#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ষোড়শ_পর্ব
৪০.
রুমের মধ্যে সেই কখন থেকেই এসে বিছানায় এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে উপমা। ভয়ে আর আতংকে শরীর বারবার কেঁপে উঠছে। সেই দৃশ্য, সেই রক্ত মাখানো দা এর কথা মনে পড়তেই গা শিউরে ওঠে তার। উপমার এমন পরিবর্তিত করুণ অবস্থা পরিলক্ষিত হতেই পূর্ণা দ্রুত এগিয়ে যায় উপমার নিকট। বেশ কয়েকবার এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটে না উপমার মাঝে। হঠাৎ কাঁধে জোরে ঝাঁকুনি পড়াতে হকচকিয়ে উঠে উপমা। ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। সামনে মাথা তুলে তাকাতেই খেয়াল করে পূর্ণা তার দিকেই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
– “কি হইছে বুবু? তোর মুখখানা এমন শুকাইয়া গেছে ক্যান? একটু আগেও তো সব ঠিক ছিল। আর তুই এমন দরদর কইরা ঘামতেছিস ক্যান?”
আসলেই তো। পুরো শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে গিয়েছে উপমার। কি করে পূর্ণাকে বলবে যে একটু আগে ঠিক কি দেখে এসেছে সে? আজ এতগুলো বছর পর অয়ন্তিকার মৃত্যুর এত বড় একটা বিষয় খোলাসা হওয়ার মতো ঘটনার সম্মুখীন হতেই অনেকটাই শক খেয়েছে সে। আর অন্যদিকে ইফতেখার সাহেব এসব কিছু জানা সত্ত্বেও ঠিক এমন ভাবখানা ধরে বসে আছেন যেন এর কোনোকিছুই তিনি জানেন না। অথচ এসব করার পেছনে ইফতেখার সাহেবের হাত যে আছে সেটা খুব ভালো করেই জানে উপমা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে না এখনি সবটা পূর্ণাকে সবটা জানানো যাবে না।
এমনিতেই ইফতেখার সাহেব আর আমেনা বেগম মোটেও সুবিধার নয়। যখন নিজের স্বার্থের জন্য অয়ন্তিকাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে তাকে এতিম করে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি তখন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই যে তাকে আর পূর্ণার কোনো ক্ষতি করবেন না ইফতেখার সাহেব। তার এই সব অপকর্ম ফাঁস করতে হলেও সুনির্দিষ্ট কিছু প্রমাণ প্রয়োজন আর এ সময়ে এসব প্রমাণ যোগাড় করতে একজনই সহায়তা করতে পারে উপমাকে; অফিসার আমান!
ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। রুমের মধ্যে জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। চোখে ঘুম নেই তার। কালকের দিনের মধ্যে যা করার তাই করতে হবে। জল বেশিদূর গড়িয়ে পড়লে নিজেরই বিপদ। তখনই বাইরে থেকে ইফতেখার সাহেবের কর্কশ কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই পিলে চমকে উঠে উপমা। এমন অসময়ে তাকে হাঁক ছেড়ে ডেকে পাঠানোর কারণ খুঁজে পায় না সে। আচ্ছা একটু আগেই যে সে ইফতেখার সাহেবের রুমে গিয়ে তল্লাশি করেছে তা কোনোভাবে টের পাননি তো তিনি? ভাবতে ভাবতেই গলা ক্রমশ শুকিয়ে আসে উপমার। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বার ডাক পড়ে গিয়েছে ইফতেখার সাহেবের। আমেনা বেগম ও একই সুরে ডেকে যাচ্ছেন। ঘুমন্ত পূর্ণাও যেন ধড়ফড় করে উঠে পড়ে বিছানা হতে।
সদর দরজায় কড়া নাড়তেই এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দেয় উপমা। বাইরেই আমেনা বেগম সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। উপমার দরজা খুলতেই তার মুখ ছুটে।
– “কি রে মুখপুড়ি; কানে কি তালা মাইরা বইসা আছোস? সেই কখন থেইকা তোর বাপে হাঁক পাইড়া ডাকতেছে। নবাবজাদীর মতোন ধীরে সুস্থে উঠতেছিস যেন কানেই শুনিস না।”
উপমার আর মন চাইল না আমেনা বেগমের বলা কড়া কথাগুলোর জবাব দিতে। তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতেই চোখ পড়ে ইফতেখার সাহেবের উপর। বারান্দায় মোড়া পেতে তামাক খেতে ব্যস্ত তিনি। এমন সময়ে উপমা সামনে এসে উপস্থিত হতেই মাথা তুলে তাকান ইফতেখার সাহেব।
– “আইজকাল দেখতেছি তোর পাখ একটু বেশিই গজায় গেছে। সারাদিন বাড়ির বাইরে এদিকে সেদিকে, ক্যাম্পে কিসের কাম? আর শুনলাম হৈমন্তীর ভাই আমজাদ নাকি তোগোর লাইগা বড় পড়াশোনার ফরম আনছে? তয় কান খুইলা শুইনা রাখ তুই শহর ক্যান এই গ্রাম তন ই বাইর হইতে পারবি না। শুধু তখনই বাইর হইবি যখন এই বাড়ি থেইকা তোর বিয়ার পালঙ্ক যাইব।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে চোখ দুটো ভারী হতে শুরু করে উপমার। ভাগ্যের কি এমন চক্র যে আজ তাকে এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সামনে থাকা মানুষটির সামনে দুর্বল হলে চলবে না।
৪১.
– “তোমার কাছে এইসবের জবাবদিহিতা দিতে আমি বাধ্য না যে সব তোমারে কইতে হইব। আর রইলো আমার পড়ালেখার কথা? তাইলে শুইনা রাখ আমি আমার স্বপ্নের মধ্যে কোনো সম্পর্ক মানব না। আমার পড়ালেখাও হইব আর স্বপ্ন ও পূরণ হইব। তাতে বাধা দিতে যাইয়া নিজের বিপদ ডাইকা আনবেন না আশা করি।”
উপমার তীক্ষ্ণ প্রশ্নোত্তর। ইফতেখার সাহেব কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উপমার দিকে। বৈশিষ্ট্য, কথাবার্তা, চালচলন ইত্যাদি দিক থেকে যেন দ্বিতীয় অয়ন্তিকা। আর অয়ন্তিকার এমন কিছু বোকামির জন্যই তাকেও প্রাণ হারাতে হয়েছে। এখন সেই পুনরাবৃত্তি যাতে উপমার সাথেও না ঘটে তাই মনে মনে চিন্তা করেন ইফতেখার সাহেব।
উল্টো মুখে ঘরের দিকে পুনরায় চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইফতেখার সাহেব পুনরায় গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠেন,
– “দাবা গুটির খেলায় নিজের অপর খেলোয়াড়ের কৌশলরে ভুল কইরাও দুর্বল ভাইবা তুচ্ছ করন লাগে না বুঝলি উপমা? যদি প্রাণে বাঁচতে চাস তাইলে সবকিছু আমার মোতাবেক চলতে হইব আর না হইলে সেই বাড়ির পেছনের নর্দমা আবার ও রক্তাক্ত হইব। তয় এইবার সেইখানে অয়ন্তিকার জায়গায় থাকব অন্য কেউ। হয় তুই আর না হয় পূর্ণা।”
পা দুটো থমকে যায় সেখানেই উপমার। পুরো শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ইফতেখার সাহেবের আচরণ দেখে না যতটা অবাক হচ্ছে তার চেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে তার কথা শুনে। কি নিদারুণ ভাবে সে তার স্ত্রীর হত্যার বর্ণনা দিয়ে চলেছে; তার উপর দ্বিতীয়বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার হুমকিও দিচ্ছে! ভাবা যায় এসব? ক্ষমতার লোভে নিজ সন্তানকে ও হত্যা করতে বোধহয় পিছপা হবেন না তিনি।
না এভাবে চলতে দেয়া যাবে না। পূর্ণা আর তার উভয়ের জীবনই এখন সংকটে আছে। আর যতদূর বোঝা যাচ্ছে তার এ লড়াই খুব একটা সহজ হবে না। আচ্ছা ইফতেখার সাহেবের মুখোশ সে সবার সামনে টেনে খুলতে পারবে তো? অন্যদিকে দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনে নেয় পূর্ণা। বারো বছর বয়সী মেয়েটার মনেও বাবা নামক শব্দটার প্রতি একরাশ ভয় আর ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। আর এক পা ও দাঁড়ায় না উপমা সেখানে। দ্রুত বড় বড় পা ফেলে রুমের দিকে চলে যায় সে; যা পরিলক্ষিত হতেই মৃদু হাসেন ইফতেখার সাহেব যার অর্থাৎ তার তৈরি করা পরিকল্পনা সঠিক ভাবেই এগোচ্ছে।
৪২.
বারান্দায় বিনা বিরতিতে একপাশ থেকে অন্যপাশে হেঁটে চলেছে আবেগ। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ চোখে ঘুমের রেশ নেই বললেই চলে। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অস্থিরতা বিরাজ করছে। কিন্তু সেটার কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পায় না সে। তার ক্রমশ হাঁটার মাঝেই ছেদ পড়ে ডক্টর সায়ানের কথা শুনে।
– “কি ব্যাপার ডক্টর আবেগ? আজ আপনাকে একটু বেশিই স্ট্রেসড দেখাচ্ছে। কেন প্রেমিকাকে নিজের মনের কথা বলতে গিয়ে ব্লাড প্রেশার আবার হাই হয়ে যায় নি তো?”
লাস্টের বাক্য কিছুটা মজার ছলেই বলে উঠে ডক্টর সায়ান। আবেগ ও মৃদু হাসে তার কথায়। অতঃপর মাথা খানিকটা চুলকে ইতস্তত স্বরে বলে উঠে,
– “আসলে আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না ডক্টর সায়ান। ঘুম আসছিল না তাই একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম।”
আবেগের কথায় সায়ান না হেসে পারে না। অতঃপর আবেগের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠে,
– “আরে ইয়াং ম্যান ডোন্ট ওয়ারি! এমনটা হয় এসময়। প্রেমে পড়লে সারাদিন ভেতরে অস্বস্তি লাগবে, প্রেয়সীকে চারপাশে অনুভব করবেন সবসময়। তবে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
আবেগের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করে সায়ান। আবেগ ও কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই সেখানে রাখা ইজি চেয়ারটাতে বসে পড়ে এবং বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যেন প্রকৃতির রূপ অতি দ্রুতই পরিবর্তন হতে চলেছে।
কাকডাকা ভোর। চারপাশে সবে মাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। চোখে কিছু টা আলোর রেশ এসে লাগতেই চোখ দুটো পিটপিট করে তাকায় উপমা। মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করে উঠেছে। গত রাতে শেষের দিকে কখন যে চোখ জোড়া লেগে এসেছিল তা খেয়াল নেই তার। অন্যদিকে বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে পূর্ণা। একপলক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে পড়ে উপমা। জানালার এক প্রান্ত অতি সন্তর্পণে খুলে উঠোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাজ নিয়ে আজও বেশ কয়েকজন বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে। হয়তো বা দু তিন দিনের মধ্যেই তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন। আর এসব কাজে ইফতেখার সাহেব ব্যস্ত থাকায় উপমার করা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটু বেশিই সুবিধা হবে। দ্রুত গোছগাছ করে রুম থেকে বাইরে বের হতে যাবে তখনই চোখ পড়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা ডায়েরির উপর। এটা তো গতরাতে টেবিলের ভেতরে রাখাই হয়নি। কেউ দেখে ফেললে সে আবার এক বিরাট সমস্যা।
দ্রুত সেটা টেবিলের উপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সবার লোকচক্ষুর আড়ালে। যে করেই হোক আজ সবটার হিসেব নিকেশ করতেই হবে।
– “এই একমাত্র ক্ষমতার লোভই আপনার ভরাডুবির কারণ হইব চেয়ারম্যান সাহেব।”
ইফতেখার সাহেবের দিকে একপলক তাকিয়ে বিড়বিড় করে উপমা। অতঃপর আড়ালেই বেরিয়ে পড়ে চৌকাঠের ওপারে।…………..
#চলবে 🖤