মাস্টারমশাই পর্ব ১১

0
190

মাস্টারমশাই
পর্ব ১১
_______________
হেমন্তের পৌঢ়ত্বের পর আসে জড়গ্রস্ত শীতের বার্ধক্য। আবহমান গ্রামবাংলার অন্যান্য সকাল থেকে শীতের সকাল আলাদা। প্রকৃতির পালাবদলে শীত আসে রিক্ততা আর শুষ্কতা নিয়ে। ফসলহীন মাঠ,ঝরা পাতা প্রকৃতি যেন বৈরাগীর বসন পরেছে। শীতের সকাল আসে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। কোমল সূর্যরশ্মিতে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু গুলো মুক্তার মতো ঝলমল করে।গাছের পাতা থেকে টুপটাপ শিশিরের ঝরে পড়ার শব্দ, আর পাখির কলরব আন্দোলিত করে গ্রামের জীবনকে। কর্মমুখী মানুষ শিশিরভেজা মেঠো পথে পা রাখে। জীবিকার প্রয়োজনে হাড় কাঁপানো শীত পরোয়া করে না ওরা।শীতের আগমনের সাথে সাথে বনভূমিতে শুরু হয় হাহাকার,মালতীলতা হয় পত্র শূন্য। খেজুর গাছের আগায় ঝুলে খেজুর রসের ছোট্ট হাঁড়ি। সূর্যের মিটিমিটি আলো দেওয়ার আগে গাছিরা বেরিয়ে পড়ে রস সংগ্রহে। ক্ষেতের পর ক্ষেত থাকে সরষে ফুল। ফুলের উপর উঠে চলা রঙিন প্রজাপতি কিংবা মৌমাছিদের মেলা মন হরণ করে। শীত মানে সরষে ফুলের হলুদ বন্যা। শীতের দাপট থামাতে পারে না পাখির চঞ্চলতা। কৃষকের মতো কৃষক-বধূ গৃহস্থলীর কাজে লিপ্ত হয়। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় পুকুরের জল স্পর্শ করে বাসন মাজে। গৃহপালিত পশুর জন্যও আছে শীতের পোশাক। জল কমে যাওয়ায় খাল-বিল, জলাশয়ে জাল ফেলতে ব্যস্ত জেলেরা। এটাই গ্রামের ঢং, বৈচিত্র্য।
রোদে পান্তা নিয়ে খেতে বসেছে শুভজিৎ আর কাবেরী। কয়েকদিন আগে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। পড়াশোনা নেই, সারাদিন শুধু ঘুরে বেড়ানো। আর‌ বিকেল হলে ঘুড়ি নিয়ে মাঠে উড়ানো। পায়েল দেবী দুজনকে খেলতে বাধা দেয়নি বরং শুভজিৎ এর কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। নিজেরই ঠান্ডায় কাজ করতে জড়তার চলে আসে,সেখানে একজন বাচ্চা শিশুকে কি করে কাজ করতে বলেতে পারেন? বিবেক বলে একটা কিছু রয়েছে। শুভজিৎ এর কোনো কাজ নেই, আর কাবেরীর পড়াশোনাও নেই। দুইজন সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। দুপুরে আর সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে। মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে আবার বিড়ালের মতো গা ঝেড়ে দিয়ে খেলতে শুরু করে। শুভজিৎ পান্তা খাচ্ছে আর দাঁত কেলিয়ে হাসেছে। খাওয়ার পর সে কি কি করবে তা কাবেরী কে বোঝাচ্ছে। কাবেরী শুধু মাথা নাড়াচ্ছে। কোনো কথা বলছে না। ঠান্ডায় পান্তা খেতে বিরক্ত। মা ইচ্ছে করে বেশি পান্তা দিয়ে গেছেন। বেশি না খেলে স্বাস্থবান হবে না। শুভজিৎ এর মতো লিকলিকে থাকবে। কিন্তু কাবেরী কিছুতেই এত পান্তা খেতে পারছে না। আবার পুকুরে ফেলার উপায় নেই। মা পুকুর পাড়ে রয়েছেন। পান্তা ফেলছে জানতে পারলে ভীষণ বকবেন। মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো।শুভজিৎ কে হালকা স্বরে বলল,’তুই আর পান্তা নিবি?’
‘না।’
‘তুই আমার পান্তাটা খেয়ে নে না! আমি আর খেতে পারছি না।’
‘আমার আর খিদে নেই।’
কাবেরী থালা থেকে কিছুটা পরিমাণ পান্তা তুলে শুভজিৎ কে দেখিয়ে বলল,’এই দেখ খুব অল্প তো রয়েছে। আমি তোকে লুকিয়ে একটা পেঁয়াজ আর কলা এনে দিচ্ছি। খেয়ে নে না!’
শুভজিৎ তার পান্তা খেতে রাজি হলো। কাবেরী আনন্দে গদগদ করে খুব সাবধানে ঘরের মধ্যে গেল কলা আর পেঁয়াজ আনতে। ওই সময়ের মধ্যে সরকারের কিছু অনুদানের জন্য মাইকে করে প্রচার করতে আসলো। শুভজিৎ রাস্তার দিকে স্থির চোখে তাকালো। রিক্সার সামনে একটা মাঝারি সাইজের বাঁশ বাঁধা হয়েছে। বাঁশের উপরে একটা মাইক বাঁধা রয়েছে। রিক্সা একজন চালাচ্ছেন আর একজন পেছনে বসে এনাউন্সমেন্ট করছেন। লোকটি গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্য কিছু বলছেন। রিক্সার পেছনে গ্রামের গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছে। রিক্সা চলতে শুরু করলে তারাও ছুটতে শুরু করছে। এই দৃশ্য দেখে রোদে বসে পান্তা খেতে মন চাইল না শুভজিৎ এর। কাবেরীর পান্তা তো দূরের কথা নিজের পান্তাটাই শেষ করল না। কোনো রকম মুখ ধুয়ে রিক্সার উদ্দেশে দৌড় দিল। কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এলো। ঘরে রাখা সাইকেলের টায়ার নিল। টায়ারকে গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটতে লাগল রিক্সার পেছনে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অবাক হল কাবেরী। আমার ভীষন রাগ হল শুভজিৎ এর উপর। তার পান্তা খাবে বলে খেলো না। এখন তাকে বসে বসে খেতে হবে। কিন্তু মন কিছুতে চাইছে না সেখানে বসে থাকতে। তারও ইচ্ছে করছে ওই রিক্সার পেছনে ছুটতে। কোনো কিছু অগ্রাহ্য না করে দৌড় দিল রিক্সার পেছনে। পায়েল দেবী শুধু তাকিয়ে দেখল দুজনকে। পেছন থেকে বারবার ডাক দিলেন। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, থালা গুলো অন্তত ধুয়ে দিয়ে যা। আমি একা কত কাজ করব? আমিও তো একটা মানুষ নাকি! তারপর যেখানে খুশি যাবি যা। পায়েল দেবী রাগে গজগজ করতে থাকলেন।কিন্তু কে শোনে কার কথা!এক দৌড়ে শুভজিৎ এর কাছে পৌঁছে গেল। তারপর রিক্সার সঙ্গে সঙ্গে তারাও গ্রামে ঘুরে বেড়ালো।

যদি ভাগ্যকে বিশ্বাস করেন তাহলে ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই পাবেন,আর যদি নিজেকে বিশ্বাস করেন তাহলে যা চাইবেন তাই পাবেন। একটাই জীবন, জীবনের সুখ-আনন্দ সবকিছুই আসবে। একইভাবে জীবন কখনো অতিবাহিত হতে পারে না। জীবনের বিভিন্ন মোড়ে বিভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় হতে হয়। তবেই না জীবনের আসল মজা পাওয়া যাবে।মানুষের জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে যেগুলো মানুষকে সম্পূর্ণ রূপে পরিবর্তন করে দেয়। সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয় প্রতিদিনকার রুটিন। বদলে যায় নিজের চরিত্র।আবার হয়তো বহু বছর পর ভাবে,তার এমন পরিবর্তন হওয়ার কোনো কি মানে ছিল? আবার কিছু মানুষ এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারে না। তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে ফেলে। এমনই একটি ঘটনার সাক্ষী থাকলো মন্ডল পরিবার। তাদের জীবনেও নেমে এলো একটা বড় বইয়ের একটা ছোট্ট দুঃখের অধ্যায়। আর পাঁচটি দিনের মতো আজও খুব স্বাভাবিক ভাবে কেটে গেল। রাতে বাড়ির তিনজন গল্প করে করে যে যার রুমে ঘুমিয়ে পড়ল।কিন্তু সকাল যে আর পাঁচটা সকালের মতো সকাল হবে না, তারা জানতো না।
সকাল প্রায় নয়টার কাছাকাছি,এখনো রোদের দেখা নেই। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে।পায়েল দেবী সকাল সকাল ছেলে-মেয়েকে ডাকেন না। কোনো কাজ নেই, শীতের মধ্যে লেপের তলায় থাকা ভালো। নিজেই শীতে কাঁপছে ছেলেমেয়েদের আর কাঁপাতে চাইলেন না। কিন্তু কাবেরী ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে পরল। ব্রাশ করে মায়ের কাছে এসে বসলো। ঠান্ডায় সকালে পান্তা খেতে বড্ড কষ্ট হয়। মেয়েটিও পান্তা খেতে চায় না। তাই তিনি সকাল-সকাল লুচি তরকারি বানাচ্ছেন। খানিকক্ষণের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তখনও শুভজিৎ বিছানা থেকে উঠেনি।শুধু আজ নয়, কয়েকদিন ধরেই এমন তীব্র শীত পড়েছে। কিন্তু শুভজিৎ কখনো দেরি করে উঠেনি। খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে। কোনো কাজ না করলেও অন্তত সকালে পুজোর জন্য ফুল তুলে আনে। বেলা হলে ফুল পাওয়া যায় না। গ্রামের ছেলে গুলো ফুল তুলে নিয়ে যায়। আজ আবার পৌষ মাসের বৃহস্পতিবার। ফুল একটু বেশি দরকার। এমন দিনে শুভজিৎ কিছুতেই দেরি করবে না। ফুলের জন্য গ্রামের ছেলেগুলোর সাথে মারপিট করে।এই দিনে লক্ষ্মীর পুজো হয়। পায়েল দেবী আবার লক্ষ্মী পাঁচালী পড়তে বসবেন। খুব তাড়াতাড়ি নিজের কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন। শুভজিৎ ঘুম থেকে না ওঠায়, তিনি কাবেরীকে বললেন ফুল তুলে আনতে। কাবেরী যথাযথভাবে মায়ের কথা পালন করল। ফুল তুলে নিয়ে আসার পরও লক্ষ করল শুভজিৎ ঘুম থেকে ওঠেনি। বাইরে রোদ বেশ অনেকক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। পায়েল দেবীর মনে খটকা লাগলো। ছেলেটা নিশ্চয় জ্বর বাঁধিয়ে এনেছে। সারাদিন এ-দিক ও-দিক ঘুরলে জ্বর হবেই তো। এমনিতেই চার-পাঁচ দিন অন্তর জ্বর বাঁধিয়ে বসে। নিশ্চয়ই শীতেও ঘুমানোর সময় ঘরের দরজা-জানালা কিছুই বন্ধ করেনি। কখনোই জানালা দরজা বন্ধ করে না সে।জানালা-দরজা বন্ধ করে দিলে যদি খুলতে না পারে তাহলে সে সারাজীবন ভেতরে আটকে থাকবে। জানলার বন্ধ করলে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না, এই ভয়ে কখনো সে জানালা-দরজা বন্ধ করে না।এমনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একদিকে তীব্র ঠান্ডা তার উপরে উত্তরা হাওয়া, সব মিলে বেশ জাঁকিয়ে শীত ধরেছে তাকে। পায়েল দেবী উৎকট কন্ঠে মেয়েকে বললেন, শুভজিৎ কে ডেকে তুলতে। বেলা অনেক হয়ে গেছে, এতক্ষণ ঘুমানো ব্যাড হ্যাবিট।
মায়ের কথা মতো এক দৌড়ে শুভজিৎ এর রুমে গেল। দরজা খোলাই রয়েছে। কিন্তু রুমের মধ্যে প্রবেশ করে যা দেখল, তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তা কল্পনা থেকে কল্পনা তর। নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারল না। মা-আ-আ বলে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মেয়ের চিৎকার শুনে পায়েল দেবী ছুটে আসলেন। তিনিও কখনই এমন দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। না এটা হতে পারে না। এ কখনোই সম্ভব নয়। তিনি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছেন। এ একটা দুঃস্বপ্ন। হু হু করে কেঁদে উঠলেন। উনার চিৎকার শুনে কয়েক জন গ্রামবাসী ছুটে আসলেন তাদের বাড়িতে। রুমের ভেতরে শুভজিৎ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছে। ধীরে ধীরে মেয়ের কাছে বসে পড়লেন। তখনও মনে হচ্ছে এট একটা দুঃস্বপ্ন। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। একটা অজানা ভয় গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। গ্রামবাসীদের মনের নানা ধরনের কথাবার্তা। পায়েল দেবী আর কাবেরী কিছু বলছে না চুপচাপ বসে আছে। শুভজিৎ এর দিকে তাকাতেই ভয় লাগছে। এক অজানা আশঙ্কা মনের মধ্যে তীব্র হচ্ছে। ব্যাকুল ভাবে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছে না। শুধু চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছে। হঠাৎ করে জীবনটা যেন থমকে গেছে। কিছুতেই নিজেদেরকে সামলাতে পারছেন না।

তিরিশ মিনিটের মতো একই ভাবে কাটলো। তারপর গ্রামের কয়েকজন মানুষ মিলে শুভজিৎ এর গলা থেকে দড়ি খুলে দিল। একটা সাদা কাপড়ের ওপর শুইয়ে দিল,আর গোটা শরীর সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে দিল। শুধু মুখখানা দেখা যাচ্ছে। ছেলেটি মারা গেছে কিন্তু মুখে হাসি বজায় রেখে। স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছে শূন্যর দিকে। মরতে মরতেও নিশ্চয়ই দাঁত কেলিয়েছে। এমন দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হবে, তা কখনো ভাবেনি কাবেরী। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ তো কখনো সম্ভব নয়। কালকে রাত পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, তাহলে সকালটা কেন এত বিচ্ছিরি হলো? এমন সকাল কেন এলো তার জীবনে? শুভজিৎ মরতে পারে না।এ কোনো খারাপ সপ্ন।
আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। গ্রামের ডাক্তার শুভজিৎ কে দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত করেন,সে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা! আত্মহত্যার মানে কি? কাবেরী হাসবে না কাঁদবে কিছু বুঝতে পারছে না? একটা মানুষ কখন আত্মহত্যা করে? যখন তার জীবনের প্রতি অতিষ্ট চলে আসে। নিজেকে ঘৃন্না করে। বেঁচে থাকার কোনো উপকরণ থাকে না তখনই সে মরতে চায়। আর একটা বাচ্চা ছেলে যে জীবনের মানে জানে না, সে করেছে আত্মহত্যা? কিছুতেই বিশ্বাস করল না কাবেরী। সে চিৎকার করে বলল,’শুভজিৎ আত্মহত্যা করেনি। সে আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে খুন করা হয়েছে।’
কার দায় পড়েছে বাচ্চা মেয়ের কথা শুনতে। কেউ পাত্তাই দিল না। আবেগের বশে বাচ্চা মেয়ে এমন কথাবার্তা বলছে। কিছুক্ষণ পর সে নিশ্চয়ই সবকিছু ভুলে যাবে। কিছুদিন তার খেলার সাথি ছিল, এখন নেই তাই সে এমন বলছে। কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। কাবেরী মাকে বারবার বলল, শুভজিৎ কে উঠতে বল। কথা বলতে বল। মা তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারল না। কিন্তু পরিস্থিতি সামলাতে হবে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। এমনভাবে আর চলতে পারে না। সকাল থেকে গ্রামের মানুষজনের আনাগোনা থাকলেও দুপুরের দিকে পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেল। নিলেশ বাবু শহরে থাকেন। উনাকে খবর দিতে হবে। উনি যা করার তাই করবেন। কিন্তু এখন চিঠি লিখলে উনার কাছে পৌঁছতে প্রায় দু-দিন লেগে যাবে। ফোন করতে হবে। গ্রামের কারোর ফোনও নেই। কেবলমাত্র তাদের বাড়িতে এবং মাস্টারমশাই বাড়িতে রয়েছে। কিন্তু ফোন তো তাদের কাছে নেই নিলেশ বাবুর কাছে রয়েছে। পায়েল দেবী আর অপেক্ষা করলেন না। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যেতেও চাইলেন না। তিনি বটতলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দোকানে টেলিফোন রয়েছে। তিনি সবকিছু নিলেশ বাবুকে বলবেন, এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করতে বললেন সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসতে।

বাড়ি পুরো ফাঁকা। সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা লাশের পাশে বসে রয়েছে কাবেরী। তখনো তার চোখ দিয়ে জল আসেনি। শক্ত হয়ে রয়েছে। সে বারবার হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে তার চোখে জল আসছে কিনা! না চোখে কিছুতেই জল আসছে না। বারবার চমকে উঠছে। তার প্রিয় মানুষ মারা গেছে। অথচ তার চোখের জল আসছে না? এমনটা কেন হচ্ছে? বুঝতে পারছে না। মা বলতো, কিছু কিছু আঘাত মানুষকে পাথর বানিয়ে দেয়। এমনকি চোখের জল পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। তবে সে কি এমনটি হয়ে গেল। হিলহিলে গৌরবর্ণ শরীরটা তার পাশে শুয়ে রয়েছে।আজ আর তার সঙ্গে কথা বলছে না। বারবার ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না। পান্ডুর দেহটা শুধু পড়ে আছে। ভেতরের আত্মা চলে গেছে না ফেরার দেশে। চাইলেও আর কখনো ফিরবে না। সমস্ত আকাঙ্ক্ষা সমস্ত স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ একই ভাবে বসে থাকার পর কাবেরী লক্ষ করল, একটা লম্বা ছায়া এসে পড়েছে।সূর্যের আলো বাড়ির ভেতরে থাকায় ছায়াটি স্পষ্ট ভাবে বোঝা গেল। কাবেরী ভয় পেলো না। ওই দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টাও করল না। ছায়াটি তানভীর স্যারের।তিনি কোনো ভাবে জানতে পেরেছেন, কয়েকদিন আগে পরিচিত হওয়া ছেলেটি মারা গেছে। তিনি আর অপেক্ষা করতে পারেননি। শেষবারের মতো দেখতে চলে এসেছেন। তিনি শুভজিৎ এর কাছে গিয়ে বসলেন। উনার চোখ দুটো ছল ছল করছে। চোখের দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে শুভজিৎ এর মুখে পড়ল। কাবেরী স্যারকে লক্ষ করল। কয়েকদিন আগেই তো শুভজিৎ স্যারের কত প্রশংসা করছিল। সেদিন খুব রেগে গিয়েছিল কাবেরী। ওই মানুষটার প্রশংসা তার সহ্য হয় না। আজও কেমন যেন লাগছে। কিন্তু আজ সে স্যারকে ভয় পাচ্ছে না। স্যার জামার পকেট থেকে একটা নতুন রং পেন্সিলের বাক্স বার করলেন। শুভজিৎ এর কাছে রাখলেন। খণখণে স্বরে বললেন,’কিরে কয়েকদিন আগে তো বললি তুই তোর সব স্বপ্ন পূরণ করবি। শহরে যাবি। আর ক’দিনের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলি। আমি বলছি, উঠে পড়। এই ভাবে শুয়ে থাকলে স্বপ্ন কখনো পূরণ হয় না। দেখ, সবাই কাঁদছে। ওইগুলো দেখতে তোর ভালো লাগছে? তোর জন্য নতুন রং পেন্সিল নিয়ে এসেছি। তুই সে দিন রং পেন্সিল নিতে চেয়েছিলিস না। এবার তো উঠে পড়……’
স্যারের কথা শুনে কাবেরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। শিরায় রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে। ভয়ংকর ভাবে আঘাত করছে শিরায় শিরায়। বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। যন্ত্রণা কাউকে দেখাতে পারছে না, আবার এই যন্ত্রণার কোনো চিকিৎসা নেই। তার বাবার অনেক টাকা আছে।চাইলে নিশ্চয়ই এই যন্ত্রণার চিকিৎসা করিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। টাকা দিয়ে সব কেনা যায় না। তাকে যন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে। শুভজিৎ না ফেরার দেশে চলে গেছে। সে তো আর কখনো ফিরবে না। সময় আরও বাড়তে রইল। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসে জড়ো হলো।তারাও আজ কেমন চুপচাপ। সেই কোলাহল আর উত্তেজনা নেই। চোখের কোণে জল টিপটিপ করছে। তারা নিজেরাও জানে না তারা কেন কাঁদছে? হয়তো, কয়েকদিন পর তাদের কান্না থেমে যাবে। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে।

পর্ব ১২ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here