#মৃণালিনী
#পর্ব ১১
বেশ কিছুক্ষন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার পরে আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে বসলো সৌম্য। চা রেখে করুণা চলে যাবার পরেও প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হয়ে গেছে, মৃণালিনী এক বারের জন্যেও ঘরে আসেনি, সৌম্যর বিরক্তি ক্রমশ বাড়ছিলো। মেসে থাকলে এই সময়ে অন্তত বার দুয়েক চা খাওয়া হয়ে যায়, আজ সকাল থেকে এক কাপ চাও পেটে পড়েনি। টেবিলের ওপর সেই থেকেই চায়ের কাপ পড়ে আছে, চা না খেলেই মাথা ধরে যায় ওর। জলখাবার নিয়ে মৃণালের ঘরে আসার প্রতীক্ষা করছিলো সৌম্য।
একটু পরেই আবার লুচির থালা হাতে মৃণালিনীর বদলে করুণা কে ঘরে ঢুকে আসতে দেখেই মেজাজ হারালো ও,
আপনাকে বলেছিলাম আপনি এঘরে আসবেন না, বলেন নি সেটা বৌদি কে?
বলেছিলাম, বৌদি দি ব্যস্ত আছেন,
হাত থেকে থালাটা টেবিলের ওপরে নামাতে নামাতে উত্তর দিলো করুণা। মৃণাল এতটাই ব্যস্ত যে করুণা বলা সত্বেও এলো না! ধরে থাকা মাথাটা যেনো আরও বেশি করে ধরে গেলো সৌম্যর,
আমি লুচি খাবোনা, আমার শরীর ভালো নেই, আপনি থালা ফেরত নিয়ে যান!
করুণার দিকে তাকিয়ে একটু রুক্ষ স্বরে বললো সৌম্য, করুণা থালা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সৌম্য, করুণার হাতে ফিরিয়ে দেওয়া খাবারের থালা দেখেই মৃণাল এক্ষুনি আসবে, তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।
ওপর থেকে লুচির থালা হাতে দৌড়ে নেমে এসেই বড়ো মার ঘরে ঢুকে এলো করুণা, পারুল বালা উদ্বিগ্ন হয়ে তার অপেক্ষাতেই ছিলেন। সকালে দ্বিতীয় বার করুণা কে দেখে সৌম্য ঠিক কি করতে পারে সেটা কিছুটা তিনিও জানেন।
লুচি খেলেন না দাদা, বৌ দিদি কে বলতে বললেন শরীর খারাপ!
হাঁফাতে হাঁফাতে বললো করুণা,
থালাটা আমার হাতে দে, আর তুই নিজের কাজে যা, ডাকলে তবেই আসবি।
করুণার হাত থেকে থালাটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন পারুল বালা।
কি ছাইপাঁশ গেলো এসব! এই জন্যেই তো শরীর খারাপ হয়,
চমকে উঠে পেছনে তাকিয়েই বড়ো মা কে দেখে হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সৌম্য।
তুমি আবার কেনো কষ্ট করে আসতে গেলে বড়ো মা!
সৌম্য খুব লজ্জায় পড়লো,
কিসের কষ্ট বাছা? তুমি সারা হপ্তা ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করো নে, তাই তো বাড়িতে এই দুটো দিন তোমাকে একটু করে খাওয়াতে ইচ্ছে করে। তাই করুণা যখন গিয়ে বউমা কে বলছিলো তোমার শরীর খারাপ, তখন আমিই তাকে বললুম তোমাকে আর ছুটে যেতে হবে নে, আমিই যাচ্ছি। দেখি আমার আনা খাবার কি করে ফেরায় ছেলে!
এই কথার ওপরে আর কিছু বলার থাকে না! বড়ো মা এই বয়সে কষ্ট করে শুধুমাত্র তার জন্যেই ওপরে উঠে এসেছেন, এটা তার মনে একটা খারাপ লাগার অনুভূতি তৈরি করছিলো, তাই হাত বাড়িয়ে লুচির থালাটা হাতে নিলো সৌম্য। মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন পারুল বালা, জীবনে স্বামী সন্তানের সুখ না পাওয়া পারুল বালা বাস্তবিক সৌম্য কে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসেন। বউ কে জব্দ করতে গিয়ে ছেলে কে না খাইয়ে রাখবেন এমনটাও তিনি চান না। তাঁর কথার অমান্য যে সৌম্য করবে না সেটা তিনি জানেন, তাই করুণা ফিরে এলে তিনি কি করবেন মনে মনে ভেবেই রেখে ছিলেন আগে থেকেই।
সারা হপ্তা কাজের মধ্যে থেকে আবার এই দুদিনের জন্য কষ্ট করে বাড়ি আসা! বড়ো কষ্ট হয় তোমাকে দেখে! এবার থেকে তুমি বরং মাসে একবার করে এসো বাবা!
মাটিতে আসন পেতে বসে খাচ্ছিলো সৌম্য, পাশে বসে পাখার বাতাস করতে করতে শান্ত গলায় কথাটা বললেন পারুল বালা, কথাটার মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রচ্ছন্ন আদেশ টা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না সৌম্যর। বড়ো মা তাকে নিয়ে চিন্তিত বুঝতে পারছিল ও, কিন্তু মাসে একবার মাত্র! ও তো নিজেই আসতে চায় প্রতি সপ্তাহে, বিয়ের পর থেকেই যে ওর বাড়ি ফেরার অন্য আকর্ষণও আছে , ওর কোনো কষ্ট হয় না ওতে! কিন্তু সেটা বড়ো মা কে বোঝাবে কি ভাবে!
তুমি ব্যস্ত থাকো, বিষয় সম্পত্তিতেও তোমার খুব বেশি আগ্রহ নেই আমি জানি, তবু বাবার বয়স হয়েছে, এবার তোমার একটু জিনিসগুলো বুঝে নেওয়া উচিত!
সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বললেন পারুল বালা, গত বেশ কিছুদিন ধরে তিনি দেখছেন মাঝে মাঝেই মৃণালিনী কে ডেকে পাঠান শ্যাম সুন্দর। বাড়ির বউ খুব বেশি শিক্ষিত হোক যিনি চান নি আগে কোনো দিনও, তিনিই এখন জমি জমা দেখতে বউ কে ডাকেন, এটা তাঁর একটুও পছন্দ নয়! কিন্তু তিনি বললে সেটা দেওর শুনবেন না তিনি জানেন। কিছু কিছু ব্যাপারে দেওর তাঁর কথা শোনে না, কিন্তু শ্যাম সুন্দর যে নিজেই ডেকে পাঠান বউমা কে সেটা তিনি সৌম্য কে জানতে দিতে চান না একটুও!
আলোক দা তো আছেন! আমি এসব পারি না বড় মা!
একটু কুণ্ঠিত গলায় বললো সৌম্য,
তা বললে কি হয় বাছা! আলোক যতই হোক বাইরের মানুষ! সব কিছু তাকে ভরসা করে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়! পুকুরের পাশের জমিটা নিয়ে যে শরিকি বিবাদ শুরু হয়েছে, তার খবর কি রাখো তুমি! আর তার থেকেও বড় কথা হলো, ইদানিং বউমাও এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছেন! বাড়ির বউয়ের পর পুরুষের সঙ্গে বসে হিসাব কষা আমাদের গ্রামে ঘরে চলে নে বাছা! তুমি এবার নিজে দেখো এসব, এটা কলকেতা শহর নয়! এখানে আমাদের একটা সম্মান আছে, চৌধুরী বাড়ির বউরা এই ভাবে চলে না। ওকে বারণ করে দিও, আবার আমি বলেছি বলো নে সেটা, ওর মন খারাপ হবে, তুমি তোমার মতো করে বুঝিয়ে বোলো সময়মত!
সৌম্য ঘাড় নাড়লো, নিজে জমি জমা দেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু মৃণালিনী কে বারণ সে করতেই পারে। আর মৃণালের যেচে এসবের মধ্যে ঢোকার কারণ কি!ও ওর কাজকর্ম, পড়াশুনা নিয়েই তো থাকতে পারে!
খাওয়া মিটলে থালা নিয়ে অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালেন পারুল বালা, নিচু হয়ে আসন টা ভাঁজ করে রাখার চেষ্টা করতে গিয়েই কাঁসার থালাটা ঝন ঝন আওয়াজ করে মাটিতে পড়লো, পারুল বালাও মাটিতে বসে পড়লেন আবার। সৌম্য সবে মাত্র জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে হাত ধোবার জন্যে বারান্দার দিকে যাচ্ছিলো, থালা পড়ার আওয়াজে চমকে উঠে ফিরে তাকালো,
বড়ো মা! পড়ে গেলে নাকি!
ছুটে এসে বড়ো মা কে ধরে তুলতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো সৌম্য, পারুল বালা ততোক্ষনে হাত তুলেছেন,
ছুঁয়ে দিও না বাছা! তুমি এখনও বাসি কাপড়ে আছো!
একটু থতমত খেলো সৌম্য, কি করবে ভাবতে ভাবতেই বলে উঠলেন বড়ো মা,
হাঁটুর ব্যথাটা বড্ড বেড়েছে! বয়স তো আর কমছে নে বাবা, সিঁড়ি ভাঙতে আজকাল বড্ড কষ্ট হয়!
সেই জন্যেই তো তখনই তোমাকে বললাম বড়ো মা, কেনো নিয়ে এলে তুমি খাবার কষ্ট করে বলতো!
খুব কষ্টের গলায় বললো সৌম্য, বড়ো মা কে সে খুব ভালোবাসে,
তাই তো এখন করুণা কে ডাকি বাবা, ছোটাছুটির কাজগুলো সেই করে এখন। কিন্তু সে বললো তুমি তাকে তোমার ঘরে ঢুকতে বারণ করেছো! আমিও ভেবে দেখলাম পরে, ভালোই করেছো সেটা, আই বুড়ো মেয়ে, তার তোমার ঘরে আসা যাওয়া বউমা ভালো চোখে নাও দেখতে পারে!
খুব লজ্জায় পড়ে গেলো সৌম্য, ইস, বড়ো মা ভাবলেন সে মৃণালিনী পছন্দ করবে না বলে করুণা কে আসতে বারণ করেছে! কিন্তু মৃণাল যে এরকম মানসিকতার মেয়ে নয় সেটা বড়ো মা কে বোঝানো টা খুব দরকার, বড়ো মার মনে মৃণালিনীর জন্যে খারাপ ধারণা তৈরি হোক, সেটা একটুও চায় না ও।
না, না, সেসব কিছু নয়! আমি ওকে ডেকে আনছি বড়ো মা,
হন্তদন্ত হয়ে করুণা কে ডেকে আনার জন্যে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল সৌম্য, পারুল বালা থামিয়ে দিলেন,
তোমাকে যেতে হবে নে বাছা, আমি ডাকলেই সে চলে আসবে,
করুণা কে চিৎকার করে ডাকলেন তিনি, করুণা বোধহয় কাছে পিঠেই কোথাও উপস্থিত ছিলো, প্রায় দৌড়েই ঘরে এসে ঢুকলো। পারুল বালা কে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে এঁটো মুছে থালাটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, পেছন থেকে ডাকলেন তিনি,
শোন, দাদা কে বলে দিয়েছি আমি, আজ থেকে দাদার সব কাজ তুই করবি, আমি বুড়ো মানুষ আর ওঠা নামা করতে পারিনা। বৌ দিদি কে কথায় কথায় বিরক্ত করবি নে, সে এসব কাজ কম্ম করে অভ্যস্ত নয়,
ঘাড় নেড়ে চলে গেলো করুণা, সৌম্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
আসি বাবা, কিছু দরকার হলে করুণা কে ডেকো,
কথাগুলো বলেই কোমরে হাত রেখে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন পারুল বালা, তিনি যে কাজে এসেছিলেন সেটা সফল হয়েছে।
ক্রমশ
( যুগে যুগেই এইরকম পারুল বালারা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। শুধু সমাজের এবং সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাঁদের ভঙ্গি বদলে যায় মাত্র, মানসিকতা বদলায় না🙏)