#মায়াবতী
কলমে রোকেয়া পপি।
শ্রাবণ মাস। সকাল থেকে আকাশ বেশ মেঘলা। মায়া যখন ক্যাম্পাসে এসে রিকশা থেকে নামলো তখন ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সবাই দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও মায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে বৃ্ষ্টিতে ভিজছে।
মায়ার আজ খুব মন খারাপ। অনেক কষ্ট করে চোখের পানি আটকে রেখেছিলো। বৃষ্টির কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে খুব হালকা লাগছে। এখন আর কেউ বৃষ্টির পানি আর মায়ার চোখের পানি আলাদা করতে পারবেনা।
গত সপ্তাহে মায়াকে দেখতে এসে ছেলে পক্ষ মায়ার ছোট বোন শ্রেয়াকে পছন্দ করে।
ছেলে ব্যাংকে জব করে। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি না থাকলেও, করতে কতোক্ষণ।
মায়ার মা কিছুতেই এই ছেলেকে হাত ছাড়া করতে নারাজ।
মায়ার বাবা এক বছর ধরে প্যারালাইছিস হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী। মায়ারা দুই বোন। মায়ার মা ছালেহা বেগম যখন মায়ার বাবার কাছে শ্রেয়ার বিয়ের কথা উপস্থাপন করলো। তখন বিছানায় পড়ে থাকা রহমান সাহেবের চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। কারণ সংসারের পুরো কতৃত্ব ছালেহা বেগমের হাতে।
মায়া বাবার গায়ের রং পেয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামলা কিন্তু চেহারায় খুব মিষ্টি ভাব। মায়াকারা চেহারা দেখে রহমান সাহেব আদর করে নাম রেখেছিলেন মায়া।
আর শ্রেয়া মায়ার সম্পূর্ণ উল্টা।
মায়ের মতো দুধে আলতা গায়ের রং। স্মার্ট, প্রচন্ড রকম চঞ্চল, এক দন্ড স্থির থাকতে পারে না। এক দেখায় যে কেউ পছন্দ করে ফেলে ওকে।
পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কম, বিধায় এক কথায় শ্রেয়ার বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক হলো এক সপ্তাহ পর।
মায়ার পড়াশোনার আগ্রহ অনেক বেশি। নিজের চেষ্টায় মায়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে চান্স পেয়েছে। শ্রেয়ার বিয়ে নিয়ে মায়ার তেমন কোন মন খারাপ হয়নি।
শ্রেয়ার প্রতি সালেহা বেগমের দুর্বলতা সব সময় একটু বেশি। একাই দৌড়ঝাঁপ করে কনভেনশন হল ভাড়া করেছে। সব আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব দাওয়াত করে বিশাল আয়োজন করেছে । কেউ যেন বলতে না পারে কোথাও কোনো কমতি আছে।
কিন্তু আজ ভোরে উঠে ছালেহা বেগম যখন বললেন, মায়া আজ তুই বাসায় থাক। তোর বিয়েতে যেয়ে কাজ নেই। শ্রেয়ার আজ বিয়ে। আমি চাই না তোর জন্য তোর ছোট বোনের কোন অমঙ্গল হোক।
শুভ যখন গাড়ি থেকে বের হয়ে মাথায় ছাতা মেলে ধরলো, অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ালো!
কি মিষ্টি এক মায়াবতী কন্যা বই খাতা ফেলে রেখে বৃষ্টিতে ভিজছে।
ও বিস্ময় গোপন করতে না পেরে সরাসরি বললো, এই মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন?
জ্বর এসে বিছানায় পড়ার শখ হয়েছে বুঝি!
মায়াকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টেনে নিজের ছাতার নিচে নিয়ে আসলো।
তারপর কপট রাগ দেখিয়ে বললো, আপনার সমস্যা কি?
এভাবে ভিজছেন কেন?
ভার্সিটি এসে কেউ বৃষ্টিতে ভিজে!
শুভ অবাক হয়ে দেখলো কি মিষ্টি একটা মেয়ে, চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে। একটু টোকা দিলেই যেন গড়িয়ে পড়বে সেই অশ্রু বিন্দু।
একটু খানি আদর মাখা শাসনে মায়ার মনটা ভালো লাগায় ভরে উঠলো। এমন নয় যে মায়াকে কেউ কখনো শাসন করেনি। খুব অনাদরে বড়ো হয়েছে সে।
ছোট বেলা থেকেই অতিরিক্ত শাসনে বেড়ে ওঠা মায়ার কাছে এই শাসনটুকু অন্যরকম এক ভালো লাগায় মন ভরিয়ে দিল।
কোন সমস্যা নেই ভাইয়া, বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগছিলো। তাছাড়া অনেক দিন বৃষ্টিতে ভিজিনা।
মায়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শুভ্র বলে উঠলো,
অনেক দিন বৃষ্টিতে ভিজি না।
বাহ্ চমৎকার!
অনেক দিন বৃষ্টিতে ভিজি না জন্য কি ভার্সিটিতে এসে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে?
পাগল নাকি!
এখন ক্লাস করবেন কিভাবে?
সমস্যা নেই। আপনি ব্যাস্ত হবেন না ভাইয়া।
আমি রিকশা নিয়ে বাসায় চলে যাবো।
আপনি ভিজে যাচ্ছেন।
প্লিজ আপনি ক্লাসে যান।
হুম ঠিকই বলেছেন, আমি ও প্রায় ভিজে গেছি। চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি ও বাসায় চলে যাবো। আজ আর ক্লাস করবো না।
শুভ্রর কথা শুনে মায়া চমকে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো।
প্লিজ আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
আমি একাই চলে যেতে পারবো।
মায়া যতোবার শুভর দিকে তাকায়, শুভ্র ততোবার একটা করে হার্টবিট মিস করে।
কি আছে ঐ চোখে?
এমন মায়াবী চাহনি এর আগে তো কখনো দেখেনি সে।
আমি জানি আপনি একা যেতে পারবেন।
কিন্তু আজ এমন বৃষ্টি ভেজা ওয়েদারের মধ্যে আমি আপনাকে কোনভাবেই একা ছেড়ে দিতে পারি না।
উঠুন বলছি গাড়িতে।
গাড়ি চলছে, মায়া একদম চুপ। সে খুব আনইজি ফিল করছে। মায়া আগে কখনো এত দামি গাড়িতে উঠেনি।তার ওপরে ওর ভেজা জামার পানিতে গাড়ির সিট ভিজে নষ্ট হচ্ছে। এটা ওর জন্য সত্যিই খুব অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরবতা ভেঙ্গে শুভ্র প্রথম কথা বললো।
তারপর বাসার ঠিকানাটা বলুন।
পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় আমাদের বাসা।
হুম।
আমি শুভ্র।
ফাইনাল ইয়ার।
আপনি?
আমি জানি আপনি শুভ্র ভাইয়া।
শুধু আমি নই, ভার্সিটিতে সবাই আপনাকে চিনে।
হা হা হা।
Really?
আমি কিন্তু আপনাকে আগে কখনো দেখিনি।
আমি মায়া।
দুই সেমিষ্টার বাকি আছে।
পদার্থ বিজ্ঞান।
আমাকে তুমি করে বললে খুশি হবো।
ওকে বলতে পারি।
দুটো শর্তে।
এক, সামনে একটা ভালো কফি শপ পড়বে। আমার খুব ইচ্ছে করছে দুজনে একসাথে কফি খাই।
আর দুই, আমাকেও তুমি বলতে হবে।
প্রথম শর্তে কোন সমস্যা নেই।
কারণ আমার আজ বাসায় যাওয়ার কোন তাড়া নেই।
আর দ্বিতীয় শর্তটা চেষ্টা করবো।
কথা দিতে পারলাম না।
মায়া আর শুভ্র বসে আছে দশতলার ওপরে একটা রুফটপ রেস্টুরেন্টে। ঢাকা শহরের এই অত্যাধুনিক রেস্টুরেন্টে গুলো অনেক সুন্দর করেছে। বৃষ্টির সিজন জন্য ওপরে টিনের চালা করে দিয়েছে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ সাথে ধুমায়িত কফি। পরিবেশ টা সত্যিই চমৎকার।
মায়া একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
মায়া মাথা কাত করে সম্মতি জানায়।
তোমার কি মনটা আজ খুব খারাপ?
একটু।
কারণ টা বলা যায়?
বলার মতো তেমন কিছুই হয়নি।
বাসায় কে কে আছে?
বাবা,মা, আমার ছোট বোন।
তোমার ফোন নাম্বার দেওয়া যাবে?
তাহলে মাঝে মাঝে কথা বলতাম।
আমার তো ফোন নেই।
মানে আমি ফোন ব্যাবহার করি না। আমার ছোট বোনের আছে। কিন্তু ওর তো আজ বিয়ে। শশুর বাড়ি চলে যাবে।
তা না হলে ওর নাম্বারটা দেওয়া যেতো।
দাঁড়াও দাঁড়াও!
কি বলছো এসব?
আজকের দিনে কোন ভার্সিটিতে পড়ুয়া মেয়ে ফোন ব্যাবহার করে না!
তোমার বোনের বিয়ে?
তুমি সেখানে অনুপস্থিত!
আমি তো কিছুই মিলাতে পারছি না।
আসলে আমি পড়াশোনার প্রতি একটু সিরিয়াস। এখন বিয়ে করতে চাই না। ভালো পাত্র জন্য হাতছাড়া না করে আমার বোনের সাথে বিয়ে হচ্ছে।
আর আমার খুব জরুরী একটা ক্লাস ছিল আজ। তাই বিয়ের গ্যাঞ্জামে না যেয়ে ….
মায়ার কথার মাঝপথে শুভ্র বলে উঠলো , বিয়ের গ্যাঞ্জামে না যেয়ে মায়া ভার্সিটি এসে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করলো।
হা হা হা
হাউ রোমান্টিক!
খুব ভালো করেছে।
তুমি যদি বিয়ের আসরে থাকতে তাহলে আমি কোথায় খুঁজে পেতাম আমার মায়াবতীকে।
সরি
কিছু বললেন?
না না কিছু না।
হা হা হা
চলবে…..
২০০০ সালের লেখা।
পরিমার্জিত রি-পোস্ট।