#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বিতীয়_পর্ব
৪.
– “আমি এই বিয়ে করতে পারব না আব্বা।”
উপমার দৃঢ় কন্ঠে বলা কথাটা মুহূর্তেই ইফতেখার সাহেবকে চুপ করিয়ে দিতে সক্ষম হলেও পেছনে থাকা বর বেশে দাঁড়িয়ে থাকা রফিক সাহেব একপ্রকার গর্জে উঠলেন।
– “চেয়ারম্যান সাহেব! এইসব কি তামাশা হইতাছে? কথা তো ছিল কোনো প্রকার তামাশা হইব না। তয় আপনে কি আপনার দেয়া কথা ভুইলা গেছেন? মনে রাইখেন, আপনার দেয়া কথার হেরফের হইলে সবকিছু বদলাইয়া যাইতে পারে।”
রফিক সাহেবের কথা শুনে ইফতেখার সাহেবের দুশ্চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হলো। একরাশ ভীতি নিয়ে বড় বড় পায়ে এগিয়ে গিয়ে রফিক সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
– “না, না আপনি কোনো চিন্তা করবেন না জামাই বাবু। আমি আমার দেয়া কথা ভুলি নাই। আপনের বিয়া উপমার লগেই হইব। উপমা ছোট মানুষ; হয়ত ভুলভাল কিছু বইলা ফেলছে। আপনি ভুল বুঝবেন না, বাবু।
আমেনা, এই আমেনা এহনো দাঁড়াইয়া আছো কেন? উপমারে তৈরি কইরা নিয়া আসো; বেলা যে গড়াইয়া যাইতাছে। হাতে সময় নাই।”
ইফতেখার সাহেব বেশ চড়া গলায় আমেনা বেগমকে তাড়া দিতেই আমেনা বেগম উপমার হাত শক্ত করে ধরে ভেতরে অগ্রসর হওয়ার জন্য পা বাড়ান। এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা মুখ বুজে সহ্য করলেও ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে তড়িঘড়ি করে নিজের হাত আমেনা বেগমের কাছ থেকে ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে কয়েক পা সরে আসে উপমা। তাকে পেয়েছে টা কি? সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে বলে একজন বয়স্ক লোকের কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়ার কথাটাও সহ্য করে নিবে।
– “ব্যাস, অনেক হইছে! আমি তো বলতেছি আমি এই বিয়ে করব না।
আর বিয়া বলতেছি কেন? এইটা তো কোনো বিয়ে না। আপনারা সবাই মিলে আমারে এই লোকটার কাছে বিক্রি করে দিতেছেন; ঠিক যেমন করে সারাবছর লালন পালন করা গরু ছাগল হাঁটে বিক্রি করে দেয়।”
এটুকু বলেই থামে উপমা। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ইফতেখার সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “আব্বা আপনি এইটা কি করে করতে পারলেন আমার সাথে? আমি তো আপনাকে আমার সব ভাবছিলাম কিন্তু আপনি আমারে এতটাই দু চোখের বিষ মনে করেন যে আমারে না জানাইয়া অন্য একটা লোকের কাছে বিক্রি করে দিতেছেন? আমি কি দোষ করছিলাম আব্বা যে আমার সাথে আপনি এমন করলেন! আমি কি বোঝা হয়ে গেছিলাম আপনার কাছে?”
কথাগুলো বলতে বলতে গলা বারবার কেঁপে উঠছিল উপমার। চোখ দুটোও অশ্রুসিক্ত। আশপাশের লোকজন অবাক চোখে উপমা আর চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গ্রামের প্রায় বেশিরভাগ মানুষই উপস্থিত দৃশ্য উপভোগ করছে।
– “হ ঠিকই বলছিস তুই! তোরে আমি বেইচা দিতেছি। আর দিবই না কেন? তোরে বিক্রি কইরা দেওনের বিনিময়ে রফিক সাহেব আমারে মোটা অংকের টাকা দিব। তোরে রাইখা লাভ কি আমার? ঘাড়ের উপর বইসা বইসা তো অন্ন গিলতেছিস; তোর মা মরনের পর থেইকাই তো আমার ঘাড়ে চাইপা বইসা আছিস। ভাবছিলাম মা মরণের পর তোকে ও বিদেয় দিয়ে দিব; কিন্তু ভাগ্যের চাকা এমনভাবে ঘুইরা গেছে সেই সুযোগ হাতছাড়া করি কইরা? এহন চুপচাপ এই বিয়ের পিঁড়িতে বইসা পড়। আমাকে কিছু করবার জন্যে বাধ্য করিস না উপমা; আমি আবার এক কথার মানুষ।”
রুক্ষ কন্ঠস্বর। চারপাশের পরিবেশ নিস্তব্ধ কোলাহলহীন। ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে ঠিক এমনই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। উপমার তো পায়ের তলা দিয়ে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম। তবে কি অয়ন্তিকার বলা কথাটাই কি সত্যি ছিল? একটা লোক কি করে এতটা জঘন্য হতে পারে?
৫.
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে আমেনা বেগম ও উপমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাকালেন। এদিকে বেশ ক্রোধ নিয়ে উপমার দিকে ইফতেখার সাহেব তেড়ে আসতে নিলে উপমা বরাবরের মতই হাত উঁচু করে কর্কশ গলায় বলে ওঠে,
– “ওখানেই থেমে যান চেয়ারম্যান সাহেব! ভুল কইরাও আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। অনেক সহ্য করছি। ছোটবেলায় ভাবছিলাম হয়তো আমার কপাল ই খারাপ; যার জন্য কোনোদিন জন্মদাতা পিতার ভালোবাসা পাই নাই। মায়ের মৃত্যুর সময় ও আমার ভাবনা পাল্টায় নাই। কিন্তু আপনার এই ভন্ডামি ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে চাপা পইড়া ছিল। যা আজ সবার সামনে আইসা পড়ছে। আমাকে বাধ্য করবেন না এমন কিছু করার জন্য যার জন্যে আপনারে সারাজীবন পস্তাইতে হয়!”
এগোতে গিয়েও থেমে যায় ইফতেখার সাহেব। উপমার কথা যেন তার ঠিক হজম হয় নি। সে তো ভেবেছিল ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে তার কথামতো বিয়ের পিঁড়িতে চুপচাপ বসে পড়বে উপমা। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। আর উপমা কিসের কথার হুমকি দিচ্ছে তাকে?
– “কি করবি তুই মুখপুড়ী? তোর সাহস তো কম না মুখের উপর তর্ক করিস; কি করবি তুই হ্যাঁ? কাজী সাহেব! আপনি বিয়া পড়ানো শুরু করেন।”
আমেনা বেগমের দৃঢ় কন্ঠ শুনতে পেলেও তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটল না উপমার মাঝে।
– “কি হবে সেটা না হয় আমাদের উপরই ছেড়ে দেন চেয়ারম্যান সাহেব। বাকিটা আমরাই যাচাই-বাছাই করে নেব!”
পেছন থেকে কারো পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই উপস্থিত সবাই সেই কন্ঠস্বর অনুসরণ করে পেছনে তাকায়। বিয়ে বাড়ির সদর দরজায় আইনের পোশাক পরিধান কারী পুলিশ অফিসার আমান সাহেবকে দেখতে পেয়ে ইফতেখার সাহেব, রফিক সাহেব, আমেনা বেগম সহ কাজী সাহেবের চেহারাতেও দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠতে শুরু করে। কাজী সাহেব তো ইতিমধ্যে দলিল, কাগজপত্র গুছিয়ে পোঁটলা বেঁধে নিয়েছেন। রফিক সাহেবের ও প্রায় পালাই পালাই ভাব। ইফতেখার সাহেব কোনোমতে আড়চোখে আমেনা বেগমকে ইশারা দিতেই তিনি দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেন।
– “আরে পুলিশ সাহেব আপনে? হঠাৎ আমার বাড়ি আসার কথা মনে পড়লো! তা বাইরে দাঁড়ায় আছেন ক্যান? ভেতরে আহেন।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে আমান সাহেব ভেতরে প্রবেশ করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন। যাক তাহলে তার কাছে পৌঁছানো তথ্য মিথ্যে ছিল না।
– “কি ব্যাপার চেয়ারম্যান সাহেব। বাড়ির সাজসজ্জা তো স্পষ্ট বলে দিচ্ছ কারো বিয়ে। তা আমার জানামতে এ বাড়ির বড় মেয়ের বয়স তো সবে মাত্র ষোল বছর। তবে কি লুকিয়ে লুকিয়ে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে গ্রামের চেয়ারম্যান হয়েও অপকর্ম করছেন? নাকি দালালি নামক অপকর্মকে বাল্যবিবাহ নামক অপকর্ম দিয়ে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন চেয়ারম্যান সাহেব?
ঠিক বলেছি না কাজী সাহেব?”
অফিসার আমানের প্রশ্ন শুনে গলা শুকিয়ে আসে ইফতেখার সাহেবের। ব্যাপারটা বেশ ধোঁয়াশা রাখার জন্য মিনমিনে করে বলে উঠেন,
– “আরে সাহেব কি বলেন এইসব? আপনি হয়তো ভুলভাল কিছু শুনছেন; কিসের বাল্যবিবাহ? আর কিসের দালালি? আর উপমার যথেষ্ট বয়স হইছে তাই তার মঙ্গল কামনা কইরা আমি আমার মেয়ের সঙ্গে সুপুত্রর বিয়ে দিমু ঠিক করছি। কি ঠিক বলছি না, কাজী সাহেব?”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে কাজী সাহেব ও মাথা নাড়ায়। পুলিশ বাহিনীর আড়াল থেকে পূর্ণা চুপিচুপি এসে উপমার পাশে এসে দাঁড়ায়। চোখের ইশারা দিতেই উপমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ভাগ্যিস সঠিক সময়ে পূর্ণা বাড়ির পেছনের আমবাগান দিয়ে চলে গিয়েছিল না হলে আজ এমন একটা ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো তা ধারণার বাইরে ও ছিল উপমার।
৬.
– “ডক্টর আবেগ, আপনার ট্রান্সফারের ফাইলে সব ইনফরমেশন দেয়া রয়েছে। ইউ ক্যান চেক ইট নাও। বাই দা ওয়ে, আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।”
সদ্য কেবিনে প্রবেশ করে গলায় থাকা ঝুলন্ত স্টেথোস্কোপটা টেবিলের উপর রাখতে যাচ্ছিল আবেগ। তখনই পেছন থেকে সিনিয়র ডক্টর ঈশান মির্জার কথা কর্ণকুহরে পৌঁছায় তার। পরনে সাদা অ্যাপ্রন, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। আলতো করে ঘাড় বাঁকা তেই ডক্টর ঈশানের মুখশ্রী চোখে পড়ে তার।
– “ডক্টর ঈশান, আপনি? প্লিজ কাম ইন এন্ড থ্যাংকস ফর ইউর হেল্প।”
বলেই হাত বাড়িয়ে ডক্টর ঈশানের কাছে থাকা ফাইলটা নিয়ে নেয় আবেগ। বেশ কিছু প্রয়োজনে আবেগ সহ হসপিটালের আরো কয়েকজন ডক্টর দের দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হবে। সেই সুবাদে আবেগকে ও হসপিটালের আন্ডারে যেতে হবে।
– “এই ট্রেনিং থেকে ফিরে আসলেই আপনার জন্য গুড নিউজ রয়েছে ডক্টর আবেগ। আই হোপ ইউ উইল ডান ইউর ওয়ার্ক প্রোপার্লি!”
ডক্টর ঈশানের কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ। তার কথার মানে কি? একটা নিউজ শোনার জন্য তাকে এতটা সময় ওয়েট করতে হবে? ইম্পসিবল! লাইফে যদি কোনো বিষয়ের প্রতি তার খুব বেশি বিরক্তি থাকে তবে সেটা হলো ধৈর্য। এই একমাত্র জিনিসটার প্রতি প্রবলভাবে বিরক্ত। তবুও খুব কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ডক্টর ঈশান পুনরায় বলে ওঠে,
– “Okay then see you soon after your twenty days journey, doctor Abeg!”
ডক্টর ঈশান কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবেগ। তার এই ডাক্তারি লাইফের জার্নি বড়ই অদ্ভুত। কি আর করার? একবার যেহেতু ডাক্তার নামক এত বড় দায়িত্ব গলায় থাকা স্টেথোস্কোপের মত ঝুলে পড়েছে সেহেতু পালন তো করতেই হবে।
হাতে থাকা ফাইলটা টেবিলের উপর রাখতে গিয়েও থেমে যায় আবেগ। ইনফরমেশন গুলো আবারো চেক করার জন্য ফাইল খুলতেই সেখানে থাকা গুটিগুটি অক্ষরে লিখা গন্তব্যের নাম চোখে পড়ে তার। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে বসে,
– “ত্রিমোহিনী! কোয়াইট ইন্টারেস্টিং!”
নামটা উচ্চারণ করে মৃদু হাসে আবেগ; যেন নামটা বেশ আকর্ষণীয় তার নিকট।………………
#চলবে 🍂
(কেমন লেগেছে আজকের পর্ব জানাবেন।
হ্যাপি রিডিং।)