#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#তৃতীয়_পর্ব
৭.
মানুষ দিয়ে পরিপূর্ণ উঠোন ধীরে ধীরে জনশূন্য হতে শুরু করেছে। পশ্চিমা আকাশেও সূর্যের ঢল নামবে খুব শীঘ্রই। উঠোনের ঠিক মাঝখানে মোড়া পেতে বসে আছেন ইফতেখার সাহেব। দৃষ্টি তার মাটিতে স্থির। মুখশ্রীতে তার চাপা রাগ স্পষ্ট। কোনো কিছুর ক্ষোভে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। তার তৈরি পুরো পরিকল্পনা এভাবে ভেস্তে যাবে কল্পনাও করে নি সে। তার বানানো পরিকল্পনা এভাবে উপমার জন্য ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছে ভাবতেই রাগের পরিমাণ তীব্র হয় তার।
একটু আগের ঘটনা,
– “গ্রামের প্রধান হয়েও এমন কাজ কিভাবে করতে পারলেন আপনি চেয়ারম্যান সাহেব? এখন আপনি সত্যটা মুখ খুলে বলবেন নাকি আমরা আমাদের আইন প্রয়োগ করে সেটা বের করে নেব? ভুলে যাবেন না পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না।”
অফিসার আমানের কথায় থতমত খেয়ে ইফতেখার সাহেব বেশ ইশপিশ করতে শুরু করলেন। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আড়চোখে উপমার দিকে তাকান তিনি। গলা শুকিয়ে আসছে ক্রমশ এই ভয়ে যদি উপমা মুখ ফসকে কিছু বলে দেয় তাহলে? অন্যদিকে রফিক সাহেব সহ কাজী সাহেব দুজনেই খুব সাবধানে এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বাড়ির প্রধান দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। উদ্দেশ্য সুযোগ পেলেই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে উপস্থিত জনসভা থেকে পলায়ন করা। উপমা একবার চোখ তুলে ইফতেখার সাহেবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তার মুখে সবকিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। না আর দুর্বল হলে চলবে না। ইফতেখার সাহেব যে ষড়যন্ত্র রচনা করেছেন তার বিরুদ্ধে এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগাতে হবে।
অফিসার আমান সরু দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই উপমার কাটকাট গলায় প্রত্যুত্তর,
– “আপনার প্রতিটা কথাই সত্য অফিসার সাহেব। আপনি যা দেখছেন তার সবটাই সত্যি। তয় আমি এই বিয়ে করবার চাই না। আমি আরো বড় হইতে চাই; অনেক পড়বার চাই।”
এটুকু বলে থামে উপমা। ইফতেখার সাহেব বেশ ঘাবড়াচ্ছেন। তার মানে কি উপমা সব বলে দিবে অফিসারকে? তার এত বড় পরিকল্পনা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে? না, না এ কি করে সম্ভব? তার এসব চিন্তাভাবনার মাঝে তাকে অবাক করে দিয়ে উপমা বলে ওঠে,
– “কিন্তু এইখানে আব্বার কোনো দোষ নাই অফিসার। আব্বা এইসব করছে একমাত্র রফিক সাহেব আর কাজী সাহেবের কথায় আইসা। যদি কেউ দোষ কইরা থাকে তা হইলো রফিক সাহেব আর কাজী সাহেব।”
উপমার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন ইফতেখার সাহেব। উপমা মিথ্যে বলছে কেন? উপমা তো চাইলেই সব বলে দিতে পারত। তবে কি উপমা তার ভয়ে অফিসারকে কিছু বলেনি? যাক ভালই হয়েছে। অন্যদিকে উপমার কথা শুনে ভয়ে উপস্থিত মানুষ জনের আড়ালে রফিক সাহেব আর কাজী সাহেব পালাতে নিলেই তড়িৎ গতিতে দুজনকে আটক করে নেয় কনস্টেবল আলী আর ভুঁইয়া।
অফিসার আমান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় উপমার দিকে। উপমা কি সব সত্যি বলছে নাকি কিছু লুকাচ্ছে? কিছু একটা ভেবে বেশ গম্ভীর মুখে তিনি বলে উঠেন,
– “আচ্ছা ঠিক আছে। তবে প্রয়োজন পড়লে আমি আবারও আসব। আর হ্যাঁ চেয়ারম্যান সাহেব, তদন্ত করার পর উপমার জবানবন্দির ঠিক উল্টো কোন তথ্য আসে তাহলে কিন্তু আপনি আইনের হাত থেকে পার পাবেন না। আজকের পর থেকে আমার বিশেষ নজর আপনার ওপর থাকবে। আসি তাহলে।”
বলেই পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করেন অফিসার আমান সহ বাকি সব পুলিশের সদস্য।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উপমা। তার জীবনের লড়াইয়ে একধাপ পার করে ফেলেছে সে। উপস্থিত মানুষ জনও একে একে কানাঘুষা করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে।
৮.
সবাই চলে যেতেই ইফতেখার সাহেব উপমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকান। রাগে ক্ষোভে এগিয়ে গিয়ে থাপ্পড় দেয়ার উদ্দেশ্যে হাত ওঠাতেই মাথা তুলে তাকায় উপমা।
– “ভুল করেও এই ভুল করবেন না চেয়ারম্যান সাহেব। এই একটা ভুল আপনার পুরো খেলাকে বিগড়ে দিতে পারে। আমি আর আগের উপমা নাই যারে আপনে হাতের পুতুল বানায় রাখবেন। এখন থেকে লড়াই আপনার আর আমার মাঝে।
আর আপনার একটা ভুল পদক্ষেপ; আপনারে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে আমার সময় লাগবে না যতই আপনে আমার জন্মদাতা পিতা হন না ক্যান! আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না পুরা গ্রামের সামনে আপনের কাছ থেইকা আপনার পদবি, সম্মান কাইড়া নিয়ে জেলে পাঠায় দেয়া হোক।”
উপমার শীতল কন্ঠে বলা কথা উক্ত মুহূর্তে বিক্ষত বাঘিনীর মত লাগছিল ইফতেখার সাহেবের কাছে। উপমার এমন পরিবর্তিত রূপ দেখে তিনি বেশ চিন্তিত। হাত নামাতেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ঘরের ভেতরে পা বাড়ায় উপমা। আজকের দিনটা তার অদ্ভুত রঙিন ছিল।
উপমা চলে যেতেই ইফতেখার সাহেব রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে মোড়াতে সজোরে লাথি মারতেই তা ছিটকে পড়ে কয়েক মিটার দূরে।
– “আমার কাজে বাধা দেয়ার ফল ভালো হইব না উপমা। আর তার জন্যে যদি তোরে আমার রাস্তা দিয়া সরায় দিতে হয় তাও করমু আমি।”
ইফতেখার সাহেবের বিড়বিড় করে বলা কথায় যেন গভীর কোনো ষড়যন্ত্র লুকায়িত।
উপমা। পুরো নাম হলো অনিন্দিতা নওরিন উপমা। আপন বলতে মা অয়ন্তিকা ছিল যে চার বছর আগেই মা’রা গিয়েছে অদ্ভুত ভাবে। উপমা প্রায়শই মায়ের মৃত্যুর কারণ চিন্তা করে। এটা কি আদৌও স্বাভাবিক মৃত্যু্ নাকি পূর্ব পরিকল্পিত কোনো ঘটনা। অয়ন্তিকার মৃত্যুর পর পরই ইফতেখার সাহেব দ্বিতীয় বিবাহ করে স্ত্রী হিসেবে আমেনা বেগমকে নিয়ে আসেন এবং তার পর থেকেই শুরু হয় উপমার জীবনের দুরবস্থা। মাত্র ষোল বছর বয়সী উপমার সাথে এত কিছু ঘটে যাবে তা তার কল্পনার বাইরে ছিল।
ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় নয়টা বাজে। বাস স্টেশনে টিকেট কাউন্টারে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তার ই একপাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত আবেগ। একটু আগে বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই মিসেস ইশিতা অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে আবেগকে। পরে একপ্রকার বাধ্য হয়েই মিসেস ইশিতার নাম্বারে ডায়াল করে সে। মিনিট দশেক কথা বলতেই পেছন থেকে ডক্টর সায়ানের ডাক পড়ায় টুক করে কল কেটে দেয় আবেগ।
অপর পাশে থাকা ইশিতা বেগম ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছেলেটা তার এমন অদ্ভুত কেন? বছর পাঁচেক আগেও তো আবেগ এমন ছিল না। কিন্তু হুট করেই আবেগের এমন গম্ভীর হয়ে যাওয়ার বিষয়টা ঠিক তিনি মেনে নিতে পারেননি। অবশ্য এখানে আবেগকে দোষারোপ করা মোটেও ঠিক হবে না; কেননা আবেগের এই পরিবর্তনশীল রূপ তার বাবার কারণেই হয়েছে। ছেলেট কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে।
– “ডক্টর আবেগ, বাইরে বাস এসে পড়েছে। চলুন কাউন্টার থেকে যাওয়া যাক।”
ডক্টর সায়ানের কথায় মাথা নাড়িয়ে লাগেজ নিয়ে হাঁটা শুরু করে আবেগ।
এসি বাসের সিট নাম্বার মিলিয়ে মাঝের দিকটায় গিয়ে বসে পড়ে ডক্টর সায়ান এবং আবেগ। হসপিটাল থেকে ডক্টর সায়ান এবং আবেগকে ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে ঢাকা থেকে বহুদূরে সিলেটের ত্রিমোহিনী গ্রামে। বাসের সিটে বসতেই মাথা এলিয়ে দেয় আবেগ। একটু পরেই হয়তো বাস ছেড়ে দিবে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে হেডফোন গুঁজে নেয় সে। ঢাকা টু সিলেটের এই জার্নিটুকু প্রশান্তির বানাতে পছন্দের প্লেলিস্ট থেকে মিউজিক অন করতেই সেখান থেকে প্রিয় লিরিক্স ভেসে ওঠে,
“আমার কল্পনা জুড়ে,,,,যে গল্পেরা ছিল!
আড়ালে সব লুকোনো!
সেই গল্পেরা সব,,,,,রঙিন হলো পলকে!
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন,,
প্রেম তুমি আসবে এভাবে,,
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি!
আজও আছে সে পথ, শুধু নেই তুমি
বলো কোথায় আছো অভিমানে?(২)
সব থেকেও কি যেন নেই,,
তোমাকে তাই খুঁজে যাই প্রতি ক্ষণে।
আমার ভালোলাগা গুলো সব;
তোমায় ভেবে সাজে রোজ রোজ এ মনে!
প্রেম তুমি আসবে এভাবে,,
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি।
আজও আছে সেই পথ; শুধু নেই তুমি
বলো কোথায় আছো অভিমানে?(২)
(বাকিটুকু নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন।)
৯.
খোলা আকাশে পূর্ণ থালার মতো চাঁদ স্পষ্ট দৃশ্যমান। জানালার গ্রিলের একাংশ দিয়ে সেই চাঁদের আলো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। বিছানায় একপাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে পূর্ণা। আর খাটের সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে উপমা। শাড়ির আঁচলটা মেঝেতে অগোছালো ভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটু আগেই আমেনা বেগমের সাথে বেশ কয়েকদফা কথা কাটাকাটি হলেও ইফতেখার সাহেবের ইশারায় দমে গিয়েছেন আমেনা বেগম। উপমাও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সবাইকে এড়িয়ে চলে এসেছে। ক্ষুধায় পেট চো চো শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। আজকে যে থালে দুমুঠো ভাত জুটবে না সে বিষয়ে খুব ভালো করেই জানে উপমা।
চোখ দিয়ে নোনা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে শরীর লুটিয়ে দেয় উপমা। কখন যে অশ্রুর বদলে ক্লান্তির ঘুম নেমে আসে চোখে টেরই পায়নি সে।
নতুন সূর্যের উদয়। সাথে একটি নতুন দিনের। চারপাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কাঁধে কারো ঝাঁকুনি দেয়ায় চোখ মুখ কুঁচকে পিটপিট করে তাকায় আবেগ। ডক্টর সায়ান কি যেন বলছেন বিড়বিড় করে,
– “আবেগ, গেট আপ কুইকলি। বাস আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে। উই আর ইন ত্রিমোহিনী নাও।”
ত্রিমোহিনী নাম শুনতেই ঝট করে সব ঘুমের রেশ কেটে যায় আবেগের। শেষ রাতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল খেয়াল নেই তার। একে একে করে বাস থেকে বেরিয়ে পড়ে যাত্রীগণ। সাথে আবেগ আর সায়ান ও।
– “ডক্টর আবেগ, এখানে তো একজন লোক থাকার কথা ছিল তাইনা; যে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাবে?”
– “হ্যাঁ, ডক্টর সায়ান। বাট এখানে তো তেমন কাউকে দেখতে পারছি না। হয়তো আমরা একটু আগেই এসে পড়েছি।”
সায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে আবেগ। তখনই পেছন থেকে কারো কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “আপনারা কি শহর থাইকা আইছেন? আপনারা কি শহুইরা ডাক্তার যারা আমগো ক্যাম্পে চিকিৎসা করব?”
আবেগ আর সায়ান মুচকি হেসে সম্মতি দিতেই ভদ্রলোক বেশ সম্মান সহিত দুজনকে নিয়ে রওনা দেয় ক্যাম্পের দিকে। আবেগ ও মনে মনে চিন্তা করে এই ত্রিমোহিনীর যাত্রা যেন বেশ স্মৃতিদায়ক হয় তার কাছে।……………
#চলবে 🍂