মৃণালিনী পর্ব-২৫

0
741

#মৃণালিনী
#পর্ব ২৫
সকাল বেলায় ফুল তুলতে তুলতেই খামার থেকে ভেসে আসা মুরগির ডাক শুনতে পাচ্ছিলো মৃণালিনী, সাধারণত এতো জোরে ডাক শোনা যায় না কখনো, তাই খানিকটা হলেও কৌতূহলী হলো সে। বড়ো মার ঘরে সাজি রেখে এসে খামারের কাছে পৌঁছে দেখলো আজ খামার খোলা হয়নি। মুরগিগুলো ভেতর থেকে বেরোবার জন্যে ছটফট করছিলো, কিন্তু আশেপাশে কোথাও হারু কে দেখতে পাওয়া গেলনা।

কি করবে ভাবতে ভাবতেই কুমুদ সেখানে উপস্থিত হলেন, দোতলা থেকেই তিনিও ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। হারুকে ডাকতে ডাকতেই তিনি নিচে নেমে এসেছেন। এতো ডাকাডাকির পরেও হারুর কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না, কিন্তু গোবর জলের ছড়া দিতে দিতে হারুর মা সেখানে উপস্থিত হলো। তাকে দেখেই বিরক্ত হলেন কুমুদ,

তোমার ছেলে কোথায় হারুর মা? মুরগিগুলো যে ডেকে ডেকে সারা হলো গো! সকাল বেলায় এতো আওয়াজ ভালো লাগে! উনি সারাদিন কাজে থাকেন, সকালে একটু নিচ্ছিন্তে ঘুমোবেন, তার জো নেই গো!

হারুর মা এদিক ওদিক চাইলো, তারপর হতাশ মুখে ছোটো গিন্নির দিকে তাকিয়ে বললো,

সে তো সকালে আমার সঙ্গেই ঘুম থেকে উঠলো গো! আমি ন্যাতা নে গোবর জল দিতে গেলুম, সে ওই গোয়ালের দিক গেলো! তারপর তো তারে আমি দেখিনি!

সাত সকালেই তিনি তার কাজ সেরে পাড়া বেড়াতে গেছেন বুজি! এই হিমে এতো ভোরে কেউ গরু বার করে! এতদিন কাজ করার পরেও কি তাকে শেখাতে হবে হারুর মা!

বিরক্ত গলায় বললেন কুমুদ, হারুর মা কিছু উত্তর দেবার আগেই কোথা থেকে করুণা হাঁফাতে হাঁফাতে সেখানে উপস্থিত হলো,

আমি মুরগি ছেড়ে দিচ্ছি ছোটো মা, হারু দা আমাকে বলে গেছে,

মৃণাল একটু অবাক হয়ে গেলো, মুহূর্তে তার কালকে দেখা রাতে হারুর বস্তা নিয়ে নিচে নেমে আসার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। হটাৎ করে হারু মুরগি ছাড়ার দায়িত্ব করুণা কে দিয়ে এমন কোন কাজে সকাল বেলায় গেলো মনে মনেই ভাবতে লাগলো সে। কিন্তু কালকের করুণার কান্নার কথা মনে পড়ায় এই প্রশ্ন করা আদৌ উচিত হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই খিড়কি দরজা দিয়ে স্নান করে পারুল বালা প্রবেশ করলেন। পুকুরঘাট থেকেই তাঁর কানেও মুরগির আওয়াজ গিয়েছিলো,

কি এমন কাজ তার এই ভোরে, যে নিজের কাজ তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে সে পাড়া বেড়াতে বেরোলো মা গো!

কড়া গলায় করুণার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি, করুণার মুখ শুকিয়ে আমশি হয়ে গেলো।

ওই সাধন আচাজ্জিদের বাড়ি ঘুঁটে চেয়েছিলো বড়ো মা, তাই আমাকে মুরগি বার করে দিতে বলে গেলো হারু দা,

তড়িঘড়ি জবাব দিলো করুণা, পারুলবালা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।

এই সাত সকালে সে সাধনের বাড়ি ঘুঁটে দিতে গেছে! কেনো তাদের বাড়ি কি ঘুঁটে না হলে হাঁড়ি চড়বে নে!! আর সাধন তো আমায় ঘুঁটের কতা কয়নি!

ভয়ে করুণার মুখ প্রায় শুকিয়ে গেলো, মৃণালিনী তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করছিলো, পারুল বালা প্রায় তাকে কোন ঠাসা করেই ফেলেছিলেন এমন সময় শ্যাম সুন্দর দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন,

তোমাদের জ্বালায় তো বাড়িতে তিষ্ঠনো যাবে না দেখছি! সেই কাল রাত থেকে শুরু হয়েছে! কেউ যদি দরকারের সময় কোনো কাজেই না আসে তাহলে সবাই কেই দূর করে দাও এবার! নতুন লোক খোঁজো! বেশিদিন পুরনো হলেই ধরা কে সরা দেখে সবাই!

সকাল বেলায় দেওরের অগ্নিমূর্তি দেখে চুপ করে গেলেন পারুল বালা, করুণা একবার মৃণালের দিকে তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তার চোখের দৃষ্টিতে রাগ ঝরে পড়ছিলো, পিসির কথাতেই সে বৌ দিদির কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে কাল,সে অপমান সে ভোলেনি। মৃণাল চিন্তিত হচ্ছিলো, কথাগুলো ধামাচাপা পড়ে যাওয়ায় যে করুণার সুবিধা হলো সেটা বুঝে সে মনে মনে অন্য পরিকল্পনা করতে লাগলো।

শ্যাম সুন্দরের রাগের পরেই জায়গা আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেলো, খামার খুলে মুরগি বার করে দিয়ে করুণা চলে যাওয়ার পরে মৃণালিনী চিন্তিত মুখেই নিজের ঘরে ফিরে এলো। চা জলখাবার পর্ব মিটে যাওয়ার পরে আলোক কে নিয়ে শ্যাম সুন্দর সদরে গেলেন, ক্রমশই বামুন দিদির রান্নার আওয়াজের সঙ্গে করুণার মসলা বাটার আওয়াজে চৌধুরী বাড়ি সরগরম হয়ে উঠলো।

প্রায় বেলার দিকে হারু বাড়িতে ঢুকলো, দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েই তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলো মৃণালিনী। সাধন আচাজ্জিদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে যে তার এতক্ষন লাগার কথা নয় সেটা মনে মনেই ভাবছিলো সে, এমন সময় করুণা হারুর সামনে এসে দাঁড়ালো। করুণার হাতে কলাইকরা থালায় ঢালা একথালা মুড়ি, আলু সেদ্ধ আর পেঁয়াজ, সেটা সে হারুর হাতে তুলে দিয়ে নিঃশব্দে হাসলো, প্রত্যুত্তরে হারুর মুখেও হাসির রেখা দেখা গেলো, সবটাই ওপরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো মৃণাল।

করুণা বোধ হয় আলাদা করে হারুর জলখাবারের থালা তৈরি রেখেছিলো আগেই, সেটা হারুর হাতে তুলে দিয়েই সে দ্রুত পায়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো। হারু সবে মাত্র মাটিতে বসে এক গ্রাস মুখে তুলেছিলো, এমন সময় হারুর মা ছেলের সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।

কোতা ছিলি ভোর থেকে! মিছে কতা বলিস তুই আবার! ঘুঁটে দিতে গেছিলি তুই! ও মেয়ে তোকে ডোবাবে, এই কয়ে দিলুম!

চাপা গলায় তার ধমক কানে এলো মৃণালিনীর, ছেলে কে ধমক দিতে দিতেই সে ওপর দিকে তাকালো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মৃণালিনী কে দেখেই তার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেলো! এতক্ষন মুখ নিচু করে খেতে থাকা হারু বোধহয় আচমকাই মায়ের ধমক বন্ধ হয়ে যাবার উৎস খুঁজতেই ওপর দিকে চোখ তুললো,

হারু, খাওয়া হলে একটু ওপরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করিস!

হারু চোখ তুলে তাকাতেই ঠান্ডা গলায় বললো মৃণালিনী, হারু মাথা নাড়লো শুকনো মুখে। ঘরে এসে সবে মাত্র বসেছিলো মৃণাল, হারুর মা ছেলে কে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো।

এতো তাড়াতাড়ি তোর খাওয়া হয়ে গেলো! না খেয়েই চলে এলি নাকি!

অবাক মুখে বললো মৃণালিনী, হারু মাথা নাড়লো,

খাওয়া হয়ে গেছে বউ দিদি, বলো কি বলবে,

সাধন আচাজ্জির বাড়ি ঘুঁটে দিয়ে এলি? কতো হয়েছে? টাকাটা আমাকে দে,

শান্ত গলায় বললো মৃণালিনী, হারু চমকে উঠে তাকালো, ছেলে কোনো কিছু বলার আগেই অবস্থা বেগতিক দেখেই হারুর মা মৃণালের হাত ধরে ফেললো,

কত্তা মা কে কিছু বলো নি বউমা! উনি শুনলে আমার হারু রে ঘর তে তাইরে দেবেন! ওই মেয়ে সব্বনাশী গো!

আমি জানি তুই ভালো ছেলে, সবটা খুলে বল আমাকে! আমি কাউকে কিছু বলবো না,

হারুর মা কে থামিয়ে দিয়ে হারুর দিকে তাকিয়ে বললো মৃণাল, হারু তাও চুপ করেই থাকলো। হারু কিছু বলতে চাইছে কিন্তু সে যে মায়ের সামনে মুখ খুলবেনা এটা বুঝেই ওর মায়ের দিকে ঘুরলো ও,

তুমি যাও বউ, নিজের কাজ করো, আমি বড়ো মা কে কিছু বলবো না। হারুর কোনো বিপদ হবে না আমি কথা দিলাম!

হারুর মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বেরিয়ে গেলো। মা বেরিয়ে যেতেই নিজে থেকেই বলে উঠলো হারু,

বউ দিদি, করুণা কিছু করে নি, মা ওকে মিছেই দুষছে! কাল রাতে আলোক দাদাবাবু ওকে কটা কাগজ দিয়ে ছিলো গো রাখার জন্যে। ও কোথায় রাখতো বলো! তাই আমি ঘুঁটের বস্তা করে সেগুলো আমার বাড়িতে রেখে এসেছিলাম।

তুই করুণা কে ভালবাসিস! ওকে বাঁচাতে চাইছিস!

নিজের অজান্তেই গলা থেকে হাসির আওয়াজ বেরিয়ে এলো মৃণালিনীর, বউ দিদির হাসি বোধ হয় কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত করলো হারু কে,

আমি কি তোমাকে কাগজ গুলো দিয়ে যাবো বউ দিদি? কিন্তু করুণার কতা বড়ো মা কে বলো নি!

বউ দিদির ইশারায় আবার দৌড়ে বাড়ির দিকে বেরিয়ে গেলো হারু, অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়ে। হারু আর হারুর মা দুজনেই এখানে থাকে, তাদের বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য বাড়ি যে গোপন কাগজ রাখার উপযুক্ত জায়গাই বটে, সেটা ও বুঝতে পারলো। করুণা কি ইচ্ছাকৃত ভাবে হারু কে ব্যবহার করছে না কি হারু ভালোবেসে করুণা কে বাঁচাতে চাইছে এটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো মৃণাল। চুপ করে ঘরে বসে রইলো ও, এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে গভীর জলের মাছ আলোকের দিকে নজর রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

করুণা বা হারু যে শুধু মাত্রই দাবার চালের বোড়ে, সেটা বুঝেই আপাতত চুপ করে থাকার সিদ্ধান্তই নিলো সে। বড়ো মা কে কিছু জানানো মানেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করবেন উনি, হয়ত হারু এবং করুণা দুজনকেই বার করে দেবেন বাড়ি থেকে কিন্তু তাতে আলোকের টিকিটিও ছোঁয়া যাবে না, নতুন হারু বা নতুন করুণা সে ঠিকই খুঁজে নেবে আবার।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here