মায়ারণ্যে পর্ব- ২৩

0
879

#মায়ারণ্যে
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-২৩

★এরই মাঝে তিনদিন পার হয়ে গেছে। মায়া এখন অনেক টা সুস্থ। অবশ্য দিনরাত অরণ্যের সেবা আর কেয়ারে সুস্থ না হয়ে উপায় কই। এই তিনদিনে অরণ্য মায়ার কাছ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যেও সরেনি। মায়ার সবকিছুর খেয়াল রেখেছে। মায়ার এই তিনদিনেই নিজেকে সর্বসুখী মনে হচ্ছে। এতো সুখ ওর কপালে ছিল তার কল্পনায় করেনি ও। নিজের ভাগ্যের ওপর নিজেরই না নজর লেগে যায়।
মায়া সুস্থ হওয়ায় আজকে অরণ্য অফিসে গেছে।

সাহিল এখনো ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ গুনগুন করে কারো কান্নার শব্দ কানে আসতেই সাহিলের ঘুম হালকা হয়ে আসলো।ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় কপাল কুঁচকে চোখ খুলে তাকালো সাহিল। তাকিয়ে দেখলো সারা ওর বেডের পাশে বসে ঠোঁট উল্টিয়ে নাক টেনে টেনে কাঁদছে আর রুমাল দিয়ে নাক মুছছে। সাহিল চমকে গিয়ে দ্রুত উঠে বসে দুই হাতে সারার মুখটা আগলে ধরে অস্থির হয়ে বললো।
–এই পিচ্চি পরি কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বাবু? বল আমাকে?

সারা এবার কান্নার সুরটা আরেকটু লম্বা করে বলে উঠলো।
–মে তো লুটগাই,বরবাদ হো গাই। আব মেরা কেয়া হোগা??

সাহিল ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট? কি বলছিস এসব? যা বলবি ঠিক করে বল।

–কি বলবো আমি? আমি তো এখন কাউকে মুখ দেখাতেই পারবোনা।

–আরে বাবা হয়েছে টা কি বলবি তো?

–হয়নি। হবে। আর বাবা আমি না আপনি হবেন।
–মানে??

–মানে, আমি প্রেগন্যান্ট। আমি মা আর আপনি এই বাচ্চার বাবা হতে চলেছেন?

বেচারা সাহিলের মাথায় যেন ফোটাস করে একটা বোম ফাটলো। পুরো তব্দা খেয়ে অটো হয়ে গেল। নিজেকে সামলাতে তার কিছুক্ষণ সময় লাগলো। অতঃপর একটা রাম ধমক দিয়ে বললো।
–হোয়াট ননসেন্স? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? কি আবোল তাবোল বলছিস এসব?

–আমি মোটেও আবোল তাবোল বলছি না।যা সত্যি তাই বলছি। আর আপনি একটা পোয়াতি মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন? তাও আপনার নিজেরই বাচ্চার মা। কোন সফটনেস নেই আপনার মাঝে? নির্দয় ব্যাক্তি একটা।

সাহিল দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–জাস্ট শাট আপ ইডিয়ট।কে বললো তোকে এই ফালতু কথা? আর আমাদের মাঝে এমন কিছুই হয়নি যে বাচ্চা হবে।

সারা নাক টেনে বললো।
–হু, এখন তো আপনি বলবেনই। আমার সবকিছু লুটে নিয়ে এখন অস্বীকার করছেন?

সাহিল এবার রেগে গিয়ে বললো।
–একটা থাপ্পড় দিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেব।কখন থেকে আবোল তাবোল বলেই যাচ্ছিস।

সারা এবার ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো।কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো।
–আপনি খুবই পঁচা। একটা পোয়াতি মেয়ের গায়ে হাত তুলবেন? উপর ওয়ালা সইবে না।আমিতো ভেবেছিলাম আপনি এই কথাটা শুনে খুশিতে আমাকে কোলে নিয়ে নাচতে শুরু করে দিবেন।আর আপনি কিনা আমাকে মারতে চাচ্ছেন? নিষ্ঠুর, নির্দয়, ব্যভিচারী।

বেচারা সাহিল পড়ে গেল আরেক মুশকিলে। তাই এবার নরম সুরে বললো।
–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে কাঁদে না বাবু। আচ্ছা বলোতো তোমার কেন মনে হলো তুমি প্রেগন্যান্ট? আর এটা আমাদের বাচ্চা সেটাই বা কিভাবে মনে হলো?

–কেন আবার? আপনি সেদিন আমায় কিস করেছিলেন না? আর আজকে সকালেই আমার কেমন উকি উকি লাগছিল।আর আমার টকও খেতে ইচ্ছে করছিল। আমি ছবিতে দেখেছি। নায়ক নায়িকা কিস করে আর পরবর্তী সিনেই নায়িকা প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়।আর নায়িকা বমি করে আর আচার খায়।

সাহিলের এখন এক বদনা পানিতে ডুব দিয়ে, সুইসাইড করে, আত্মহত্যা করতে মন চাইছে।অথবা দেয়ালে মাথা পিটিয়ে মরার আইডিয়া টাও মন্দ না। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো ও। আই মিন লাইক সিরিয়াসলি? কিস করায় প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল? সাহিল কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো।
–আরে পাগলি কিস করলে কেউ প্রেগন্যান্ট হয়না। তুই ভুল ভাবছিস।

সারা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–তাহলে কিভাবে হয়?

সাহিল বাঁকা হেসে সারাকে টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললো।
–সেটা বোঝাতে হলে আগে বিয়ে করতে হবে। তারপরে না তোকে হাতে কলমে বুঝিয়ে দিতে পারবো।

বিষয় টা লজ্জার হলেও আপাতত সারার লজ্জা লাগছে না। সে মলিন সুরে বললো।
–তারমানে আমার পেটে বাচ্চা নেই?

–আরে নারে পাগলীটা। তোর হয়তো গ্যাস হয়েছে তাই সকালে উঁকি উঁকি লেগেছে। আর টক তো তোর এমনিতেই পছন্দ।

সারা মন খারাপ করে বললো।
–ওও, আহারে আমার বাবুটা গায়েব হয়ে গেল? আমিতো আমার বাবুকে কতকিছু ভেবে বসেছিলাম। এখন তো সব মিথ্যে হয়ে গেল।
সারা এবার সাহিলের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
–আচ্ছা বিয়ে করলে বাবু হয় বুঝি?

–হুম হয়তো।

সারা ফট করে বলে উঠলো।
–তাহলে চলুন আমরা বিয়ে করে ফেলি।

সারার অতিশয় নির্দ্বিধায় বলে ফেলা কথায় সাহিল আবারও তব্দা খেয়ে গেল। মানে এখন বাচ্চার জন্য সারা বিয়ে করতে চায়? যে কিনা নিজেই একটা বাচ্চা। যে জানেই না বাচ্চা হয় কিভাবে। সাহিল সোজাসাপটা বলে উঠলো।
–ঠিক আছে তোর বাবাকে গিয়ে বল, আমি সাহিল ভাইয়া কে বিয়ে করতে চাই।

সারা ভ্রু কুচকে বললো।
–কেন? আমি কেন বলবো? আপনি বলবেন।

–আমি কেন বলবো? বাচ্চা তো তুই চাস। তাহলে তুই বলবি। এখন যা আমাকে ঘুমোতে দে।

কথাটা বলেই সাহিল আবারও উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। আর বেচারি সারা নিরাশ হয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে চলে গেল। সারা যেতেই সাহিল ঠোঁট কামড়ে হেঁসে দিল। ওর পিচ্চি পরিটা সত্যিই একটা পাগলী।
_______

সন্ধ্যা ৭ টা।
অরণ্য আজ তাড়াহুড়ো করে অফিস থেকে চলে এসেছে। এখন যে বাসায় ওর সন্ধ্যামালতী আছে। তাইতো কখন বাসায় আসতে পারবে শুধু সেই অপেক্ষায় থাকে। অরণ্য এসে রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই থমকে গেল। ওর সামনে মায়া একটা লাল রঙের জর্জেট শাড়ী পরে দাঁড়িয়ে আছে।চোখে কাজল,ঠোঁটে লিপস্টিক, হাতে লাল চুরি, কানে ঝুমকো, চুলে লাল গোলাপ। সব মিলিয়ে কোন অপ্সরি লাগছে মায়াকে। অরণ্য যেন চোখের পলক ফেলা ভুলে গেল। মায়াপরীর রুপে মোহিত হয়ে গেল।

মায়া লজ্জায় অরণ্যের দিকে তাকাতে পারছেনা। মাথা নিচু করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর হাতের মাঝে শাড়ীর আঁচল খুঁটছে। অরণ্য দরজা আটকে ধীরে ধীরে মায়ার কাছে এগিয়ে এলো। অরণ্য যতো কাছে আসছে মায়া লজ্জায় আরও নুইয়ে পড়ছে। অরণ্য মায়ার কাছে এসে নেশা ভরা চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–আমাকে ঘায়েল করার নতুন প্ল্যান করেছ বুঝি?

মায়া নিচের দিকে চেয়ে থেকে লাজুক হেসে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–আ আসলে ও ওরা করেছে এসব।

অরণ্য হাত বাড়িয়ে মায়ার শাড়ির ফাঁকে মায়ার খোলা কোমড়ে ধীরে ধীরে স্লাইড করে মায়াকে নিজে সাথে মিশিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বললো।
–ওরা কি করেছে? আর কেন করেছে শুনি?

মায়ার কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। কম্পিত স্বরে বলতে লাগলো।
–ও ওওরা বলেছে।

অরণ্য মায়ার কাঁধে নাক ডুবিয়ে কানের কাছে লো ভয়েসে বললো।
–কি বলেছে?

মায়ার এবার কথায় বেড় করতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও বেচারি কোনরকমে বললো।
–ম মা বলেছে আজকে নাকি আমাদের আবারও বিয়ে পড়াবে।

অরণ্য মাথা তুলে বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–আমাদের বিয়ে?

মায়া লাজুক হেসে মাথা ঝাকালো। মানে হ্যাঁ।
অরণ্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
—কিন্তু কেন?

–আসলে মা বললো,আমাদের বিয়েটা তো সবার অজান্তে হয়েছে। তাই লোকে নানান কথা বলতে পারে। সেইজন্য আজকে পরিবারের সামনে বিয়ে পড়াবে।

অরণ্য মুচকি হেসে বললো।
–হ্যাঁ ভালোই হয়েছে। আমিও এবার আমার সন্ধ্যামালতীর সামনে চোখে চোখ রেখে কবুল বলবো।যাতে আমাদের মাঝেও আর কোন সংশয় না থাকে।

ওদের কথার মাঝে সারা এসে দরজয় নক করে বললো।
–ভাবিই বড়মা তোমাদের নিচে আসতে বলেছে। ইমাম সাহেব চলে এসেছেন।

অরণ্য মায়ার আঁচল টেনে মাথায় ওপর দিয়ে, ওর হাত ধরে বাইরে বেড়িয়ে এলো।নিচে এসে দেখলো সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। ওরাও গিয়ে সোফায় বসলো। একটু পরে কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো আরম্ভ করলেন। বিয়ে পড়ানো শেষে সবাই মোনাজাত করলো। তারপর ডিনার শেষে অরণ্য মায়াকে নিয়ে আবার রুমে এলো। রুমে এসে অরণ্য কাবার্ড থেকে একটা বড়ো প্যাকেট নিয়ে এসে মায়ার সামনে বসে বললো।
–জানো আমার অনেক স্বপ্ন ছিল তোমাকে বধূবেশে দেখবো। আর সেই স্বপ্নের চক্করেই এতো গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তবে যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আমি আবারও সুযোগ পেয়েছি। আমি কি আজ আমার সন্ধ্যামালতীকে বধূবেশে দেখতে পারি?

মায়া ছলছল চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাকালো। মানে হ্যাঁ। অরণ্য মুচকি হেসে বললো।
–আজ আমি আমার বধূকে নিজ হাতে সাজাবো।
তারপর অরণ্য প্যাকেট টা খুলে তার ভেতর থেকে একটা লাল বেনারসি বের করলো। এটা সে গতকাল কিনে এনে রেখেছিল। মায়াকে পড়ানোর আশায়।

অরণ্য মায়াকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এনে দাঁড় করালো। মায়ার কাঁধের কাছে হাত দিয়ে শাড়ীর সেফটিপিন খুলে শাড়ীর আঁচল আস্তে করে নামিয়ে দিল। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো মায়া। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। অরণ্য মায়ার পেটের কাছে স্লাইড করে শাড়ির কুঁচি টান দিয়ে খুলে ফেললো। মায়ার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। অরণ্য এবার বেনারসি শাড়ীটা পড়ানো শুরু করলো। শাড়ী পড়ানো শেষে মায়াকে টুলে বসিয়ে দিয়ে এক এক করে গহনা গুলো পড়িয়ে দিল। মায়া শুধু ধ্যানমগ্ন হয়ে অরণ্যের দিকেই তাকিয়ে আছে। এত ভালোবাসা ওর কপালে ছিল? আমার মতো অতি সাধারণ মেয়েকে কেউ এতো কিভাবে ভালোবাসতে পারে? এত সুখ ওর কপালে সইবে তো?

সাজানো শেষে মাথায় আঁচল টেনে ঘোমটা দিয়ে বললো।
–আমার সুন্দরী বঁধু। আমার মায়াপরী।
কথাটা বলে অরণ্য মায়ার কপালে একটা গভীর চুমু একে দিল। তারপর মায়াকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বেলকনিতে এলো। ব্যালকনিতে এসে মায়াকে কোলে নিয়ে ডিভানে বসলো।

অরণ্য মায়ার মুখের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে গালে হাত বুলিয়ে বললো।
–জানো এই মুহূর্ত টার জন্য আমি কতদিন ধরে অপেক্ষা করেছিলাম? নিজেকে আজ পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। জীবন থেকে আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। শুধু সারাটা জীবন এভাবেই আমার পাশেই থেক। আর কিছু চাইনা আমি। ভালোবাসি মায়াপরী। অনেক ভালোবাসি।

মায়া শুধু অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে অরণ্যের দিকে। ও চেয়েও মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারছেনা। হঠাৎ পাওয়া সুখটায় বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ও। অরণ্য বলে উঠলো।
–শুধু আমিই বলবো? তুমিও কিছু বলো। জানো তোমার মনের কথাগুলো শোনার জন্য আমি কতটা ব্যাকুল হয়ে আছি।তুমি কিন্তু এখনো ভালোবাসার কথা বললে না। এবার তোমার পালা বলার।

মায়া ছলছল চোখে অরণ্যের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে অরণ্যের গালে হাত রেখে আবেগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–কি বলবো জানা নেই আমার। কোন ভাষায় প্রকাশ করলে তা শুদ্ধ হবে তাও জানা নেই। জীবনে এমন একটা দিনও আসবে সেটাই জানা ছিলনা আমার। আপনাকে যে এভাবে কখনো নিজের করে পাবো সে আশা করাটাও আমার কাছে দূর্লভ ছিল। সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে ঘুম ভাঙলেই এই সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। সত্যি বলছি এটা যদি কোন স্বপ্ন হয়ে থাকে তাহলে আমি কখনোই এই ঘুম থেকে জাগতে চাইনা। সারাজীবন এই ঘুমের মাঝেই কাটিয়ে দিতে চাই। ভালোবাসা কাকে বলে জানিনা। তবে আপনার প্রতি যে অনুভূতি গুলো আমার মনের বাগান জুড়ে জন্ম নিয়েছে, তার নাম যদি ভালোবাসা হয়ে থাকে তাহলে হ্যাঁ ভালোবাসি। অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। আমি জানি আমি আপনাকে না চাইতেও অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আপনি আমাকে মাফ করলেও আমি নিজেকে যে মাফ করতে পারছিনা। মনের মাঝে অপরাধ বোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমার।

বলতে বলতে মায়ার চোখ দুটো দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলতে লাগলো।
–আমার অনেক ভয় হয়। আমার অপরাধের জন্য যদি আপনাকে হারিয়ে ফেলি? তাহলে যে আমি শেষ হয়ে যাবো। প্রথমে যখন আপনার কাছ থেকে দূরে থাকতাম। তবুও মনকে বুঝ দিয়ে বুকে পাথর চেপে থাকতে পারতাম। তবে এখন আপনাকে পাওয়ার পর যদি আবারও হারিয়ে ফেলি তাহলে কিছুতেই সহ্য করতে পারবোনা। মরে যাবো আমি। আপনি চাইলে আমাকে যতখুশি তত শাস্তি দিন।সত্যি বলছি আমি টু শব্দও করবোনা। শুধু আমাকে নিজের কাছ থেকে কখনো আলাদা করবেন না প্লিজ।

মায়ার এমন করুন কন্ঠ অরণ্যের হৃদয় ভেদ করে দিচ্ছে। অরণ্য দুই হাতে মায়ার মুখটা ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠলো।
–হুঁশশ, এই পাগলী এসব কি বলছো? শরীর কখনো তার আত্মাকে ছাড়তে পারে? তাহলে সে বাঁচবে কি করে? তুমিযে আমার হৃদয়ের স্পন্দন। তুমি না থাকলে যে সে চলাই বন্ধ করে দিবে। আর তোমাকে আমি বলেছিনা, পুরানো আর কোন কথাই মনে করবেনা। এখন থেকে আমাদের নতুন জীবন শুরু হয়েছে। তাই পুরাণ কোনকিছুরই রেশ থাকবেনা আমাদের মাঝে। শুধু ভালোবাসা বাসি থাকবে।

মায়া বলতে লাগলো।
–এখন থেকে আমার সবকিছু আপনার নামে। আমার সবটা জুড়ে শুধুই আপনি। আমার পৃথিবী শুধুই আপনি।আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস শুধুই আপনার নামে। আপনার খুশীর জন্যই বাঁচবো আমি। আপনার হাসিতেই হাসবো আমি।আপনাতেই আমার বসবাস।

মায়ার এমন হৃদয় নিংড়ানো আবেগী কথাগুলো শুনে অরণ্যের মনে যেন প্রাপ্তির এক মহাখুশির ঢেউ বউছে। অরণ্য মায়া ভরা দৃষ্টিতে মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মায়াকে নিজের সাথে আরেকটু শক্ত করে মিশিয়ে নিয়ে নেশা ভরা কন্ঠে বললো।
–তবে শাস্তির কথাটা ঠিকই বলেছ। শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। অনেক কঠিন শাস্তি। রাতদিন প্রতিটা মুহূর্তে পেতে হবে শাস্তি। আর এই শাস্তি থেকে তুমি কখনো নিস্তার পাবে না। তোমাকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হবে।
অরণ্য মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে আরও নেশালো কন্ঠে বললো।
–তো প্রস্তুত তো শাস্তি ভোগের জন্য?

অরণ্যের কথার মর্ম বুঝতে পেরে মায়া লজ্জায় অরণ্যের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে ফেললো। অরণ্য মায়ার থুতনি ধরে মায়ার মুখটা উপরে তুললো। মায়া লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে দুজনেরই। অরণ্য ধীরে ধীরে মাথা ঝুকিয়ে মায়ার অধর যুগলে ডুব দিল। মায়ার অধরের মধু আহরণ করতে লাগলো । মায়া অরণ্যের শার্ট খামচে ধরে নিজেও সেই জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিল। অরণ্য মায়াকে কোলে নিয়ে আবারও রুমে চলে এলো। মায়াকে নিয়ে হারালো মায়ারণ্যের গহীন বনে।
____

পানির কিছু ছিটা গায়ে লাগতেই ঘুম ভেঙে এলো অরণ্যের। অরণ্য কপাল কুঁচকে চোখ মেলে দেখলো ওর সদ্য শাওয়ার নেওয়া নববধু তার ভেজা চুল ঝাড়ছে। ব্যাস এতটুকুই যথেষ্ট ছিল অরণ্যকে পাগল করার জন্য। অরণ্য নেশাময় হাসি দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ার দিকে এগিয়ে গেল। আজ আর ওর বউকে আদর করতে কোন বাঁধা নেই। তাইতো সে মায়ার কাছে এসে শাড়ির ফাঁকে কোমড়ে হাত দিয়ে মায়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মায়ার ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে দিল। মায়া কেঁপে উঠে বললো।
–কি কি করছেন?

অরণ্য মায়ার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে নেশালো কন্ঠে বললো।
–সকাল সকাল আমাকে এই রুপে পাগল করে বলছ কি করছি? পাগল যখন করেছ এখন তার শাস্তিও ভোগ করো।
অরণ্য মায়ার ভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর থেকে সরিয়ে একপাশে রেখে দিল। তারপর মায়ার পিঠে জমে থাকা পানিগুলো ঠোঁট দিয়ে শুষে নিল। শিহরণে মায়ার পিঠ কুঁচকে এলো। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। অরণ্য মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মায়ার ঠোঁটের দিকে এগুতে নিলেই দরজায় টোকা পড়লো। অরণ্য সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে মগ্ন। মায়া তখন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–কে কেউ এসেছে দরজায়।

অরণ্য চেহারায় বিরক্তির ছাপ এনে বললো।
–ধ্যাৎ এই অসময়ে আবার কে ডিসটার্ব করতে এলো? নিজের বউয়ের সাথে একটু শান্তিমতো রোমাঞ্চও করতে দেয়না কেউ।

অরণ্যের এমন অসহায় চেহারা দেখে মায়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। মায়া ঠোঁট টিপে হাসছে। সেটা দেখে অরণ্য বলে উঠলো।
–খুব হাসি পাচ্ছে তাই না? সময় আসতে দাও এর শাস্তি তো তুমি পাবেই। কথাটা বলে অরণ্য মায়ার হাতের টাওয়াল টান দিয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

আর মায়া মুচকি হেসে দরজা খুলে দিয়ে দেখলো সারা এসেছে। সারা বেকুবের মতো বলে উঠলো ।
–ভাবি তুমি এতো সকালে গোসল করেছ কেন? শীত লাগে না তোমার?

সারার কথায় থতমত খেয়ে গেল মায়া। আমতাআমতা করে বললো।
–আ আসলে আমার সকাল সকাল গোসল করাই অভ্যাস।

–ওও আচ্ছা। শোন বড়মা তোমাকে নিচে ডেকেছে।

–আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি এখুনি।

–ঠিক আছে।
___

আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকাতেই চমকে গেল ইরিন। ওর পাশেই ইহান আধশোয়া হয়ে কাত হয়ে এক হাতে ভর দিয়ে ইরিনের দিকেই মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। ইরিন থড়ফড়িয়ে উঠে গায়ের কাপড় ঠিকঠাক করে নিয়ে বিভ্রান্তিকর সুরে বলে উঠলো।
–তু তুমি? তুমি এখানে এভাবে কি করছ?

ইহান আগের মতো থেকেই মুচকি হেসে বললো। –কি আর করবো, আমার ইরাবতীর ঘুমন্ত মায়াবী মুখখানা দেখছিলাম। কিযে শান্তি লাগছিল। ইশশ কবে যে রোজ সকালে এই সুন্দর দৃশ্য টা দেখতে পাবো? বলনা কবে দিবে সেই সুযোগ? কবে আসবে আমার হয়ে? কবে এই খরা পরা জমিনে সুখের বর্ষণ হবে?

ইহানের আবগী কথায় ইরিন কিছুসময়ের জন্য মোহিত হয়ে গেলেও নিজেকে আবার সামলে নিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।
–দেখ ইহান সবকিছুর একটস সীমা আছে। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো তুমি যা চাইছ তা কখনোই সম্ভব না। আমার পিছনে ঘুরে তুমি শুধু তোমার জীবন নষ্ট করছ। প্লিজ এসব বন্ধ করো। তুমি অনেক ভালো একটা ছেলে। তুমি অনেক ভালো কাউকে পাবে। এবং তাকে নিয়ে জীবনে অনেক সুখী হবে।যে সুখ আমি কখনোই তোমাকে দিতে পারবোনা। তখন আর এসব আবেগের কথা মনেও থাকবে না।

ইহান হঠাৎ ইরিনের হাত ধরে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–ডোন্ট ইউ ডেয়ার। আমাকে যা বলার বলতে পারো। তবে আমার ভালোবাসা কে আবেগের নাম দিয়ে ছোট করার চেষ্টাও করবে না। আমি সেটা কখনোই মেনে নিবো না। তোমাকে কতটা ভালোবাসি সেটা হয়তো বোঝাতে সক্ষম না আমি। কারণ আমি নিজেই তার গভীরতার পরিমাপ জানি না। শুধু একটা কথা জেনে রাখ আমার মাঝে আমি বলতে কিছুই নেই। আমার সবকিছুতে শুধু তোমার রাজত্ব । তাই আমি চাইলেও অন্য কাওকে আমার জীবনে জায়গা দিতে পারবোনা। কারণ অন্যকে দেওয়ার মতো আমার মাঝে কিছুই নেই।

ইহানের কথায় ইরিন এবার বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ইহানের দিকে। ইহানের পাগলামির পেছনে যে এতোটা অনুভূতি জড়িয়ে আছে তা ভাবতেই পারে নি ও। ইহান আরও বলে উঠলো।
— আর হ্যাঁ তুমি আমাকে কি সুখ দিতে পারবে সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি শুধু একবার আমারে জীবনে এসো। দেখবে আমার জীবন টা সুখের সাম্রাজ্য হয়ে গেছে।

ইরিন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ইহানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–বলাটা সহজ। তবে বাস্তবতা বড়ই কঠিন। বাস্তবতার সম্মুখীন হলে তখন এই ভালোবাসাই নিজের গলার ফাঁস হয়ে যাবে। যে ভালোবাসা কে এখন সর্বসুখ মনে করছ, সেটাই তখন সর্বদুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর এটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।

ইহান আবেগী কন্ঠে বললো।
–দেখ ইরাবতী আমি জানি তুমি তোমার জীবনে অনেক খারাপ এক্সপেরিয়েন্স পেয়েছ। তাই হয়তো এখন আর কারোর ওপর ভরসা পাচ্ছ না। তবে সবাই এক হয়না। শুধু একটা চান্স দিয়ে দেখ আমাকে। একবার আমার ওপর ভরসা করে দেখ। আই প্রমিজ আমি কখনো তোমাকে নিরাশ করবোনা।

–আচ্ছা তাই? নিজের ওপর এতো কনফিডেন্স তোমার? ওকে ফাইন। চলো মানলাম তোমার কথা। তারপর কি করবে? তোমার পরিবার কি মানবে তোমার কথা? দুই বছরের বড়ো একটা ডিভোর্সি মেয়েকে তাদের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবে তারা? আচ্ছা চলো তাদের কে নাহয় তুমি কোনভাবে মানিয়ে নিলে। কিন্তু বাকি লোকজনের মুখ কিভাবে ঠেকাবে? আমাকে নিয়ে তোমার বন্ধু বান্ধবের সামনে সবসময় ছোট হতে হবে। পারবে সেটা মানতে? তারপর আসি মেইন কথায়।তুমি ছেলে মানুষ। আর সব ছেলের মতো তোমারও কিছু চাহিদা আছে। তো তুমি কি এমন একটা মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে স্যাটিসফাইড হবে যে কিনা আগেই অন্য কারোর কাছে তার….

আর বলতে পারলো না ইরিন। বাকি কথা গলায় আটকে গেল ওর। মুখে হাত চেপে কেঁদে উঠলো ও। ইহান দ্রুত দুই হাতে ইরিনের মুখটা ধরে বললো।
–হুঁশশ হুঁশ, ওকে ওকে ফাইন। কেদনা প্লিজ। তুমি যেসকল বাঁধা দেখিয়েছ সেগুলো আমার জন্য কোন মাইনেই রাখে না। আর হ্যাঁ তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না। তবে তুমি যদি না চাও আমি কখনোই তোমাকে সেই ভাবে কাছে টানবো না। তুমি জানো, তুমি যদি সারাজীবন শুধু আমার বউ হয়ে চোখের সামনে বসে থাকো। এতটুকুতেই আমি সারাজীবন খুশী খুশী কাটিয়ে দিতে পারবো। তবে আমি জানি আমার কোন কথাই হয়তো তোমার বিশ্বাস হবে না। তাও আমি আশা ছাড়বো না। দরকার হলে আমি সারাটা জীবন তোমার অপেক্ষা করবো। তোমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে যদি আমার মরণও হয়ে যায়। তবুও আপসোস নেই আমার।

কথাগুলো বলে ইহান ইরিনের কপালে আলতো করে একটা চুমু খেল। মুহূর্তেই থমকে গেল ইরিন। বুকের মাঝে কবর দিয়ে রাখা হৃদপিণ্ড টা হঠাৎ নতুন উদ্যমে জেগে উঠলো। নতুন অনুভূতির বাতাস ছুয়ে গেল তাকে। ইহান অপরাধী সুরে বলে উঠলো।
–আজ হয়তো নিজের অজান্তেই তোমার পুরান ক্ষতগুলো জাগিয়ে দিয়েছি। অ্যাম সো সরি ইরাবতী। পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে।
কথাটা বলেই ইহান চলে গেল।

আর ইরিন ইহানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা আজ ওকে কেমন যেন এলেমেলো করে দিয়ে গেল। কিন্তু আমিযে আর নতুন কোন জোয়ারে ভাসতে চাইনা। ভয় হয় আমার। বড্ড ভয় হয়।

চলবে…..

গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে আমার গ্রুপে এড হওয়ার আমন্ত্রণ রইল।
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here