#মায়াপরি
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#পর্ব_০২
বাসর রাতে একহাত ঘোমটা দিয়ে বউ বরের জন্য অপেক্ষা করবে, বর ঘরে আসলে উঠে গিয়ে সালাম করবে, একসাথে নামায পড়তে হবে এগুলো নাকি নিয়ম। অথচ সাদিয়া এখন কোনোটাই করতে পারবে না। কথাটা ভাবতেই কেঁদে ওঠে সাদিয়া। মুহিব সবে ঘরে ঢুকেছে। দরজা লাগিয়ে স্বভাবিক ভাবেই খাটের পাশে এসে দাড়ালো ও। সাদিয়াকে কাঁদতে দেখে আবার বাইরে চলে যায় মুহিব। কিছুক্ষন পর একটা কাঁচের বোতল নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
– ” সাদিয়া তুমি শুয়ে পড়ো। আমি তোমার পেটে গরম পানির সেক দিয়ে দিচ্ছি। ”
মুহিবের কথায় চমকে তাকালো সাদিয়া। কিছুক্ষন আগে পিরিওড হয়েছে ওর। পেটে ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলো বিছানায়। কিন্তু সেটা তো কেউ জানে না। কাউকে বলেনি ও। তাহলে মুহিব জানলো কিভাবে? অনুমান করে? শুধুই অনুমান করে সবটা বোঝা যায়?
– ” আমি.. ”
– ” আল্লাহ কখন কি চান তা কেউ বলতে পারে না সাদিয়া। উনি যদি চান তাহলে আমারদের বিয়ের রাত টা বাকি সবার মতোই হবে। কিন্তু আজকের রাতটা তুমি কষ্টে কাটাবে সেটা স্বামী হিসাবে আমি মেনে নিতে পারবো না। ”
মুহিবের বলা কথাগুলো সাদিয়ার কাছে এক এক টা ধাধার মতো। কথাগুলোর মধ্যে কি অন্য কথাও লুকানো আছে? যা দুইটা অর্থ নির্দেশ করছে। নাকি সবটাই কাকতালীয়।
– ” আমি থাকায় কি তোমার অস্বস্তি হচ্ছে? ”
– ” আসলে..”
– ” কাউকে ভালোবাসো? তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো তুমি কারোর জন্য অপেক্ষা করছো। কারোর কি আসার কথা ছিলো? ”
– ” হ্যা। ”
– ” কে সে? ”
– ” নাম জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি সে আসবে। আমি আব্বু আম্মুর জন্য কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? ”
– ” বলো। ”
– ” কাল সে আসবে। আমি চাই তার সাথে কথা বলতে। সে কি বলতে চায় সেটা শুনতে। আপনি দয়া করে আজ আমাকে ছোঁবেন না। আমি জানি আপনি আমার স্বামী, আমার ওপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে আপনার তবুও বলছি আমাকে একটু সময় দিন। ”
– ” আমি তোমাকে কখনো জোর করবো না। কিন্তু আজ তোমাকে আমার স্পর্শে থাকতেই হবে। অন্ততো হাতে হাত বা আঙ্গুলে আঙ্গুল রেখো। বিশ্বাস করতে পারো কিছু করবো না আমি। ”
– ” কি করবো আমি? আমি তো তার কাছ থেকে অনুমতি নেইনি। তার স্পর্শ ব্যতিত কারোর স্পর্শ আমার শরীরে থাকবে না এটা তো সে নিজে বলেছিলো। তাহলে কেন হারিয়ে গেলো সে? কেন আসছে না আমার কাছে? ” মনে মনে বললো ও।
মুহিব কুসুম গরম পানির বোতলটা সাদিয়ার হাতে দিলো। তারপর সাদিয়া যেপাশে আছে তার বিপরীত পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।
– ” কোমরে আর পেটে সেক দাও। ব্যাথা কমে যাবে। একটু পর ডেকো আমাকে আমি দুধ আর ডিম নিয়ে আসবো। ”
– ” আপনি কি আমাকে বহুদিন ধরে চেনেন? যেভাবে কথা বলছেন মনে হচ্ছে আমি আপনার ৪-৫বছরের বিয়ে করা বউ। আমি সর্বদা সত্য বলতে পছন্দ করি। তাই আজই আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই। আপনার আগে আামকে অন্যএকজন স্পর্শ করেছে। ”
চট করে উঠে বসলো মুহিব। চোখদুটো রাগে লাল হয়ে আছে। মুহিবকে দেখে ভয় পায় সাদিয়া । তবুও সবটা জানাতে হবে, স্বামী হন যে মুহিব।
– ” একজন জ্বীন সে। সে আজ অবধি তার নাম বা কাজ বা তার বিষয়ে কোনো কিছুই আমাকে বলেনি। আমি প্রথমদিকে ওনাকে ভয় পেতাম। পরে ভালো লাগতো তার ব্যাবহার। আমার যত্ন নেওয়া আমাকে ভালোবেসে সব কাজ করা। সবকিছুই মুগ্ধ করতো আমাকে। এমনকি তার স্পর্শ কোনোকিছুই ভুলতে পারবো না আমি। ”
– ” তুমি কি করে জানলে ও তোমাকে ভালোবেসে সবটা করতো? ও নিজে কিছু বলেছে? শুনেছি প্রতিরাতেই সে আসে। কই আমি আসার পর তো দেখলাম না। ও শুধু তোমার লোভে আসতো। তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আসতো। ”
ধমকের সুরে কথাগুলো বললো মুহিব। মুহিবের বলা প্রতিটা কথা সাদিয়ার হৃদয়ে আঘাত করতে করতে মস্তিষ্কে পৌছে গেলো। মানুষ বলে আগে মস্তিষ্ক সকল কিছু আয়ত্ত্ব করে কিন্তু সাদিয়ার ক্ষেত্রে কথাগুলো প্রথমেই হৃদয়ে গিয়ে ঠেকলো কেন? সত্যিই কি সে শুধু মোহিত হয়ে আসতো? এতোদিনের এতেকিছুর মাঝে কি একটুও ভালোবাসা ছিলো না?
– ” আপনি এসব জানলেন কিভাবে? আর আপনি ভুল ভাবছেন। সে এসেছিলো আমার কাছে কিন্তু ধরা দেয়নি। কেন এমন করেছে জানিনা তবে এটা জানি সে যা আমার ভালোর জন্যই করে ”
– ” এতো বিশ্বাস! এর জন্যই তো আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তুমি হয়তো জানো না তোমার অতিত, তোমার ছোটবেলা। তাই বুঝতে পারছো না। তোমার কাছে মাঝে মাঝে যে এসেছে সে ভালো নয়। আর তোমার কাছে যার আসার কথা ছিলো সে আর আসেনি ”
– ” আসেনি মানে? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? দেখুন হেয়ালি করবেন না। আমার ভালো লাগছে না এসব। আপনি পরিষ্কার করে কিছুই বলছেন না। ”
– ” স্বামী হই তোমার। তোমার সব ইচ্ছা, আশা পূরণের ক্ষমতা আমার আছে। তাই অন্যের জন্য আশা করে থেকো না। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ আর তোমার জীবনে আসবে না। এটা মনে রেখো। ”
– ” আপনি আমাকে ভয় দেখেচ্ছেন?”
– ” সাবধান করছি। আমার সামনে আমার বউ অন্যকারোর নাম বলবে, অন্য কারোর জন্য অপেক্ষা করবে সেটা মেনে নিবো না আমি। প্রয়োজনে তোমাকে জোর করবো তবুও ”
– ” জোর করবেন? এতোটা খারাপ আপনি? আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না আমি ওই জ্বীনকে..”
– ” নো মোর ওয়ার্ড। দেখি শুয়ে পড়ো আমি সেক দিয়ে দিচ্ছি। তার আগে দুধ আর ডিম নিয়ে আসছি আমি। ”
মুহিব বাইরে চলে গেলো। সাদিয়া বসে বসে কাঁদছে। ওর বর এমন হবে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি ও। মুহিব দুধ এনে সাদিয়াকে জোর করে খাইয়ে দেয়। তারপর বোতল কেড়ে নিয়ে সাদিয়ার কোমরে সেক দিতে থাকে।
– ” কাঁদবে না একদম। চুপচাপ ঘুমাও। ”
মাঝরাতে সাদিয়ার স্বপ্নের মধ্যে সে আসে। সাদিয়া ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সে সাদিয়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে।
– ” কাঁদছেন কেন? আল্লাহ যা চেয়েছেন সেটাই হয়েছে। আপনার স্বামী আপনাকে অনেক ভালোবাসে। তাকে কখনো কষ্ট দিবেন না। ”
– ” আপনি কেন আসলেন না? ”
– ” আমি চেয়েছিলাম আপনার বিয়েটা হোক। কারন আপনার জন্যই আল্লাহ মুহিবকে পাঠিয়েছেন। আপনার সুরক্ষার জন্য মুহিব এসেছেন। ”
– ” উনি আমাকে ধমকায়। আপনার মতো করে আমাকে বুঝতে পারে না। উনি শুধু নামেই আমার স্বামী। ”
– ” তাহলে ওনাকে শাস্তি দিন। যদি মনে করেন উনি আপনার সাথে অন্যায় করছে তাহলে তার ভুল শুধরে দিন। কিন্তু আপনারা যে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন সে বন্ধন ছিন্ন করবেন না। কথা দিন আমায়। ”
– ” আপনি আমাকে ভালোবাসেন না? ”
– ” নাহ। আমিও শুধু আপনার সুরক্ষার জন্যই এসেছিলাম। আমাকে পাঠানো হয়েছিলো। আসছি আমি। ভালো থাকবেন। ”
সাদিয়ার কান্নার শব্দ শুনে জেগে যায় মুহিব। সাদিয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে দেখে সাদিয়ার চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। আৎকে ওঠে মুহিব। সযত্নে নিজের রুমাল দিয়ে সাদিয়ার চোখ মুছে দেয় ও। তারপর সাদিয়াকে বুকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে হালকা মিষ্টি একটা নেশালো তীব্র ঘ্রান নাকে আসতেই কেঁপে ওঠে সাদিয়া। একটা অদ্ভুত বেষ্টনিতে আটকে আছে সে যার কারনে তিল পরিমাণ নড়তেও পারছে না। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় ও। মুহিবের রোমশ বুক। মুহিবকে দেখে দ্রুত সড়ে আসতে চায় ও। কিন্তু মুহিব ছাড়ে না।
– ” কি সমস্যা নড়ছো কেন? আর এতো ভোরে উঠলে কেন? নামায তো পড়বে না।”
– ” আআপনার জজামা? ”
– ” গরম লাগছিলো তাই নামায পড়ে পাঞ্জাবি খুলে এসে শুয়েছি। তুমি তোতলাচ্ছো কেন? ”
– ” আআমাকে এএভাবে ককেন ধধরে আআছেন? ”
সাদিয়াকে উচু করে ওর গালে গাল ঘসলো মুহিব।
– ” কোন ভাবে? ”
মুহিবের স্পর্শে কেঁপে উঠলো সাদিয়া। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে ওর মাঝে তবে সেটা শারিরীক ভাবে। মনের মাঝে হাজার অশান্তি আর অস্বস্তি। কিন্তু জ্বীনটার কথা শুনেই রাগে গা জ্বলে উঠলো। কপাল কিঞ্চিত কুচকে মুখ গোমরা করে নিচে তাকালো সাদিয়া।
– ” কি হলো? বলো কেমন ভাবে ধরেছি? ”
– ” জানিনা ছাড়ুন আমাকে। ভালো লাগছে না আপনার সাথে এভাবে মিশে থাকতে। ”
– ” কেন? ”
– ” আমি অসুস্থ। অস্বস্তি লাগছে। তাছাড়া খারাপও লাগছে। তাই প্লিজ ছাড়ুন। আর ওদিকটায় গিয়ে ঘুমান। ”
– ” তোমার মাসিক হয়েছে এতে সমস্যার কি আছে? প্রতিটা মেয়েরই হয়। আমার মায়ের তোমার মায়ের সবারই হয়েছে। তাহলে খারাপ লাগছে বলতে কি বোঝাচ্ছো? ”
– ” আমি না-পাক তো। ”
সাদিয়ার কথায় হাসলো মুহিব। তারপর সাদিয়াকে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়লো। সাদিয়া মুহিবের এমন আচরণ দেখে অবাক হয়। মুহিব হুট করে এসে সাদিয়াকে কোলে তুলে নেয়।
– ” আরে ককি ককরছেন? কেউ দেখে ফেলবে নামান। নামান বলছি। ”
– ” কেন নামাবো? তুমি নিজেকে আমার কাছ থেকে যত দূরে সড়াতে চাইবে আমি তত তোমার কাছে চলে আসবে। তুমি অসুস্থ হলে আমি তোমাকে অবহেলা, তুমি যেটা বলতে চেয়েছিলে খাস বাংলায় ঘৃনা করবো এটা ভাবলে কিভাবে? এটা সারাধন একটা বিষয় কিন্তু তুমি সেটা নিয়ে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছো আমাকে ভয় পাচ্ছো। কিন্তু কেন? ”
– ” আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগছে। আর কিছু না। ”
– ” সুস্থ হও আগে। তারপর দেখো আমি কি করি। তোমার লজ্জা অস্বস্তি সবকিছু দূর করার দায়িত্ব নিয়েছি যে। ”
– ” আপনাদের বাড়িতে কে কে থাকে? ”
– ” আমি আর সেহের। মা-বাবা মারা গেছে। ”
– ” আপনি না থাকলে সেহের একা থাকে? ভয় পায় না? বাচ্চা একটা মেয়ে। ”
– ” নাহ। ও তোমার চেয়েও বেশি সাহসী। আস্তে আস্তে বুঝে যাবে।এখন সামনে তাকাও। ”
সাদিয়া সামনে তাকাতেই ভয়ে মুহিবকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে।সামনে বড় বড় পাহাড় আর ঝর্না।
– ” আল্লাহ গো। এটা কোন জায়গা। ”
– ” মেঘের দেশ সাঁজেক। তোমার নাহ প্রিয় এই জায়গাটা? তাই নিয়ে আসলাম। তাছাড়া আরও একটা কারন আছে। কারনটা হলো আজই তোমার শেষদিন। আমি তোমাকে ফেলে দেওয়ার পর এই পাহাড়ের নিচে হবে তোমার কবর,, মৃত্যুর পর আল্লাহ তোমাকে জান্নাত দান করবে এটাই দোয়া করি। ”
সাদিয়া ভয়ে ভয়ে তাকালো মুহিবের দিকে। মুহিব ঠোট চওড়া করে হাসছে। ঠিক তখনই সাদিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। পাশে তাকাতেই দেখে মুহিব নামায পড়ছে। এই অদ্ভুত ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে ঘেমে ভিজে গেছে সাদিয়া। বেশ জোরেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সাদিয়া। মুহিব নামায পড়ে পাঞ্জাবি খুলে বিছানার দিকে আসলো ঠিক স্বপ্নের বর্ণনার মতো। তাহলে কি স্বপ্নটাই সত্যি হতে চলেছে?
চলবে?
[ নাইস নেক্সট কমেন্ট করুন। ইহা আমার প্রচুর ভালো লাগে ঠিক আপনাদের মতো 🙂🙂]