মৃণালিনী পর্ব-১৯

0
775

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৯
দিন কাটছিলো, আই এ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, কিন্তু ভালো ফলের জন্য কোনো উচ্ছাস প্রকাশের জায়গা ছিলো না মৃণালিনীর। যাকে পড়াশুনাই এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় গোপনে, তার কাছে ফল প্রকাশের আনন্দের প্রকাশ মানেই তো মূর্খামি। শুধু সৌম্য যখন শনিবারে বাড়ি ফিরলো তখন হাতে করে নিয়ে এলো বাড়ির জন্যে বড়ো হাঁড়ি ভর্তি এক হাঁড়ি রসগোল্লা আর মৃণালের জন্যে রবীন্দ্র রচনাবলী।

রসগোল্লার হাঁড়ি দেখে সবাই খুশী হলেও এর পেছনের রহস্য জানার উৎসাহ কারোরই ছিলো না, কলকাতার মিষ্টির সুখ্যাতি করতেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রাতে ঘরে এসে বউয়ের হাতে বই এর সঙ্গে শ্বশুর মশাইয়ের চিঠিও তুলে দিলো সৌম্য। বাবার চিঠি পেয়ে মৃণাল যারপরনাই উচ্ছসিত হলো, চেপে রাখা আবেগ বাবার চিঠি দেখে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়লো।

এবার পরবর্তী পদক্ষেপ ছিলো আরও উচ্চতর শিক্ষা। সৌম্য তার প্রস্তুতির প্রথম ধাপ যে বই পত্র, তা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলো। স্বামীর সহযোগিতায় বি এ পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি শুরু হলো এরপর। বিয়ের পরে প্রায় মাস ছয়েক কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বউয়ের তকমা ছেড়ে আস্তে আস্তে বাড়ির একজন সদস্য হিসাবে জায়গা করে নিচ্ছিলো মৃণালিনী।

রাতে শাশুড়ির ঘরে থাকার সুবিধে নিয়ে নিজের পড়াশুনার সঙ্গে শ্বশুরের সম্পত্তির হিসাব নিকাশ ও নিজের আয়ত্বে এনে ফেলছিলো সে। ক্রমশই আলোকের হিসাবে করা গোলমালের মাত্রা বাড়লেও, সেটা মৃণালিনীর দৌলতে শ্যাম সুন্দরের কানেও পৌঁছে যাচ্ছিলো দ্রুত। হিসাবে দক্ষ হয়ে ওঠা বৌমার ওপর আরো বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলেন শ্বশুর মশাই, কিন্তু সবটাই পারুল বালার অজান্তে।

পারুল বালা যার যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চলতেন, তাঁর মূল পরামর্শ দাত্রী সেই হারুর মায়ের ক্ষমতাই ছিলো না মৃণালিনীর মতো মেয়েকে জব্দ করার। কুমুদের ক্ষেত্রে যে নিয়ম নীতি পারুল বালা প্রয়োগ করেছিলেন সেগুলি তিনি মৃণালের ক্ষেত্রেও চেষ্টা করতেন। কিন্তু মৃণালিনী কুমুদ ছিলো না, তাই সে কোনোদিনও তার শাশুড়ির মতো স্বামীর কাছে অভিযোগের চেষ্টাই করে নি। পারুল বালা তাকে পুজো দেওয়া, ফুল তোলা, হেঁসেলের রান্নায় সাহায্য, ইত্যাদি সংসারের কাজের মধ্যে আটকে রেখে, বিভিন্ন রকমের কটু কথায় উঠতে বসতে অপমান করে, নিজেকে গিন্নি দেখানোর চেষ্টা করতেন।

কিন্তু মৃণালিনী সেগুলো গায়ে মাখতো না, তার আসল উদ্যেশ্য ছিলো, বড়ো মা কে জানতে না দিয়ে নিজের কাজগুলো সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করা, সেগুলো যে নির্বিঘ্নে হয়ে যাচ্ছিলো তাতেই সে খুশি ছিলো। প্রতি মুহূর্তে যেকোনো কটু কথা শোনার সময় সে শুধুই সৌম্যর বলা কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করতো, সংসারে সব কিছু গায়ে মাখতে নেই।কিন্তু মৃণালিনীর এই যে গায়ে কথা না মেখে কাজ করে যাওয়া এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না পারুল বালা, ছোটো জা যেমন তাঁর কথায় ওঠে আর বসে, ঠিক সেই জিনিস তিনি মৃণালের কাছেও আসা করতেন।

কিন্তু সৌম্য বা দেওরের কাছে অভিযোগ করার জন্যে কিছু প্রমাণ দরকার, সেই ধরনের কোনো প্রমাণ তিনি পাচ্ছিলেন না। মৃণাল মুখরা নয়, সে বড়ো মার মুখে মুখে জবাব দেয় না, কোনো কাজ যা তাকে বলা হয় সে কোনো প্রতিবাদ না করেই করে, কিন্তু তার সব কাজের পরেও যে সে পারুল বালার হাতের পুতুল নয়, এটা তার হাবে ভাবে ফুটে ওঠে। কিন্তু হাবে ভাবে ফুটে ওঠা তো আর কাউকে দেখানো যায় না! সেটা শুধু তিনিই অনুভব করেন, প্রমাণ হিসেবে সেটা গ্রাহ্য হয়না কোনোদিনও।

তাই নিজের অসহায়তা, ক্ষোভ তাঁকে আরও বেশি করে মৃণালের ওপর ক্ষুব্ধ করে তোলে, তিনি আরো নতুন নতুন বুদ্ধি বার করার চেষ্টা করেন। করুণা আসার পরে বউ কে সৌম্যর কাছ থেকে দূরে রাখার এক সুবর্ন সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, কিছুতেই সারা দিনেও তিনি মৃণাল কে ওপরে ওঠার সুযোগ দিতেন না। কিন্তু মৃণালিনী কোনো দিনও তাঁর কোনো প্রতিবাদ করেনি, বড়মার কথার সে একটুও অবাধ্য হয়নি কখনো।

শনিবার দিন সৌম্য বাড়িতে আসার পর থেকে সোমবার সকালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত, সে রাতে শুতে যাওয়া ছাড়া এক মুহূর্তের জন্যেও দোতলায় স্বামীর ঘরে যেতনা। কিন্তু তার ফরমাশ এর ঠ্যালায় করুণার জীবন ওষ্ঠাগত হতো, এক মুহূর্তের জন্যেও সে দুদণ্ড শান্তি তে বসতে পারতোনা কোথাও। কখনো তার চিরুনি, চুলের ফিতে, কখনো শাড়ি কাপড়, এসব ঘর থেকে বয়ে নিয়ে আসতে আর রাখতে যেতে গিয়ে পায়ে ব্যথা হয়ে যেতো করুণার। তার পরে তো সৌম্যর ফরমাশ ছিলোই, যেগুলোর জন্যেই বড়ো মা তাকে দোতলার দাদার ঘরের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।

শেষে আর না পেরে একদিন পারুল বালার কাছে কেঁদে পড়েছিলো করুণা, আর সে এতবার দোতলায় যেতে পারছেনা! প্রচণ্ড রেগে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন বউ কে,

হ্যাঁ গো বউমা, বলি এবার কি করুণা তোমার জন্যেই ছুটে মরবে সারাদিন! ওর কি আর কোনো কাজ কম্ম নেই গা! নিজের জিনিসগুলো তো একটু নিজে গিয়েই নিয়ে আসতে পারো নাকি!

কোনো উত্তর না দিয়েই আস্তে করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলো মৃণালিনী, আর কোনো ফরমাশ সে করুণা কে করেনি এরপরে। শুধু সারাদিনে যে নিজের জিনিস আনতে কতবার তার পর থেকে সে ওপরে যায়, পারুল বালা গুনে ওঠাও ছেড়ে দিয়েছেন আজকাল। বিশেষ করে রবিবার দিন যেনো তার ওপরে নিজের কাজ শেষই হয়না আর। কিন্তু এসব তো আর অভিযোগ জানানোর বিষয় হতে পারেনা, তিনি তো নিজেই বউমা কে নিজের কাজ নিজে করে নিতে বলেছেন, তাই চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার আছে তাঁর!

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে একবার একটা সুযোগ তিনি পেলেন। সেদিন ছিলো শুক্রবার, রাতে যথারীতি শ্বশুরের ঘরে বসে হিসেব নিকেশ দেখার পরে লন্ঠন শাশুড়ির ঘরে নিয়ে এসে গল্পের বই পড়ার অছিলায় পড়ার বই খুলে বসেছিলো মৃণালিনী, এমন সময় পুকুরে জাল ফেলার আওয়াজ হলো। গ্রামে থেকে থেকে এতদিনে বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে মৃণাল, সে হাতের লন্ঠন কে কমিয়ে নিয়ে পা টিপে টিপে এসে পুকুরের ধারের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় পুকুর ধারের নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে ঢোকা আলোয় সে বেশ কয়েকজন লোককে নিঃশব্দে জাল ফেলতে দেখলো।

তার প্রবল চিৎকারে আশে পাশের বাড়ির লোকজন বেরিয়ে এলো, এ বাড়িতেও সবাই উঠে পড়লো, চোর ধরতে না পারলেও তাদের ফেলে যাওয়া মাছ যা ছিলো তাতে আগামী দুদিন গোটা গ্রামের লোক খেতে পারতো। সেই মাছ তুলে আনা, ভাগ করা, পুকুরের পাড় এবার ঘিরে দেওয়া হবে কিনা এইসব বিভিন্ন কথা তে যে কখন সকাল হয়ে গেলো কেউ বুঝতে পারলো না।

সব পর্ব মিটে যাওয়ার পর সেদিন সবাই দুপুরে খেয়ে ঘুমোতে গেলেন, ছাদের মজলিশ সেদিন বন্ধ রইলো। সন্ধ্যে বেলায় সৌম্য কলকাতা থেকে ফিরলো, রাস্তায় আসতে আসতে বউয়ের চোর ধরার গল্প সে ড্রাইভারের কাছে শুনেছিল ইতিমধ্যেই, তাই সেদিনের সান্ধ্যকালীন চায়ের আসরে একটা হাসির রোল পড়ে গেলো। কিন্তু পারুল বালা গম্ভীর হয়ে রইলেন, রাতে তিনি মৃণালের হাতে জ্বলন্ত লন্ঠন দেখেছিলেন, এমনকি তার ঘরে খোলা বই রাখা ছিলো সেও তাঁর নজর এড়ায়নি।

কি হলো বড়মা? তুমি গম্ভীর কেনো?

সৌম্যর প্রশ্নের উত্তরে আচমকাই দুচোখে জল এলো পারুল বালার,

আমি কে বাছা! তোমাদের সংসার, তোমাদের বাড়ি, আমি এখানে গলগ্রহ বই তো নই! কবে আমাকে বাড়ি ছাড়া হতে হয়, সেই অপেক্ষাতেই আছি!

দৌদন্ডপ্রতাপ বড়ো মার চোখে জল, মুহূর্তের মধ্যেই সৌম্যকে নরম করে ফেললো, আজ পর্যন্ত সে কোনোদিনই কাঁদতে দেখেনি পারুল বালা কে।

কি হয়েছে বড়ো মা? কে তোমায় অপমান করেছে? বলো আমাকে!

এর অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি, তাঁর চোখের জল যে সৌম্যর খারাপ লাগবে, মনে মনে বিলক্ষণ জানতেন,

তোমার বউ গো! একটা কথাই তো অনুরোধ করেছিলে তুমি, মাথা যেনো সে না ঘামায় এসব জমি জমায়, তা সেতো স্বামীর কথায়ও কান দেয়না দেখলাম। যে বউ তার স্বামীকেই সম্মান করে না, সে যে আমাকে করবে, সে আশা আমি রাখিনা বাছা। কাল নেহাত চোরের খবর পেয়ে তাকে দেখলুম, না হলে তো জানতেই পারতুম নে বাবা!

সৌম্য সত্যি অবাক হয়ে গেলো, সে বাবা কে গিয়েও বারণ করে এসেছিলো, তারপরেও মৃণাল আবার এসবের মধ্যে ঢুকেছে! সে তো তার কোনো আবদার ফেরায় না, যথা সাধ্য চেষ্টা করে সব ইচ্ছে পূরণ করার, আর তার একটা কথা মৃণাল রাখতে পারলো না! এতো বার কলকাতায় থাকার সময়ে এই সব ছোট খাট বিরোধ গুলো সে এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছিলো মৃণাল কে তার পরেও মৃণালের এইরকম নির্বুদ্ধিতা তাকে বিরক্ত করে তুললো।

তুমি আবার এসবের মধ্যে ঢুকেছো! তোমাকে আমি তো বারণ করেছিলাম, তাই না?

আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে ওখানে সবার সামনেই চিৎকার করে উঠলো সৌম্য, মৃণালিনী তাকে সম্মান করে না, তার বলা কথার কোনো দাম নেই তার স্ত্রীর কাছে, বড়ো মার বলা এই কথাগুলোই তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলার জন্যে যথেষ্ট ছিল। মৃণাল মাথা নিচু করে বসে রইলো, এই মুহূর্তে যে সৌম্য কে কোনো কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা, তা স্বামীর রাগ দেখেই বুঝতে পারছিলো সে।

সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে শুকনো মুখে নিজের কাজ করছে মৃণালিনী, এ দৃশ্য পারুল বালা কে বড়ই তৃপ্তি দিলো। অনেকদিন থেকে এই মুখটি দেখার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সান্ধ্যকালীন চায়ের আসর ছেড়ে সৌম্য কাল উঠে গিয়েছিলো তৎক্ষণাৎ, রাতে কোনো রকমে বড়ো মার সাধাসাধি তে খেতে নেমেছিলো শুধু।

হেঁসেল মিটিয়ে ঘরে ঢুকেই মৃণাল স্বামীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো, বার বার বলেছিলো সে নিজের ইচ্ছেই যায় নি, শ্বশুর মশাই তাকে ডেকেছিলেন।

তুমি বোধহয় আমার বলা কথাগুলো বোঝনি মৃণাল, তুমি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছো! বাবার যদি প্রয়োজন থাকে তাহলে সেটা তাঁকেই বড়ো মা কে বলতে দাও! আমার বাবা কে আমি চিনি, তিনি তাঁর প্রয়োজনের জন্য সব কিছুই করতে পারেন।

বাবার ঘরের লণ্ঠনে তেল বেশি থাকে, আমার পড়তে সুবিধে হয়! আমাদের লণ্ঠনের তেল তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়!

স্বামীর বিরক্ত গলায় বলা কথার উত্তরে বলেছিলো মৃণালিনী, সৌম্য আরও বিরক্ত হয়েছিলো।

তুমি কি মনে করো, তুমি লুকিয়ে হিসেব দেখছো এটা জানার পর আর বড়ো মা তোমাকে ওই ঘরে যাবার সুযোগ দেবেন?

এবার সত্যিই ভয় পেয়েছিলো মৃণাল, এরপর কিভাবে চলবে তার পড়াশোনা!

বউয়ের ভীত মুখ দেখে এতক্ষনে একটু হলেও মাথা ঠান্ডা হয়েছিলো সৌম্যর,

সব ব্যাপারেই এত সহজে ভেঙে পড়তে নেই! সমস্যা থাকলেই তার সমাধানও থাকবে, তোমাকে আগেই বলেছি। আপাতত আমার বড়ো টর্চটা থাকলো, সামনের সপ্তাহে আরও কিছু ব্যাটারি এনে দেবো। কিন্তু এসব ব্যাপারে আর মাথা ঘামিও না, তাতে তুমি তোমার নিজের কাজ করতে পারবে না ঠিক মতো। অকারণে শত্রু বাড়াতে নেই!

স্বামীর সঙ্গে গোলমাল মিটে গেলেও মনের ভেতরের খুঁত খুঁত ভাবটা যাচ্ছিলো না তার, আলোকের হিসাবের ওপর আর তার কোনো আস্থা ছিলো না। কিন্তু এবার সে কি করবে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু সৌম্যর কথায় যুক্তি আছে, নিজের কাজ নিশ্চিন্তে করতে গেলে তাকে বড়ো মার বিরাগভাজন হওয়া চলবে না কিছুতেই।

পরের দিন কলকাতা ফিরে যাবার সময়, সবাই নিচের বারান্দায় সৌম্য কে বিদায় জানানোর জন্যে দাঁড়িয়েছিলো, মৃণালিনী যথারীতি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো, করুণা তাকে এসে ডাকলো,

বউ দিদি, শিগগির নিচে চলো, তোমাকে দাদা ডাকছেন,

আজ পর্যন্ত বড়ো মার নির্দেশ মেনেই স্বামীর ফেরার সময় সে নিচে নামেনা, আজ এমন কি হলো! একটু অবাক হয়েই নিচে নেমে এলো মৃণাল।

আমি বড়ো মা কে কথা দিয়েছি, তুমি আর কখনো জমি জমার বিষয়ে মাথা ঘামাবে না, আজ ওনার সামনেই আবার তোমাকে বলে দিলাম, মনে রেখো,

স্বামীর কথায় ঘাড় নাড়লো মৃণাল, বড়ো মার মুখের উৎফুল্ল ভাব তার নজর এড়ালো না, তার দিকে ঘুরলেন পারুল বালা,

আজ থেকে আবার আগের মতো তুমি আর সরমা তোমার ঘরেই থেকো, শাউড়ির ঘরে থাকার আর দরকার নেই কো! ওই রাতে শোয়াই আসলে যত নষ্টের গোড়া! আর একজন তো দু চোক মুদেই থাকেন, ঘরের মধ্যে যে কি হয়, তিনি কিছুই নাকি জানতে পারেন নে!

শেষের কথাগুলো তিনি ছোটো জা কে লক্ষ্য করে বললেন, শাশুড়ির সাহায্য ছাড়া যে এগুলো মৃণালের পক্ষে সম্ভব ছিলনা, তা তিনি ভালোই জানেন।

মৃণাল অবাক হয়ে গেলো, বড়ো মা তাকে আর ওই ঘরে যেতে দেবেন না, সৌম্যর এই ধারণা যে কতো টা সঠিক ছিলো, এই মুহূর্তে সেটা বুঝতে পারছিলো সে, আর টর্চ রেখে যাবার জন্যে মনে মনেই কৃতজ্ঞ হচ্ছিলো স্বামীর কাছে।

সৌম্য কে বিদায় দেবার জন্যে শ্যাম সুন্দর ও ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর ছেলে কে বলা কঠিন গলার স্বরে এবার সবাই চমকে গেলো,

এবার থেকে তাহলে শনিবার করে বাড়ি ফিরে তুমিই আমার সঙ্গে বসবে! শুধু আলোকের ভরসায় তো এসব ছাড়া সম্ভব নয়! ঘরের ভেতরে বসে বউমা হিসাব দেখেন তাতে তোমারই বা অসুবিধা কি?

শেষের কথাগুলো বৌদির উদ্যেশ্যে বললেন তিনি, সৌম্যর তো নিজের কোনো আপত্তি ছিল না তাই সে বড়ো মার মুখের দিকে তাকালো।

যে সব বোঝনা সেসব জায়গায় মাথা গলাও কেনো! তোমাকে তো আমি এসব কথায় কথা বলতে বলিনি বৌদি! সংসার তোমার, তুমি সেটা নিয়েই থাকো না!

পারুল বালা চুপ করে গেলেন, শ্যাম সুন্দর এক কথায় তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করলেন। আসল কর্তা যে তিনিই, তাঁর ঠিক করা সীমানার মধ্যেই যে পারুল বালা কে থাকতে হবে এটা বুঝিয়ে দিয়েই কথা শেষ করলেন তিনি।

তুমি এখন এসো, আর দেরি করলে ট্রেন পাবে না, এসব বিষয়ে তোমার কিছু বলার দরকার নেই!

বাবার কথার উত্তরে আর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না সৌম্য, গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসে বউয়ের দিকে তাকালো,

আমার টর্চটা টেবিলের ওপর ফেলে এসেছি বোধ হয়,

আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি,

দৌড়ে দোতলার নিজের ঘর থেকে সৌম্যর কালকে রেখে যাওয়া টর্চটা নিয়ে এলো মৃণাল, ওটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তার, হাসি চেপে রাখা কষ্টকর হচ্ছিলো তার পক্ষে। স্বামীর হাতে টর্চটা তুলে দিয়ে তার দিকে তাকালো মৃণালিনী, এখানে সামান্য টর্চের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যে দৃশ্য সংগঠিত হলো তা বোঝার মতো ক্ষমতা তাদের স্বামী, স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তির ছিলো না।

মৃণালের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো, মনে মনেই হাসলো সৌম্য, তার বাবা কে তার থেকে বেশি আর কেই বা চেনে! নিজের স্বার্থের বাইরে তিনি কিছুই বোঝেন না। তিনি যে আবার বউমা কে ডেকে নেবেন, এতো তার জানাই ছিলো। নিজের অতি সরল, সংসার অনভিজ্ঞ বউয়ের জন্য করুণা হতে লাগলো তার। মৃণাল ক্রমশ বিস্মিত হতেও ভুলে যাচ্ছিলো, সৌম্যর প্রতিটা কথা মিলে যেতে দেখে তার মুখে কথা সরছিল না।

পারুল বালা মনে মনে আফসোস করতে লাগলেন, সৌম্য তাঁকে কথা দিয়েছিলো আগেই যে তার বউ আর এসব বিষয়ে মাথা ঘামাবে না। তিনিই তাকে সামনে ডেকে এনে নতুন করে কথা দেওয়ার জন্যে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন সৌম্যর নাম করে, কিন্তু সেটা যে এই মুহূর্তে তাঁর দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে সেটা তিনি একটুও বুঝতে পারেন নি।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here