেকে টিশার্ট আর টাওজার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। অন্য সময় হলে আদিত্যের ফ্রেশ হতে আধাঘন্টা একঘন্টা লেগে যায়। তবে আজ আদিত্য পাঁচ মিনিটের ভেতর তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে গেল। যেন ওয়াশরুমে আগুন লেগে গেছে এমন ভাবে তারাহুরো করে বের হলো। নূরকে রুমে একা একা রেখে ওর চিন্তা হচ্ছিল। তাই এতো তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে বের হলো আদিত্য। বের হয়ে দেখলো নূর অনেক প্রফুল্লচিত্তে মোবাইল দেখছে। আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
তখনি রুমের দরজায় কেও নক করলো। আদিত্য দরজা খুলে দেখলো সার্ভেন্ট খাবার নিয়ে এসেছে। আদিত্য খাবারের ট্রেটা হাতে নিয়ে নূরের সামনে এসে বসলো। নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–নাও মোবাইল রেখে এখন খেয়ে নেও।
নূর ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো।
–না আমি খাবোনা। আমার ক্ষিদে নেই। আমি মোবাইল দেখছি।
–আরে তাই বললে হবে নাকি? খাবার না খেলে অসুস্থ হয়ে পরবে তো?
–বললাম না আমি খাবোনা? আমার ক্ষিদে নেই তো।
–আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি মোবাইল দেখ। আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
–না আমি খাবো না।
–তাহলে কিন্তু আমি মোবাইল নিয়ে নেব?
–না না মোবাইল নিও না।
–তাহলে হা করে লক্ষি মেয়ের মতো খাবার মুখে নাও।
নূর মোবাইল হারানোর ভয়ে অগত্যা হা করে আদিত্যের হাতের খাবার মুখে নিল। মোবাইল দেখতে দেখতে পুরো খাবার শেষ করলো।নূরকে খাবার খাইয়ে আদিত্যর মনে হলো ও কোন যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে। নূরকে খাওয়ানোর পর আদিত্য নিজেও খেয়ে নিল। তারপর প্লেট গুছিয়ে সার্ভেন্ট কে ডেকে তার কাছে দিয়ে দিল।
রাত প্রায় এগোরটা বেজে গেছে। আদিত্য নূরের হাত থেকে মোবাইল টা নিয়ে বললো।
–অনেক রাত হয়ে গেছে তুমি এখন ঘুমিয়ে পরো।নাহলে শরীর খারাপ করবে।
নূর বলে উঠলো।
–কিন্তু আম্মু তো নেই। আমার আম্মু লাগবে। আম্মু এনে দাও।
আদিত্য নূরের গালে আলতো করে হাত রেখে চিন্তিত সুরে বললো।
–কেন কি হয়েছে আমাকে বলো?
–আম্মু ছাড়া আমি ঘুমাবো কিভাবে? আম্মুই তো আমাকে ঘুম পারিয়ে দেয়। নাহলে আমার ঘুম আসে না।
আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–আম্মু নেই তো কি হয়েছে? আমি আছি না? এখন থেকে তোমার যা লাগবে আমাকে বলবে।আমি তোমার সবকিছু করে দেব। এখন এসো আমি তোমাকে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছি।
আদিত্য নূরকে আস্তে করে বালিশে শুইয়ে দিয়ে, নূরের পাশে কাত হয়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। দশ মিনিট পার হয়ে গেলেও নূরের চোখে ঘুম নেই। নূর চোখ পিটপিট করে আদিত্যের দিকে তাকাচ্ছে। আদিত্য সেটা দেখে বললো।
–কি হলো ঘুমাচ্ছোনা কেন?
–ঘুম আসছে নাতো। তুমি একটু গান গাও না? আমার ঘুম না আসলে আম্মু আমাকে গান গাইয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। তুমিও গান গাওনা,তাহলে ঘুম আসবে।
আদিত্য একটু অবাক হয়ে বললো।
–গান?
–হ্যাঁ গান। তুমি গান পারো না?
আদিত্য একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। আদিত্য ছোটবেলায় গান গাইতো।কিন্তু ওর বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে আর কখনো গান গাইনি। কিন্তু নূরের জন্য এখন গান না গেয়েও উপায় নেই। তাই আদিত্য জোরপূর্বক হেসে বললো।
–তুমি চোখ বন্ধ করো।আমি গান গাইছি।
নূর বাদ্ধ মেয়ের মতো একফালি হাসি দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। আদিত্য নূরের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নূরের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে,নূরের সাথে দেখা হওয়ার মূহুর্ত থেকে ওর সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো মনে করে মুচকি হেসে গেয়ে উঠলো।
♬ ♬ জিসে জিন্দেগী ঢুন্ড রাহি হে
♬ ♬ কেয়া ইয়ে মাকাম মেরা হে
♬ ♬ ইহা চ্যান ছে বাস রুক যাউ
♬ ♬ কিউ দিল এ মুঝে কেহতা হে
♬ ♬ জাজবাত নায়ে সে মিলে হে
♬ ♬ জানে কেয়া আছার ইয়ে হুয়া হে
♬ ♬ ইক আস মিলি ফির মুঝকো
♬ ♬ জো কুবুল কিসি নে কিয়া হে
♬ ♬ হা… কিসি শায়ার কি গাজাল
♬ ♬ জো দে রুহ কো সুকু কে পাল
♬ ♬ কোই মুঝকো ইউ মিলা হে
♬ ♬ জেইসে বানজারে কো ঘার
♬ ♬ নায়ে মাওসাম কি সেহের
♬ ♬ ইয়া সারদ মে দোপেহের
♬ ♬ কোই মুঝকো ইউ মিলা হে
♬ ♬ জেইসে বানজারে কো ঘার
♬ ♬ হুম…জেয়সে কোই কিনারা
♬ ♬ দেতাহো সাহারা
♬ ♬ মুঝে ও মিলা কিসি মোর পার
♬ ♬ কোই রাত কা তারা
♬ ♬ কারতা হো উজালা
♬ ♬ ওয়াইসে হি রোসান কারে ও সেহের
♬ ♬ দারদ মুঝে ও ভুলা হি গায়া
♬ ♬ কুছ এইসা আসার হুয়া
♬ ♬ জিনা মুঝে ফির সে ও শিখা গায়া
♬ ♬ হা..জেইসে বারিশ কারদে তার
♬ ♬ ইয়া মারহাম দারদ পার
♬ ♬ কোই মুঝকো ইউ মিলা হে
♬ ♬ জেইসে বানজারে কো ঘার
♬ ♬ নায়ে মাওসাম কি সেহের
♬ ♬ ইয়া সারদ মে দোপেহের
♬ ♬ কোই মুঝকো ইউ মিলা হে
♬ ♬ জেইসে বানজারে কো ঘার
♬ ♬ জেইসে বানজারে কো ঘার
(সংক্ষিপ্ত)
গান শুনতে শুনতে নূর ঘুমিয়ে গেছে। আদিত্য মুচকি হেসে নূরের কপালে একটা চুমু দিয়ে দিল। তারপর নিজেও নূরের পাশে শুয়ে পড়লো। নূরের দিকে কাত হয়ে শুয়ে নূরকে দেখতে দেখতে একসময় ঘুমে তলিয়ে গেল।
__________
জানালার সচ্ছ কাচ ভেদ করে পর্দার ফাঁক দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ এসে ঘড় আলোকিত হয় গেল। ঘড়ির কাটায় সাতটা বাজতেই রোজকার নিয়ম মাফিক আদিত্যের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের লেশ ছাড়িয়ে চোখ খুলতেই বুকের ওপর ভারি কিছু অনুভব করলো আদিত্য। আদিত্য এবার পুরোপুরি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো নূর ওর বুকের ওপর মাথা রেখে,এক হাত পা ওর শরীরের ওপর তুলে দিয়ে, ওকে কোলবালিশের মতো পেচিয়ে ধরে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।
আদিত্যের সারা শরীর জুড়ে যেন এক ঠান্ডা প্রশান্তির বাতাস বইয়ে গেল। মনে হচ্ছে হাজার বছরের খা খা মরুর বুকে শ্রাবণের ঘন বর্ষণ হচ্ছে। সেই বর্ষণে আদিত্যের সব কষ্ট গ্লানি ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। আজকের সকাল টা যে এতো মধুর হবে তা কখনো ভাবতেই পারেনি আদিত্য। নিজেকে অনেক সুখী সুখী লাগছে। এই খুশিটারই অপেক্ষায়ই তো ছিল আদিত্য। যা ও আজ পেয়ে গেছে।
আদিত্য একটা প্রাপ্তির হাসি দিয়ে দুই হাতে নূরকে নিজের সাথে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিল।
কিছুক্ষণ পরে নূরকে আস্তে করে বালিশে শুইয়ে দিল। তারপর নূরের ওপর ঝুঁকে আলতো করে গালে হাত বোলাতে লাগলো। হাত বোলাতে বোলাতে আবগী কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো।
–আমার অন্ধকার জীবনে নূরের আলো হয়ে এসেছিস তুই। আমার একাকিত্ব জীবন টাকে রংধনুর সাত রঙে রাঙাতে সুখপাখি হয়ে এসেছিস তুই। তুই আমার জীবনের এঞ্জেল। হ্যাঁ আমার এঞ্জেল।
আদিত্য নূরের কপালের সাথে নিজের কপাল আলতো করে ঠেকিয়ে লো ভয়েসে বললো।
— অনেক ভালোবাসি তোকে এঞ্জেল। কখনো হারাতে দেবনা তোকে। অনেক যত্নে এই বুকের খাচায় আগলে রাখবো তোকে। তোর ওপর কোন খারাপ ছায়াও পড়তে দেবনা আমি। তুই শুধু তোর এই মিষ্টি মুখের হাসিটা দিয়ে এভাবেই আমার ওপর সুখের বর্ষণ করিস। আরকিছুই চাই না আমার।
কথাগুলো বলে আদিত্য নূরের কপালে সময় নিয়ে একটা চুমু খেল। তারপর নূরের গায়ের ওপর ভালো করে চাদর জড়িয়ে দিয়ে উঠে গেল। আদিত্যে রোজকার অভ্যাস অনুযায়ী জগিং ট্রাকার পরে জগিং করতে গেল।
ঘন্টা খানিক পর আদিত্য জগিং থেকে ফিরে এসে দেখলো নূর এখনো ঘুমাচ্ছে। আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কাবার্ড থেকে কাপড় বেড় করে শাওয়ার নিতে গেল। বিশ মিনিট পরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো আদিত্য। নূর এখনো ঘুমে কাদা। আদিত্য মনে মনে বললো,বউটা তো আমার দেখছি একদম ঘুম পাগলি। কিন্তু এখনতো উঠাতে হবে। এভাবে না খেয়ে ঘুম পারলে তো শরীর খারাপ করবে। কথাটা ভেবে আদিত্য নূরের কাছে এসে বেডের ওপর বসলো। নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম সুরে ডাকতে লাগলো।
–নূর,এই নূর। গেট আপ মাই এঞ্জেল। অনেক বেলা হয়ে গেল তো।
আদিত্যের ডাকে নূরের চেহারায় বিরক্তির ছাপ দেখা গেল। নূর নড়েচড়ে আবার উল্টোদিকে কাত হয়ে ঘুমের ভেতরই বলে উঠলো।
–উমম…আম্মুউউউ আরেকটু ঘুমাতে দাওনা। আমার ঘুম শেষ হয়নি।
নূরের ঘুমো ঘুমো কন্ঠ শুনে আদিত্য হালকা হাসলো। আরো অনেক বার নূরকে ডাকলো।কিন্তু নূরের ওঠার কোন নাম নেই। আদিত্য এবার নূরকে উঠানোর জন্য একটা ট্রিকস করলো। আদিত্য একটু উচ্চ স্বরে বলে উঠলো।
— আরে, নূরের বেবিটা কই গেল? বেবিটা কি তাহলে আবার হারিয়ে গেল? আহারে বেবিটা,,
নূর হকচকিয়ে একলাফে উঠে বসে বলতে লাগলো।
–বেবি, বেবি কোথায়? আমার বেবি,,,,
নূর একবার আদিত্যের দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে, আবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। তারপর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–এই তুমি কে? আর এটা কোন জায়গা? আম্মু কোথায়?
আদিত্য যেন তব্দা খেয়ে গেল। কি বলে এই মেয়ে? বিয়ের প্রথম দিনই স্বামীকে ভুলে গেল? আদিত্য নূরের গালে হাত রেখে বললো।
–নূর আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার হিরো। কাল তোমাকে এখানে নিয়ে আসছি মনে নেই?
নূর কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো।
–আরে হ্যাঁ মনে পরেছে। আমি কাল এসেছি তোমার সাথে। আমিতো এখন এখানকার রানী তাইনা?
আদিত্য ফোত করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।বেচারার দমটা গলায় আটকে গিয়েছিল নূরের কথায়। তবে এখন বুঝতে পারছে নূর ঘুম থেকে আচমকা ওঠায় ওর মস্তিষ্ক হয়তো ব্লাঙ্ক হয়ে গিয়েছিল। তাই এমন রিয়াক্ট করেছে। আদিত্য এবার মুচকি হেসে বললো।
–তো রাণী সাহেবা, শুধু ঘুমিয়ে থাকলেই হবে? ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করতে হবে না? এখন গুড গার্লের মতো ফটাফট উঠে পরো।
কথাগুলো বলে আদিত্য নূরের হাত ধরে উঠে দাড় করালো।তারপর নূরের হাত ধরেই ওয়াশরুমে নিয়ে গেল।
আদিত্য নিজেই নূরের ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে বাচ্চাদের মতো নূরকে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে,নূরের মুখ ধুইয়ে দিল। ফ্রেশ হওয়ার পর আদিত্য নূরকে রুমে নিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসিয়ে দিল। টাওয়াল নিয়ে নূরের হাত মুখ মুছে দিল। তারপর চিরুনি হাতে নিয়ে নূরের চুল আচরানোর চেষ্টা করছে। আদিত্য আগে কখনো এসব করেনি। তাই চুল আচরাতে গিয়ে নূরের চুলে টান লেগে হালকা ব্যাথা পেল। নূর একটু আওয়াজ করে বললো।
–আহহ,, লাগছে তো,,
আদিত্য তড়িঘড়ি করে বললো।
–সরি সরি সরি এঞ্জেল, বেশি লাগেনি তো। আসলে আমি আগে কখনো করিনি তো।তবে চিন্তা করোনা জলদিই সবকিছু শিখে যাবো।
নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কিন্তু এই এঞ্জেল টা কে?
আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–তুমি এঞ্জেল। আমার এঞ্জেল।
–কিন্তু আমি তো রাণী তাইনা?
–হুম সবার জন্য রাণী। তবে আমার জন্য তুমি আমার এঞ্জেল বুঝেছ?
নূর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–হুমম,, এত্তগুলা নাম আমি কিভাবে মনে রাখবো?
আদিত্য একটু হাসলো। তারপর মোবাইলে ইউ টিউব দেখে সাবধানে নূরের চুল বেঁধে দিল। তারপর নূরের হাত ধরে নিচে ডাইনিং টেবিলের কাছে এলো ব্রেকফাস্ট করতে। নূর বলে উঠলো।
–আমাকে বেবি কোথায়?
আদিত্য একটা সার্ভেন্ট কে দিয়ে নূরের বিড়াল ছানাটা এনে দিতে বললো। সার্ভেন্ট টা মাথা ঝাকিয়ে একটু পরে নূরের বিড়াল ছানাটা নিয়ে এলো। নূর হাসি মুখে বিড়াল ছানাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। হঠাৎ আদিত্যর ফোন আসায় আদিত্য ফোনে কথা বলতে ব্যাস্ত হয়ে গেল। অফিসের কিছু ইম্পর্ট্যান্ট বিষয়ে কল এসেছে।
নূরের বিড়াল ছানাটা হঠাৎ নূরের কোল থেকে নেমে বাইরের দিকে চলে গেল। নূরও ছানাকে ধরার জন্য ওর পিছনে পিছনে গেল। বাইরে এসে কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ির পর নূর ছানাটাকে ধরতে সক্ষম হলো। নূর ছানাটাকে কোলে নিয়ে সামনে তাকালো। এতক্ষণে ও চারপাশ টা ভালো করে খেয়াল করছে। বাসার সামনে বিশাল একটা লন। চারিদিকে নানারকমের সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা। আর মাঝখানে বড়ো একটা সুইমিং পুল। নূর বিস্ময় নিয়ে সবকিছু দেখছে। মনে মনে বললো,আমার প্রাসাদ টা কত্তো সুন্দর। নূর দেখলো চারিদিকে কালো কাপড় পোড়ে কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে অনেক গুলো লোক দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে নূর অনেক ভয় পেয়ে গেল। নূর বিড়াল ছানাটাকে কোলে নিয়ে একছুটে বাসার ভেতর চলে এলো।
ভেতরে ঢুকে আদিত্যের কাছে দৌড়ে এসে আদিত্যের হাতের বাহু চেপে ধরলো। আদিত্য ফোন রেখে নূরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি হলো এঞ্জেল? কোন সমস্যা?
নূর আদিত্যের হাতটা একটু টান দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো।
–হিরো, আমাদের প্রাসাদে না ডাকাত ঢুকেছে। আমরা তাড়াতাড়ি পালাই চলো। নাহলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।
আদিত্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো।
–ডাকাত?
–হ্যাঁ ডাকাত। আমি এইমাত্র বাইরে দেখে আসলাম। অনেক গুলো কালো কাপড় পোড়া ডাকাত, ঢিসকাও ঢিসকাও নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
–ঢিসকাও ঢিসকাও?
আদিত্য একটু ভেবে হঠাৎ বিষয় টা বুঝতে পেরে হেঁসে উঠলো ।
আদিত্যকে এভাবে হাসতে দেখে মিনু আন্টি সহ বাসার সব সার্ভেন্ট রা বিস্ফোরক চোখে তাকিয়ে রইলো। ওদের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে। আদিত্যকে এর আগে কখনো এভাবে হাসা তো দূরের কথা, কখনো মুচকি হাসতেও দেখেনি। মিনু আন্টি মনে মনে অনেক খুশী হলেন। আদিত্যকে সে অনেক বছর ধরে দেখে আসছে। কিন্তু আজকের মতো খুশী তাকে কখনো দেখেনি।
নূর অবাক হয়ে বললো।
–তুমি হাসছো কেন?
আদিত্য হাসি থামিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আরে ওরা ডাকাত না।
–তাহলে?
–ওরা হলো গার্ডস। মানে পাহারাদার। যেমন প্রাসাদে রক্ষিরা থাকে। তেমনি ওদেরও আমাদের বাসার আর বাসার লোকজনের সুরক্ষার জন্য রাখা হয়েছে বুজেছ?
–ওওওও,, কিন্তু ওরা কালো কাপড় কেন পড়েছে? আমার কালো কাপড় পছন্দ না। ওদের অন্য রঙের কাপড় পড়তে বলবে।
–হুম, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমিই বলো ওরা কি পড়বে? তুমিতো এখন এই রাজ্যের মহারাণী তাইনা?
—আচ্ছা ঠিক আছে।
নূর কিছুক্ষণ ভেবে বললো।
—হ্যাঁ পেয়ে গেছি। ওদের হলুদ আর লাল রঙের কাপড় পড়তে বলবে। অনেক ভালো লাগবে দেখতে।
আদিত্য মনে মনে হলুদ আর লাল রঙের কাপড়ে গার্ডসদের ইমাজিন করতই ওর হাসি আটকাতে পারছে না। বেচারা গার্ডসদের পুরো জোকার রুপ দিয়ে দিয়েছে নূর। আদিত্য বলে উঠলো।
–আচ্ছা সেসব পরে দেখা যাবে। এখন এসো আগে ব্রেকফাস্ট করে নাও।
কথাটা বলে আদিত্য নূরকে চেয়ারে বসালো।
নূরের প্লেটে সিদ্ধ ডিম দিতেই নূর লাফিয়ে উঠে বললো।
–আরে আরে ডিম দিচ্ছ কেন?
–কেন মানে,খাওয়ার জন্য দিচ্ছি। চলো ফটাফট ডিমটা খেয়ে নেও।
–আরে তুমি এতো নির্দয় কেন হিরো?
–মানে?
–এইযে ডিমটা, এই ডিম একটা মুরগী কত কষ্ট করে পেরেছে। আর তুমি তার ডিমটা এভাবে বিনা অনুমতিতে নিয়ে এসে সিদ্ধ করে মেরে ফেললে? এখন ওই মুরগীটা নিশ্চয় বসে বসে কাঁদছে তার ডিমটার জন্য। আহারে বেচারি মুরগী।
আদিত্য যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। একটা ডিম নিয়ে কতো ইতিহাস করে ফেললো এই মেয়েটা। এখন কি ওর মুরগির কাছে গিয়ে অনুমতি নিতে হবে? নূর যে না খাওয়ার জন্য এসব তাল বাহানা করছে তা ভালোই বুঝতে পারছে আদিত্য। এই মেয়েটাকে খাওয়াতে গিয়ে যে ওর কতো প্যারা পোহাতে হবে সেটাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আদিত্য।
চলবে…….