#মৃণালিনী
#পর্ব ১০
দিন টা শনিবার, সৌম্য বিকেলের ট্রেনে ফিরে আসবে, তাকে স্টেশন থেকে আনতে গাড়ি গিয়েছে, এই নিস্তব্ধ গ্রামে সন্ধ্যে হয়ে গেলে যথেষ্ট দূর থেকে গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়, তাই মৃণালিনী অধীর আগ্রহে কান পেতে দোতলার নিজের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সাত দিন অনেক লম্বা সময়, সারা সপ্তাহ শুধু এই দিনটার জন্যেই অপেক্ষা করে থাকা।
সকালের ঘটনার পর থেকেই তার মন খুব খারাপ হয়েছিলো, দুপুরে গিয়ে নিচে খেয়ে আসা ছাড়া তার সারাদিনে আর করণীয় কিছু ছিলো না আজ। সারা দুপুর কান্না কাটি করার পরে এতক্ষনে উঠে কাপড় ছেড়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো।
একটু পরেই দূরে অন্ধকারের বুক চিরে গাড়ির হেড লাইট দেখতে পেয়েই দৌড়ে নীচে নামলো মৃণালিনী, সৌম্য এসেই দোতলায় নিজের ঘরে উঠবে, সেই সময় যদি মৃণাল ঘরে থাকে তাহলে পারুল বালা বিরক্ত হন। সারাক্ষন বউ স্বামীর সামনে ঘুরে বেড়াবে এটা তাঁর একটুও পছন্দ নয়। মৃণাল যথেষ্টই বুদ্ধিমতী, আজ যে বড়ো মা আরও বেশি করে তার খুঁত খুঁজতে ব্যস্ত থাকবেন সে জানে, তাই একটুও সুযোগ সে দিতে চায়না।
নিচে নেমে এসে সে সোজা রান্না ঘরে ঢুকে গেলো। সৌম্য গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই পারুল বালা এগিয়ে এলেন, ড্রাইভার মাল পত্র বার করে দাওয়ায় রাখলো। অনেকের অনেক ফরমায়েশি জিনিস আছে, সাথে পারুল বালার জর্দা। জর্দা ছাড়া চলে না তাঁর, সেই জর্দা সৌম্য কলকাতা থেকে নিয়ে আসে।
ঢুকেই এদিক ওদিক তাকালেন পারুল বালা, মৃণালিনী কে দেখতে না পেয়ে যথেষ্টই হতাশ হলেন, এখানে তাকে দেখতে পেলেই কিছু কথা শোনাতেন, কিন্তু সে সুযোগ তাঁর হাত ছাড়া হয়ে গেলো। এমনিতেই তেলের খবর না পাওয়ায় তিনি যথেষ্টই চিন্তিত আছেন, এই মেয়েটির সঙ্গে যেনো কিছুতেই পেরে উঠছেন না তিনি।
রাত বাড়ছিলো, এতক্ষন সবাই সৌম্যর জন্যেই অপেক্ষা করছিলো, তাই ছেলে বাড়ি ঢোকার পর পরই তাঁকে নিয়ে খেতে বসলেন শ্যাম সুন্দর। বড়ো জা কে গম্ভীর মুখে ছেলের সামনে পাখা হাতে বসতে দেখেই মনে মনে প্রমাদ গনলেন কুমুদ। সকাল থেকে যে পরিমাণ অপমান তিনি বউ কে করেছেন সেটা দেখতে পেলেও প্রতিবাদ করার মতো সাহস তাঁর নেই। কিন্তু বউয়ের শুকনো মুখ দেখে তাঁর খারাপ লাগছিলো বৈ কি!
তোমার বউ বড্ড মুখরা বাবা, একটু তাকে বুঝিয়ে বোলো, আমরা তো আর শহরে থাকিনা। লোকের মুখ তো বন্ধ করাই দায় হয়ে উটচে গো!
বড়ো মার কথায় চমকে তাকিয়ে উঠে কারণ বুঝতে চেষ্টা করলো সৌম্য, তার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে আরও বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি,
তোমাকেই আর কি দোষ দিই বাছা, সারা হপ্তা তো আর থাক নে তুমি, আর মেয়েও তো আর তুমি দেকনি কো। দোষ তোমার বাবার, কার কতায় যে এই মেয়ে কে পছন্দ করে আনলেন কে জানে!
বড়ো মার এই কথায় তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে ফেললো সৌম্য, পাছে এই বিয়ের পেছনে তার ভূমিকার কথাও বাবার জানার দৌলতে প্রকাশ্যে চলে আসে! তাহলেই বিরাট বিপদের মুখে পড়বে সে। কিন্তু গতকাল থেকেই একই প্রসঙ্গে বিরক্ত হয়ে ওঠা শ্যাম সুন্দর আর বৌদি কে এগোতে দিলেন না,
থাক না এসব কথা! কালই তো বলে দিয়েছি, আর নতুন করে কেনো!
দেওরের কথায় আপাতত এ প্রসঙ্গে বড়ো মা ইতি টানলেও সৌম্য একটু ক্ষুব্ধ হলো। সারা সপ্তাহ পরে একদিনের জন্যে বাড়িতে ঢুকেই এসব তার ভালো লাগছিলো না।
তাঁদের খাওয়া মিটে যাওয়ার পর মহিলাদের খাওয়া দাওয়া মিটতে আরও কিছু রাত হলো। এদিকে সরমা অস্থির হয়ে পড়ছিলো বই এর জন্যে। আজ সে মায়ের কাছে রাতে শোবে, তাই চিঠি পড়া সম্ভব হবে না তখন।
বউ দিদি দাদার কাছ থেকে একটু এনে দাওনা বই টা!
মৃণাল কে কয়েক মিনিটের জন্যে একা পেয়ে ধরে বসলো সরমা,কাজ কর্ম মিটে গিয়েছিলো প্রায়, মৃণাল আস্তে আস্তে উপরে উঠে এলো। সৌম্য বই নিয়ে বসে ছিলো, দরজা ঠেলে ঢুকতেই ফিরে তাকালো।
লাইব্রেরী থেকে বই পাল্টে এনেছো?
একটু কুণ্ঠিত গলায় বললো মৃণাল। সরমা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
এখনই পড়বে নাকি! অনেক রাত হয়েছে, আলো নিভিয়ে দাও,
অবাক গলায় বললো সৌম্য, মৃণালের এতো আগ্রহের কারণ ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলো না। মৃণালিনী একটু থতমত খেলো, সরমা র মুখটা মনে ভেসে উঠলো একবার, বেচারা খুব কষ্ট পাবে!
না না একবার দেখেই রেখে দেবো,
বলতে বলতেই সৌম্যর বাক্স খুলে বই টা বার করে নিয়েই দ্রুত বারান্দায় বেরিয়ে গেলো মৃণাল। সরমা র হাতে চিঠি টা বার করে দিলো বইয়ের ভেতর থেকে, সরমা নিচে নেমে গেলো, একটু পরেই ভেতরে ঢুকে বইটা টেবিলের ওপর রেখে দিলো।
বাইরের এই অন্ধকারে বই পড়লে!
ইতিমধ্যেই বড়মার কথায় বিরক্ত হয়ে থাকা সৌম্য, বউয়ের এই অদ্ভুত আচরণে আরও বিরক্ত হলো। একটু ভয় পাওয়া চোখে সৌম্যর দিকে তাকালো মৃণালিনী, সৌম্যর মুখে কেমন যেনো অবিশ্বাসের ছায়া, ভ্র কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
আলো নিভিয়ে দি? অনেক রাত হয়েছে, কাল পড়বো,
প্রসঙ্গ পাল্টাতে তাড়াতাড়ি লন্ঠন টা হাতে নিয়ে নিলো মৃণালিনী, সৌম্যর তাকানোর কোনো পরিবর্তন হলো না দেখে মনে মনে একটু চিন্তায় পড়লো ও, সরমা বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ে! এবার থেকে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে!
এই প্রথম বার খাটে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে পড়লো সৌম্য, মৃণালিনীর খুব খারাপ লাগছিলো, সৌম্যর যে খুব রাগ হয়েছে সেটা বুঝতে পেরে সৌম্যর পিঠে হাত রাখলো ও,
তুমি কি রেগে গেছো! জানোতো কি বই না দেখা পর্যন্ত ধৈর্য্য থাকে না আমার!
কি বই সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো বলে দিতাম! তার জন্যে বাক্স খুলে এক্ষুনি বার করার কি দরকার ছিলো?
বেশ বিরক্ত গলায় বললো সৌম্য, এর উত্তরে কি বলা যায় সেটা ভাবার আগেই আবার কড়া গলায় বললো,
আর কথা বলো না, আমার ঘুম পাচ্ছে!
বড়ো মার কথাতেই যে সৌম্য এতটা রেগে আছে সেটা মৃণাল বুঝতে পারছিলো। কিন্তু ওর কাছে তো ঘটনাটা একবারের জন্যেও জানতে চাইলো না ও! বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত এতো কড়া কথা কোনো দিনও বলেনি আগে ওর সঙ্গে মৃণালিনী খুব দুঃখ পেলো, একটা বই ই তো বার করেছে শুধু! তার জন্যে এতো রাগ! সকাল থেকে জমে থাকা অভিমান আরও বেশি করে বেড়ে গেলো, আর কোনো কথা না বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো সেও।
প্রতিদিনের মতোই সকালে ঘুম ভেঙে বউ কে পাশে দেখতে পেলনা সৌম্য, এই সময় টা বড়ো মা র পুজোর ফুল তোলে মৃণাল। ওর খুব খারাপ লাগছিলো, সামান্য একটা বই বার করা নিয়ে অতো টা কড়া হওয়া ঠিক হয়নি, সেটা নিজেও বুঝতে পারছিলো। সব কিছুর মুলে আসলে যে বড়ো মার ঘরে ঢোকা মাত্র ওকে উত্তেজিত করা এটা বুঝেই আরও নিজের ওপর বিরক্তি আসছিলো। একটু পরেই মৃণালিনী চা নিয়ে ঘরে ঢুকবে, তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো ও। কিছুক্ষণ পরেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার আওয়াজ পেয়েই সৌম্য উঠে বসলো, সবে কাল রাতের ঘটনার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করতে যাচ্ছিলো, তার আগেই ঘরে ঢোকা অপরিচিত একটা মেয়ে কে দেখে চমকে গেলো ও।
আপনি কে? এখানে কি করছেন! মৃণাল কোথায়?
চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো ও,
আমি করুণা, পিসির সঙ্গে এখানে এসেছি, আপনাদের বামুন দিদি। বউ দিদি আপনার চা পাঠিয়ে দিলেন, উনি ব্যস্ত আছেন,
বলতে বলতে চায়ের কাপ টা টেবিলের ওপরে রাখল করুণা, মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো সৌম্য। তার ওপরে রাগেই যে মৃণাল নিজে না চা এনে এই মেয়েটির হাতে পাঠিয়ে দিয়েছে সেটা সে বুঝতে পারছিলো, সে কোনো অপরিচিত মেয়ের ঘরে আসা একদম পছন্দ করে না।
শুনুন, এর পর থেকে আর আপনি আসবেন না, মৃণাল কে বলে দেবেন আমি একথা বলেছি,
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো ও, মেয়েটা একটু ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেলো। সকাল টা একদম তিত লাগছিলো সৌম্যর, মৃণালিনী একটু অভিমানী, একটু জেদি সে জানে, কিন্তু তা বলে নিজে না এসে, একটা অপরিচিত মেয়ে কে ভোর বেলা ওর ঘরে চা দিয়ে পাঠিয়ে দেবে! টেবিলের ওপর চায়ের কাপ পড়েই রইলো, ছুঁয়েও দেখলো না সৌম্য, ও যে কতো টা বিরক্ত হয়েছে ও মৃণাল কে দেখাতে চায়।
মৃণাল ঠাকুর ঘরে ফুলের ঝুড়ি টা নামিয়ে রেখে রান্না ঘরে এসে ঢুকলো, বামুন দিদি চা করেছে, সবার হাতে হাতে চায়ের কাপ। নিজে ও চা খায় না, কেটলি থেকে সৌম্যর জন্যে চা ঢালতে গিয়ে দেখলো কেটলি খালি! বামুন দিদি কি ভুলে গেছে সৌম্যর কথা! অবাক হলো মৃণালিনী, এরকম ভুল তো হয়না তাঁর! কাল রাতে রাগারাগির পরে সকাল বেলায় চা নিয়ে গিয়েই সৌম্য কে ঘুম থেকে তুলবে মনে মনে ভেবে রেখেছিলো ও। হাতে শুধু দুটো দিন, তার পরেই আবার ফিরে যাওয়া, তাই কোনো মনোমালিন্য রাখতে চায় না ও!
চা করুণা দিয়ে এসেছে, এবার থেকে ওই দিয়ে আসবে এসব, তোমার বার বার ওপরে ওঠার দরকার নেই। এতো ওপর নিচ করলে অসুস্থ হয়ে পড়বে, এসব তো তোমার অতো অভ্যেস নেই বাছা, তাই ওকেই বলেছি করতে,
ওকে চায়ের খালি কেটলি হাতে বিস্মিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন পারুল বালা, মৃণাল একদম অবাক হয়ে গেলো! বড়ো মা যে ওর সৌম্যর সঙ্গে দেখা হওয়া আটকাতে চাইছেন, সেটা বুঝতে একটুও দেরি হলো না বুদ্ধিমতী মৃণালের, কিন্তু ও চুপ করে থাকলো।
পারুল বালা মনে মনে খুব খুশি হলেন, এই যে বিভিন্ন ছুতোয় মৃণাল ওপরে যায় বার বার এটা কিভাবে আটকাবেন অনেকদিন ধরেই ভাবছিলেন। করুণা আসায় তাঁর খুব সুবিধা হলো, হারুর মা বাদেও আরও একজন কাউকে তিনি পেলেন যাকে নিজের প্রয়োজনে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করা যায়। মৃণাল ওখান থেকে চলে গিয়েছে দেখে করুণা কে ডেকে পাঠালেন তিনি,
চা দিয়ে এসেছিস দাদা কে?
করুণা ঘাড় হেলা লো,
দাদা আমাকে আর ওই ঘরে যেতে বারণ করেছেন,
করুণার উত্তরে গম্ভীর হয়ে গেলেন পারুল বালা,
শোন এই কথাগুলো বৌদি দি কে বলার দরকার নেই! তুই যেমন যাচ্ছিস, তেমনই যাবি, দাদা কোনো কথা বললে উত্তর দিবি না, মনে থাকবে তো! আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি বউ দিদি তোকে যেতে বলেছে,
ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেলো করুণা, এতদিন পরে তিনি বাগে আনার সুযোগ পেয়েছেন মৃণালিনী কে, একটুও সে সুযোগ হারাতে চান না। এই মেয়েটা নিজের ক্ষমতায় তাঁর সংসার দখলে আনতে চলেছে ক্রমশ, সেটা তিনি হতে দেবেন না কিছুতেই। জীবনে কিই বা আছে তাঁর, এই সংসার টুকু ছাড়া! কুমুদ পারেনি, আর এইটুকু একটা মেয়ের কাছে তিনি হেরে যাবেন! কোনো দিনও হতে পারে না।
ক্রমশ