মাস্টারমশাই
পর্ব ১২
______________
শুভজিৎ মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। দু-দিনের মতো পায়েল দেবী মন মরা হয়ে ছিলেন। তবে বেশিদিন একই অবস্থা রইল না। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন। আগের মতো সবকিছু স্বাভাবিক হলো। শুধু স্বাভাবিক হতে পারলো না কাবেরী। এখনো মনে করে, শুভজিৎ আত্মহত্যা করেনি তাকে খুন করা হয়েছে। এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তি দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু তার এই যুক্তি কেউ মানতে চায় না। বাচ্চা মেয়ে। অনেক কথাই বলবে। সব কথা শুনলে চলবে না। সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। অনেক কান্নাকাটি করেছিল সেদিন কাবেরী। বাবাকে বারবার বলেছিল তদন্ত চালিয়ে যেতে। সঠিক তদন্ত হলে সবার সামনে আসল ঘটনা উদঘাটিত হবে। কিন্তু নিলেশ বাবু রাজি হননি। একটা চাকরের জন্য তিনি এত টাকা খরচ করতে পারবেন না। ছেলেটা পাপী তাই আত্মহত্যা করেছে। পাপের আবার কোনো তদন্ত হয় বুঝি? পাপ করেছে তার শাস্তি পেতে হবে। তাও মানতে পারছিল না কাবেরী। বারবার বাবাকে অনুরোধ করে যায়। কিন্তু নিলেশ বাবুর পাষাণ হৃদয় দোলাতে পারেনি। পুলিশ তদন্ত করলে তিনি কিছুতেই শহরে যেতে পারবেন না। বাড়িতে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। পুলিশ বারবার তার কোম্পানিতে যাবে, মানুষ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তাতে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের যেমনটা লস হবে তেমনি কোম্পানির প্রতিপত্তি ক্ষয় হবে। তার চাইতে সবকিছু ভুলে নতুনভাবে জীবন শুরু করা ভালো। সে তাদের পরিবারের কেউ না।তাকে নিয়ে এত ভাবনা নিছক বৃথা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তিনি কথা দিয়েছেন খুব শীঘ্রই আবার একটা নতুন কাজের ছেলে কিংবা মেয়ে আবেন। এতে পায়েল দেবী খুশি হলেও কাবেরী খুশি হতে পারেনি। সে জানে, তার বাবা চাইলে একজন নয় দশ জনকে এনে দিতে পারবে। কিন্তু শুভজিৎ এর মতো কাউকে এনে দিতে পারবে না। কারণ শুভজিৎ একটাই। তার বিকল্প কেউ নেই।
বাড়ির উঠোনে দুটো হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে রয়েছে কাবেরী। রোদ এসে তার চুলের উপর পড়েছে। কতগুলো দিন হয়ে গেল সে নিজের যত্ন নেয় নি। চোখের নিচে একরাশ কালি জমা হয়েছে।চুলগুলো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চুলের উপর পড়া সূর্যের রশ্মি সঙ্গে লাল চুলের বর্ণ এক অদৃশ্য রংয়ের সৃষ্টি করেছে। শুভজিৎ থাকলে তার সামনে এসে বসতো। কিছুতেই কাবেরীকে উঠতে দিত না। আলোক রশ্মি আর চুলের রং এর খেলা দেখতো। মাঝেমধ্যে লম্বা আলোকরশ্মি তে হাত নাড়াতো। আলোকরশ্মির ভেদ করে এ-পাশ ও-পাশ যেত আর দাঁত কেলিয়ে হাসতো। কয়েকদিন আগে যা ছিল বাস্তব, আজ তা হয়ে গেছে কল্পনা। অদ্ভুত এক প্রাণী মানুষ। কিছু মানুষ সারা জীবন কল্পনা করে সেই কল্পনার মধ্যে সুখ খুঁজে নেয়। তারা জানে, সেই কল্পনা কখনো বাস্তব হবে না। আবার কিছু মানুষ বাস্তবতাকে পিছনে ফেলে সামনে চলে আসে। কিছুদিন পর তারা সেই বাস্তবতাকে কল্পনা করে সুখ খুঁজে। তারাও জানে, সেই বাস্তবতা তাদের সামনে কখনো আসবে না।সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। মা কতবার এসে বলে গেছেন স্নান করার জন্য। সেদিকে খেয়াল নেই কাবেরীর। কাকে নিয়ে স্নান করতে যাবে? রোজ স্নান করার জন্য শুভজিৎ যেত। পুকুরে একসঙ্গে স্নান করতো। জলের মধ্যে এ-দিক ও-দিক সাঁতার কাটতো। মা যতক্ষণ না লাঠি নিয়ে পুকুরপাড়ে আসবেন, ততক্ষণ দুজন কিছুতেই পুকুর থেকে উঠবে না।আবার শীতকালে সামান্য গরম জল নিয়ে পুকুরে ঢেলে দিত, আর বলতো, পুকুরের পুরো জল গরম হয়ে গেছে এবার স্নান করে নি। সেই বোকা ছেলেটা নাকি আত্মহত্যা করেছে! তাকে তা বিশ্বাস করতে হবে? সে তো ছোট কিন্তু তার বাবা অনেক বড়। অনেক কিছু বোঝেন। তিনি কি করে বিশ্বাস করছেন ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে? বড্ড স্বার্থপর এ সমাজ। নিজের বাবা মা ছাড়া কেউ কারোর নয়। শুভজিৎ এর যদি বাবা-মা থাকতো, তাহলে তার এই মৃত্যুটাকে কি আত্মহত্যা মেনে নিতেন? কিছুতেই মানতেন না। সঠিক তদন্ত হতো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তদন্ত চালিয়ে যেতেন। কিন্তু তার তো বাবা মা নেই। তার পুরো বিশ্ব শূন্য। এই শূন্য পৃথিবীতে এক টুকরো খড় নিয়ে বেঁচে ছিল। আর সেই খড়ও তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।হতে পারে, তাদের পরিবারের জন্য তার খুন হয়েছে। সে যদি রাস্তায় থাকতো তাহলে দিব্যি বেঁচে থাকতো। হয়তো খাবার পেত না, কষ্ট হতো, শীতে কাঁপতে হতো, স্বপ্ন পূরণ হতো না কিন্তু প্রাণটা থাকতো। প্রাণের চাইতে কোনো জিনিস বড়ো হতে পারে না। আজ প্রাণটাই নেই। মন একটু তৃপ্তি পেতো যদি মৃত্যুর সঠিক তদন্ত হতো। কিন্তু তাও হলো না।একটা প্রাণ হারিয়ে গেল শুধুমাত্র কিছু মানুষের একটু বেশি চাহিদার কাছে।
হাঁটুর নিচে মুখ রেখে বারবার কেঁদে উঠছে। বুক চিন চিন করছে। এই বুকের যন্ত্রণা কেউ দেখতে পায় না। তার মাথায় নানা ধরনের উদ্ভট চিন্তা।সে আজ থেকে কি করবে? কার সঙ্গে স্কুলে যাবে? কার সঙ্গে খেলা করবে? লুকিয়ে কার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাবে? কেউ তো আর তার কানের কাছে সারাদিন বকবক করবে না। কেউ তার স্টুডেন্ট হবে না। হঠাৎ করে সবকিছু হারিয়ে যেতে বসেছে। মনে মনে বলছে, তুই মরলি। তোর চিতা জ্বলল। কিন্তু ওই আগুনে তুই ছাই হলি না,ছাই আমি হলাম। তার চোখের সামনে শুভজিৎ এর সেই হাসিমাখা মুখটা ভেসে ওঠল। হাঁটু থেকে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকালো। নারকেল গাছে একটা কাক বসে ‘কা কা কা’ শব্দ করছে। শব্দ খুব বিকট হলেও তার শুনতে বেশ ভালই লাগলো। মা বলেছিলেন, মানুষ মারা গেলে নাকি কাক হয়ে যায়। শুভজিৎ নিশ্চয়ই কাক হয়ে গেছে। সে আবার ফিরে এসেছে তার কাছে। কাবেরী একরাশ অভিমান সুরে কাককে উদ্দেশ্য করে বলল,’তোর তো ভালো লাগছে, আমাকে এভাবে রেখে যেতে। পারলি আমাকে ছাড়া থাকতে। আমাকে ছাড়া তো তুই খুশি আছিস। তাহলে আবার কেন এসেছিস?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাকের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ থেকে জল বেয়ে পড়ছে। কাকটি বারবার চোখ এ-দিক ও-দিক ঘুরালো। সুযোগ বুঝে ছাদের ওপর শুকতে থাকা একটা মাছের টুকরো নিয়ে উড়ে গেল। আচমকা ঘটনায় হতভম্ব হলো কাবেরী। দুচোখ নিমজ্জিত হলো কাকের উড়ে চলার দিকে। কাক ধীরে ধীরে অনেক দূরে উড়ে গেল। আস্তে আস্তে করে তার চোখের সামনে মলিন হয়ে উঠল।
রোজ সকালের মতো আজকেও পায়েল দেবী তাড়াতাড়ি উঠে রান্না বসালেন। নিলেশ বাবু শহরে ফিরে যাবেন। অনেকদিন হলো গ্রামে আছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো দেখভাল করতে পারছেন না। এমন ভাবে চলতে থাকলে লোকসান অনিবার্য। নিলেশ বাবুর আগে কাবেরী বিছানা থেকে উঠে পড়ল। মুখ ধুয়ে ছুটে মায়ের কাছে এসে বসলো। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখলো। গাছে অজস্র ফুল রয়েছে। শুভজিৎ নিশ্চয়ই ফুল তোলেনি। দিনদিন সবকিছু ভুলে যাচ্ছে। শীতের শুরু থেকেই, কাজে প্রচুর ফাঁকি দিচ্ছে। হাসিমুখে মাকে বলল,’মা, শুভজিৎ বিছানা থেকে উঠেনি? আমি ফুল তুলে আনবো?’
পায়েল দেবী মেয়ের চোখের দিকে তাকালেন। দুটো চোখ ছল ছল করছে। মেয়ে কী সবকিছু ভুলে গেল?মেয়ের বয়স নিতান্ত কম নয়। এই বয়সে এমন ছেলে মানুষকতা মানায় না। তিনি কিছু বলার আগেই, কাবেরী শুভজিৎ এর রুমের দিকে ছুটে গেল। হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন পায়েল দেবী। এইভাবে চলতে পারে না। এর একটা বিহিত চাই। এমনভাবে আর কদিন চলবে? শুভজিৎ এর হঠাৎ মৃত্যু তিনিও মানতে পারেনি। কই তিনি তো পাগলামো করছেন না! পাগলামো করলে কি সে ফিরে আসবে? আসবে না। তিনি সবকিছু স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করতে চাইলেন। ব্রেকফাস্টের সময় স্বামীকে সব কিছু বললেন। নিলেশ বাবু চিন্তা পড়লেন। আজ প্রায় দশ দিনের মতো স্কুল খুলে গেছে। কাবেরী একদিনও স্কুলে যায়নি। নতুন বছরের নতুন বই খাতা এনে দিয়েছে। কোনো বই একবারের জন্যও খুলে দেখেনি। যে মেয়ে বছর শুরু হতে না হতে নতুন বই আনতে বলতো, স্কুলে পড়ানো না শুরু হলেও নিজে থেকে পড়ে ফেলে, -আজ সে পড়াকে ফাঁকি দিচ্ছে। তানভীর স্যারকে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে না। উনাকে ভয় পেলে নিশ্চয়ই স্কুলে যেত। মেয়ে কতটা উচ্ছন্নে গেছে বুঝতে পারলেন তিনি। এভাবে চলতে পারে না। তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। একটা ছেলে তাদের পরিবারকে তছনচ করে দিতে পারে না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর সঙ্গে স্ত্রী এবং মেয়েকেও শহরে নিয়ে যাবেন। এমন সময় কাজের লোক পাওয়ার সম্ভবনা খুব কম। স্ত্রীর অসুবিধা হবে। তার উপর রয়েছে কাবেরীর ছেলেমানুষি। শুভজিৎ এর নানা ধরনের স্মৃতি এই ঘরকে কেন্দ্র করে রয়েছে। স্মৃতির বুক ছিঁড়ে কাবেরীর বড় হয়ে ওঠা অনেক কঠিন হবে।
নিলেশ বাবু সেদিন শহরে ফিরলেন না। দশ দিন পর শহরে ফিরবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা একটা করে শহরে পৌঁছে দিতে লাগলেন। তারা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাবে। কিন্তু কাবেরী কিছুতে গ্রাম ছেড়ে শহরে যেতে চাইলো না। কিন্তু কতক্ষণ? বড়দের সব কথা মানতে বাধ্য সে। কেউ একজন বলেছেন,ছোটরা একটা সিসি কিংবা গ্লাস ভাঙলে দোষ। অথচ বড়োরা দেশ ভাঙছে,অট্টালিকা ভাঙছে, -তার কোন দোষ নেই। তার কোনো বিচার নেই। গ্রাম থেকে শহরে কিছুতেই যেতে চাইলো না কাবেরী। এর জন্য বাবার কাছ থেকে মার খেলো। জীবনে প্রথমবার বাবার কাছে মার খেলো সে। তাও রাজি করাতে পারল না। কিন্তু নিলেশ বাবুর ধূর্ত মনের কাছে কতক্ষণ? তিনি শিকারির মতো যেভাবে জাল বিছিয়ে রেখেছেন ওই জালে পড়তেই হবে। তিনি কাবেরীকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিলেন।শহরে গিয়ে শুভজিৎ এর মৃত্যুর তদন্ত করাবেন। প্রয়োজন হলে সিআইডি তদন্তের দাবি জানাবে। মিথ্যে প্রতিশ্রুতির আশ্বাসে শহরে যেতে রাজি হল কাবেরী।
শীতে জর্জরিত গ্রামবাসী। সকাল সকাল শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল মন্ডল পরিবারের সকল সদস্য। বেশ কয়েকদিন ধরে মনের মধ্যে আলাদা এক অনুভূতি ছিল। প্রথমবার তারা শহরে যাচ্ছে। নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ কত কিছু দেখার বাকি আছে শহরে।আবার তাদের ধারণা শহরে নাকি সব স্বপ্ন সত্যি হয়। কিন্তু যাওয়ার দিন পুরোটাই ভিন্ন। একটা পুরনো কষ্ট বুকের মধ্যে রোমাঞ্চকর হয়ে উঠলো। কত স্মৃতি ঘিরে রয়েছে এই গ্রামকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি পদে-পদে জড়িয়ে রয়েছে স্মৃতি।বাড়ি বিক্রি হয়নি তারা আবার ফিরে আসবে,কিন্তু কবে আসবে তা জানে না।নিলেশ বাবুর মন ফুরফুরে থাকলেও কাবেরী আর পায়েল দেবীর মন বিষাদে ভরে গেল। নিলেশ বাবু তো গ্রামে তেমন একটা থাকেন না, বাকিরা গ্রামে থাকে। তারা জানে গ্রামে থাকার অনুভূতিটা কেমন। ওই অনুভূতি কিছু মুহূর্তের পর মৃত্যুবরণ করবে। কাবেরীকে জানালার পাশে বসতে বারন করলেও সে বারন মানলো না। জানালার পাশে গিয়ে বসলো। আস্তে আস্তে করে বাস চলতে শুরু করলো। বুক চিনচিন করতে উঠলো। কুয়াশায় আস্তরণে ঢাকা রয়েছে মাঠ ঘাট। তবুও কাবেরীর সামনে সেগুলো স্পষ্ট। শুভজিৎ কে নিয়েই মাঠে কত ঘোরাঘুরি করেছে। মারামারির শেষ ছিল না। কথা ছিল একসঙ্গে শহরে যাবে। একসঙ্গে দুজনে স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু হঠাৎ করে সব বদলে গেল। দেখতে দেখতে বাস বটতলা অতিক্রম করল। কাবেরী ওই দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। বটতলাও অজস্র স্মৃতি সংগ্রহশালা। অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে পায়েল দেবী আর নিলেশ বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু কাবেরী ঘুমাতে পারল না। সে শুভজিৎ এর মধ্যে মগ্ন রইল। শুভজিৎ এর আগমন ছিল বসন্তের মতো সুন্দর। কিন্তু তার ফিরে যাওয়া ছিল, শীতের মতো শুষ্ক ও রুদ্র।
১।
বেলা গড়িয়ে যেতে থাকে, কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের ছেলের প্রশংসা শেষ হয় না। তিনি এখনো ছেলের প্রশংসা করে যাচ্ছেন। কাবেরী বিরক্ত হলেও প্রকাশ করতে পারছে না। বৃদ্ধাবস্থায় মানুষ একটু বেশি কথা বলেন। ছেলে মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের ছেলে মেয়ে তো বিদেশে থাকে। তিনি কারোর সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। পেটের মধ্যে এক গুচ্ছ কথা জমা আছে।তাই কাবেরীকে পেয়ে গল্প জুড়িয়ে দিয়েছেন। অনেকক্ষণ পর মাস্টারমশাই থামলেন। কাবেরী আর মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে থাকতে চাইলো না। এখনো অর্ধেক রহস্যের উন্মোচন ঘটেনি। আর এই রহস্যের সন্ধান কেবল মাস্টারমশাই দিতে পারেন। তবুও তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। ব্যস্ততার জালে জড়িয়ে রয়েছে।পরে না হয় কোনো দিন মাস্টারমশাইকে সবকিছু জিজ্ঞেস করবে।দুপুরের রান্না করতে হবে। স্থির চোখে মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ মাষ্টারমশাই, এবার আমি আসি। আমাকে বাড়িতে রান্না করতে হবে।’
‘সে কি রে…. এত বেলা হল আর তুই এক্ষুনি রান্না করে খাবি কখন?’
‘সে ঠিক হয়ে যাবে। বিকালে খাওয়ার অভ্যাস আছে।’
‘আজকে আর রান্না করতে হবে না। আমার বাড়িতে খেয়ে যা। রঘু রান্না করেছে।’
‘না না, মাস্টারমশাই! সে তো আপনার জন্য রান্না করেছে। আপনি খান।’
‘তোর বাবা যদি তোকে খেয়ে যেতে বলতো, তাহলে না বলতে পারতিস?’
কাবেরী আর কিছু বলতে পারলো না। এত বছর পরও মাস্টারমশাই তাকে মনে রেখেছে। তার বাড়িতে খেতে বলছে। এমন সুযোগ কি সবাই পায়? সে পেয়েছে। ছাড়বে কেন? মনের মধ্যে আবার পুরনো স্মৃতি জেগে উঠলো। মাস্টারমশাই চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। তিনি কি করতে চাইলেন, ওই দিকে চোখ রাখলো কাবেরী। আস্তে আস্তে উঠে তিনি টিভির সুইচ অন করলেন। খবরের চ্যানেল চালিয়ে তিনি বললেন,’তুই নিউজ দেখ। আমি এমন মসজিদে নামাজ পড়তে যাব। আজ বছরের শেষ শুক্রবার। ফিরলে একই সঙ্গে খাবো।’
কাবেরী চুপচাপ বসে রইল। নিউজ দেখতে তার একদম ভালো লাগে না। আজ পর্যন্ত নিউজে পলিটিক্যাল ছাড়া তেমন কিছু দেখালো না। মাস্টারমশাই ফিরছিলেন, তখনই টিভি থেকে তাঁর কানে একটা অস্পষ্ট ভাষা ভেসে আসলো। তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। মাস্টারমশাই অস্পষ্ট শুনলেও কাবেরী স্পষ্ট ভাবে শুনতে পারল। কাবেরী চোখ ঘুরিয়ে টিভির পর্দায় নজর দিল। তিনি বাইরে গেলেন না কিছুক্ষণের জন্য টিভির সামনে এসে দাঁড়ালেন।
“ব্রেকিং নিউজ,,,,,
এবছরের ‘সাহিত্য একাডেমী’ পুরস্কার পাচ্ছেন কিশলয় কুমার দাস। তাঁর রচিত ‘মাস্টারমশাই’ উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পাচ্ছেন। আগামী সোমবার সাহিত্য সম্মেলনে উনার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। শহর থেকে প্রায় শত কিলোমিটার দূরে এক পল্লী গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম কিশলয়ের। সেখান থেকে আজ……”
নিউজ দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠলো কাবেরী। কিশালয় স্কুলের ক্লাসমেট। সে পাচ্ছে ‘সাহিত্য একাডেমী’ পুরস্কার। এর চাইতে খুশির খবর কি হতে পারে? এত বছর পর গ্রামে ফিরল। তার সঙ্গে এত বড় একটি সুখবর। সে পেছনে ঘুরে দেখল, মাস্টারমশাইয়ের চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছে। তিনি কাঁদছেন। কিন্তু কেন? তার ছাত্র ‘সাহিত্য একাডেমী’ পুরস্কার পাচ্ছে। সারাদেশে তার নাম ছড়িয়ে পড়ছে। এ তো খুশির খবর। তবে মাস্টারমশাই কি আনন্দে কাঁদছেন? না, তিনি আনন্দে কাঁদছেন না। কাবেরী আজ তিরিশটা বছর পার করেছে। জীবনে চলার পথে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে। সে জানে কোনটা আনন্দের কান্না,আর কোনটা দুঃখের কান্না। মাস্টারমশাইয়ের সব দুঃখ যেন টিভির পর্দায় দেখানো বইকে কেন্দ্র করে।
‘মাস্টারমশাই, আপনি কাঁদছেন? আপনার ছাত্র ‘সাহিত্য একাডেমী’ পুরস্কার পাচ্ছে, -আপনি খুশি হননি?’
মাস্টারমশাই চোখ থেকে জল মুছলেন। শান্ত গলায় বললেন,’হ্যাঁ, আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমার ছাত্র আমাকে অমর করে দিয়েছে। আমি সারা জীবন এই বইয়ের মাধ্যমে সবার কাছে অমর থাকবো। আর এই ‘মাস্টারমশাই’ বইটি আমার জীবনী নিয়ে লেখা।’
মাস্টারমশাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। তাঁর চোখে আবার জলের রেখা বয়ে আসলো। কাবেরী খুব ভালোভাবে তা প্রখর করল। মাস্টারমশাই ভীষণ কান্না করছেন। এই বইয়ের কারণে তিনি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছেন। কিন্তু এই বইতে এমন কি রয়েছে? যা মাস্টারমশাইয়ের মতো একজন শক্ত মানুষকে ভেঙে দিয়েছে? কাবেরী আবার টিভির দিকে নজর রাখলো।পুরো সাদা রঙের বই তার উপরে একজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে আছেন।আর একজন ছাত্র সালাম দিচ্ছে। নিচে লেখা রয়েছে মাষ্টারমশাই আরও নিচে লেখা রয়েছে কিশলয় কুমার দাস। কাবেরীর চোখ পড়ার টেবিলের দিকে গেল। একই বই স্যারের টেবিলের উপর রয়েছে। এই বই নিয়ে স্যার বাসস্ট্যান্ডে বসে ছিলেন। আর এই বইটা উনার যন্ত্রনা। কাবেরী ভাবতে শুরু করলো…।মাস্টারমশাই নিজে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন, তাঁর প্রিয় ছাত্র কিশলয়। কিশলয় খুব ভদ্র পরিবারের জন্মেছিল। সে নিশ্চয়ই মাস্টারমশাইকে অপমান করে কোনো কিছু লিখবে না। যদি অপমান করে কিছু লিখে থাকে,তাহলে সেই বই কিছুতেই ‘সাহিত্য একাডেমীর’ জন্য নির্বাচিত হবে না। তাহলে মাস্টারমশাই কান্না করছেন কেন? কিছুতো রহস্য রয়েছে এই বইয়ের মধ্যে। এই রহস্যর উন্মোচন করতেই হবে। আবার মাস্টারমশাই কিছুক্ষণ আগে বললেন, তাঁর গর্ব তাঁর ছেলে। মাহাবুব সবসময় তাঁর খবর নেয়। মাহবুব যদি সত্যিই ভালো হয়। তাহলে সে কেন বাবাকে ছেড়ে বিদেশে পড়ে রয়েছে? এখানে বৃদ্ধ বাবা দিনের পর দিন যন্ত্রণা সহ্য করছে।আর সে বিদেশে পড়ে আছে। নানা ধরনের প্রশ্ন কাবেরীর মাথায় আঁকিঝুকি দিল। এত শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করে দিল।
পর্ব ১৩ আসছে।।