মানলাম তুমি ভালোবাসোনি পাঠ-১

মানলাম তুমি ভালোবাসোনি
কলমেঃ মম সাহা

১.

আমি প্রথম প্রেমে পড়ি নবম শ্রেণি থাকা কালীন। তুমুল বর্ষার সময়, হাতে ছাতা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুল গেলাম। আকাশ ভেঙে যেন বৃষ্টির উৎপাত। কাঁদা চিপ চিপে রাস্তা পার হয়ে স্কুলে গিয়ে শুনলাম স্কুল বন্ধ। আমার সে কী কান্না! এত সকাল সকাল স্কুলে এলাম তাও এত ঝড় ঝাপ্টা পেরিয়ে কোনো লাভ হলো না ভেবেই আমার ছোটো মনটা ভেঙে গেলো। ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে যেই না আমি আবার বাড়ির পথ ধরলাম ঘটলো অঘটন। ছাতাটা ভীষণ বাতাসে উল্টে গেলো। অর্ধ ভেজা শরীরটা সেই কল্যাণে পুরো ভিজে গেলো ততক্ষণে। মনে মনে রাগ হলো, সকালে কার মুখ দেখে উঠেছি ভেবেই হা হুতাশ করছিলাম। ঠিক তখনই কালো টি-শার্ট পরিহিত বিশাল সুদর্শন এক পুরুষ আমার মাথার উপর একটা হলুদ রঙের ছাতা মেলে ধরলো। আমি অবাক হলাম, অবাক কণ্ঠে বললাম,
“আরে! আপনি ছাতা দিচ্ছেন ক্যান? আপনাকে তো আমি চিনিনা।”

“চেনা অচেনা দিয়ে কী আসে যায়? আমাকে চিনলেই কি তোমার বৃষ্টিতে ভেজা বন্ধ হয়ে যাবে? বৃষ্টি কী তোমার উপর পরবে না?”

একে তো অচেনা পুরুষ তার উপর কিনা তুমি করে বলছে! আমি বিরক্ত হলাম আর রাগ তখন সপ্তম আকাশে। বেশ ঝাড়ি মেরে বললাম,
“এই আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন ক্যান? অচেনা মেয়েকে সম্মান দিতে জানেন না?”

“তোমাকে অসম্মান কখন করলাম? দেড় ফুটের একটা পাঙ্গাশ মাছ আর রাগ কিনা এত! যান সম্মানিত মহিলা, ছাতাটা ধরে সুন্দর মতন বাড়ি যান।”

আমি আরও কিছু বলতাম কিন্তু বলা হলো না। লোকটা আমাকে অবাক করে দিয়ে চলে গেলো। আমি আরও মিনিট পাঁচেক রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজলাম। এরপর যখন দেহ কাঁপিয়ে শরীরের তাপমাত্রা বাড়া শুরু করলো ঠিক তখনই বুঝলাম আর ভিজলে আমার রক্ষে নেই। দ্রুত ছাতাটা মাথায় চেপে ছুটলাম বাড়ির দিকে কিন্তু সেদিনই যে রাস্তায় মনটা ফেলে গেছিলাম কে জানতো?

সেই বৃষ্টিতে ভেজার পর আমার টানা তিনদিন তুমুল জ্বর। জ্বরের জন্য বিছানা থেকে উঠতে পারছিলাম না। কিছুটা বেহুঁশ হয়েই পড়ে রইলাম তিনটা দিন। কিন্তু যখনই হুঁশ হতো, চোখ মুখে কেবল ভেসে বেড়াতো অপরিচিত সেই পুরুষ অবয়ব। ভাবতে চাইতাম না তবুও ভাবনাতে সে এসে যেতো অনুমতি বিহীন৷ আমি নিজের প্রতিই নিজে বিরক্ত হলাম। চেনা নেই জানা নেই একটা পুরুষ কি-না জাদু করে গেলো!

তিনদিন অব্দি স্কুল না গেলেও চতুর্থ দিনের বেলা আমাকে আর ধরে বেঁধেও ঘরে রাখা যায় না। ছুটলাম স্কুলে। স্কুলে না যেতে পারলে আমার ভালো লাগতো না। খুব ভালো ছাত্রী যে ছিলাম সেটা পরিবার, আত্মীয় স্বজনের মুখেমুখেই থাকতো। আর স্কুলে সব দিক দিয়ে পারদর্শী একজন ছাত্রী হিসেবেও পরিচিত ছিলাম।

স্কুলে যাওয়ার পথে আমি চোরা চোখে আশপাশে যেন কিছু একটা খুঁজলাম। মস্তিষ্ক আমাকে বলছিল খুঁজিস না কিন্তু মন বলছিলো খোঁজ খোঁজ। হুট করে আবিষ্কার করলাম আমি অপরিচিত সেই মুখটা খুঁজছি। নিজেই নিজের ভাবনা দেখে অবাক। যাকে চিনি না তাকে কেন খুঁজছি? আমার প্রশ্ন আমাকে উত্তর বিহীন বড্ড পোড়ালো। আর সাথে ইচ্ছে পূরণ না হওয়ার ব্যাথাও আমাকে পোড়ালো।

স্কুল গেলাম, প্রিয় বান্ধবীদের দেখলাম তারপর, তারপর ভুলে গেলাম সব। ভুলে গেলাম হলুদ ছাতার কথা, ভুলে গেলাম অপরিচিত সেই মানবের কথা। কিন্তু সমাপ্তিতে ভুলতে গিয়েও অবশিষ্ট হিসেবে তাকে হয়তো আমি ভুলতে পারি নি।

নবম শ্রেণি পেরিয়ে আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। হাজার রকম পড়ার চাপে ডুবে রইলাম। চোখে মুখে বই ছাড়া কিছু দেখছি না। বাবা-মা বারংবার বুঝাচ্ছেন এত চাপ না দিতে কিন্তু তখন আমি অন্য এক দুনিয়ায় চলে গেলাম। আমাকে পড়তে হবে, প্রচুর পড়তে হবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে। সারাদিন ব্যস্ত আমি অন্য দুনিয়ায়। নিজেকে এত চাপের মাঝে রেখেও হলুদ ছাতার আত্মকথন আমি ভুলতে পারছিলাম না। ভুলতে পারছিলাম সে অপরিচিত পুরুষকে। গুনে গুনে এক বছর কেটে যাওয়ার পরও আমি ভুলতে পারছিলাম না। নিজেকে এত চাপ দিয়ে ছিলাম যা কল্পনাতীত। মস্তিষ্ক তখন আমাকে এতটাই বিভ্রান্ত করলো যার ভার নিতে পারলো না শরীর। হুট করেই একদিন সে নেতিয়ে গেলো। বাবা-মা চিন্তায় কাহিল। কী হলো তাদের একমাত্র কন্যা সন্তানের! রজনীগন্ধার নিশ্চুপতা তো তাদের হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমাকে দেখানো হলো হাজারো রকমের ডাক্তার। হলো না কোনো সমাধান। আমার প্যানিক অ্যাটাক শুরু হলো। হুটহাট শরীর কাঁপিয়ে চোখ উল্টে যেতো, শ্বাস নিতে পারতাম না, মনে হতো এই বুঝি পৃথিবীর শেষ দিন! বাবা-মা ভয় পেয়ে যেতেন। আমাকে তখন বুকে জড়িয়ে নিতেন। ইনহেলার হলো তখন আমার সম্বল। দেখানো হলো সাইক্রেটিস্ট। মনের ডাক্তার যাদের বলা হয়। উনার নাম পামেলা রহমান। আমার মায়ের বয়সী মহিলা। সে আমাকে বুঝালো। অনেক উপায়ে আমার মনের রোগ জানার চেষ্টা করলো। কিন্তু যেই রোগের ব্যাখ্যা আমার কাছেই নেই, সে রোগের বিশ্লেষণ আদৌও আমি দিতে পারতাম? পামেলা মেডাম তখন একটা কথা বললেন,
“শোনো মেয়ে, নিজেকে খুশি রাখো। নিজেকে বাঁচাও। তোমার মনের রোগ তুমিই সাড়াতে পারো। বি কনফিডেন্ট বাচ্চা, আবেগের বয়সে আবেগ ভালো তাই আবেগই দেখাও। কিন্তু আবেগে ডুবে গিয়ে হারিও না। তোমরা নক্ষত্র, জীবন বাকি। কাম অন, বেরিয়ে আসো যান্ত্রিকতা থেকে।”

আমি অনুভব করলাম, সত্যিই আমাকে আবেগই শেষ করে দিচ্ছে। আমি আবার শুরু করলাম নিজের মনকে বোঝানো। বারংবার নিজেকে ভরসা দিলাম, তুই পারবি, পারতে হবে। তখন সময়টা আগস্ট, পামেলা মেডামের সাজেশন অনুযায়ী আমাকে পাঠানো হলো মামার বাড়ি। এত পড়াশোনা রেখেই বাবা-মায়ের জোড়াজুড়িতে আমি সেখানে গেলাম। নিজেকে ততদিনে আমি কিছুটা সামলে নিলাম, প্যানিক অ্যাটাক টাও আর দেখা দিলো না। তারপর আমার জীবনে দ্বিতীয় বার আবার প্রেম নাছোড়বান্দা হলো।

আগস্টের সাত তারিখ বোধহয়। অসময়ে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। ছিলাম মামাদের এলাকারই একটা বড়ো বাজারে। কাজিনের আবদারে এসেছিলাম এখানে। হুট করেই বৃষ্টির জন্য আটকে গেলাম। মনে পড়ে গেলো সেই বৃষ্টি ভেজা পুরুষের কথা। সেই হলুদ ছাতার কথা। ও হ্যাঁ বলতেই ভুলে গেছি, আমি কিন্তু হলুদ ছাতাটা সবসময় নিজের সাথেই রাখতাম। অক্সিজেনের মতন হয়ে গিয়েছিল।

বৃষ্টির ছাঁট বাড়লো। ছাতাটা বের করবো কি না করবো নিয়ে দ্বিধায় ভুগলাম। যদি ছাতাটা বাতাসে উল্টে যায়? ভেঙে যায়? তখন তো আমার কান্না পাবে! সে ভয়ে আর দ্বিধায় আমি তখন অর্ধভেজা। হুট করেই আমার মাথার উপর আরেকটি হলুদ ছাতার দেখা মিললো। আমার দম আটকে আসতে লাগলো। চোখ মুখ উল্টে যেতে লাগলো। বুঝলাম, প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষ্মণ। তবুও আমি ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুটা ঘোলাটে চোখ নিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলাম। সেই কালো টি-শার্ট! সেই সুদর্শন পুরুষ! তার মাঝেই আমার কাজিন তুলি উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“রজনী, দেখ কে এসেছে! নীল! রজনী, পরিচিত হ। ও নীল, মাই লাইফলাইন। আর নীল, ও রজনী, মাই কাজিন।”

আমি বাকিটা আর শোনার অপেক্ষা করলাম না। চোখ মুখ উল্টে, শ্বাস বন্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লাম কাঁদা চিপ চিপে রাস্তায়। সারা দুনিয়া আমার আঁধার করা এলো। চোখে ভেসে উঠলো হলুদ ছাতায় আবিষ্ট আমি, যার সামনে সুদর্শন পুরুষ মিষ্টি হাসছে। কিন্তু পুরুষের পাশে অনাকাঙ্খিত নারী স্বত্তা চোখে ভাসতেই আমি জ্ঞান হারালাম। তারপর, তারপর সব শেষ। আমি নিথর!

(চলবে)

[গল্প কী সবসময় গল্প হয়! প্রেমোত্তাপ আজ দিবো না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here