মৃণালিনী পর্ব ২৮

0
777

#মৃণালিনী
#পর্ব ২৮
যথেষ্টই বেলা হয়েছিলো, আপাতত শ্যাম সুন্দর নিমরাজি হয়েছেন দেখে আর বেশিক্ষন কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো না সৌম্য, পাছে নতুন কোনো ওকালতি বুদ্ধিতে তিনি আবার নতুন কোনো সমস্যা তৈরি করেন। মনের মধ্যে একটু হলেও ভয় কাজ করছিলো তার, পাছে বাবার আবার মত পরিবর্তন হয়ে যায়। তার ইশারায় কুমুদ এবং মৃণালিনী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো, শ্যাম সুন্দর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দোতলা থেকে নেমে এসে শাশুড়ির পিছু পিছু রান্না ঘরে ঢুকলো মৃণাল, সৌম্য থাকার দিনগুলো তে রান্নার চাপ একটু বেশি পড়ে বামুন দিদির ওপরে, তাই সবাই হাতে হাতে তাঁকে সাহায্য করার চেষ্টা করে।

পারুল বালা ওখানে বসেই জপ করছিলেন, জপ করতে করতেই হাতের ইশারায় বামুন দিদি কে বিভিন্ন রকমের পদ বুঝিয়ে চলেছিলেন। কুমুদ এবং মৃণাল কে একসঙ্গে ঢুকতে দেখেই কুমুদ এর দিকে রান্না দেখার জন্যে ইশারা করেই খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আবার জপ করতে শুরু করলেন। কুমুদ বামুন দিদির কাছে এগিয়ে গেলেন, মৃণাল ওখানেই পিঁড়ি নিয়ে বসে, কুটনো কাটার জন্যে তরকারির ঝুড়ি নিজের দিকে টেনে নিলো।

করুণা মসলা বাটছিল, মৃণাল কে ওখানে তরকারির ঝুড়ি টেনে নিয়ে বসতে দেখেই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, তার মুখভঙ্গি তে ঔদ্ধত্যের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। মৃণাল লক্ষ্য করছিলো, পারুল বালাও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে, গত দুদিনের ঘটনায় তিনি করুণার ওপরে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ ছিলেন।

একেনের বাটনা আর লাগবে নি, তুই আমিষ হেঁসেলে চলে যা দিকি, হারুর মা প্যাজ, রসুন নে বসেচে, ওর হাতে হাতে এট্টু এগগে দে,

ভাই ঝির দিকে তাকিয়ে বললেন বামুন দিদি, এখানে নিরামিষ পদের রান্না সেরেই তাঁকে আমিষ হেঁসেলে ঢুকতে হবে। আমিষ পদ রেঁধে নিরামিষ হেঁসেলে ঢুকতে গেলে তাঁকে কাপড় ছাড়তে হয়, নিরামিষ থেকে আমিষের হেঁসেলে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। তাই এদিকের কাজ সেরে তবেই তিনি ওদিকের হেঁসেলে ঢোকেন। করুণা উঠে দ্রুত পায়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বেলা গড়াচ্ছিল, হাতের কুটনো শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালো মৃণাল, সৌম্যর দ্বিতীয় দফার চায়ের সময় হয়ে এসেছিলো। মেসে থাকার সুবাদে এই একটি বদ অভ্যাস তার ছিলো, সকাল থেকে অন্তত বার তিনেক চা তার চাইই। মৃণাল বামুন দিদির দিকে তাকালো,

দিদি, তোমার উনুন খালি হলে একটু চা বসাবো,

বামুন দিদি মাথা নাড়লেন, তাঁর প্রায় হয়েই এসেছিলো, তিনি আমিষ হেঁসেলে যাবার জন্যে তৈরী হচ্ছিলেন, এদিক ওদিক তাকিয়ে চায়ের বাসন, ছাঁকনি খুঁজতে লাগলেন।

তুমি চলে যাও দিদি, আমি দেখে নিচ্ছি,

বামুন দিদি বেরিয়ে চলে যাবার পরে উঠে এলো মৃণাল, কিন্তু হাজার খোঁজা খুঁজি সত্বেও চা এর বাসন খুঁজে পাওয়া গেলো না। হারুর মা সামনে দিয়েই ঝাঁটা হাতে যাচ্ছিলো, মৃণাল কে বাসন খুঁজতে দেখে কুমুদ তাকে ডাকলেন,

ও হারুর মা, চায়ের বাসন কই? পুকুরে মাজতে গিয়ে ফেলে এলে নাকি!

হারুর মা মাথা নাড়লো,

না গো মা, বাসন তো মেইজে এনিছি, করুণা তো বাসনের ঝুড়ি আমার হাত তে নে নেলো, এরপর তো আমি আর জানি নি। ওরে জিগিয়ে দেকো দেকি!

কুমুদ করুণার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকলেন, কিন্তু তার সাড়া পাওয়া গেলো না।

থাক মা, আমি দেখে নিচ্ছি, ও আশে পাশেই কোথাও আছে নিশ্চয়ই,

শাশুড়ি কে থামিয়ে দিয়ে দ্রুত পা চালালো মৃণাল, হেঁসেলের উনুনের আঁচ প্রায় পড়ে এসেছিলো, বেশি দেরি হলে আর চা করা সম্ভব হবে না। আমিষ হেঁসেলের উনুনে চা বড়ো মা করতে দেবেন না তখন আবার জনতা স্টোভ জ্বালাতে হবে। বামুন দিদি ইতিমধ্যেই আমিষ রান্না শুরু করে দিয়েছিলেন, করুণা সেখানে ছিলো না।

বামুন দিদি করুণা কে দেখেছো?

বামুন দিদি ঘাড় নাড়লেন,

না তো বউমা, আমি এসে তারে দেকিনি কো! সে বোধ করি তার আগেই কাজ সেরে চলে গেচে গো,

করুণা কে কোথাও পাওয়া গেলো না, কিন্তু বাসনের ঝুড়ি আমিষ হেঁসেলের বারান্দায় রাখা ছিলো। সে কোথায় গেলো সেটুকু ভাবার মতো সময় আর মৃণালের ছিলো না, উনুনের আঁচ পড়ে যাবার ভয়ে প্রায় দৌড়ে বাসন নিয়ে ফিরে এসেই তাড়াতাড়ি চা বসালো মৃণাল।

সকালে জলখাবারের পরে দোতলার ছাদের কোণে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো সৌম্য, হাতের জ্বলন্ত সিগারেট পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো। কি করে এবার বড়ো মার কাছে বিমলের প্রসঙ্গে কথা তোলা যায় ভাবতে গিয়েই সে একটু অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিলো, হটাৎ করেই করুণার গলার আওয়াজে তার চমক ভাঙলো,

আপনার চা!

সৌম্য পেছন ফিরে তাকালো, করুণা চায়ের কাপ তার দিকে বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অনেকদিনই করুণার সৌম্যর জন্যে চা আনা বন্ধ হয়েছিলো, আজকাল মৃণালিনী নিজেই তার জন্যে চা নিয়ে আসে, তাই আজ করুণা কে দেখেই তার মুখে হালকা বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো। সে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে, কাপে চুমুক দিয়ে বললো,

বউ দিদি কি ব্যস্ত নাকি?

কেনে? বউ দিদি আমারে পাইঠে দিলেন, আমার করা চা কি আপনি খাবেন নি? চা কেমন হয়েছে কইলেন নি তো!

আচমকা এই কথায় সৌম্য চমকে উঠে করুণার মুখের দিকে তাকালো, আজ পর্যন্ত কোনোদিনই চা এনে করুণা তাকে এই ভাবে জিজ্ঞেস করে নি। করুণা একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে সৌম্যর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো, অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিয়ে সৌম্য ছোট্ট করে উত্তর দিলো, ” ভালো”। তারপরেও করুণা ওখানে দাঁড়িয়েই পায়ের নখ ছাদের মেঝে তে ঘষতে লাগলো, এবার অবাক হলো সৌম্য,

দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? কিছু বলবেন?

করুণা ঘাড় কাত করলো,

আমার কিছু কতা ছিলো, যদি অনুমতি দেন তালে বলি!

সৌম্য মনে মনে অবাক হলো, করুণা এইভাবে আগে কখনই ওর সঙ্গে কথা বলেনি, মুখে বললো,

বলুন, কি বলতে চান!

করুণা চোখ মুছলো,

বউ দিদি আমারে দু চক্ষে দেখতে পারে নি, উনি কয়েছেন, আমি মিছে কতা কই! উনি আমারে একান তে তাইরে দেবার চেষ্টা করছেন, আমি গরীব মানুষ, বাড়ি গেলে বাপ মা খেতে দিতে পারবে নি! উপায় তাকলে কবেই চলে যেতুম, লাথি ঝ্যাটা খেয়ে পড়ে থাকতুম নি!

সৌম্য বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, করুণা তারই কাছে মৃণালের নামে অভিযোগ করছে! করুণার স্পর্ধা দেখে সে এতটাই অবাক হয়ে গেলো যে তার মুখে আর কোনো কথা সরছিলো না। অনেকক্ষন চুপ করে থাকার পরে সে গম্ভীর গলায় বললো,

আমার মনে হয়না কোনো কারণ ছাড়াই বউ দিদি এগুলো করেছে, এর পেছনের কারণটা আমি আগে মৃণালের কাছে জানবো তার পরে এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলবো। একতরফা কথা শুনে আমি কোনো মতামত দিতে পারবো না!

করুণা মুখ তুলে তাকালো, সে হয়ত আশা করেনি যে সৌম্য এরকম কিছু বলতে পারে, তার মুখে একটা হতাশ ভাব ফুটে উঠলো। সৌম্য আর কিছু বলার আগেই সে তড়িঘড়ি বলে উঠলো,

উনি ইচ্ছে করেই করছেন এসব, বড়ো মা আমারে ভালোবাসেন, তাইতে ওনার রাগ, তিনি বড়ো মা কে জব্দ করার জন্যই আমায় একান তে তাইরে দিতে চান!

মুহূর্তের মধ্যে ধৈর্য্য হারালো সৌম্য, সে যথেষ্টই শান্ত এবং ধৈর্য্যশীল, কিন্তু এই মুহূর্তে তার পক্ষে শান্ত থাকা অসম্ভব হয়ে উঠছিলো। কড়া গলায় করুণার দিকে তাকিয়ে বললো,

আপনি বোধ হয় আপনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন! ভবিষ্যতে এ বিষয়ে যা করার আমি বড়ো মার সঙ্গে আলোচনা করে করবো, ফলাফল আপনি খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবেন!

বড়ো মার সঙ্গে আলোচনা করার কথায় করুণার মুখ শুকিয়ে গেলো, এ ব্যাপারে পারুল বালার সঙ্গে সৌম্য আলোচনা করতে পারে এটা সে একটুও আশা করেনি। বেশ কিছুদিন ধরে সৌম্যর ব্যক্তিগত কাজ করতে করতে তার এক প্রকার ধারণা জন্মেছিলো যে সৌম্য তাকে অন্য দের তুলনায় একটু আলাদা চোখেই দেখে, তাই তার কাছে বউ দিদির নামে অভিযোগ করার সাহস সে সঞ্চয় করেছিলো। এখন ঘটনা প্রবাহ অন্য দিকে গড়াতে দেখে সে তার একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র চোখের জল বের করে ফেললো, হাত জোড় করে বললো,

বড়ো মা কে বলবেন নি, উনি জানতে পারলে আর রক্ষে রাখবেন নি। এ বাড়ি থেকে তাইরে দিলে আমায় গলায় দড়ি কলসি দিতে হবে!

এই কথায় একটু হলেও থমকে গেলো সৌম্য, কিন্তু তার করুণা কে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বিরক্তি লাগছিলো। হাতের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা টা এক চুমুক দিয়েই মুখ বিকৃত করে করুণার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো,

এটা নিয়ে যান!

মৃণাল দোতলায় নিজের ঘরে চা নিয়ে উঠে এসে সৌম্য কে দেখতে পেলো না। ছাদের দরজা খোলা দেখে সৌম্য হয়তো ছাদে আছে ভেবেই সে ছাদের সিঁড়ি তে পা দিলো। খোলা দরজার সামনে এসেই সে করুণা এবং সৌম্যর কথোপকথন শুনতে পেয়েছিলো। করুণা হাত বাড়িয়ে কাপ নিয়ে চোখের জল মুছে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো, চায়ের কাপ হাতে বউ দিদি কে ছাদে উঠে আসতে দেখে চমকে উঠে চুপ করে গেলো।

করুণার চমকে ওঠা সৌম্য বা মৃণাল কারোর চোখই এড়ালো না, করুণার হাতে চায়ের কাপ দেখেই মৃণালের ভ্রু কুঁচকে গেলো।

তুই দাদার জন্যে চা করে নিয়ে এসেছিস! আমাকে বলার প্রয়োজনও মনে করিস নি তাই তো?

কড়া গলায় বললো মৃণালিনী, করুণা থতমত খেলো,

তুমি জানতে না ও চা নিয়ে এসেছে! তুমি ওকে পাঠাও নি!!

সৌম্য একদম হতবাক হয়ে গেলো। মৃণাল কোনো উত্তর দিলো না, করুণা হটাৎ তার অজান্তে সৌম্যর জন্যে চা নিয়ে ছাদে উঠেছে কেনো বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। তার মনের মধ্যে আশঙ্কার একটা চোরা স্রোত বইতে লাগলো, সে করুণা কে উদ্যেশ্য করে রূঢ় গলায় বললো,

তুই কি স্টোভ জ্বালিয়ে ছিলি? নিরামিষ ঘরে তো আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, তোকে তো চা করতে দেখলাম না!

করুণা চুপ করে থাকলো, সে স্টোভ জ্বালিয়েছে এটা স্বীকার করা যত টা কঠিন তার পক্ষে ছিলো, ঠিক ততটাই কঠিন ছিলো আমিষ হেঁসেলে সে চা করেছে এটা স্বীকার করা। দুটোর কোনো একটাও যদি পারুল বালা জানতে পারেন তাহলে আর তার রক্ষা থাকবে না। নিরামিষ উনুনে আগুন থাকতে অহেতুক কেরোসিন তেলের অপচয় তিনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। আর আমিষ রান্না ঘরের উনুনে সে চা করেছে এটা জানতে পারলে তাকে এই মুহুর্তেই বাড়ি থেকে তিনি বার করে দেবেন।

গত কালই এঁটো কাপড়ে জল তোলার জন্যে ইতিমধ্যেই পারুল বালা তার ওপরে ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন, তাতে তার না বলে বাড়ি যাওয়া আরও বেশি করে ইন্ধন যুগিয়ে ছিলো, এখন নতুন করে তার এই অকাজ জানতে পারলে ঠিক কি কি তিনি করতে পারেন তার মোটামুটি সব আন্দাজই করুণার ছিলো। তাকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃণাল আরও ক্ষিপ্ত হচ্ছিলো, খানিকটা ধৈর্য্য হারিয়ে সে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললো,

এরপর থেকে ভবিষ্যতে যে কাজ গুলো আমার, সেগুলো যখন তুই করবি, তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেই করবি, এটা যেনো দ্বিতীয় বার বলার দরকার না পড়ে তোকে,

এতো কথার পরেও করুণা ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো, তাকে এখনও ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো মৃণাল,

এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যা, নিচে যা! তোর পিসি তোকে রান্না ঘরে খুঁজছে!!

করুণা আর দাঁড়ালো না, সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে এগোলো, তার চলে যাওয়ার দিকে মৃণাল এবং সৌম্য দুজনেই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মাত্র কদিন আগেই পিসির হাত ধরে চৌধুরী বাড়িতে আশ্রয় নিতে আসা গ্রাম্য তরুণীটির এই অভাবনীয় পরিবর্তন তাদের কে অবাক করছিলো।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here