১.
ষোল বছর বয়সী সদ্য কিশোরীর মনে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উৎফুল্লতা বাড়ি পৌঁছানোর পরেই নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল। সাথে করে মনে জাগ্রত হওয়া সব স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা গুলো ও কাঁচের টুকরোর মতো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় তার।
গ্রামের চেয়ারম্যান ইফতেখার সাহেবের দোচালা ঘরটা ঠিক এমনভাবে সাজানো হয়েছে যা খুব সাদামাটাও না আবার জাঁকজমকপূর্ণ ও না। বাড়ির সামনে এসে হরেক রকম মানুষের হট্টগোল আর আয়োজন দেখে মনে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সন্দেহের সৃষ্টি হয় কিশোরীর। একরাশ আশংকা আর ভয় নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই বয়স্ক বেশ কিছু পুরুষ ও নারীকে চোখে পড়ে তার। সাথে করে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইফতেখার সাহেবকেও চোখ এড়ায় না। স্বভাবত বেশ কৌতুহলপ্রবণ হওয়ায় সবকিছু ছেড়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় ইফতেখার সাহেবের দিকে।
– “আব্বা?”
গুরুজনদের সাথে মশগুল হয়ে থাকা ইফতেখার সাহেব অল্পবয়সী তরুণীর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তড়িৎ গতিতে পাশ ফিরে তাকান। আমতা আমতা করে বলে উঠেন,
– “উপমা? মা তুই?”
সামনে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা উপমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ইফতেখার সাহেব চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অতি সন্তর্পণে সবার লোকচক্ষুর আড়ালে ভেতরে বড় কামরার দিকে পা বাড়ান। উপমাও বড় বড় পা ফেলে পিছু নেয় তার।
বড় কামরায় বসে সুপারি কাটতে কাটতে পান চিবোচ্ছিলেন আমিনা বেগম। হঠাৎ কারো ধুপধাপ পদধ্বনির শব্দ শুনতে পেয়ে দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ান তিনি। মেঝেতে লুটিয়ে থাকা শাড়ির আঁচল টুকু দিয়ে মাথা ঢেকে নেন মুহূর্তেই।
– “আব্বা, দাঁড়ান। কথা তো শুনেন আমার।”
উপমার কথায় তেমন কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে কামরায় প্রবেশ করতেই আমিনা বেগমকে চোখে পড়ে ইফতেখার সাহেবের। উপমাও রুমে এসে থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য।
– “আমিনা, উপমা চইলা আইছে। ওরে সুন্দর কইরা পরিপাটি কইরা দাও। কাজী সাহেব আর জামাই বাড়ির মানুষজনও কিছুক্ষণের মধ্যেই চইলা আসবে।”
ইফতেখার সাহেবের পুরো কথা কর্ণপাত হতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম উপমার। ইফতেখার সাহেব ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন আমিনা বেগমকে? আর তাকেই বা তৈরি হতে হবে কেন? কাজী সাহেবকে তো তখনই ডাকা হয় যখন বাড়িতে কোনো বিয়ে সম্বন্ধীয় অনুষ্ঠান থাকে। তবে কি তাকে না জানিয়েই তার বিরুদ্ধে বিয়ে নামক পিঁড়িতে বসিয়ে দেয়া হবে তাকে? এমন সব ভয়ঙ্কর চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতেই তৎক্ষণাৎ এগিয়ে গিয়ে ইফতেখার সাহেবের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় উপমা। অতঃপর দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “আব্বা, আমি আপনারে কিছু জিজ্ঞেস করছি। আপনি আমারে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? কিসের জন্য তৈরি হব আমি? আর বাড়িতেই বা আজ কিসের আয়োজন?”
উপমার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়াতে পুরো রুম জুড়ে সেকেন্ড কয়েকের জন্য পিনপতন নীরবতার সৃষ্টি হয়। ইফতেখার সাহেব দুম করে নিঃশ্বাস নিয়ে কিছু বলতে যাবেন তার পূর্বেই পেছন থেকে আমিনা বেগম বেশ কটাক্ষের সুরে বলে উঠেন,
– “কারণ আইজ তোর বিয়া! এখন হাজার প্রশ্ন কইরা মাথা না খাইয়া এই শাড়ি, চুড়ি পইরা তৈরি হইয়া নে। তোর এত প্রশ্ন শোনার এত সময় নাই। আর খবরদার বিয়ার পিঁড়িতে কোনো প্রকার তামাশা করবি না!”
আমেনা বেগমের কথা শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে উপমার। চোখে মুখে একপ্রকার বিস্ময়তার ছাপ। তাহলে তার ভাবনাই সত্যি হতে চলেছে। যদি এটাই হয়ে থাকে তাহলে তার স্বপ্ন, তার এতদিনের পরিশ্রমের কি হবে?
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ইফতেখার সাহেবের দিকে খানিকটা এগিয়ে যায় উপমা। অন্যদিকে ইফতেখার সাহেবের দৃষ্টি মেঝেতে স্থির।
– “আব্বা, মা এসব কি বলতেছে? আমার বিয়ে মানে? তোমরা আমারে না জানিয়েই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলছ? আমার বিয়ে হয়ে গেলে আমার পড়াশোনা, আমার স্বপ্নের কি হবে?”
– “হ্যাঁ, তোর মা ঠিকই বলতেছে। তোর বিয়া আইজকাই হইব। পোলা ভালো কামাই করে। খালি একটাই দোষ তা হইল আগের বউডা মইরা গেছে। তাছাড়া সব দিক দিয়াই রাজকীয়; তোরে মেলা ভালো রাখব।
আর এত পড়াশোনা দিয়া কি হইব? জামাই যদি চায় তহন তোরে পড়াশোনা করাইব। এসব নিয়া ভুলেও চিন্তা করবি না। আমেনা তুমি উপমারে দেইখা রাখো। বাইরে যাইয়া দেখি কাজী সাহেব আইছে নাকি!”
ইফতেখার সাহেবের এমন রূঢ় আচরণ পরিলক্ষিত হতেই মুহূর্তের মধ্যে হতবাক হয়ে যায় উপমা। নিজ জন্মদাতা পিতা তার জীবনের এত বড় ভুল পথে তাকে ঠেলে দিচ্ছে। আর মা? মা মা’রা যাওয়ার পর যাকে এতদিন নিজের মায়ের মতো সম্মান করেছে সেও আজ তার আসল রূপ দেখিয়ে দিল তবে?
২.
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে আমেনা বেগম যথারীতি তাড়া দিতে শুরু করেন উপমাকে। গোল্ডেন পাড়ের লাল শাড়ি, দু ডজন কাঁচের চুড়ি, সামান্য কিছু গয়নাগাটি বিছানায় একপ্রান্তে অবহেলিত হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। উপমাও জানালা ঘেঁষে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। বাড়ির পেছনের শিমুল গাছটায় থাকা কোকিলটা হাঁক ছেড়ে ডেকে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁক ছেড়ে ডাকার পর হুট করেই উড়ে আকাশের বিশালতায় মিলিয়ে গেল চোখের পলকেই। এমন সংকটপূর্ণ অবস্থার মাঝেও উপমার মনে এক অদ্ভুত ইচ্ছে জাগ্রত হলো। ইশ্ যদি এই বিহঙ্গের মতো স্বাধীন হতে পারত সে? কোনো ধরাবাধা নিয়ম না থাকত তার জন্য?
তার এই সুপ্ত ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়ে কোনো মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে। পেছনে ফিরে তাকায় উপমা। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা হাঁপিয়ে উঠেছে বেশ। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে।
– “পূর্ণা, তুই?”
উপমার কথা শুনে পূর্ণা একবার আশপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কি না। তারপর অতি সাবধানে কক্ষে প্রবেশ করে দরজাটা লাগিয়ে দিল সে। এদিকে উপমা ভ্রু কুঁচকে পূর্ণার কার্যকলাপ দেখে চলেছে।
– “বুবু? তুই কি করতে যাইতেছিস!”
পূর্ণার প্রশ্নে কিঞ্চিৎ হকচকিয়ে যায় উপমা।
– “মানে? কি করব আমি? আর তুই এখন এখানে কি করছিস? বাইরে কি সবাই চলে এসেছে?”
– “বুবু তুই কি ঠিক আছিস? তুই নিজে ঐ বুড়া লোকটারে বিয়া করতে যাইতেছিস? ঐ বুড়া লোকটারে আমার একটুও সুবিধার ঠেকতেছে না। তুই জানিস লোকটা লুকাইয়া লুকাইয়া আব্বার হাতে মেলা টাকা ধরাইয়া দিছে। আম্মাও তো দেখছে সব।”
পূর্ণার কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় উপমা। পূর্ণা কি বলছে এসব? ইফতেখার সাহেব ঐ লোকটার কাছ থেকে কিসের টাকা নিয়েছে? কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবে বারো বছর বয়সী ছোট পূর্ণা হয়তো ভুল ও বুঝতে পারে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে পূর্ণা যা বলে তাতে যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় উপমার।
– “আব্বায় তোমারে ঐ বুড়া লোকটার কাছে মেলা টাকার বিনিময়ে বেঁইচা দিতাছে বুবু। আমি শুনছি, সব শুনছি আমি! ঐ বুড়া লোকটায় আব্বারে মেলা খানেক টাকা দিছে এই জন্যে। তুমি নিজের এত বড় সর্বনাশ কইরো না গো বুবু। তুমি এই বিয়াডা কইরো না; দোহাই লাগে।”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় উপমা! অতি পরিমাণ বিস্ময়তায় তার মুখের রং উড়ে গিয়েছে। কি বলছে এসব পূর্ণা? তার অন্তরালে তার বিরুদ্ধে এত বড় ষড়যন্ত্র করেছে তার জন্মদাতা পিতা; ভাবতেই গা শিউরে ওঠে উপমার। নিস্তব্ধ হয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় আধভাঙা টেবিলের দিকে। বইয়ের পাতা থেকে একজন সুদর্শনা রমণীর ছবি বের করে তাতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে। সে কি তার বাবা মায়ের কাছে খুব বেশি বোঝা হয়ে গিয়েছে? তাহলে তার প্রতি এমন রূঢ় আচরণ কেন?
ভাবতে ভাবতেই ছবিটা জড়িয়ে হুট করে ডুকরে কেঁদে ওঠে উপমা। জীবন তার এমন অদ্ভুত কঠিন কেন? ছবিটা জড়িয়ে ধরতেই মা অয়ন্তিকার বলা শেষ কথাটি মনে পড়ে যায় তার।
– “কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবি না। সবসময় সত্য আর ন্যায়ের জন্য তোর প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করবি; যত কষ্টই হোক না কেন! প্রতিপক্ষ যদি তোর জন্মদাতা পিতাও হয় তবুও পিছপা হবি না।
মেয়েদের জীবন অনেক সংগ্রামের রে উপমা। এখানে হাত গুটিয়ে বইসা থাকলে চলবে না। তোকে অনেক দূর যেতে হবে; অনেক বড় হতে হবে মা! অনেক বড়!”
তারপরের দৃশ্যটুকু আর কল্পনা করতে পারে না উপমা। সে দৃশ্য যে ভয়ংকর! কল্পনা করলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার।
৩.
– “উপমা, মা তুই এখনো তৈরি হস নাই? আর তুই এভাবে এখানে কি করতেছিস? আমেনা, ও আমেনা! এইখানে আসো। উপমারে ভিতরে নিয়া যাও।”
উঠোনে দাঁড়িয়ে আমেনা বেগমকে হাঁক ছেড়ে ডাকতে শুরু করলেন চেয়ারম্যান সাহেব। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। কন্ঠে তার বিরক্তি স্পষ্ট। উঠোনে উপস্থিত মানুষজন ও কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপমার দিকে। আর এদিকে উপমা বেশ ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে সকালের সেই শাড়িটাই আছে। ইফতেখার সাহেবের ডাক শুনে আমেনা বেগম ও হুড়মুড় করে এসে উপমার সামনে উপস্থিত হন। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে চাঁপা রুক্ষ স্বরে বলে উঠেন,
– “তোরে কইছিলাম না বিয়ার পিঁড়িতে কোনো তামাশা করবি না। এখানে শাড়ি চুড়ি না পইরা এখানে কি করতাছিস তুই? আয় আমার সাথে আয়। আজকে তোর নাটক, উড়নচণ্ডী স্বভাব শেষ কইরা দিমু আমি!”
বলেই খপ করে উপমার হাত ধরে ফেলেন আমেনা বেগম। উপমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে গেলেই উপমা উপস্থিত সবার সম্মুখেই থমথমে গলায় বলে ওঠে,
– “আমি এই বিয়ে করব না!”
ভরা মজলিসে এই ছোট্ট কথাটাও যেন বোমা বিস্ফোরণের মতো রূপ নেয়। কাজী সাহেবের পাশে বর বেশে বসে থাকা রফিক সাহেব ও সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। মানুষজনের মধ্যে কেউ কেউ তো কানাঘুষা ও শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। আমেনা বেগম ও থেমে যায় উপমার কথা শুনে। ইফতেখার সাহেব যেন অবাক হওয়ার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যান; কেননা উপমা বরাবরের মতই তার বাধ্য মেয়ে যে কখনো তার কথার খেলাপ করে না।
– “উপমা, মা তুই এইসব কি বলতেছিস? তোর জন্য এহেনে সবাই অপেক্ষা করতাছে আর তুই এইসব কি কইতেছিস? আমেনা, ও আমেনা উপমারে সামলাইয়া ঘরে নিয়া যাও।”
বেশ থতমত খেয়ে বলে উঠেন ইফতেখার সাহেব।
– “হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলতেছি আব্বা। আমি এই বিয়ে মানি না! বিয়ে বলতেছি কেন? আমি কোনো পণ্য না যে তোমরা আমারে কোনো খদ্দেরের কাছে বেইচা দিতাছো!
আমি করব না এই বিয়ে।”
উপমার কথা শুনে এক মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশ শুনশান নীরবতায় পরিণত হলো। বরপক্ষ সহ সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপমার দিকে যেন এ কথা তাদের কারোরই বোধগম্য হয় নি।…………….
#চলবে?
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#মায়াবন_বিহারিনী 🌻🌻
(আসসালামু আলাইকুম 🌼। সবাই কেমন আছেন?
আবারো ফিরে এসেছি আপনাদের মাঝে নতুন কিছু নিয়ে। হতে পারে ভিন্নধর্মী। সূচনা কেমন লাগলো কমেন্ট বক্সে জানাবেন অবশ্যই।
রেসপন্সের ভিত্তিতে পরবর্তী পর্ব দেয়া হবে।
ভালোবাসা অবিরাম 🖤)