#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৪৩
★আরও একটা মধুর সকালের আগমন ঘটলো আদিত্য আর নূরের জীবনে। আদিত্য চোখ খুলে রোজকার মতো তার এঞ্জেল কে তার খোলা বুকে পেল। প্রতিদিন সকালের এই মুহূর্তটা আদিত্যের কাছে অনেক স্পেশাল। চোখ খুলে যখন তার বউকে এভাবে তার বুক জমিনে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে, তখন রাজ্যের প্রশান্তি এসে আদিত্যের মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়।নিজেকে তখন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখি ব্যাক্তি মনে হয়। দুনিয়ার অন্য কোন কিছুতেই বোধহয় এতটা প্রশান্তি পায়না আদিত্য।
আদিত্য আস্তে করে নূরকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে গালে হাত বোলাতে লাগলো। আবার কপালে চুমু খাচ্ছে। নূরের ঘুমের ডিস্টার্ব হওয়ায়, নূর ঘুমের ভেতরেই একটু নড়েচড়ে উঠে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো।
–উমমম ঘুমুতে দাওনা,,,
নূরের এই ঘুমু ঘুমু কন্ঠটা আদিত্যের কাছে অনেক কিউট লাগে। আদিত্য নূরকে একটু জ্বালানোর জন্য আরও বেশি করে নূরের মুখে গলায় চুমু খেতে লাগলো। নূর বিরক্ত হয়ে এবার গায়ের চাদরটা দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে ফেললো। আদিত্যও দুষ্টুমি করে চাদরের ভেতর ঢুকে নূরকে জ্বালাতে লাগলো। নূরকে কাতুকুতু দিতেই নূর খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। অগত্যা নূরের ঘুমও ভেঙে গেল। আদিত্য নূরের গালে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো।
–এখনতো উঠতে হবে এঞ্জেল। অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমাদের রিসোর্টে ফিরতে হবে।সবাই অপেক্ষা করছে হয়তো।
নূর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু এখানে শাওয়ার নিবো কোথায়?
–এখন শুধু চেঞ্জ করে নাও। রিসোর্টে গিয়ে শাওয়ার নিও।
–ঠিক আছে।
দুজনেই চেঞ্জ করে একটু পরে রিসোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
রিসোর্টের ভেতর আসতেই দেখলো। বাকি সবাই রিসিপশন এরিয়ায় সোফায় বসে আছে। আদিত্য নূরকে নিয়ে ওদের কাছে এসে বললো।
–কিরে তোরা এখানে বসে আছিস কেন?
আবির তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–আইছেন আপনেরা? রঙ্গলীলা শেষ হইছে আপনাদের? আরে ভাই রঙ্গলিলা করবে ঠিক আছে, আমাদের বলেতো যাবে? নিজেরা রঙ্গলিলা করে বেড়াবে আর এদিকে চিন্তায় আমাদের ঘুম কামাই।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–এখানে চিন্তার কি আছে?
বিহান বলে উঠলো।
–আরে ওর কথা বাদ দেতো। বোচারা অনাহারে থাকতে থাকতে মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে গেছে। তাই আবোল তাবোল বকছে।
আদিত্য হেঁসে দিয়ে বললো।
–আচ্ছা তোরা বস। আমরা ফ্রেশ হয়ে আসছি। তারপর একসাথে নাস্তা করবো।
–আচ্ছা যা।
____
আজকে ওরা পাথরঘাটা সহ আরও বিভিন্ন কিছু জায়গা ঘুরে দেখলো। সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে সবাই রিসোর্টে এসে ডিনার করে রিসোর্টের সামনের এরিয়ায় একটু খোলা জায়গায় বসে আছে। মেয়েরা এক জায়গায় বসে নিজেদের মতো কথাবার্তা বলছে।
এই সুযোগে আবির আদিত্য আর বিহানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–ভাই জানো এখানে পাশেই একটা নতুন পাব খুলেছে। শুনেছি অনেক ভালো। চলনা আজকে যাই আমরা।
আদিত্য কপাল কুঁচকে বললো।
–পাগল হয়ে গেছিস? মেয়েদের এভাবে রেখে যাওয়া যাবে?
–আরে তাতে কি হয়েছে ওরা তো রুমেই থাকবে। দরকার হলে সবাই নাহয় একরুমেই থাকবে। প্লিজ ভাইয়া চলনা? এই একটা আবদার পুরণ করো আমার। প্লিজ প্লিজ প্লিজ
–দেখ জিদ করিস না। যেতে হলে বিহানকে নিয়ে যা। আমি নূরকে এভাবে একা রেখে যেয়ে শান্তি পাবোনা।
আবির এবার একটু রাগ দেখিয়ে বললো।
–ধ্যাৎ,আমার কথা একটুও রাখনা তোমরা। আমার এখানে আসায় ভুল হয়েছে। আর কখনো কোথাও যাবোনা তোমাদের সাথে।
কথাটা বলে আবির রাগ করে ওখান থেকে উঠে গেল।
বিহান আদিত্যের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–বেচারা বোধহয় এইবার হাচাই রাগ করছে। চলনা যাইগা? কিছুক্ষণ থাইক্কাই নাহয় চইল্যা আমুনে।
আদিত্য একটু চিন্তিত সুরে বললো।
–কিন্তু ওদের এভাবে একা রেখে যাওয়া টা আমার মন টানছে না।
–আরে কিছু হইবো না। সবাই তো রুমেই থাকবো। আর আমরাও বেশি দেরি করমুনা। কিছুক্ষণ থাইকাই চইলা আমুনে।
আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–ঠিক আছে চল আর কি করার। আমি রুমে গিয়ে নূরকে বলে রেডি হয়ে আসি।
–হ আমরাও যাই।
অতঃপর আদিত্য নূরকে নিয়ে রুমে এসে নূরকে সব খুলে বললো। নূরও খুশী খুশী আদিত্যকে যেতে বললো। আদিত্য বারবার করে নূরকে বললো,তারা যেন একসাথেই এক রুমে যেন থাকে। আর তারা না আসা পর্যন্ত যেন কোথাও না যায়। নূর মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। একটু পরে আদিত্য, আবির আর বিহান রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল। আর মেয়েরা সবাই রুমে বসে কথাবার্তা বলতে লাগলো।
আয়াত বলে উঠলো।
–ভাবি ছেলেরা বাইরে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আর আমরা এখানে রুমে বসে বসে বোর হবো কেন? চল আমরাও আড্ডা দেই। শুনেছি এখানে একটু খানি দূরেই নাকি একটা মেলা হচ্ছে। এখানকার স্থানীয় লোকেরা মিলে পর্যটকদের জন্য এই মেলার আয়োজন করেছে। চলনা আমরা ঘুরে আসি? অনেক মজা হবে।
নূর বলে উঠলো।
–আরে না না কি বলো? ওরা কেউ নেই। আমরা মেয়ে মানুষ এভাবে একা একা বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। এমনিতেও আদিত্য বারবার বলে গেছে আমরা যেন বাইরে কোথাও না যাই।
নীলা বললো।
–আরে কিচ্ছু হবে না আপু চলনা। ওরা ফিরে আসার আগেই আমরা চলে আসবো। চলনা আপু প্লিজ প্লিজ প্লিজ,,,
নীলা আর আয়াত মিলে নূরকে চেপে ধরলো। ওদের চাপে পড়ে অগত্যা নূরকে রাজি হতে হলো। নূর বলে উঠলো।
–ওকে ওকে ঠিক আছে। তবে শুধু অল্প সময়ের জন্য। বেশি দেরি করা যাবেনা। আদিত্য জানতে পারলে কিন্তু রাগ করবে।
আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চলো যাই। অতঃপর ওরা তিনজন রেডি হয়ে বের হলো। মেলাটা বিচের কাছাকাছিই হচ্ছে। তাই ওরা হেটেই গেল। মেলায় এসে ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলো। মেলাটা সত্যিই সুন্দর। এখানে হরেক রকম জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। আয়াত আর নীলাতো যা পছন্দ হচ্ছে তাই কিনে ফেলছে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর নূর এবার ফিরে যাওয়ার তাগিদ দিল। নাহলে দেরি হয়ে যাবে। নূরের কথায় ওরা রাজি হয়ে একসাথে মেলা থেকে বেরিয়ে এলো।
তবে এতক্ষণ ধরে যে দুই জোড়া চোখ ওদের ফলো করছে সে ব্যাপারে ওদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সেই দুই জোড়া চোখের মালিক এখনো পেছনে পেছনে ওদের ফলো করছে। তাদের একজন আরেকজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–ভাই দেইখা মনে হইতাছে অনেক মালদার পার্টি। মাইয়া গুলানরে কিডন্যাপ করবার পারলে বস অনেক খুশী হইয়া যাইবো মোগো উপরে।
আরেকজন বলে উঠলো।
–হ রে মদনা, ঠিকই কইছস। খালি একবার কিডন্যাপ করতে পারলেই হয়। বসের কাছে মোরাই খাস হইয়া যামু।
–হ বদনা ভাই, তাইলে মুই যাই কিডন্যাপ করতে?
–না না তুই হইলি ছোড মানুষ,তুই পারবিনা। আর তাছাড়া তুই তো আগে কহনো কিডন্যাপ করসও নাই। তাই তুই থাক মুই এই কাজ করি।
মদনা ন্যাকা কান্না করে বললো।
–তুমি ব্যাকসময়ই এরাম হরো।ব্যাকসময়ই খালি নিজে সব কাজ করে বসের কাছে মহান হইয়া যাও।আর মোরে কিছু করার সুযোগ দাওনা। যাও মুই খেলমুনা তোমার লগে।
–আরে কান্দোস ক্যা? আইচ্ছা ঠিক আছে আইজকা তুই যা। তোরে সুযোগ দিলাম।
মদনা খুশী হয়ে বললো।
–থাংক্কু ভাই।
মদনা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার বদনার কাছে ফিরে এলো। বদনা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি হইলো ফিরা আইলি ক্যা?
–ভাই এইডা মোর প্রেত্তোম(প্রথম) কিডন্যাপিং। মোরে আর্শীবাদ দাও। মুই যেন এই কামে সফল হই। মুই যেন তোমার নাম উজ্জ্বল করবার পারি।
বদনা গদগদ হয়ে বললো।
–হ হ ঠিক আছে, মুই আর্শীবাদ দেলাম। তুই যেন তোর কার্যে বিজয়ী হস। আর মোরে গর্বিত করস। যা যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফের।
মদনা বদনার আর্শীবাদ নিয়ে আবারও সামনে এগুলো কিডন্যাপিং এর মিশনে। বদনাও ওর পিছে পিছেই আসছে। কিন্তু ওদের কিডন্যাপ কিভাবে করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না মদনা। প্রথমে ভাবলো ওদের মাথায় কিছু দিয়ে আঘাত করে ওদের বেহুঁশ করবে। তাই ওর ভাবনমতে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো রাস্তার পাশে একটা লাঠি পরে থাকতে দেখে মদনা সেটা হাতে নিল। লাঠি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে নূরদের পেছনে গেল। লাঠি উঠিয়ে ওদের দিকে ভয়ে তাক করছে। সাহস যুগিয়ে যেই মারতে যাবে, তখনই আয়াতের হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকস এর ক্যানটা ফুরিয়ে যাওয়ায় পেছন দিকে সেটা ছুঁড়ে মারলো। আর সেটা এসে সোজা মদনার মাথায় লাগলো। মদনা বেচারা নিজের মাথা এলোমেলো পায়ে ঘুরতে লাগলো। বদনা তাড়াতাড়ি করে মদনাকে ধরে ফিসফিস করে বললো।
–এইয়া কি করতাছোস তুই? এমনে কেউ কিডন্যাপ করে? আরে মোগো কাছে তো বেহুঁশ করার আছে। হেইয়া রুমালে মিশাইয়া অগো বেহুশ করন লাগবো।
বদনা একটা রুমালে বেহুঁশ করার মেডিসিন মিশিয়ে মদনার হাতে দিয়ে বললো।
–এই নে, এইডা নিয়া অগো নাকে ধর। হেরপর ওরা বেহুঁশ হইয়া যাইবো।
মদনা রুমাল টা হাতে নিয়ে নিজের মাথার ঘাম মুছতে লাগলো। রুমালের মেডিসিনের গন্ধে মদনার মাথা কেমন যেন ঘুরে উঠলো। বদনা আবারও ধমক দিয়ে বললো।
–আরে তোর মুখে ধরছস ক্যান গাধা? তোরে দিয়া কিচ্ছু হইবো না।
মদনা আবারও ন্যাকা কান্না করে বললো।
–তুমি খালি মোর লগে এরামই হরো। আমি এইবার বাইত্তে গিয়া মারে কইয়া দিমু। তুমি মোরে এট্টুও ভালোবাসনা, খালি ধমকাও।
–আচ্ছা ওইছে ওইছে কান্দন থামা অহন। আর যা তারাতাড়ি অগো বেহুঁশ কইরা আয়।
মদনা আবারও এগুলো সামনে। রাস্তায় আপাতত লোকজন তেমন নেই। তাই ওদের সুবিধা হচ্ছে। আয়াতের পায়ে হঠাৎ কি যেন লেগে গেল। আয়াত সেটা ছাড়ানোর জন্য থেমে গিয়ে নিচে ঝুঁকে পায়ে লাগা জিনিস টা ছাড়াতে লাগল। নীলা আর নূর কিছুটা এগিয়ে গেছে। মদনা এই সুযোগে আয়াতের পেছনে গিয়ে পেছন থেকে রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়াত বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। মদনা আর বদনা গিয়ে এবার নূর আর নিলাকেও একইভাবে বেহুঁশ করে ফেললো। মদনা ওদের বেহুঁশ করে খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো।
–ওরে মোর খোদা, মুই মোর জীবনের প্রেত্তোম কিডন্যাপিং এ সফল হইছি। মোর যে কি খুশী লাগতাছে।
বদনা বলে উঠলো।
–ও মনু চিল্লাও ক্যা? কেউ আইয়া পরবো জলদি হরো।
তারপর একটা গাড়িতে করে ওদের উঠিয়ে নিয়ে গেল।
____
ঘন্টাখানিক পর আদিত্যরা রিসোর্টে ফিরলো। আদিত্যের রুমে সবার থাকার কথা তাই সবাই আদিত্যের রুমে প্রথমে আসলো।দরজায় এসে নক করলো আদিত্য। তবে ভেতর থেকে কোন সারাশব্দ এলোনা। আদিত্য ভাবলো হয়তো ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আদিত্যের কাছে থাকা ডুবলিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো ওরা। কিন্তু ভেতরে কাউকে না দেখে চমকে গেল সবাই। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–সবাই গেল কোথায়?
বিহান বলে উঠলো।
–কি জানি? চল আমাদের রুম গুলো চেক করি।হয়তো অন্য রুমে গেছে।
সবাই তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে গিয়ে বিহান, আবির আর নীলার রুম চেক করলো। কিন্তু কোথাও কাওকে পেল না ওরা।ওদের নাম্বারে ফোন দিলে ফোনও বন্ধ পেল। আদিত্যর টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ওরা পুরো রিসোর্ট আর রিসোর্টের বাইরে চেক করলো কিন্তু কোথাও কাওকে পেল না। সবারই এবার ভয় হতে লাগলো। নাজানি কোথায় গেল সবগুলো। আবিরের প্রচুর অপরাধ বোধ হচ্ছে। আজ ও জেদ ধরে ওদের রেখে না গেলে এসব হতো না। নিজের ওপর খুব রাগ লাগছে ওর। আদিত্য এবার তাড়াতাড়ি করে রিসোর্টের সিকিউরিটি রুমে এলো।তারপর সিকিউরিটিদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে বললো। সিকিউরিটি রা প্রথমে মানা করলেও আদিত্যের পরিচয় যেনে তখন সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। সিসিটিভি ফুটেজ চালু করলে ওরা দেখতে পেল মেয়েরা তিনজন দু’ঘন্টা আগে রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে গেছে। এরপর আর ফেরেনি।
এটা দেখে সবার টেনশনে সবার গলা শুঁকিয়ে এলো। এতরাতে কই গেল মেয়েগুলো? ওরা মেয়েদের খোঁজার জন্য রিসোর্টের বাইরে বেরিয়ে এলো।
_
আরও দু ঘন্টা পর,
মেয়েদের জ্ঞান ফিরে আসলো। মেয়েরা সবাই চোখ পিটপিট খুলে তাকালো। মাথাটা কেমন ভারি হয়ে আছে। চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ওরা কোথায় আছে। ওরা দেখলো ওরা একটা সামুদ্রিক বড়ো নৌকার ওপর বসে আছে। নৌকাটা ঘাটে বাঁধা আছে। আশেপাশে আরও অনেক গুলো নৌকা বাঁধা আছে। ওরা এবার নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওদের তিনজন কে তিনটা চেয়ারে একসাথে বেঁধে রেখেছে।
এসব দেখে নূর অনেক ভয় পেয়ে গেল। ওরা এভাবে এখানে কেন? তারমানে কেউ ওদের কিডন্যাপ করে এনেছে? কথাটা ভাবতেই ওর গলা শুঁকিয়ে এলো।
তখনই চার পাঁচজন লোক ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। বদনা আর মদনাও ওদের ভেতর আছে। মদনা ওদের দেখে আবালের মতো হেসে বলে উঠলো।
–আরে আফারা আফনেগো জ্ঞান ফিরা আইছে? যাক ভালোই হইলো, এই লন মিষ্টি খান।
কথাটা বলে মদনা ওর হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা মিষ্টি আয়াতের মুখের সামনে ধরলো। আয়াত মাথাটা পেছনের দিকে সরিয়ে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কে আপনি? আর কিসের মিষ্টি এটা?
মদনা বোকার মতো দাঁত বের করে বললো।
–আরে আফা মুই আজ প্রেত্তোম কিডন্যাপিং এর বউনি করলাম। তাই হেই খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করতাছি। আর আপনেগো হাতেই তো মোর বউনি হইলো তাই পয়লা মিষ্টি আফনেরাই খান।
–কিহ তারমানে আমাদের এখানে কিডন্যাপ করে আনা হয়েছে?
–হ তা নয়তো কি?
নীলা হঠাৎ উচ্চস্বরে চিল্লানি দিয়ে উঠলো। নীলার চিল্লানিতে সব গুন্ডা গুলোর আত্মা বেড়িয়ে আসার উপক্রম। বেচারা মদনা বুকে হাত দিয়ে বললো।
–ও মোর খোদা,বাঁচাও মোরে। কি হইলে এইহানে? ও আফা আফনে এমনে চিল্লান ক্যা? মোর মাছুম পরাণডা তো অহনি বারাইয়া যাইতো। হেইলে মোর বড় গুন্ডা হওয়ার স্বপ্ন ক্যামনে পুরন হইতো?
নীলা হাসি মুখে বলে উঠলো।
–সরি সরি আসলে আমি না একটু বেশিই এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে আমার না অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল কেউ আমাকে কিডন্যাপ করবে। আজ ফাইনালি আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ওয়াও আমার যে কি খুশি লাগছে।
নীলার কথায় সবাই তাজ্জব হয়ে গেল। কিডন্যাপ হওয়ারও কারোর শখ থাকে তা আজ জানলো ওরা। কিডন্যাপার দের মধ্যে চান্দু নামের এক ব্যাক্তি তার পাশের ব্যাক্তির দিকে তাকিয়ে বললো।
–আজ কাল কি কিডন্যাপ হওয়া শখের বিষয় হয়ে গেছে নাকি? আমি তো জানতামই না।
চান্দুর কথা শুনে পাশের দুঃখু নামের ব্যাক্তিটি তার অভ্যাস মতো নাকের পানি চোখের পানি এক করে জনম দুখী ভাব ধরে বললো।
–হইতে পারে ভাই, আমার মতো অভাগা কি আর এইসব জানবো? শখতো আমার ছিল ভাই। কত শখ ছিল বড়ো হয়ে কত বড়ো মানুষ হবো। কিন্তু কি হইলো? ছোটবেলায় আমার বাপ পাশের বাড়ির চুমকিরে লইয়া পালাইয়া গেল। আর সেই শোকে আমরা মা,,,, 😭
লোকটির অসম্পূর্ণ কথা শুনে আয়াত আগ্রহ দেখিয়ে বললো।
–সেই শোকে কি? আপনার মা মরে গেছে?
লোকটি এবার কান্না থামিয়ে নরমাল ভাবে বললো।
–না না মরে নাই। সেই শোকে আমার মাও চুমকির জামাইর লগে পলাইয়া গেছে।
চান্দু বলে উঠলো।
–আরে আফনেরা ওর কোথায় কান দিয়েন না। কথায় কথায় বালতি ভরে কান্দা ওর জনমের অভ্যাস।
দুখু আবারও কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–হ তুইতো কবিই। তোরা কেও আমার কষ্ট বুঝবি না। আমার কত কষ্ট জানোস? ছোটকালে বাবা মা ছাইরা গেল। আর আমি ছোট মানুষ ভাই বোনেরে পালার লাইগা এই ছোট ছোট হাতে চুরি করতাম। কহনো ভালো হাত মারতে পারতাম, কহনো খালি হাতে ফিরতাম।তহন বাড়িতে আইলে আমার ভাই বোনেরা আমার জান খাইতে আইতো।
দুখু মিয়ার কষ্টকাব্য শুনে নূর বলে উঠলো।
–থাক ভাইয়া কাদেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে ভাইয়া।
দুখু মিয়া নূরের করুন চোখে তাকিয়ে বললো।
–কি কইলেন আফা? আপনে আমারে ভাই কইলেন? জানেন আমার ছোট বোনও আমারে এমন কইরা ভাই ডাকে।
কথাটা বলে দুখু মিয়া আবারও তার কান্না শুরু করে দিল।
এবার কোপা শামসু নামের আরেক ব্যাক্তি দুখু মিয়াকে ধমক দিয়ে বললো।
–এই তুপ এদ্দম তুপ। আল একবালও কানলে তোল মাতা ফাতাই দিবো। তালা(সালা) তালাদিন(সারাদিন) খালি প্যাঁ প্যাঁ কলে বাতিল (বাঁশির) মতো বাততেই থাকে। তালা আবাল একতা। আল দদি(যদি) তোল প্যাঁ প্যাঁ তুনতি(শুনছি) তোল গলাল মধ্যে তিমেন্ট(সিমেন্ট) ঢেলে আততাই দিবো।
কোপা শামসুর এমন তোতলানো কথা শুনে মেয়েদের পেট ফেটে হাসি আসছে। ওরা মুখ টিপে নিজেদের হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে।
আর বদনা তখন কোপা শামসুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–ও মনু তুমি দুখুর গলা পরে আটকাইয়ো। আগে নিজের গলার মধ্যে যেইডা বাইজা আছে ওইডা পরিস্কার হরো। কি কও হেইয়াই তো বুজবার পারিনা।
কোপা শামসু বলে উঠলো।
–না বোজাল কি আতে? আমি তো এদ্দম তিলিয়ার(ক্লিয়ার) কলেই বলতি।তি থুন্দল(সুন্দর) পলিতকাল(পরিস্কার) তথা আমাল। আমি আমাল কতা তবই বুদি। তুমি বোদনা থেতা(সেটা) তোমাল তবলেম(প্রবলেম)।
এদের ঝগড়া দেখে এবার রাধে নামের আরেক ব্যাক্তি এগিয়ে এলো। তার চুলগুলো #তেরেনাম ছবির রাধের মতো মাঝখানে সিধি করে কপালের উপর নামিয়ে রাখা। (উনি আবার সালমান খানের অনেক বড়ো এসি)
রাধে সালমান খানের মতো অঙ্গভঙ্গি করে বলে উঠলো।
–এই তোরা থামবি?নাকি আমার ভাইগিরি দেখাবো? তোরা ভালো করেই জানিস “একবার জো কমেন্টমেন্ট কার দিয়া,উসকে বাদ তো মে খুদকি ভি নেহি সুনতা।
মদনা বলে উঠলো।
–ভাই দ্বিতীয় বার কমেন্টমেন্ট করলে কি করেন।
–দুসরিবার কমেন্টমেন্ট কারদিয়া তো, মে মেরে বাপকি ভি নেহি সুনতা।
–আর তৃতীয় বার।
–অর তিসরি বার কমেন্টমেন্ট কারদিয়া তো, কই মেরি নেহি সুনতা।
রাধের ডায়লগ বাজি দেখে নীলা উৎসাহ নিয়ে বললো।
–ওয়াও কেয়া বাত কেয়া বাত। ভাইয়া আপনিতো সত্যিই সালমান খানের মতোই ডায়লগ বললেন।
নীলার প্রসংশায় রাধে যেন খুশিতে ডগমগ হয়ে তালগাছের মাথায় উঠে গেল। নীলা আবার বললো।
–ভাইয়া আমার হাতটা একটু খুলে দিবেন। না মানে আপনার জন্য একটু তালি বাজাতাম।
রাধে যেন আরও ফুলে বেলুন হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে নীলার কাছে এসে হাতের বাঁধন খুলে দিতে দিতে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। কেন নয়।
নীলার হাত খুলে দিলে নীলা জোরে জোরে তালি বাজিয়ে বললো।
–ওয়াও অনেক ভালো করেছেন আপনি। আরও কিছু করে দেখান না। আসলে সালমান খান আমার অনেক পছন্দ।
রাধে আনন্দে গদগদ হয়ে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ এখুনি করছি।
রাঁধে সালমান খানের আরও ডায়লগ বাজি করে দেখালো। নীলা এবার বললো।
–ভাইয়া আমি একটু আমার ফোনটা পেতে পারি? না মানে আপনাদের সবার সাথে একটু সেলফি নিতাম। আপনি জানেনই আজকাল ফ্রেন্ডগুলো একনাম্বারের হারামি। আমার কিডন্যাপ হওয়ার কথা মুখে বললে একদম বিশ্বাস করবে না। তাই একটু সেলফি তুলে নিতপ চাই। যাতে ওদের দেখানো যায়। এতে করে কিন্তু আপনারাও ফেমাস হয়ে যাবেন। আপনাদের বিজনেসও অনেক পপুলার হয়ে যাবে।
রাধে বোকার মতো নীলার কথায় রাজি হয়ে গেল। নীলার ফোনটা এনে দিলে নীলা একে একে সবার সাথে সেলফি তুলতে লাগলো। আর লোকগুলোও দাত কেলিয়ে ওর সাথে সেলফি তুলছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে ওরা এখানে পিকনিক করতে এসেছে।
নূর নীলার দিকে ইশারা করতেই নীলা সেলফি তোলার মাঝেই টুক করে আদিত্যের নাম্বারে একটা ম্যাসেজ আর ওদের লোকেশন পাঠিয়ে দিল।
আদিত্যের এদিকে পাগল প্রায় অবস্থা। ওর এঞ্জেল টাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। টেনশনে হাত পা জমে যাচ্ছে ওর। তখনই ওর ফোনে নীলার দেওয়া ম্যাসেজ আসলো। ম্যাসেজ টা দেখে ওরা তিনজন দ্রুত সেই লোকেশনে গেল।
আর নূরেরা এদিকে সবার সাথে খাতের জমিয়ে নিয়েছে। যেন হারিয়ে যাওয়া ভাইবোনের মিলন হয়েছে। নূর ওদের দিকে তাকিয়ে বললো।
–ভাইয়া আমর তো এখন আপনাদের বোন হয়ে গেছি তাইনা? তাহলে আমাদের ছেড়ে দিন না? আপনাদের দুলাভাইরা চিন্তা করছে।
বদনা বলে উঠলো ।
–মাফ করো বইন এইকাম করতে পারবো না। আমাগো বস অনেক ভয়ংকর। তোমাগো ছাইড়া দিলে আমাগো জানে মাইরা ফালাইবো। সে খুবই ভয়ংকর।
বদনার কথায় নূর ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। নাজানি এদের বস সত্যিই কতো ভয়ংকর। তখনই মদনা বলে উঠলো।
–ভাই ভাই ওই দেহ বস আইতাছে।
মদনার কথামতো নূরেরা মাথা তুলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বসকে দেখার জন্য। কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না ওরা। নূর মদনার দিকে তাকিয়ে বললো।
–কোথায় আপনার বস? দেখিনাতো?
–এইযে আমি এখানে। নিচের দিকে তাকান।
বসের কন্ঠ শুনে নুরেরা নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তিন ফুট লম্বা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। নূর অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো।
–,আপনিই ওদের বস?
–হ্যাঁ আমি ওদের বস। আমি হলাম দ্য ভয়ংকর ছোটকা ডন।
এবার আর নিজেদের হাসি আটকাতে পারলোনা ওরা। তিনজনই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে একজনের ওপর আরেকজন গড়িয়ে পড়ছে ওরা। লাইক সিরিয়াসলি! এটা আবার ডন?
বেচারা ডন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। নিজের দাপট প্রমাণ করার জন্য আরও রাগী ভাব দেখিয়ে বললো।
–এই তোমারা হাসছো কেন? আমি কিন্তু সত্যিই অনেক ভয়ংকর। এই দেখ আমার কাছে গানও আছে।
কথাটা বলে বস তার মতোই একটা পিচ্চি ডুবলিকেট গান বের করলো।
সেটা দেখে ওদের হাসি থামার বদলে আরও বেড়ে গেল।হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। নীলা হাসতে হাসতে বলতে লাগলো।
–বাস বাস আর বলেন না। মরে গেলাম হাসতে হাসতে।
ডন বেচারা নিজের দাপট প্রমাণ করার আরও কিছু চেষ্টা করতে লাগলো। তবে যত চেষ্টা করছে ওদের হাসি ততই বেরে যাচ্ছে। এবার বেচারা ডন কেঁদেই ফেলল। হাত পা ছড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–এমন করো ক্যা? একটু ভয় পাওনা আমারে? এক চিমটি তো ভয় পাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ,,,
বেচারার কান্দা দেখে ওরা অনেক কষ্টে নিজেদের মুখ চাপালো। কিন্তু পাঁচ সেকেন্ড যেতে না যেতেই আবারও ওরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। যেন ওদের কেউ লাফিং গ্যাস দিয়ে দিয়েছে।
তখনই ওখানে আদিত্যের চলে এলো। নূরদের এভাবে হাসতে দেখে আর এখানকার পরিবেশ দেখে ওরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ওরা বুঝতে পারছে না। ওদের কিডন্যাপ হয়েছে। নাকি এখানে ফ্রেন্ডসদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।
আদিত্যেরা ওদের কাছে এগিয়ে গেল। আদিত্যদের দেখে নূরেরা ওদের হাসি থামাল। আদিত্য ওদের কাছে এগিয়ে যেতে নিলেই বদনা এসে ওদের থামাতে গেলেই আদিত্য এক চড় মেরে দিল। বেচারা বদনার চান্দী ঘুরে উঠলো। সে ঠাস করে নিচে পড়ে। বদনার অবস্থা দেখে বাকিদের ভয়ে মুতে দেওয়ার দফা।
আদিত্য দ্রুত গিয়ে নূরের বাঁধন খুলে দিয়ে দুই হাতে মুখটা ধরে বললো।
–ঠিক আছ তুমি?
–হ্যাঁ হ্যাঁ আমি একদম ঠিক আছি।
আবির আর বিহান এসে আয়াত আর নীলার বাঁধন খুলে দিল। আদিত্য ওই লোকগুলোদের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে তেড়ে যেতে লাগলো। বেচারারা তো আগেই ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। নূর আদিত্যের হাত ধরে ওকে আটকে দিয়ে বললো।
–থাক ওদের মেরনা। ওরা এতটা খারাপ না। একটু বুদ্ধিকম।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে নূরের দিকে তাকালো। কিডন্যাপারের জন্য এতো দরদ দেখে একটু অবাক হচ্ছে ও। যাইহোক শেষমেশ আর মারলো না। ওরাও আদিত্যদের কাছে মাপ চেয়ে তওবা করলো। আর কখনো এমন কাজ করবে। তারপর আদিত্যেরা ওদের নিয়ে চলে গেল।
চলবে……