মায়ায় ভরা সেই দিনে পর্ব ১০

মায়ায় ভরা সেই দিনে
পর্ব ১০

রাজবীরের রুমে কেউ আসলে এটা একটা শরণার্থী ক‍্যাম্প মনে হবে তার। সব গুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। না আছে কারো ঘুমানোর ঠিক না কারো শরীরের পোশাকের ঠিক। ফজরের নামাজ সেড়ে শুয়েছে সব গুলো। এখন পরে পরে ঘুমাচ্ছে।
বড় আপা রুমের ভিতর ঢুকে হতবাক হয়ে গেলেন। এত বড় বড় ছেলে গুলোর কি দশা ঘুমের। রাজবীরের দিকে চাইতেই মনটা শীতল হয়ে গেলো তার। ইস ভাইটা দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেলো। কি নিস্পাপ চেহারা খানা। আদুরে ছোঁয়ায় কপালের চুল গুলো গুছিয়ে দিলো সে। রাজবীর নড়ে উঠলো পিটপিট করে চেয়ে বোনকে দেখে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো।
কখন এসেছো আপা?
মাত্রই আসলাম ফ্রেশ হয়ে নে নাস্তা করে গোসল করাবে মামি চাচীরা।
রাজবীর আঁতকে উঠলো। বলো কি আপা।
বড় আপা সুন্দর করে হাসলেন। আজকের দিনটাই একটু সহ‍্য করে নে লক্ষী ভাই।
রাজবীর অসহায় চোখে চাইলো। বড় আপা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন যা উঠ ফ্রেশ হয়ে নে। এরপর একে একে জিসান, জিহাদ রাতুল, মুন্না, রোহান ওদেরকে ও মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকে তুলে দিলেন।
সকালের নাস্তা করে বাইরে আসলো ওরা। গ্রামের লোকদের জন‍্য খিচুড়ি করা হয়েছে। রাজবীরদের বাড়ির সামনে বড় মাঠে প‍্যান্ডেল সাজিয়ে সেখানে খাবারের ব‍্যাবস্থা করা হয়েছে। বড় দুলাভাই ছোট দুলাভাই এসবের তদারকি করছিলেন। ওদেরকে দেখে এগিয়ে আসলো। বললো উঠেছো ভালো হয়েছে। লোকজনের খাবারের দিকটা দেখো একটু সাথে।ওরা কাজে ব‍্যাস্ত হয়ে পড়লো।

ইশিতা সকালের নাস্তা সেড়ে ছাদে উঠে আসলো বাড়িতে লোকজনের সমাগমে গিঞ্চি অবস্থা। হাতে মেহেদীর দিকে তাকালো। খুব গাঢ় রঙ হয়েছে। লোকে বলে বিয়ের মেহেদী যত বেশি লাল হয় বর ততই আদর করে। ইশিতা জানে এটা কুসংস্কার কথা। তাও অবুঝ মন বুঝতে চাইছে তার মেহেদী লাল হয়েছে তার বরও তাকে খুব ভালোবাসবে।
ইশিতা ছাদ টা ভালো করে দেখে নিলো। টবে থাকা ফুল গাছ গুলোকেও। তার চোখ ভিজে উঠছে কেবলই। মনের ভিতর কেমন যেনো একটা হাঁসফাস লাগছে। এতো আনন্দ তবুও তার আনন্দ অনুভূতি হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মা বাবা কে ছাড়া কোন অচিণপুরেই না জানি চলে যাচ্ছে সে। কেন এমন লাগছে। ভয় হচ্ছে। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকলো আকাশ পানে সে।
____________________
বেলা এগারোটার দিকেই পার্লার থেকে লোক এসে পড়েছে সাজানো শুরু করতে হবে। রাজবীরদের বাড়ি থেকে চারটা বড় বড় ল‍্যাগেজ ভরে বিয়ের জামা কাপড় কসমেটিকসসহ নানান কিছু পাঠানো হয়েছে। স্বর্ণের পুরো গয়নার সেট দেয়া হয়েছে। ইশিতার মামা খালারা চাচা ফুফুরা খুব খুশি। বিয়ের মধ্যে তাদের মেয়ের শশুর বাড়ি থেকে কোন কিছুরই কমতি রাখেননি। শাড়ি গয়না পড়িয়ে ভাড়ি সাজে পুতুলের মতো লাগছে দেখতে ইশিতাকে। ইশিতা চুপচাপ নির্বিকারভাবে বসে রয়েছে। সবাই বউ দেখছে আর প্রশংসায় পঞ্চমূখ হচ্ছে।
বর যাত্রী আসা শুরু করেছে। বিয়ে বাড়ি উৎসব মূখর হয়ে উঠেছে। জমজমাট পরিবেশ। রাজবীর ইশিতাকে কমিউনিটি সেন্টারের রাজকীয় চেয়ারে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। সবার মধ্যে চঞ্চলা ভাব।বিয়ে পড়ানো মুহূর্তে ভয়ে ইশিতার হাত পা অবশ হয়ে এলো। ভাই ভাবি এসে পাশ দাঁড়িয়ে নানান রকম শান্তনা দিয়ে স্বাভাবাবিক পর্যায়ে এনেছে তাকে। কবুল ঐ গিীয়ে কেঁদে কেটে কি অবস্থা করে ফেলেছে ইশিতা। বিয়ে পড়ানো হলে সবাই আলহামদুলিল্লাহ্ বলে উঠে। মোনাজাত শেষে। বন্ধুদের দলটা ইশিতার কাজিনরা হৈ হৈ করে উঠে পার্টি স্প্রে দিয়ে সাদা ভূত বানিয়ে ফেলেছে একে অপরকে। তাদের কান্ড দেখে বড়দের মধ্যে হাসির রোল পর গেছে। বরের খাবার দেয়া হলে সেখানে আরেক দফা হৈ হল্লা হলো। আস্ত খাসি সাগরানা দেয়া হয়েছে। মরগী ফ্রাই আস্ত রোস্ট গরুর গোস্ত দই বোরহানি জর্দা আরো নানান পদের খাবারে টেবিল ভরে উঠেছে।খুব মজার সাথেই খাবার পর্ব শেষ হলো।
কন‍্যা বিদায়ের মুহূর্তে আসাদ হক রাবেয়া হকের কান্নায় চারপাশ ভারি হয়ে উঠলো। ইশতিয়াক ছেলে মানুষ হয়েও হুু হুু করে কেঁদে ফেললো। ইশিতা আর পারলোনা ঠিক থাকতে। কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারালো সে। তাকে পাজকোলা করে গাড়িতে তুললো রাজবীর। ইশিতার ফ‍্যামিলি কে বুঝিয়ে রওনা দিলো তারা গ্রামের উদ্দেশ্য।
_____________________
বউ নিয়ে এসেছে বউ নিয়ে এসেছে কথাটা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। আফিয়া বেগম বরণ ডালা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ছেলে ছেলের বউ কে বরণ করে ঘরে তুললেন তিনি। ড্রয়িং রুমে বসানো হয়েছে ইশিতাকে। মানুষের ঢল নেমেছে আজ দেওয়ান বাড়িতে। একে একে দল বেঁধে নারী পুরুষ শিশু সব ধরনের মানুষের কি মেলা বউ দেখার। ইশিতার শরীর ক্লান্তি তে নেতিয়ে গেছে। চোখ বুঝে আসছে। বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আস্তে আস্তে লোকজনের ভীর কমতে শুরু করেছে। ইশিতা রাজবীর কে বাড়ির মুরব্বিদের হাতে মিষ্টি মুখ করানো হয়েছে। ইশিতা আর ধকল নিতে পারলো না বেসিনের সামনে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে ভাসালো সব।বড় আপা ছোট আপা দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরলেন। আফিয়া বেগম হাতের কাজ রেখে ছুটে আসলেন। তাদের সাহায্য নিয়ে ইশিতা দু তলায় উঠে আসলো। শাড়ি গহনা সব বড় আপা ছোট আপার হাতে খুলে ফেললো।
ক্লান্ত কন্ঠে বললো আপা শাওয়ার নেবো। ছোট আপা দ্রুত পায়ে লাগেজ থেকে সুতি শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট বের করে দিলেন। শাওয়ার সেড়ে দু তলা মেহমান ঘরেই ঘুমিয়ে পড়লো ইশিতা।
রাজবীরের বন্ধুরা ছাদের ঘরে
গোলাপ বেলী ফুলের মেলা বইয়ে দিয়েছে। ফ্লোর পর্যন্ত বাদ রাখেনি তার গোলাপি সাদার কম্বিনেশনে ঘরটাকে স্বর্গ বলে ভ্রম হচ্ছে।

বন্ধুদের দুলাভাই দের প‍্যানপ‍্যানানিতে বড় রকমের একটা টাকার অংক হাতছাড়া হলো রাজবীরের। বাসর ঘর সাজানোর টিপস্ সেটা।
রাত এগারো টার দিকে ইশিতার ঘুম ভাঙ্গলো। মাথা ভার হয়ে আছে তার। আফিয়া বেগম এসে অল্প করে খাইয়ে দিয়ে গেলেন ওকে।
ইশিতার ঘুম ভাঙ্গার কথা শুনে বড় দুলাভাই ছোট দুলাভাই বন্ধুরা রাজবীরকে টেনে দুতলায় নিয়ে আসে।
রাজবীরকে নিয়ে ঈশিতার রুমে আসে তারা। রাজবীর ব‍্যাস্ত কন্ঠে বলেই যাচ্ছে কি হয়েছে সমস্যা কি আপনাদের? এভাবে টেনে আনলেন কেন?
লোকজনের আওয়াজ পেতেই ইশিতা শাড়ি টেনে ঠিক হয়ে বসলো। ভিতরে ইশিতাকে বসা দেখে এগিয়ে আসলো রাজবীর বললো উঠে গেছো? শরীর এখন কেমন?
ইশিতা মলিন হাসলো বললো মাথায় একটু যন্ত্রণা হচ্ছে।
বড় দুলাভাই এগিয়ে আসলো বললো এতক্ষণে চিল্লিয়ে কান ফাটিয়ে দিচ্ছিলে। আর এখন বউ কে জিজ্ঞাসা হচ্ছে শরীর কেমন।
রাজবীর লাজুক হাসলো।
বন্ধুদের দলটা ঠোঁট টিপে হাসলো টিপ্পনি কেটে বললো থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। নে এবার ঝটপট ভাবিকে কোলে তুলে নে। তারপর রওনা হো তোর ঘরে।
রাজবীর অবাক চোখে তাকালো লা বুঝের মতো করে বললো কাকে কোলে নিবো। আর কোলে নিবো কেন? হেঁটেই তো যাওয়া যায়।
বন্ধুরা দুলাভাইরা তেঁতে উঠলো বললো আরে চোখে দেখো না মেয়েটা অসুস্থ ওর রেস্ট দরকার। নাও এবার চট করে কোলে তুলে নাও তো দেখি। চাইলে দুই তিনটা চুমু টুমু দিতে পারো আমরা মাইন্ড করবো না। রাজবীর ইতরের মতো হাসলো বললো আমার বউকে আমি যখন ইচ্ছা তখন চুমু দিবো। তবে আপনাদের সামনেই কেন?
তাদের লাগামহীন কথা চলতেই থাকলো। ইশিতা লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। তর্ক বন্ধ হলে রাজবীর এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলো ইশিতাকে। বন্ধুদের দলটা হৈ হৈ করে উঠলো।ভিডিও ফটো তুলে নিলো কতগুলো। রাজবীর গরম চোখে তাকালো বললো সর সামনে থেকে অশ্লীল গুলো। সব গুলো যেন বিরাট কৌতুক শুনে ফেলেছে এমন ভাবে হাসতে থাকলো। সামনে থেকে সড়ে গিয়ে রাজবীরকে যাবার রাস্তা করে দিলো। রাজবীর হেঁটে তাদের ছাদের ঘরে উঠে আসলো। রুমের ভিতর এসে অপরূপ সৌন্দর্য দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। ইশিতাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো রাজবীর।ইশিতা বিমোহিত চোখে রুমটার সাজ দেখে নিলো। গোলাপ বেলীর তীব্র গন্ধে ঝিমুনি এসে যাচ্ছে। রাজবীর ইশিতার পাশে বসলো বললো শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?
ইশিতা রাজবীরের দিকে তাকালো বললো না। খুব সুন্দর হয়েছে রুমটা সাজানো। রাজবীর মৃদু হাসলো। মাথা নেড়ে সায় জানালো।
রাজবীর অপলক তাকিয়ে ইশিতাকে দেখতে থাকলো। ইশিতা রাজবীরের দিকে ফিরে বললো কিছু বলবেন?
রাজবীর সংযত হলো। অজু করে এসো শুকরিয়া আদায়ের দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে নেই।
ইশিতা উঠে গিয়ে অজু করে আসলো। দুজনে একসঙ্গে নামাজ আদায় করলো মোনাজাত করলো। মহান রবের কৃতজ্ঞতা আদায় করলো।
ইশিতা বিছানায় বসলো তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। শরীর কেমন ছেড়ে দিচ্ছে। রাত জাগা আর টাইম মতো না খাওয়ার ফল এটা। বিছানার হেড বোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো সে। রাজবীর পাশের রুমের কাবার্ড থেকে একটা জুয়েলারি বক্স পাঞ্জাবীর পকেটে নিলো। ইশিতার পাশে বসে চুলে হাত দিয়ে বিড়বিড়িয়ে একটা দুআ আওড়িয়ে কপালে ফু দিলো। সাথে ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ দিলো। ইশিতা শিউরে উঠে রাজবীরের পাঞ্জাবীর কলার চেপে ধরলো। রাজবীর মৃদু হাসলো। ইশিতার পা গুলো টেনে নিয়ে নিজের কোলের উপর রাখলো। ইশিতা মৃদু চিৎকার করে উঠলো কি করছেন? পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?
রাজবীর কোন উত্তর দিলো না। পকেট থেকে বক্স টা বের করে সোনার তৈরী পায়েল দুটো পরিয়ে দিলো ইশিতার পায়ে। ইশিতা সেদিকে চেয়ে থাকলো মুগ্ধ নয়নে। তার চোখের দৃষ্টি নিভু নিভু। রাজবীর ইশিতাকে বুকে টেনে নিলো। ইশিতা আদুরে ভাবে লেপ্টে থাকলো। চুলা হাত বুলিয়ে দিলো ধীরে ধীরে। ঘুমাও রেস্ট প্রয়োজন তোমার। ইশিতাকে বিছানায় সুইয়ে দিলো রাজবীর। কিছুক্ষণ ইশিতার মিষ্টি চেহারা টা দেখে সে ও ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।

চলবে
জান্নাত রেশমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here