#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#অষ্টম_পর্ব
২০.
কথায় আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না। তেমনই মাঝ দিয়ে আরো তিনটে দিন চলে গিয়েছে। সবাই যার যার নিজ ব্যক্তিগত জীবনে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সময় ব্যাতীত করছে। আবেগের সময় কেটেছে বিভিন্ন মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে গবেষণা করার মধ্য দিয়ে। এই তিন দিনের মাঝে খুব একটা বাইরে যাওয়ার অবসর হয়ে উঠেনি তার। ডাক্তারি পেশার এই একটাই বৈশিষ্ট্য নিজের জন্য অবসর সময়টাকে নিজেদের লাইফ ডিকশনারি থেকে বাদ দিয়ে দিতে হয়। আবেগের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হচ্ছে। অন্যদিকে উপমা দুইদিন বিকেলে বাড়ির বাইরে টুকটাক বের হলেও ব্যস্ততায় হৈমন্তীর সাথেও দেখা করেনি। এদিকে পূর্ণারও গা পুড়িয়ে জ্বর এসেছে। বিকেলের দিকে পানি ভর্তি কলস নিয়ে বাড়িতে ফেরার সময় উপমার চোখ পড়ে উঠোনে বসে থাকা ইফতেখার সাহেবের উপর। ইফতেখার সাহেব মোড়ায় বসে নিজ আনন্দে তামাক চিবোচ্ছেন। উপমার দিকে একপলক তাকালেও পুনরায় তামাক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরই মাঝে সদর দরজা দিয়ে হেলেদুলে প্রবেশ করে সজল। সজলকে এমন অসময় বাড়িতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় উপমা। এই সভ্যতা বিহীন মানুষটাকে বাড়িতে কি প্রবেশ করতে দেয় ইফতেখার সাহেব তা ভেবে কুল কিনারা খুঁজে পায় না সে। বহুবার আকার ইঙ্গিতে ইফতেখার সাহেবকে সজলের অপকর্ম সম্পর্কে ধারণা জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করলেও তা বরাবরের মতই উপেক্ষা করে গিয়েছেন ইফতেখার সাহেব; যেন এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই নেই।
সজল উপস্থিত হতেই ইফতেখার সাহেব এবার বেশ নড়েচড়ে বসলেন। তামাকের বাটি টা সরিয়ে একবার উপমার দিকে তাকিয়ে সজলকে আড়ালে ইশারা দিতেই সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে ইফতেখার সাহেবের পেছন পেছন হেঁটে ভেতরের দিকে চলে যায় সজল। তবে যাওয়ার পূর্বে উপমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে যায় যা উপমার চোখ এড়ায় না।
প্রায় একঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। বাড়ির বড় কামরাতে সেই কখন ইফতেখার সাহেব আর সজল প্রবেশ করেছে; কিন্তু এখনো তাদের বের হওয়ার নামগন্ধ নেই। পাশের রুমেই বসে টেবিলের উপর পড়তে বসেছিল উপমা। বেশ কিছুদিন হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার জন্য হৈমন্তীকে দিয়ে আগ থেকেই কিছু বই সংগ্রহ করে নিয়েছিল সে। অপরপাশে খাটের মধ্যে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে পূর্ণা। সকালের দিকেই জ্বর কমে এসেছে। তন্মধ্যে হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ কর্ণগোচর হতেই নড়েচড়ে উঠে উপমা। টেবিল থেকে উঠে দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখে সজল বেরিয়ে পড়েছে কক্ষ থেকে। হাতে একটা ব্যাগ রয়েছে। ইফতেখার সাহেব চারপাশে একবার ভালো করে দৃষ্টিপাত করে নেন এই উদ্দেশ্যে যে কেউ আছে কিনা।
ইফতেখার সাহেব আর সজল বেরিয়ে যেতেই উপমাও পিছু পিছু বের হয়। বারান্দার পাশ ঘেঁষে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পায়ে কিছু অনুভব হতেই থমকে দাঁড়ায় সে। নিচে মেঝেতে তাকিয়ে দেখে সাদা রঙের গুঁড়ো বস্তু সারি দিয়ে পড়ে আছে। কই একটু আগেই তো এ জায়গাটা পরিস্কার ছিল এমনকি সে নিজেই করেছে। তৎক্ষণাৎ নিচে বসে হাতের সাহায্যে সেই গুঁড়ো বস্তু নাকের কাছে নিতেই নাক সিঁটকায় উপমা। কেমন ঝাঁঝালো বিদঘুটে গন্ধ। মাথাও ঝিমঝিম করছে। কিন্তু এই বিদঘুটে গন্ধযুক্ত বস্তু বাস্তবে কি? সিনেমা, নাটকের কথা মনে পড়তেই আতকে উঠে সে। এগুলো কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নাকি আসলেই কোনো নেশা দ্রব্য? আর সেটা হলেও এ বাড়িতে কি করছে? এসবের মধ্যে ইফতেখার সাহেব আর সজলের কোনো যোগসূত্র নেই তো আবার? ব্যাপারটা নিয়ে সেখানেই গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে উপমা।
২১.
সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশের বিশালতা লালিমায় ছেয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। একটু আগেই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছে আবেগ আর সায়ান। ঘরে প্রবেশ করতেই সায়ান চলে গিয়েছে ফ্রেশ হতে। আর আবেগ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার টাই খুলতে ব্যস্ত। হাতে থাকা ঘড়িটা খুলে টেবিলের উপর রাখতেই চোখ পড়ে টেবিলের উপর অযত্নে এককোণে পড়ে থাকা একটা ঝুমকার উপর। ঝুমকাটার কথা তো মনেই পড়েনি এ দুদিনে। ঝুমকাটা আলতো হাতে তুলে নিয়ে মুচকি হাসে আবেগ। মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই চঞ্চল কিশোরীর ডাকনাম,
– “ভ্যাবলা কান্ত মশাই? স্ট্রেঞ্জ বাট ফানি।”
তার ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়ে ফোনের রিংটোনে। ফোনের স্ক্রিনে মা নামটা ভেসে উঠতেই স্মিত হাসে আবেগ। অতঃপর ফোন রিসিভ করে ভাব বিনিময় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দু’পাশে থাকা দুজন ব্যক্তি।
রাত ধীরে ধীরে ঘনিয়ে এসেছে। গ্রাম এলাকায় রাত আটটা বলতেই প্রায় অনেকখানি রাত। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত সাড়ে নটা বেজেছে। আশপাশের বাড়ির মানুষজন অনেকক্ষণ হয়েছে ঘুমিয়ে পড়েছে। খোলা জানালা ভেদ করে চাঁদের আলো ঘরে প্রবেশ করছে। চোখে ঘুম নেই উপমার। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে এসে দাড়াতেই বাইরের দৃশ্য দর্শন হয় তার। মন কেমন যেন ছটফট করছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ বাইরে একটু বেশিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অতঃপর বাড়ির সবার আড়ালে অতি সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে উপমা। এভাবে রাত বিরাতে বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারটা নতুন কিছু নয় তার নিকট। বাইরে বের হয়ে সোজা উত্তর পার্শ্বের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করে উপমা। বিষন্নতা কাটাতে এর চেয়ে ভালো উপায় আর কি হতে পারে? দেখতে দেখতে প্রায় অনেকটাই গন্তব্যে এসে পৌঁছায় সে। চারপাশে স্বচ্ছ পানি চিকচিক করছে চাঁদের আলোয়। নিস্তব্ধ কোলাহলহীন পরিবেশে এগিয়ে গিয়ে নদীর ধারে বসে পড়ে উপমা। চোখ জুড়ে নেমে আসে ক্লান্তির ছায়া।
অন্যদিকে গ্রামের রাস্তায় অন্ধকারে টর্চের আলোতে হেঁটে চলেছে আবেগ। সাথে সায়ান ও ছিল তবে একটু আগেই জরুরি ফোন আসায় অগত্যা বাড়ি যেতে হয়েছে তাকে। রাতের সোডিয়াম আলোতে ঢাকার রাস্তায় হাঁটার অভ্যাসটা বোধহয় এখনো যায়নি আবেগের। তাইতো গ্রামে এসেও সেই একই অভ্যাস রয়ে গিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকদূর ই এসে পড়েছে সে। আশপাশে দূর দূরান্তে কোনো বাড়ির চিহ্ন ও নেই। চারপাশে শুধু সারি সারি ধান ক্ষেত। সামনে যাওয়া টা কি ঠিক হবে? কিয়ৎক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে পুনরায় হাঁটা ধরে সামনের দিকে। মিনিট পাঁচেকের পথ পেরোতেই সেই নদীটা চোখে পড়ে আবেগের যেখানে তার আর সেই চঞ্চল কিশোরীর সাথে দেখা হয়েছিল। কিন্তু নামটাই তো জানা নেই তার? যদি দ্বিতীয়বার দেখা হতো তাহলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে নিত তার এই আশায় সেখানেই পা বাড়ায় আবেগ।
২২.
– “তয় আইজ ও কি কারো গানের সুর শুইনা আইসা পড়ছেন নাকি ডাক্তার মশাই?”
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে কারো শীতল কন্ঠে এমন প্রশ্ন শুনে পিলে চমকায় আবেগ। যে ব্যক্তি অন্যের হার্টের চিকিৎসা করবে আজ তারই হার্ট ধড়ফড় করছে। ভাবা যায়? মেয়েলি কন্ঠের অনুসরণ করে সামনের দিকে এগোতেই চোখ পড়ে বাঁধা নৌকার উপর বসে থাকা কিশোরীর উপর। তবে কি সেদিনের সেই চঞ্চল কিশোরী আসলেই এখানে উপস্থিত রয়েছে নাকি এটা শুধুই তার কল্পনা? তার মাঝেই দ্বিতীয়বার মতো কন্ঠস্বর শুনতেই টনক নড়ে আবেগের।
– “এই যে মশাই! ওমন কইরা ড্যাবড্যাব কইরা কি দেখেন?”
উপমার প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আবেগ। তবুও নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়,
– “তোমাকে!”
এবার যেন কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম আবেগের। একটু আগে কি বললো সে? মেয়েটা কি ভাববে? যদি তাকে ভুল বুঝে কিছু বলে বসে? কিন্তু তাকে আরেক দফা অবাক করে দিয়ে উপমা সশব্দে হেসে ওঠে।
– “বিড়ালচোখী মাইনষের এই একটাই সমস্যা জানেন? যারে একবার দেখে তার প্রতি আলাদা একখান মায়া জন্মায় যায়। তাই বারবার দেখে।”
উপমার কথার ভাবার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না আবেগ। এমন কোথাও লিখা আছে নাকি? না নিশ্চয়ই এসব মেয়েটার বানোয়াট কথা। পরক্ষনেই হাসি থামিয়ে চুপচাপ হয়ে পড়ে উপমা।
– “এইভাবে না দাঁড়াইয়া থাইকা সামনে গিয়ে নৌকায় বসেন।”
আবেগ ও আর কথা বাড়ায়না। চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ে; এমনিতেই শরীর বেশ ক্লান্ত। উপমাও যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পাশে বসে পড়ে আবেগের। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। মিনিট দশেক এভাবে থাকার পর নীরবতা ভেঙে আবেগ মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “নাম কি?”
উপমা নদীর স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়েই বলে উঠে,
– “উপমা!”
বিনিময়ে মুচকি হাসে আবেগ। চঞ্চল কিশোরীর চরিত্রে নামটা বেশ মানিয়েছে।…………….
#চলবে 🍂
(আমি প্রথমেই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সারাদিন নেটওয়ার্ক এর সমস্যা থাকায় পোস্ট করতে পারিনি।)