মাস্টারমশাই
পর্ব ৫
_________________
“উড়ছে টাকা ছুটছে মানুষ।
করছে নিজের সর্বনাশ।
ভোর হতে জোর খবর।
সুখের খোঁজে শান্তির লাশ।”
“উড়ছে টাকা ছুটছে…….”
এই চারটি বাক্য অনবরত ঠোঁটস্থ হচ্ছে শুভজিৎ এর মুখে।পুরো তিনদিন ধরে তার মুখ থেকে সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে এই চারটি বাক্য। যাত্রা শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে পুজো কমিটির সদস্যরা যেভাবে অ্যানাউন্সমেন্ট করে, সেও সারাদিন ধরে একইভাবে অ্যানাউন্সমেন্ট করে যাচ্ছে। যথাসাধ্য চেষ্টা করছে তাদের মতো করে ফুটিয়ে তোলার। যাত্রা কমিটির সদস্যরা বক্সে ইকো দিয়ে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলছেন, আর শুভজিৎ নিজের মুখে ফুটিয়ে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। প্রথমের দিকে বেশ মজা পাচ্ছিলেন পায়েল দেবী এবং কাবেরী। কিন্তু পরে তাদের কাছে বিরক্ত হয়ে উঠেছে।একটা বাক্য কার-ই-বা ভালো লাগে বারবার শুনতে? এর জন্য যথেষ্ট বকুনি খেয়েছে, কিন্তু সে শুনেনি।
দুদিন হলো গ্রামে মেলা বসেছে। আজ দ্বিতীয় দিন। নিলেশ বাবু শহর থেকে গ্রামে ফিরেছেন। গ্রামে ফেরার সময় তিনি মেয়ের জন্য এবং শুভজিৎ এর জন্য দু’খানা জামা নিয়ে এসেছেন। প্রায় সময় এমনটা ঘটে থাকে। শহর থেকে ফেরার সময় তিনি দুজনের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। বিকেল বেলায় দুজন পরিপাটি হয়ে মেলায় ঘুরতে বের হলো। পায়েল দেবী নিজে হাতে শুভজিৎ কে বেশ পরিপাটি করে গুছিয়ে দিলেন। এবং দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তারা যেন কিছুতেই একে অন্যের হাত না ছাড়ে। মেলায় অনেক মানুষ থাকবে। কারোর দেওয়া চকোলেট কিংবা অন্য কোনো খাবার যেন না খায়।যাত্রা শুরু হওয়ার আগে তারা যেন বাড়ি ফিরে ভাত খিয়ে যায়। দুজন মাথা নাড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। বাড়ি থেকে অল্প দূরেই মেলা বসেছে। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল।তখনো কাবেরীর কানের কাছে শুভজিৎ একই বাক্য ঘ্যান ঘ্যান করে বলে গেল। কাবেরী ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। মুখটাকে ভগ্নস্তূপের মতো করে বলল,’কিরে তুই? এখনো সেই একটা বাক্য নিয়ে পড়ে আছিস। অন্তত এবার থাম। তোকে শেখানোটাই আমার ভুল হয়ে গেছে।’শুভজিৎ নিজের চকচকে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।
‘আবার হাসছিস?’ভ্রু কুঁচকে কাবেরী বলল। শুভজিৎ সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কাবেরী হাসবে না কান্না করবে কিছু বুঝতে পারছে না। ছেলেটাকে দেখলে ভীষণ দয়াও হয় আবার রাগও হয়। শুভজিৎ এর হাত ধরে আবার হাঁটতে লাগল। সে হাঁটতে হাঁটতে শুভজিৎ কে জিজ্ঞেস করল,’তোর জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই?’শুভজিৎ স্থির চোখে কাবেরীর মুখের দিকে তাকালো। আবার হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বলল,’লক্ষ্য মানে কি?’ কাবেরী কপালে হাত চাপড়ালো। কি করে বোঝাবে এইগুলোর মানে কি? ভুল তার নিজের। যে ছেলে এখনো ঠিকমতো অক্ষর শিখতে পারেনি। তাকে লক্ষ্য কিংবা প্যাশন জিজ্ঞেস করা মোটেও উচিত হয়নি। সে অন্য ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,’আমার যেমন ইচ্ছা আছে, আমি বড় হয়ে চাকরি করবো, বাবা-মার দেখাশোনা করব, শহরে গিয়ে থাকবো। তোর এমন কোনো ইচ্ছে নেই?’
‘হ্যাঁ আছে তো।’
‘কী ইচ্ছে আছে? আমায় বল?’
‘ওই যে রেডিওতে মানুষ গুলো খবর পড়ে না..।আমি ওদের মতো হতে চাই। আমিও খবর পড়তে চাই।’ বলেই হেসে ফেলল সে।
‘ও আচ্ছা বুঝেছি। তুই সাংবাদিক হতে চাস তো!’
শুভজিৎ মাথা নাড়ালো। সাংবাদিকের মানেটা সে বুঝতে পারেনি। তবে কাবেরীর উপর বিশ্বাস রয়েছে তার। তাকে মিথ্যা কথা বলবে না। কাবেরী প্রসন্ন হাসি বিনিময় করে বলল,’কিন্তু তার জন্য তো অনেক পড়াশোনা করতে হবে। অনেক কিছু জানতে হবে। বাংলা ভাষা ছাড়া আরও অন্যান্য ভাষা জানতে হবে। উচ্চারণ স্পষ্ট হওয়া দরকার।’
শুভজিৎ গভীর ভাবনায় পড়ল। শুধুমাত্র রেডিওতে খবর পড়ার জন্য এত কিছু জানা দরকার। তার ধারণা ছিল খুব সহজে রেডিওতে খবর পড়া যায়।হাসি ভরা মুখটি মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। কিন্তু কাবেরী হাল ছাড়লো না। সে নিজেও অনেক ছোট, শুভজিৎ কে দেওয়ার মতো কিছু নেই তার কাছে। তবে একটা জিনিস রয়েছে যা প্রত্যেক সাকসেসফুল মানুষের খুব প্রয়োজনীয়। শুভজিৎ কে অনুপ্রেরণা দিল। তাকে উৎসাহ করল, সে একদিন বড় সাংবাদিক হবে। আজ থেকে প্রত্যেকদিন পড়তে বসার সময় তাকে পড়তে বসতে বলল। একটা একটা অক্ষর শিখতে শিখতে সেও একদিন অনেক কিছু শিখে যাবে। দুজন গল্প করতে করতে কখন মেলায় পৌঁছে গেল বুঝতে পারল না। মেলায় বেশ হট্টগোল। মেলা গ্রামীণ জীবনে একমাত্র আনন্দের উৎসব।এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে আর একজন অঞ্চলের মানুষের ভাবগত যোগসুত্র গড়ে ওঠে এই মেলার মাধ্যমে। মেলায় খুঁজে পাওয়া যায় আনন্দের বৈচিত্র্যময় বিস্তার। তারা যখন মেলায় পৌঁছলো তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যায়। সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল হয়ে রয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে বেশিরভাগ বয়স্ক এবং ছোটদের আনাগোনা। প্রাপ্তবয়স্করা রয়েছে তবে খুব অল্প। অফিসে বারবার মাইককে ঘোষণা হচ্ছে আজকের যাত্রা কথা। শুভজিৎ তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে যাচ্ছে। মেলায় সারি সারি দোকান বসেছে। চা, তেলেভাজা, মিষ্টি, শহর থেকে আমদানি করা বেলোয়ারী শাড়ি,কাপড়,জামা,ছবি, খেলনা,পুতুল বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে চারিদিকে এক বিরচিত পরিবেশ। শুভজিৎ এর চোখ থমকে স্থির তেলেভাজা দেখে। ছোটবেলা থেকে তেলেভাজার প্রতি লোভ ভীষণ। লোভ এখনও সামলাতে পারে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর সে কাবেরীর নির্মল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’চল না আমরা তেলেভাজা খাই।’ কাবেরী ভীষণ অবাক হয় শুভজিৎ এর কথা শুনে। কতটা আবেগপ্রবণ দিয়ে বলেছে তা অনুমান করতে পারলো না।কাবেরী তেলেভাজার দোকানের দিকে তাকালো। কত ছোট ছোট শিশু নিজেরা নিজেদের মতো করে কিনে খাচ্ছে। সুন্দর মুখশ্রী পুলকে ভরা। চোখ দুটো জলে ভরে গেল। কিন্তু তাদের কাছে একটা টাকাও নেই। তাদের যে সামর্থ্য নেই তা নয়। তার বাবা গ্রামের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। বাবা কৃপণ জানে সে। তা বলে মেলায় আসার সময় একটি টাকাও দিলেন না। বাবার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে কাবেরীর। নীল আকাশের দিকে তাকালো। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ভাবলো। তারপর সে তেলেভাজার দোকানের কাছে গেল। রোজ স্কুল যাওয়ার সময় তার মা দু-টাকা করে দেয়। কোনো কারণে আজ ওই দু-টাকা খরচ করেনি। বাঁচিয়ে রেখেছিল।ওই টাকা দিয়ে দুটো তেলেভাজা নিল। একটা নিজে নিল আর একটা শুভজিৎ কে দিল। মাত্র একটা তেলেভাজা পেয়ে শুভজিৎ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। জীবনের সমস্ত খুশি সে যেন পেয়ে গেছে। সে খুব কম মানুষকে দেখেছে, যারা অনেক অল্পতে খুশি হয়ে যায়। তারমধ্যে শুভজিৎ একজন। এই জন্য, হয়তো, সে ভীষণ ভালোবাসে শুভজিৎ কে। সে নিজের তেলেভাজাটা খেলো না। খেতে ভালো লাগছে না বলে শুভজিৎ কে দিয়ে দিল। শুভজিৎ আরও বেশি খুশি হল। তার হাসিমাখা মুখটা বারবার দেখতে চায়। নিজের চাইতে অনেক বেশি ভালবাসে শুভজিৎ কে।
আরও ঘন্টাখানেক মেলায় ঘুরলো তারা। শুভজিৎ বারবার প্যান্ডেলে থাকা বাঁশ গুলোর উপর উঠে পড়ছে। দুই হাত শূন্যে তুলে বাঁশ গুলোর উপর হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এগুলো মোটেও পছন্দ নয় কাবেরীর।অনেকবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শুভজিৎ সার্কাসের দক্ষ ব্যক্তির মত হেঁটে চলে যাচ্ছে শূন্য বাঁশে। তার সঙ্গে জুটেছে আরও কয়েকটি গ্রামের ছেলে। তাদের সঙ্গে জমিয়ে খেলছে। কাবেরী খেলাধুলো একদম পছন্দ করে না। সে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। আর তাদের খেলা উপভোগ করল। আর মাঝেমধ্যে শুভজিৎ অতিরিক্ত কিছু করতে চাইলে বাধা দিল।
দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে আসলো। আলোয় ঝলমল করে উঠলো ময়ূরগঞ্জ। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের রঙিন আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। স্টেজে বিভিন্ন ধরনের লাইটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাত্রার লোকজন ইতিমধ্যে চলে এসেছেন। শুভজিৎ সেখানে পর্দা সরিয়ে বারবার উঁকি মেরে দেখছে। ভলেন্টিয়ার বাধা দিচ্ছে কিন্তু সে শুনছে না। কোনো না কোনো ভাবে দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে লোকের আগমন ঘটতে শুরু করেছে। বৃদ্ধরা চায়ে চুমুক দিয়েছেন। কেউ আবার নিজের মতো করে জায়গা নিয়ে বসে গেছেন। বাচ্চা ছেলে মেয়েরা একেবারে স্টেজের সামনে বসে গেছে। কাবেরী শুভজিৎ এর কাছে রয়েছে। সেও পর্দা সরিয়ে নায়িকাকে দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। অনেকক্ষণ দুজন চেষ্টা চালিয়ে গেল। একসময় কাবেরীর মনে পড়লো মায়ের বলা শেষ কথাগুলো। যাত্রা শুরু হওয়ার আগে তারা যেন ভাত খেয়ে যায়। কাবেরী শুভজিৎ কে মায়ের বলা কথা গুলো মনে করিয়ে দিল। শুভজিৎ কিছুতেই মেলা ছেড়ে বাড়ি ফিরতে চাইল না। রাতের খাবার খাবে না। কাবেরীকে বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসতে বলল। কিন্তু কাবেরী শুভজিৎ কে ছাড়া বাড়ি ফিরবে না। তার ভূতের ভয় রয়েছে। শেষমেষ দুজন বাড়ি ফিরতে উদ্যত হলো। একে অপরের হাত ধরে বাড়ি ফিরছে,তখনই কাবেরী চোখ যায় তানভীর স্যারের দিকে। তিনি একটা জিলিপির দোকানে বসে রয়েছেন। উনার আড়াল হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু উনার তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে কাবেরীকে কাছে ডাকলেন। কাবেরী কিছুতেই কাছে যাবে না। উনাকে বিশ্বাস নেই এখানেও সবার সামনে বোকুনি দিতে পারেন। না গিয়ে উপায়ও নেই। কাল স্কুলে ঠিক ধরবে। ধীর পায়ে স্যারের কাছে গেল। পেছনে পেছনে শুভজিৎ ও। তিনি দুজনকে আপাদমস্তক দেখলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন,’একা এসেছিস?’ শুভজিৎ এর কিছু বলার আগে কাবেরী তাড়াতাড়ি করে বলল,’না, মা সঙ্গে এসেছেন।’ শুভজিৎ তার দিকে তাকিয়ে রইল। মিথ্যা কথা কেন বলল সে বুঝতে পারল না। আসলে বাড়ি থেকে একা বেরোনো মোটেও পছন্দ করেন না তানভীর স্যার। তারা একা বেরিয়েছে জানালে ভীষণ বোকুনি দেবেন। তিনি মাথা নাড়ালেন। তারপর তাদেরকে চলে যেতে বললেন। স্যারের আড়াল হতেই কাবেরী দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। যেন এতক্ষণ যম দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিল।আর চারটা মানুষের মতো কাবেরীও ভীষণ ভয় পায় তানভীর স্যারকে।শুধু ভয় নয়,সমস্ত ছাত্রছাত্রীর মতো তারও একটি অপছন্দের স্যার হলো তানভীর আলম। মানুষটিকে একদম সহ্য করতে পারে না। উনার কঠোরতা একদম পছন্দ নয়।উনার হাতে কত যে মার খেয়েছে কল্পনাও করতে পারবে না। মেলায় দেখা হয়েছে ভালো কথা,কিন্তু কাছে ডাকার কি দরকার ছিল? তাদেরও তো বাক স্বাধীনতা রয়েছে। বাকস্বাধীনতা হাতিয়ার করার অধিকার কারোর নেই,তা হয়তো তিনি জানেন না। জানলেও মানতে চান না। সব জায়গাতে নিজের আইন প্রণয়ন করেছেন। উনার ইচ্ছাই উনার আইন। তাই তো সবার অপছন্দের প্রথম তালিকায় তিনি থেকে গেছেন।
রাত প্রায় বারোটা। যাত্রা অর্ধেকের বেশি হয়ে গেছে।এত রাত জাগার অভ্যাস তাদের নেই। কাবেরী অনেক আগে ঘুমিয়ে পড়েছে মায়ের কোলে।পাসে শুভজিৎ বসে রয়েছে। তার চোখে ঘুম নেই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে স্টেজের দিকে। বেশ জমে উঠেছে যাত্রা। কিন্তু এখনো সে পুলিশের দেখা পায়নি। তার যাত্রা দেখার মূল উদ্দেশ্য সে পুলিশ দেখবে। পুলিশ দেখতে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু এখনো দেখতে পেল না। আচমকা তার পিঠে হাত দেন পায়েল দেবী। শুভজিৎ পেছন ঘুরল। পায়েল দেবী হাসিমুখে বললেন, বাড়ি থেকে একটা চাদর নিয়ে আসতে। কাবেরী ঘুমিয়ে পড়েছে তার ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। উনার যাত্রা ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে নেই। এদিকে, বাড়ি ফিরতে একদমই মন চাইল না শুভজিৎ এর। আবার মালিকের কথার অবাধ্য হতেও চাইল না। বড্ড মুশকিলে পড়লো সে।গম্ভীর মুখ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সারাদিন আনন্দে থাকার একটা কারন ছিল সে পুলিশ দেখবে। কিন্তু তা মনে হয় আর হবে না। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে দৌড় দিল। আর ভাবতে থাকলো,পায়েল দেবী এত স্বার্থপর কেন? তিনি চাইলে তো নিলেশ বাবুকে বলতে পারতেন,কিংবা নিজে এসে নিয়ে যেতে পারতেন। তাকেই বলতে হল। নিজের মাও কি এমনটা করতেন?ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। মায়ের মতো একটি মানুষ পেয়েছে, কিন্তু মাকে পায়নি। ওই একটা বাংলায় প্রবাদ রয়েছে না, পরের ছেলে পরমানন্দ যত উচ্ছনে যায় ততই আনন্দ। আবার পরক্ষণেই অনুতাপ করতে থাকে, মালিকের নামে এসব ভাবা পাপ। তার সব সময় উচিত মালিকের প্রতি আনুগত্য থাকা। সমস্ত কথা মেনে চলা। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর সে সম্পূর্ণভাবে মেলার বাইরে চলে আসলো। নায়ক নায়িকার গান স্পষ্ট ভাবে শুনতে পাচ্ছে সে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারের বুক চিরে হাঁটতে রইল। ভীষণ ভয় করছে কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। তাকে যেতেই হবে। এমন সময় তার চোখে পড়ল একটি লম্বা লোক তার সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। ভীষণ ভয় পেলো। গ্রামে ভূতের কথা কম শুনেনি সে। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকলো। এই বুঝি তার জীবন শেষ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ভুতটি বদমাশ হবে। কিন্তু লোকটি কাছে আসতেই তার ভয় দূরে চলে গেল। এতক্ষণ ধরে যাকে ভূত ভাবছিলো সে আসলে রঘু। মন্দিরের পাশেই তার বাড়ি। বাবা মন্দিরে পুজো করেন। ওইখান থেকে যা রোজগার হয় তাতেই তাদের সংসার চলে। তবে ছেলেমেয়েদের হাবভাব সম্পূর্ণ আলাদা। তারা যেন কোটিপতি ঘরের ছেলে। শুভজিৎ হাসিমুখে রঘুকে ডাকলো। সে কাছে আসলো।
‘বল রে চাকরের ছেলে। কি হয়েছে তোর?’
ভীষণ চটে গেল শুভজিৎ। রঘুর কথা মোটেও পছন্দ হলো না। তবুও শান্ত মাথায় বলল,’এমন কথা বলতে নেই রঘু দাদা। মালিক বলে, অন্যের পেশা নিয়ে হাসাহাসি করলে, একদিন তাকেও ওই পেশায় নিযুক্ত হতে হয়।’ রঘু হা হা করে হেসে উঠলো। শুভজিৎ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
‘আরে পাগল আমি ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে। সমাজে সবচেয়ে উঁচু বংশে আমার জন্ম। আমি করব চাকরের কাজ…….।’ রঘু হাসতেই থাকলো।
‘কেন? ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলেরা এমন কাজ করে না বুঝি।’
‘না, ওই সব কাজ তোদের জন্য আমাদের নয়।’
‘আচ্ছা, বুঝেছি।’
রঘু ভীষণ সাহসী এবং বুদ্ধিবান ভালো করে জানে শুভজিৎ। তাকে নিয়েই তাদের বাড়িতে গেল। আবার একই সঙ্গে মেলায় ফিরে আসলো। রঘু সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে গেল। তবে পায়েল দেবী কিছু বললেন না। শুভজিৎ এইটুকু কাজ করে দিয়েছে তাতেই তিনি অনেক খুশি। কিন্তু শুভজিৎ এর পুলিশ দেখা হলো না। সে পায়েল দেবীর মুখে শুনল,এই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশের চরিত্রটি সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। যাত্রার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করল, কিন্তু পুলিশের দেখা পেল না। ভীষণ কষ্ট পেলো। সারাদিনের হাসি নিমিষে মিলিয়ে গেল। এমনটাই হতে হলো? পুলিশ একটু পরে বের হলে হতো না? হাজার হাজার মানুষের খুব ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন এমন ভাবে শেষ হয়ে যায়, শুধুমাত্র অন্যের মুখে সামান্য হাসি ফোটানোর জন্য।
পর্ব ৬ আসছে।।