মায়ায় ভরা সেই দিনে
পর্ব ৬
কিছু সময় পূর্বেই এক চোট ঝেঁপে বৃষ্টি নেমে গেছে। হওয়ায় ঠান্ডা রেশ। রাজবীর তার বন্ধুরা ছাদে বসে ছাতার নীচের চেয়ারে। গল্প গুজবে মশগুল তারা। সাথে চানাচুর চিবোচ্ছে আর কোক গিলছে। ছাদ থেকে নদী দৃশ্যমান সাথে তার পাশে বিশাল আখক্ষেত। মুন্না রাতুল ফুসুর ফুসুর করছে তাদের মাথায় দুষ্টুমি চেপেছে। বলতে গেলে বড় রকমের শয়তানি চেপেছে। রাজবীর খেয়াল করেও নির্বিকারভাবে ফোনে ষ্ক্রোল করছে। একে একে মুন্না রাতুল থেকে জিসান জিহাদ রোহনের মধ্যে কথা দেয়া নেয়া হলো। সবাই ভিষণ এক্সসাইটেড ব্যাপার টা নিয়ে। রাজবীরের নিকট চেয়ার টেনে চেপে আসলো ওরা। রাজবীরের সুদর্শন মুখে ইতেরর ন্যায় বাঁকা হাসির রেখা ফুটলো। ভ্রু নাচিয়ে বললো কি খবর মামারা?
দোস্ত বড় রকমের একটা মিশনে যাবো আজ। রাজবীর ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে কি মিশন?শুনি তো
আখক্ষেত থেকে আখ তুলে আনবো খেতে সামনের ক্ষেতেরটার আখগুলো লাল মোটা মোটা রস হবে খেতে খুব।
রাজবীর অবাক হলো বললো মাথা খারাপ তোদের? দিনের বেলা লোকে দেখলে আব্বার কাছে বিচার দিবে।
বন্ধুদের দিকে একপলক তাকিয়ে বললো তোদের জন্য আখ আনার ব্যাবস্থা করছি একটু ওয়েট কর।
বন্ধুরা ঠোঁট ভাঙ্গিয়ে বললো কিভাবে?
অলক কে বলছি ও নৌকা করে গিয়ে নিয়ে আসবে।
বন্ধুদের সবাই হইহই করে উঠলো বললো ঠিক আছে ঠিক আছে।
রাজবীরের ডাকে অলক উপরে আসলো অলককে বুঝিয়ে টাকা দিয়ে আখক্ষেতে পাঠালো। অলক ভদ্রছেলের মতো টাকা হাতে প্রস্থান নিলো।
কিছুক্ষণ চুপচাপ সময় কাটলো বন্ধুদের মধ্যে আবারো ফিসফিসিয়ে কথা বলার বাতিক শুরু হলো। রাজবীর এবার সরাসরি সবগুলোর দিকে তাকালো বললো আবার কি হলো তোদের??
তুমি বন্ধু মানুষ ভালা না………… সুর করে এক লাইন গেয়ে উঠলো।
রাজবীর ওদের এই বিহেভে অবাক হলো না ভ্রু নাঁচিয়ে বললো কেন বন্ধু আমি আবার করলাম। কোথায় আঘাত করে মাসুম বাচ্চাদের কে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। ইস রে রাজবীরের মুখে আফসোসের আওয়াজ। বন্ধুরা তেঁতে উঠলো চুপ শালা এত দিন এক সাথে আছি তাও তোর মুখ থেকে এখন পর্যন্ত তোর প্রেমের কাহিনী টা শুনতে পারলাম না। রাজবীর হঠাৎ উদাস হয়ে গেলো দুর আকাশে তাকিয়ে অতীত হাতড়ালো। বন্ধুদের দিকে চেয়ে বললো এটা একটা বাজে ঘটনা। প্রেমে পরার মতো বাজে জিনিস আর দুইটা হয় না। তোরা কিন্তু এই দিক দিয়ে বহুত ভালো আছিস এসব প্রেম ফেম করিসনা কেউই।
তোর সত্যিই মনে হয় প্রেম বাজে খারাপ?
হ্যা অবশ্যই যদি প্রেম টা ভুল মানুষের সাথে হয় তবে সেটা গলায় ফাঁসের মতো। আর যদি সঠিক মানুষের সাথে হয় তবে তা পরিশুদ্ধ নির্মল বাতাসের মতো প্রশান্তিকর। তোর কোনটা??
দুটোই দুটোর অভিজ্ঞতাই আছে আমার। অবাক হচ্ছিস কেন? ভুল তো মানুষেরই হয়। শুরু থেকে বলছি নয়তো বুঝবিনা তোরা।
_________________
আমার বারো বছর আর ইশিতার ছয় সাত বছর হবে বোধহয়। দাদাজান বেঁচেছিলেন তখন। গ্রামে বাৎসরিক মেলা উৎসবে ইশিতা ইশতিয়াক ভাইকে নিয়ে আসাদ আংকেল আন্টি আমাদের বাসায় আসলেন। বড় আপা ছোট আপা সবাই মিলে সেকি আনন্দ হৈ হল্লা। মেমোরি শার্প হবার কারনেই সম্ভবত তখনকার সব ঘটনাই মনে আছে আমার। ইশিতার মিষ্টি চেহারা তোতা পাখির ন্যায় কথা দাদাজানের পছন্দ হলো খুব। আর তার এই পছন্দই আমার ইশিতার বাল্যবিবাহ্ হয় তখন। আব্বা দাদাজান বলার সাথে সাথেই রাজি হয়ে যায়। আসাদ আংকেল প্রথমটায় দ্বিধান্বিত ছিলেন পরে রাজি হন। তখন কিন্তু আমাদের অবস্থা এতো উন্নতি ছিলো না মধ্যম ছিলো সব কিছু। আর আব্বাও মেম্বার ছিলো না । তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ মজবুত সম্পর্ক অটল ছিলো। সে যাই হোক পুরোপুরি রীতি মেনে সব নিয়ম কানুন পালন করে ইশিতার আমার বিয়ে হয় তখন। দাদাজান কি খুশি ছিলেন। সেই বছর নভেম্বর মাসেই দাদাজান মৃত্যুবরণ করলেন। আস্তে আস্তে সময় চলে গেলো। বড় আপার বিয়ে হলো। তখন আমি নিউ টেইনে কেবল। তবে মাথায় সবসময়ই ছিলো আমি ইশিতা ছোট বেলার জামাই বউ। মা আব্বা কখনও এই বিষয়ে কিছু বলেনি তারা জানতো মনে হয় আমি আমার লেখাপড়া ছাড়া অন্যদিকে ফোকাস করবো না। তবে তাদের আশা আমি বেশি দিন ধরে রাখতে পারিনি। বড় আপা আমার ভাবগতি বুঝেছিলেন তখন আমি কলেজে উঠেছি। আপা ডেকে নিয়ে বুঝালেন যে আমার ইশিতার সাথে বিয়ে ঠিক করা। যখন আমার লেখাপড়া শেষ হবে আমি ভালো জব করবো তখন আমার ইশিতার সামাজিক নিয়মে বিয়ে হবে। তাই প্রেম টেম যেন এড়িয়ে চলি। আপার কথায় কাজ হলো। মাথা থেকে প্রেম ঝেড়ে ফেললাম। আসলে বহুু মেয়ের থেকে প্রোপোজ পেতে পেতে মনটা দুর্বল হয়ে পড়ছিল আর তা ষোলকলায় পূর্ণ হলো ইশিতাকে ছোট আপার বিয়েতে দেখে। তখন আমি অনার্সে আর ইশিতা কলেজে। আঠারো বছর বয়স ওর। তো ওকে দেখে ভিষণ ভাবে প্রেমে পড়লাম আমি ওর। ওকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগছিল না আমার। ওকে দেখার জন্য ছটফট করতাম প্রতিক্ষণ। ও তখন কিশোরী বয়সের আনন্দে মজে। এসব কিছু ও জানতো না। আমি ওর কাছ ঘেষে দাড়িয়ে থাকতাম। অবাক চোখে চেয়ে থাকতাম ওর মুখ পানে। ও তো জানতো না আমার ভিতরে তখন কি ঝড় বইছে। মায়ের চোখে পড়ে আমার এরকম খাপছাড়া ব্যাবহার সে আব্বাকে জানায় আব্বা ডেকে পাঠালেন আমায় তখন নতুন মেম্বার তিনি কাজ কর্ম বিচার শালিস এসব নিয়ে সে খুব ব্যাস্ত সময় পার করছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি চাই আমি নিঃসংকোচ ভাবে বললাম আমি ইশিতার সাথে প্রেম করতে চাই বিয়ে যেহেতু হবেই তাহলে আগে থেকে দুজন দুজনকে চিনি বুঝি যাতে বিয়ের পর সংসার জীবনটা সুন্দর হয়। আব্বা আমার মুখের দিকে কিছক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন এই বিষয়ে তোমার সাথে পরে কথা বলবো। আমি আমার রুমে চলে আসি তখন। রাতের বেলা আব্বা আমার রুমে এসে ভিষন রাগ ঝাড়লেন আমার প্রতি। আমি কেন এই বয়সে প্রেম করতে পাগল হয়েছি। এসব যেন মাথায় না আনি। হ্যানতেন কত কি। আমি বোকার মতো আব্বার দিকে চেয়ে ছিলাম কেবল। পরে শুনলাম বড়রা বসে মিটিং বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ব্যাপারে। আসাদ আংকেল ইশতিয়াক ভাই আমার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আমি নাকি ঢাকায় কোন বাজে ছেলেদের সঙ্গে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
আমার তখন খুব কষ্ট লাগলো আর ঠিক এর কিছুদিন পর ঢাকায় এসে রিমা নামের একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে যাই। মেয়েটা বহুুবার প্রোপোজ করেছিলো। না করার পরেও পিছনে পড়ে ছিলো তো ওর সাথে সম্পর্ক করার কারন ছিলো আব্বার সাথে রাগ মনের অশান্তি ইশিতাকে ভুলতে না পারার যন্ত্রণা। ভাবলাম হয়তো আমার জন্য ভালো হবে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আর কি। রিমা মেয়েটা লোভে পরেছিলো আমার টাকা পয়সা আছে শুনে। তবে আমি মানিয়ে নিতে চেয়েছিলাম ওর সাথে কিন্তু পারিনি। আমি টিউশনি করে ওর আবদার মেটাতাম। তবে এতে ওর পোষায় নি। সাধারণ অজুহাত দেখিয়ে সম্পর্কে ইতি টেনেছিলো। আমিও হাফ ছেড়ে বেঁচেছি।পরে অবশ্য মেয়েটা ফিরতে চেয়েছিল কিন্তু আমার আর আগ্রহ হয়নি। এর পর মাষ্টার্সের কমপ্লিট করার জন্য যখন নতুন ফ্ল্যাটে তোদের সঙ্গী হলাম। নিজেকে শক্ত করলাম। আবেগকে বিদায় জানালাম। এখনতো বেশ আছি। এইতো চলছে।
বন্ধুদের সবার মনটাই খারাপ। রাজবীর সিড়ির দিকে তাকিয়ে। লাল রঙ্গের ওড়নার কোনা বাতাসে দুলছে। ইশিতা অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে। মেয়েটা সব শুনেছে। রাজবীরের ভিতর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না যেন এটা নরমাল একটা বিষয়। একদিন তো সব জানতোই এখন না হয় একটু আগেই জেনে গেলো।
ঠকঠক শব্দ তুলে ইশিতা নেমে গেলো রাজবীর সস্তির শ্বাস ফেললো। মেয়েটা বুদ্ধিমতি কোন সিনক্রিয়েট করেনি এই ঢের।
অলক আখ এর গাট্টি মাথায় করে এনে রাজবীরদের সামনে ফেললো। সবার দিকে তাকিয়ে বললো ইশিতা আপারে দেখলাম নিচে নামতাছে। কইলাম আহেন উপরে আখ খাইতে। বাপরে কেমন রাগি চোখে চাইলো হেয়।
বন্ধুদের দলটা আখ এর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। অলকের কথা শুনে চমকে গেলো তারা। রাজবীর মৃদু হাসলো বললো কুল। আমাদের সাথে গল্প করার জন্য বোধহয় এসেছিল।ভাগ্য সহায় তাই সব শুনে নিয়েছে।
তুই ওকে দেখেছিলি
হ্যা
ও আল্লাহ্ এখন কি হবে?
যা হবার হবে। তোরা তোদের রসালো আখ চিবা। বিষাদের রঙ কেটে গেল সবার হাসি মজায় আখের মিষ্টি রসে ডুবে রইলো সবাই। ইস্ বন্ধু কি মিষ্টি মধুর একটা শব্দ।
চলবে
জান্নাত রেশমি