মৃণালিনী পর্ব-১৮

0
741

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৮
একমাস ধরে পরীক্ষা পর্ব চললো, যেটুকু ক্ষতি শ্বশুরবাড়িতে থাকাকালীন তার পড়াশুনায় হয়েছিল, এখানে এসে নিজের প্রবল পরিশ্রমে এবং বাবা ও স্বামীর যৌথ সহায়তায় নিজের আয়ত্তে এনে ফেললো মৃণালিনী। একসময় তার পরীক্ষা শেষ হলো, ইতিমধ্যেই প্রায় মাস দেড়েক হয়ে গিয়েছিলো তার কলকাতা আসার, বারবার করে সৌম্য বাড়ি গেলেই মৃণালিনী কে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন পারুল বালা।

তাই এবার সব কিছু মিটে যেতেই বউ কে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য শ্বশুরের কাছে অনুমতি চাইলো সৌম্য। রমণী বাবু অনুমতি দিলেন, ফল বেরোলে সৌম্যর কাছ থেকে এমনই জানতে পারবে মৃণাল, তাই আর তাকে এখানে আটকে রাখার কোনো প্রয়োজন তিনিও মনে করলেন না। পরবর্তী তে বি এ তে ভর্তি হতে গেলে কি কি করতে হবে সবটা বাবার কাছ থেকে জেনে নিয়ে মৃণালিনী শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার গোছ গাছ করতে লাগলো।

নির্দিষ্ট দিনে স্টেশনে গাড়ি ছিলো, রাস্তায় আসতে আসতে নতুন দোতলা স্কুলের নির্মীয়মান বাড়ি বউ কে দেখালো সৌম্য,

ইস, এখানে যদি মেয়েরাও পড়তে পারতো! কি ভালো হতো তাই না!

বউয়ের কথাতে একটু হাসলো সৌম্য, ছেলেদের স্কুল তৈরি করতেই তাকে কম মাথা খাটাতে হয়নি! সেখানে আবার মেয়েদের পড়ার ব্যবস্থা! আর হলেও তাতে পড়বে কে! এখানের মানুষজন এতোই গোঁড়া,তারা ছেলেদের স্কুলে মেয়েদের পড়তে কোনো মতেই পাঠাবেন না। তাদের জন্যে আলাদা স্কুল লাগবে তাহলে!

তাকে পৌঁছে দিয়ে পরের দিন সৌম্য চলে গেলো, আবার সেই নতুন করে অন্ধকারে লণ্ঠনের আলোয় রাত কাটানো জীবন শুরু হলো মৃণালের। সরমা কে বইয়ের মধ্যে আনা বিমলের চিঠি পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সৌম্যর কাছে বদলাতে পাঠানো বইয়ের মাঝে সরমার চিঠি ঢুকিয়ে দিলো মৃণাল। সরমার হাতের লেখার উন্নতি হয়েছে যথেষ্টই, এমনকি লাইব্রেরী থেকে আনা বইগুলোও এখন পড়ে সরমা, নিজের কৃতিত্বে নিজেই খুশি হলো মৃণালিনী।

দুপুরের ছাদের মজলিশে অনেকদিন পরে যোগ দিলো মৃণাল, সেখানে বিভাও বসেছিলো। তাকে দেখেই খুব কৌতুহল হলো মৃণালের, যাবার আগের দিন তাকে দেখতে কলকাতা থেকে পাত্র এসেছিলো, সেই সাজাতে গিয়েই তো কতো কথা শুনতে হয়েছিলো তাকে আর তার শাশুড়ি কে! কি হলো সেই পাত্রের! চুপি চুপি সরমার কাছে জানতে চাইলো মৃণালিনী।

সে বিয়ে তো হয় নে গো বউ দিদি, সে ছেলে পড়াশুনা জানা মেয়ে চায়!

ফিসফিস করে বললো সরমা, একটু মনটা খারাপ হয়ে গেলো মৃণালিনীর। কলকাতার মেয়েদের মতো করে সাজিয়ে দিয়ে যে আসলে কিছুই লাভ হয়নি বিভার, এটা সে বুঝতে পারলো। আজকাল শুধু সাজলেই হয়না পেটে বিদ্যেও থাকতে হয়! সেটা এখানকার লোকেদের কে বোঝাবে!

বিকেল হয়ে আসছিল, ছাদের মজলিশ ভেঙে যাওয়ার পর সবাই নিচে বারান্দায় এসে বসেছিল। নিজের কাজের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তুলসী তলায় আগের মতোই সন্ধ্যে দেখিয়ে এসে চাটাইয়ের এক পাশে বসেছিলো মৃণালিনী।

সকালের দিকে নিচেই থেকো বাছা আগের মতোই, বেশি ওপর নিচ করার দরকার নেই তোমার,

পারুল বালার কথায় ঘাড় নাড়লো মৃণাল, এখন আবার সৌম্যর শনিবার করে বাড়ি আসা শুরু হয়েছে তাই বড়ো মা যে তাকে দোতলায় উঠতে দিতে চাননা, সেটা সে বোঝে। সে এখন যথেষ্টই পুরনো হয়ে গিয়েছে, এ বাড়ির সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকি বহাল। ফিরে এসেই তাই আর বড়ো মার সঙ্গে খুব বেশি তর্কে সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই যেতে চাইলো না। শুধুই নিজের স্বামীর বলা কথা গুলো মনে পড়ছিলো মৃণালের। বড়ো মার বিরাগ ভাজন না হয়ে কি ভাবে তার পড়াশুনা নির্বিঘ্নে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেটুকুই ভাবার চেষ্টা করছিলো সে।

পরের দিন ভোরবেলায় ঝগড়ার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো মৃণালের, নিচে প্রবল গন্ডগোল চলছে, বিভার বাবার সঙ্গে পাশের বাড়ির কমল জ্যেঠুর চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে, সেখানে শ্বশুর মশাইও দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে অতো বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে, সরমা পাশে এসে দাঁড়ালো। গন্ডগোলের কারণ যে পুকুরের পাশের সেই শরিকি জমি, সেটা সরমার কাছ থেকেই জানতে পারলো। জমির দখল নিয়ে প্রায়ই গন্ডগোল হয়, এখানে এসে থেকেই সে দেখে আসছে, তবে এতটা সাংঘাতিক বাড়াবাড়ি তার চোখে পড়েনি আগে।

সকালের গন্ডগোলের পরে কোনো মতে খাওয়া দাওয়া সেরে শ্যাম সুন্দর গাড়ি নিয়ে সদরে বেরিয়ে গেলেন, আজ তাঁর জরুরী কেস আছে কোর্টে। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে নিজের স্নান সেরে, পুজো দিয়ে ঘরে এলো মৃণাল। ঘর বেশ অগোছালো হয়ে আছে, কলকাতা থেকে আনা তোরঙ্গ সেই ভাবেই খাটের তলায় পড়ে আছে, সেটা টেনে নিয়ে কাপড় চোপড় বার করে ঘর জোড়া সেগুন কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে রেখে জিনিসপত্র গোছ গাছ করতে লাগলো সে।

দুপুর ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে আসছিলো, গোয়াল থেকে গরুর হাম্বা হাম্বা ডাক ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো আওয়াজ নেই, হারু সম্ভবত গোয়াল পরিষ্কার করছে। ঘরের জানলা দিয়ে পুকুর ঘাট থেকে বামুন দিদি আর করুণা কে স্নান করে গায়ে গামছা জড়িয়ে ফিরতে দেখলো মৃণাল।

করুণা হেঁটে যাচ্ছিলো, সে পিসির সঙ্গে কথায় মত্ত ছিলো, কোনো দিকেই তার খেয়াল নেই। গোয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হারুর চোখ যে তার ওপরেই নিবদ্ধ সেটা সে খেয়াল না করলেও দোতলার নিজের ঘরের জানলা দিয়ে সে দৃশ্য মৃণালিনীর চোখে ধরা পড়ছিলো, নিজের মনেই মুচকি হাসলো একটু।

দুপুরের খাওয়ার সময়ও প্রায় হয়ে এসেছে, এরপরেই করুণা খাবার আসন পেতে, জলের গ্লাস রাখবে, বামুন দিদি ভাত বাড়তে বসবেন, আবার নতুন করে চৌধুরী বাড়ির নিচের তলা, ঠাকুর, চাকর, পারুল বালার আওয়াজে সরগরম হয়ে উঠবে। এসব প্রাত্যহিক ঘটনা এখন আর মৃণালের অজানা নয়, সেও ধীরে ধীরে এ সংসারের একজন হয়ে উঠেছে।

এইসব ভাবতে ভাবতেই একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিলো মৃণালিনী, পারুল বালার তীক্ষ্ণ চিৎকারে চমকে উঠে ছুটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর সে যা বুঝতে পারলো, তার সারমর্ম এই যে, সকালের তাড়াহুড়োয় শ্বশুর মশাই তাঁর কেস সংক্রান্ত কিছু জরুরী কাগজ পত্র বাড়িতেই ফেলে গেছেন এবং এখন ড্রাইভার কে সেগুলি নিয়ে যাবার জন্যে পাঠিয়েছেন। কিন্তু এ বাড়ির এক মাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি এই মুহূর্তে আলোক, কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড়ো মার হাজার চিৎকারেও যখন আলোক কে খুঁজে পাওয়া গেলো না তখন, অত্যন্ত ধীর পায়ে নিচে নেমে এলো মৃণালিনী।

আমি খুঁজে দিতে পারি বড়ো মা, যদি আপনি অনুমতি দেন,

মৃদু স্বরে পারুল বালার দিকে তাকিয়ে বললো সে, অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকলেন পারুল বালা, পর পুরুষ ড্রাইভারের সামনে বউ এর নেমে আসা নিয়েও এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছেন না তিনি। সময় বয়ে যাচ্ছে, আলোকের দেখা নেই, দেওর বিরক্ত হবেন, সবটা বুঝেই অগত্যা মাথা নাড়লেন তিনি,

দেখো দিকিনি বাছা! খুঁজে পাও নাকি! অলাউঠো আলোক আসুক আজ, তাকে কি মুখ দেকার জন্যে রেকেচি! কাজের সময় তার টিকিটিও দেখা যায়নি কো!

বড়ো মার প্রবল চিৎকারের মধ্যেই হাসি মুখে স্বশুর মশাইয়ের ঘর থেকে কার্য সমাধা করে ফিরে এলো মৃণাল। কাগজ যে পাওয়া গেছে তাতে শান্তি পেলেও বউ এর এসব বিষয়ে মাথা ঘামানোর অনুমতি দিতে বাধ্য হওয়ায়, সব রাগ তাঁর আলোকের ওপর গিয়েই পড়লো!

কিছুক্ষণ পরেই খাবার সময়ে বাড়ি ফিরে এলো আলোক। স্নান সেরে আসনে বসে, হাতে জল নিয়ে থালার পাশে গোল করে ছিটিয়ে সবে প্রথম গ্রাস মুখে তুলতে যাচ্ছিলো, পারুল বালা সামনে এসে দাঁড়ালেন।

তোমাকে কি এখানে পাড়া বেড়াতে নিয়ে এইচি গো বাছা? কাজের সময় তোমার টিকিটিও দেকা যায় নে কো! খাওয়ার সময় তো বাড়ি আসতে একটুও ভোলোনে! ডেকে ডেকে গলায় আমার ব্যতা হয়ে গেলো, ডাক শুনে অন্য গেরামের লোকজনও বাড়ি এসে গেলো তবু তুমি শুনতে পেলে নে বাছা!

নিজের অপরাধ কি সেটা কিছুতেই বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে পারুল বালার দিকে তাকিয়ে থাকলো আলোক, পিসির করা অপমানে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। এ বাড়িতে নিতান্তই বাধ্য হয়েই থাকে সে, মাঝে মাঝেই তাকে শ্যাম সুন্দর এবং পারুল বালা অপমান করেন। মনের ভেতরে যে ক্ষোভের আগুন ইতিমধ্যেই ধিকি ধিকি করে জ্বলছিলো, পিসির আজকের বাক্যবাণ তাতে আরো বেশি করে ইন্ধন যোগালো। চৌধুরী পরিবারের যে সর্বনাশ এতদিন ধরে সে একটু একটু করে, করে আসছিলো তা আরও বেশি করে করার জন্য মনস্থ করলো।

শেষ পর্যন্ত কুমুদ এগিয়ে এলেন,

খাওয়ার সময়ে একটু ছেলেটা কে শান্তি করে খেতে দাও দিদি, এসব কথা এখনই কি বলতে হবে! আর বউমা তো খুঁজে দিয়েছে কাগজ, সমস্যা যখন মিটে গেচে, তখন আবার একই কথা নিয়ে টানাটানি কেনো!

একটু বেশি করে ঘি আলোকের পাতে ঢেলে দিলেন কুমুদ, ছেলেটা ঘি খেতে বড্ড ভালো বাসে! মুখ নিচু করে খেয়ে যাচ্ছিলো আলোক, বড়ো মা এখান থেকে চলে গেছেন, শাশুড়ি পাশে বসে আলোক কে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পাখার বাতাস করছেন, ওনার মন টা বড্ড নরম, বড়ো জার আলোক কে করা অপমান, একটু একটু করে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো মৃণালিনী, আগের বার কলকাতা যাওয়ার আগে থেকেই আলোকের করা হিসাবে কিছু কিছু গরমিল লক্ষ্য করেছিলো সে, আজকের আলোকের মুষ্টিবদ্ধ বাম হাত, আরও বেশি করে তার চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here