মৃণালিনী পর্ব-১৫

0
815

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৫
সন্ধ্যার পর থেকে যেনো একটা ঝড় বয়ে গেলো তার জীবনে। বড়মার প্রবল চিৎকার করে তাদের শাশুড়ি, বউমা কে শাসনের মধ্যেই, করুণার ছুটে এসে বাবার অসুখের খবর দেওয়া, সব মিলিয়ে কিছুক্ষনের জন্যে কথা বলতেও ভুলে গিয়েছিল মৃণাল। নিজেকে সামলে উঠে দেখেছিলো বাড়ির চাকর ব্রজ দাদা আর বামুন মাসি দুজনেই ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

কর্তা বাবুর অসুস্থতার খবর দিয়ে শ্যাম সুন্দরের কাছে মৃণাল কে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার আবেদন জানালো ব্রজ,পাছে পরপুরুষ ব্রজর সঙ্গে একা তাকে ছাড়তে না চায় শ্বশুরবাড়ি র লোকেরা তাই সাথে করে বামুন মাসি কে নিয়ে এসেছে সে। সেই সঙ্গে শ্বশুরের অসুস্থতার খবর দিয়ে লেখা, বাবার কাছে পাঠানো সৌম্যর চিঠিও তুলে দিলো শ্যাম সুন্দরের হাতে।

ছেলের চিঠি পড়েই দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন শ্বশুরমশাই, মৃণালের কলকাতা যাবার ব্যবস্থা হতে লাগলো। ভোর বেলা আলোক কে গাড়ি বার করার নির্দেশ দিয়ে রাখলেন, কিন্তু ট্রেন তো আর সকালের আগে ছিলো না তাই সেই সময়টুকু তো অপেক্ষা করতেই হতো। সেদিনের মতো কুমুদ আর মৃণালের বিচার স্থগিত রইলো, পারুল বালা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পেরে দুঃখিত হয়ে পড়লেন।

তবে প্রসঙ্গ ঘুরে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি, এই মুহূর্তে বউয়ের বাড়ির ঠাকুর, চাকরের সামনে বিচার সভা বসালে তাতে যে আখেরে তাঁরই ক্ষতি সেটা বুঝেই সে চেষ্টায় আপাতত ইতি টানলেন। বউয়ের সাহস দেখে তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র রাগ দেখিয়ে রাতে না খাওয়ার প্রয়োগও তিনি করতে পারলেন না কারণ সবার সহানুভূতি সেই মুহূর্তে বাবার অসুস্থতার খবরে মৃণালের দিকেই গেলো। তাই বউয়ের এত বড় ধৃষ্টতা দেখেও নিজেকে সংযত রাখা ছাড়া সেই মুহূর্তে অন্য কিছু তাঁর করার ছিলো না।

রাতের খাবার মুখে উঠলোনা মৃণালের, কোনো মতে শাশুড়ির কথা তে জোর করে দু মুঠো মুখে দিলো সে। রাতে নিচের ঘরে আলোকের সঙ্গে ব্রজ র থাকার ব্যবস্থা হলো, রাত পর্যন্ত জিনিস পত্র গোছানোয় সাহায্য করার সুবিধার জন্যে মৃণালের ঘরের মেঝেতে বামুন মাসি শুলেন। সরমা তার মায়ের সঙ্গে শুতে গেলো।

আস্তে আস্তে সারা গ্রামের সঙ্গে চৌধুরী বাড়িও নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো, মৃণালিনী চোখের জল মুছতে মুছতে তোরঙ্গ খুলে জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো, চারপাশ ক্রমশ নির্জন হয়ে এসেছে দেখে এতক্ষনে বামুন মাসি তার কাপড়ের পুঁটলি খুলে এক খানা চিঠি মৃণালের দিকে এগিয়ে দিলো।

জামাই বাবু দিয়েছেন,

সৌম্যর চিঠি! অথচ সেটা তাকে লুকিয়ে দিচ্ছে বামুন মাসি! চিঠিটা খুলেই অবাক হয়ে গেলো মৃণাল, সৌম্য তাকে বাবা কে নিয়ে চিন্তিত না হয়ে বরং নিজের বই পত্র নিয়ে যেতে কিছু মাত্র ভুল যাতে না হয় সেদিকে বেশি নজর দিতে বলেছে! একই চিঠি প্রায় বার পাঁচেক পড়ে ফেলার পরে এটুকু মৃণালের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো যে বাবার অসুস্থতা নয়, ব্রজ আর বামুন মাসির এখানে আসার আসল উদ্যেশ্য তাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়া!

কিন্তু বাবা কি জানেন এসব! তিনি মিথ্যাচার পছন্দ করেন না, তাঁর অগোচরে ব্রজ দাদা বা বামুন মাসি এখানে কি করে এলো! ধৈর্য্য রাখতে না পেরে শেষে কথাটা জিজ্ঞেস করেই ফেললো মৃণাল,

জামাই বাবু কর্তা বাবু কে তোকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেই পাঠিয়েছেন, তিনি এসব জানেন না। পরে জামাই বাবু আমাদের এ বাড়ি এসে এরকম বলতে বলে দিয়েছেন,

মৃণালিনীর বুকের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে গেলো একদম, বাবা বা শ্বশুর মশাই পরে জানতে পারলে কি হবে সেটা ভেবেই পরীক্ষা দিতে যাওয়ার ইচ্ছেটাও কমে আসছিলো ক্রমশ। সৌম্য যে নিজের বিয়ের ক্ষেত্রেও এরকমই কিছু করে ছিলো সেই গল্প সে পরে স্বামীর মুখ থেকেই মজার ছলে শুনেছিলো আগে, কিন্তু সেখানে তার কোনো ভূমিকা ছিলো না। এখানে সে নিজেও জড়িত, ভয়ে তার মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে দেখে হেসে ফেললো বামুন মাসি,

তুই চলতো মা! কেউ জানতে পারবে না। একা ব্রজ এলে কোনো মেয়ে মানুষ সাথে নেই বলে তোর জ্যেঠ শাশুড়ি যে তোকে একা ছাড়বেন না সেটা জেনেই তো জামাই বাবু আমাকেও আসতে বললেন। না হলে নাকি উনি তোদের বাড়ির কাজের লোক কে সাথে পাঠিয়ে দেবেন! সে গেলে তো আর দেখতে হবে না! সবাই সব জেনে যাবে! জামাই বাবু সব দিক ভেবেই কাজ করেছেন, কর্তা বাবুও কিছু বুঝতে পারবেন না।

এতক্ষনে মুখে হাসি ফুটলো মৃণালের, মনে মনে সৌম্যর বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না সে। গত কয়েকদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, দুঃখ, মান অভিমান সব কিছু মিলিয়ে গেলো এক নিমেষে, রাত টা যেনো আর কাটতে চাইছে না, কলকাতা যাবার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো মৃণালিনী।

সকালে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই বাসি কাপড় ছেড়ে যাবার জন্যে তৈরী হলো মৃণাল, মুখে একটা দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে বড়ো দের প্রণাম পর্ব শেষ করলো, কুমুদ বেয়াই মশাইয়ের মঙ্গল কামনায় দিয়ে আসা পুজোর প্রসাদী ফুল, তার শাড়ির আঁচলে বেঁধে দিলেন।

বাপ সুস্থ হলেই কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো বাছা! বেশি দিন বাপের বাড়ি থাকা আমাদের বাড়িতে চলে নে,

গাড়ির পেছনে সব জিনিসপত্র ওঠানোর পরে, মৃণাল উঠে বসতে যাচ্ছিলো, বড়ো মা র কথায় ফিরে তাকালো। পারুল বালা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হয়তো, শ্যাম সুন্দর তাঁকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলেন।

আহ! যাবার মুখে আবার পিছু ডাকা কেনো! এসব কথা এখন থাক!

বলেই বৌমার দিকে ঘুরলেন শ্যাম সুন্দর,

সৌম্য কে বলো বেয়াই মশাইয়ের সুস্থতার খবর দিয়ে একটা তার করে দিতে,

শ্বশুরমশাই এর কথায় মুখ নিচু করে ঘাড় নাড়লো মৃণালিনী, সরমা জল ভরা চোখে বৌদির দিকে তাকিয়ে ছিলো, সে বাস্তবিকই দুঃখ পেয়েছে এই খবরে। খুব ইচ্ছা করলেও শেষ পর্যন্ত তাকেও কিছু না জানানোর সিদ্ধান্তই নিলো মৃণাল। অনেক সময়ই কিশোরী বয়সের উচ্ছাসে সে অনেক অপ্রয়োজনীয় কথাও বলে ফেলে।

গাড়ি বেরিয়ে যাবার পর দু হাত কপালে ঠেকালেন কুমুদ, “দুর্গা দুর্গা”। সরমা চোখের জল মুছে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো, শুধু একমাত্র কোনো কথা না বলেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলেন পারুল বালা। গত কালের আনন্দ আজ তার চিন্তায় পর্যবসিত হয়েছে। তিনি নিজেই সৌম্য কে এক মাস ছাড়া বাড়ি আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশ মেনেই সৌম্য এই শনিবার বাড়ি আসেনি। কিন্তু সে প্রচেষ্টায় লাভ হলো কই! বউই তো কলকাতা চলে গেলো! এখন বাপের অসুখে সেবার নাম করে কতো কাল ওখানে পড়ে থাকবে কে জানে!

পারুল বালার এই চিন্তিত মুখ অন্য কেউ খুব একটা লক্ষ্য না করলেও হারুর মার নজর এড়ালো না, উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে সবটাই লক্ষ্য রাখছিলো সে। এতক্ষনে সবাই চলে গেছে দেখে সে সামনে এগিয়ে এলো,

বলি কাজটা কি ঠিক হলো গো কর্তা মা! একদম তাকে একা ছেড়ে দেওয়া কি উচিত কাজ হলো! সঙ্গে কাউকে পাঠালে কি ভালো হতুনি!

কথাটা যে তাঁর নিজেরও মনে হয়নি তা নয়, কিন্তু তিনিই বা কি করবেন! শুধু ব্রজ এলে না হয়, একা তার সঙ্গে না ছাড়ার অজুহাতে সঙ্গে করুণা কে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু এখানে তো বাড়ির বামুন মেয়েটিকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে, এখন তিনি পাঠাতে চাইলেও তো দেওর শুনতেন না!

কিন্তু মনের মধ্যে থেকে খুঁতখুঁতে ভাবটা তাঁর কিছুতেই যাচ্ছে না, কে জানে বাপের বাড়ির লোকজন তাঁর চিৎকার শুনেছিলো কিনা! গিয়ে আবার তিল কে তাল করে বাড়ির কর্তার কানে তুলে দেয় নাকি! পারুল বালা কে অন্য মনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারুর মা খুব অবাক হলো, সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, পারুল বালা তাকে থামিয়ে দিলেন,

চুপ যা দিকি তুই! একে আমি মরছি নিজের জ্বালায় তার মধ্যে তোর বক বক! ওদিকে ছোটো কে দেখেছিস! ভোর না হতেই বেয়াইয়ের নামে পুজো দিয়ে এলেন! আমাকে বোকা ঠাওরেছে! এই করে বিদ্যেধরী বউ কে নাকি উনি হাত করবেন! ওই বউ যদি না ওর মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে, তবে আমার নামও পারুল বালা নয়।

হারুর মা আরও কিছু সঙ্গত করতেই যাচ্ছিলো, দূর থেকে এগিয়ে আসা কুমুদ কে দেখে থেমে গেলো। এখানে যে তাঁরই সম্বন্ধে কথা হচ্ছে সেটা কুমুদ দুজনকে এক সঙ্গে দেখেই বুঝতে পারলেন, কালকের করা বড়ো জায়ের অপমান তিনি একটুও ভোলেন নি এখনো।

মৃণালিনীর কথা কিছুটা হলেও তাঁর মধ্যে সাহসের সঞ্চার করেছিলো। নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হয়, বৌমার বলা এই কথা তাঁর মনের জোর বাড়াতে সাহায্য করছিলো। মনটা যথেষ্টই বিক্ষিপ্ত হয়েছিলো, কিন্তু বড়ো জা কে কিছু বলার সাহস এখনও তাঁর নেই, তাই সমস্ত রাগটাই গিয়ে হারুর মায়ের ওপর পড়লো,

বলি ঝাঁটা হাতে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেই কি চলবে হারুর মা, ওদিকে যে রাতের এঁটো বাসন গুলো সেই থেকে পড়ে আছে, তার কি হবে? বলো তবে, আমিই ওগুলো পুকুরে নিয়ে যাই না হয়! আমিও তো এবাড়ির ঝি বই আর কিছুই নই!

শেষের কথাটা যে তাঁরই উদ্যেশ্যে বলা, সেটা বুঝতে পারলেও চুপ করেই রইলেন পারুল বালা, কাল ছোটো জা কে ঘর থেকে বার করে দেবার কথাটা বলা যে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে সেটা মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে তিনি নিজেই জানেন। এই প্রথম বার দেওরও তাঁর কথায় সায় দেয়নি বুঝেই নিজের খাস লোকের অপমান আজ তিনি মুখ বুঝেই সহ্য করলেন।

হারুর মা কর্তা মা এর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো, আশা ছিল তার অপমান তিনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। কিন্তু তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে মনে মনে একটু ভীত হলো হারুর মা, বৌমার কথা যে ক্রমশ ছোটো গিন্নির মুখও খুলে দিচ্ছে সেটা বুঝেই আর দ্বিরুক্তি না করেই বাসনের ঝুড়ি কাঁকে পুকুরের দিকে রওনা দিলো সে।
ক্রমশ
(গল্প এগোনোর সাথে সাথে চরিত্রগুলোও স্পষ্ট হবে ক্রমশ, আপনারা সবাই চরিত্রগুলো কে নিয়ে মতামত দিয়েছেন, আরও মতামত পেতে চাই, প্রত্যেক চরিত্রকে তার দোষ, গুন নিয়ে কেমন লাগছে জানার ইচ্ছে রইলো 🙏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here