#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্দশ_পর্ব
৩৪.
মাঝ থেকে কেটেছে আরো এক দিন। আজ সকালেই বাড়ি ফিরে এসেছেন ইফতেখার সাহেব। বাড়ি পৌঁছানোর পর থেকেই তার মাঝে বেশ অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ যে তিনি কোনো একটা বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছেন। আমেনা বেগম অফিসার আমানের প্রসঙ্গ তুলে ধরতেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ক্রমশ সরু হচ্ছে যেন কোনো রহস্য উন্মোচন হয়ে যাওয়ার আশংকা। তাছাড়া সকাল বেলাই সজলকে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। একদিকে অফিসার আমানের নজরদারি আর অন্যদিকে উপমার সবকিছু ফাঁস করে দেওয়ার বিষয় নিয়েই তিনি আজ সিদ্ধান্ত নিতে বসবেন।
নিজের কক্ষে বসে সবটাই জানালা দিয়ে পরখ করে উপমা। বাড়িতে বসে থাকতে মোটেও খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না তার নিকট। পূর্ণাও তো বাড়িতে নেই। এমতাবস্থায় ইফতেখার সাহেব, আমেনা বেগম আর সজলের সামনে থাকা ঠিক হবে না বলে ধীরে ধীরে মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ঘড়ির দিকে একপলক দেখে নেয় কটা বাজে। ভালোই বেলা হয়েছে। তার উপর হাতে খুব একটা সময় নেই উপমার। মাত্র ৫৩ ঘন্টা বাকি আছে আবেগকে ফেরানোর। গত দিন ও একইভাবে সেই নদীর ধারে অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যে লেগে আসে উপমার। তবুও সবকিছু ফেলে ক্যাম্পের দিকে ছুটে যায় সে। যে করেই হোক আবেগের অভিমান ভাঙাতে হবে।
কিন্তু উপমার ভাবনার ঠিক উল্টোটাই ঘটে গতদিন। ক্যাম্পে যাওয়ার পর দেখা হলেও কথা বলেনি আবেগ। বরাবরের মতই তাকে দেখেও না দেখার ভান করেছে সে। আবেগের অভিমান ভাঙানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেও বিফলে যায় সবকিছু। আবেগের অভিমান যে খুব একটা সহজে ভাঙানো যাবে না তা খুব ভালো করেই জানে সে। অন্যদিকে উপমার এমন আচরণ বারবার ভাবিয়ে তুলেছে আবেগকে। মেয়েটা আসলে কি চায়? খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে উপমাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সে।
কিন্তু অবাধ্য মনকে চাইলেই বা কতক্ষণ আর আটকানো যায়? উপমা যখন তার বিষন্ন মাখা মুখশ্রী নিয়ে ফেরত পথে চলে যাচ্ছিল তখন আবেগের মনটাও দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। এই মনে হচ্ছিল যদি সে তার প্রেয়সীকে আটকাতে পারত। নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে রাখতে পারত তাহলে কতই না ভালো হতো। এ কেমন মায়াজালে আটকে রয়েছে দুজন?
আজ আর এদিক সেদিক সময় নষ্ট না করে গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে সোজা হৈমন্তীদের বাড়ির পথের দিকেই পা বাড়ায় উপমা। পথেই দীর্ঘদিন পর দূরসম্পর্কের এক চাচীর সাথে দেখা হয় তার। প্রথমে না চিনতে পারলেও কিয়ৎক্ষণ সময়ের ব্যবধানে মুখশ্রী মনে পড়ে তার। গুটিকয়েক আলাপচারিতায় হঠাৎ করেই জমেদা বেগম হতাশার সুরে বলে উঠেন,
– “আইজ যদি তোর বাপ টা ঠিক থাকত তয় অয়ন্তিকারে এমনে মরণ লাগত না। ফুলের মতোন মাইয়াডার লগে কি হইয়া গেল? তয় আইজ আমি যাই উপমা; বেলা হইয়া যাইতাছে। তোর চাচায় মাঠ থেইকা আইয়া পড়ছে মনে হয়।”
বলেই নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করেন জমেদা বেগম। অন্যদিকে উপমা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জমেদা বেগমের যাওয়ার দিকে। কি বলে গেল সে? অয়ন্তিকার মৃত্যুর সাথে ইফতেখার সাহেবের সম্পর্ক কি? কোনোভাবে এই মৃত্যুর পেছনে ইফতেখার সাহেবের হাত নেই তো? ভাবতেই তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে শুরু করে।
৩৫.
জনমানবহীন ক্লান্ত দুপুর। চারপাশে কোনো মানুষের ভীড় ভাট্টা নেই বললেই চলে। আর সে সময়ই হৈমন্তীকে নিয়ে ক্যাম্পে উপস্থিত হয় উপমা। আজ সে ঠিক করেছে আবেগের মুখোমুখি হয়ে সবটা পরিষ্কার ভাবে জিজ্ঞেস করবে তাকে। কেন এই দূরত্ব? কেন এই অবহেলা? সবটার উত্তর আজ আবেগের কাছ থেকেই জেনেই নিবে। এই উদ্দেশ্য অনুসরণ করেই ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশ করে সে। আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় সে একবার। কোথাও আবেগের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ঐ তো কর্ণারটায় বসে ডক্টর সায়ান কিছু ফাইলপত্র চেকআপ করছে। এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে নিতেই পেছন থেকে হৈমন্তী ফিসফিস আওয়াজে বলে উঠে,
– “কি ব্যাপার? এইখানে তো তোর ডাক্তার মশাইয়ের কোনো খোঁজ ই নাই। তয় কি সত্যি সত্যিই তুই তোর ডাক্তার মশাইরে হারাইয়া ফেললি উপমা?”
হৈমন্তীর কথা কর্ণগোচর হতে দেরী কিন্তু উপমার আঁতকে উঠতে দেরি নেই। ভীতি দৃষ্টে হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলে উঠে,
– “না এইরকম হইতে পারে না। ডাক্তার মশাই তো শহরে যাওয়ার আরো দুইদিন বাকি। এত তাড়াতাড়ি তিনি কিভাবে যাইতে পারে? আর আমার বিশ্বাস আমারে না জানাইয়া সে কোথাও যাইব না।”
উপমার চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। এই বুঝি তার ডাক্তার মশাই কে হারিয়ে ফেলবে। তার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে কোনো পুরুষালি কন্ঠে ডাক পড়ে।
– “আপনারা? এখানে?”
তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে তাকায় উপমা। এ তো ডাক্তার সায়ান। ডক্টর সায়ানকে দেখে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা হৈমন্তী সজাগ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “এইখানের আরেকজন শহুরে ডাক্তার কোথায়? নামটা যেন কি? হ্যাঁ, ডাক্তার আবেগ; তারে তো দেখতে পাইতেছি না।”
উপমাও উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সায়ানের দিকে তার উত্তর জানার আশায়। সায়ান ও বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “ডক্টর আবেগ? সে তো এখানে নেই। ইভেন আর আসবেন ও না। তিনি তো কাল রাতেই ঢাকার ট্রেনে ব্যাক করেছেন।
এমনিতে কোনো প্রয়োজন ছিল? উনি ছাড়াও এখানে আরো বেশ কয়েকজন ডক্টর রয়েছে। আপনারা চাইলে তাদের দিয়ে চেকআপ করাতে পারেন।”
সায়ানের বলা শেষোক্ত কথাগুলো কর্ণপাত হয় না উপমার। তার পূর্বেই সে থমকে গিয়েছে। চারপাশ কেমন যেন বর্ণহীন শূন্য শূন্য লাগছে। উপমাকে আবেগের ইনফরমেশন দিয়ে পুনরায় ভেতরে চলে যায় সায়ান। অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত আশ্চর্যিত হওয়ায় শরীর ভারবিহীন হতে থাকে ক্রমশ উপমার। এ কি বললো ডক্টর সায়ান? আবেগ চলে গিয়েছে? কিন্তু কেন? তাকে একটি বারও বলে যেতে পারল না? অসাড় শরীর নিয়ে ক্যাম্পের দরজা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে যায় উপমা। হৈমন্তী ও দ্রুত পিছু নেয় তার। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বাইরে ভাঙা মোটা ডালটার উপর চুপচাপ বসে পড়ে উপমা। সবটা এখনও কেমন যেন ঘোরের মতো লাগছে।
– “দেখলি তো, আমার কথাই সত্য হইলো। বলছিলাম তোরে শহুরে ডাক্তারের অভিমান ভাঙা, নাইলে নিজের মনের কথা বইলা দে গিয়া। এখন তো চইলাই গেল সে সবকিছু ছাইড়া। রাখতে পারলি না তারে আটকাইয়া। কি হইত যদি বইলা দিতি সবটা তারে?”
হৈমন্তীর কথা কর্ণপাত হলেও তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই উপমার মাঝে। আবেগ কি আসলেই তার কাছে আর নেই? তবে কি আর কোনোদিনই পাওয়া হবে না তাকে? বলা হবে না তাকে মনে জমে থাকা অনুভূতির কথা?
৩৬.
– “উপমা হইলো এই খেলার মূল গুটি। তয় যদি এই খেলায় উপমা কোনো হেরফের করে তয় অয়ন্তিকার মতোন ওরেও দুনিয়া থেইকা সইরা যাইতে হইব।”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠেন ইফতেখার সাহেব। অন্যদিকে ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করেন আমেনা বেগম এবং সজল। ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে তো মনে হচ্ছে কোনো অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে।
– “কিন্তু উপমা যদি তার আগেই সুযোগ বুইঝা অফিসাররে সব কইয়া দেয়?”
সজলের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে তাকান ইফতেখার সাহেব। চাহনি তার ক্ষিপ্ত, হিংস্র। চাপা কন্ঠে প্রত্যুত্তরে বলে উঠেন,
– “পারব না কইতে! তার আগেই উপমা নিশ্চিহ্ন হইয়া ধুলায় উইড়া যাইব।”
ইফতেখার সাহেবের কথায় শুকনো ঢোক গিলেন আমেনা বেগম। এ তো দেখি ভয়ঙ্কর কিছুর পূর্বাভাস।
নৌকার পাটাতনে বসে সামনের বিশাল জলরাশির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপমা। হাতে থাকা ছোট ছোট নুড়ি পাথরগুলো বিশাল জলরাশির মাঝে ছুড়ে মারতেই তা মিলিয়ে যাচ্ছে অতলে। হৈমন্তী ও ছিল এখানে। কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই হৈমন্তীর বড় ভাই আসায় তার সঙ্গে বাধ্য মেয়ের মতোন চলে গিয়েছে সে। আজ দিনটাই কেমন যেন অগোছালো, বিষাদময় লাগছে উপমার নিকট।
“দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।
দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।
বাঁধন-বিহীন সেই, যে বাঁধন অকারণ;
মায়াবন বিহারিনী।
মায়াবন বিহারিনী হরিণী
গহন-স্বপন-সঞ্চারিণী,
কেন তারে ধরিবারে; করি পণ অকারণ।
#মায়াবন_বিহারিণী ।”
হঠাৎ করেই সুর তোলে উপমা। গলা ধরে আসছে ক্রমশ অজান্তেই। চোখ দুটোও অশ্রুসিক্ত। এই বুঝি বিরহের বেদনা?
– “কেন ডাক্তার মশাই? কেন ছাইড়া চলে গেলেন আমায়? আমি ঠিকই বলছিলাম, চাইলেই কাউরে মায়ার বাঁধনে আটকান যায় না।”
একা একাই বিড়বিড় করে বলে উঠে উপমা। নিস্তব্ধ কোলাহলহীন প্রকৃতি। একটু পরেই ঘোর অমানিশা নেমে আসবে ঐ আকাশে। মৃদু কোলাহলহীনতার মাঝেই কারো আগ্রাসী কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হয় উপমার।
– “আর আমি যদি বলি চাইলেই কাউকে নিজের মায়াতে আটকানো যায়? চাইলেই তাকে নিজের করে সারাজীবনের জন্য রাখা যায়?”
পিলে চমকায় উপমা। তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকায় সে। এটা কি কোনো কল্পনা নাকি পুরোটাই বাস্তব? ছুঁয়ে দিলে তা কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে যাবে না তো?…………………
#চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন।)