মৃণালিনী পর্ব -৩৫

0
710

#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৫
মৃণাল যখন শ্বশুর মশাইয়ের ঘর থেকে নিজের ঘরে ফিরে এলো, সৌম্য তখন ঘরের লাগোয়া বারান্দায় সিগারেট হাতে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো। বাবার বকাবকি তে সে যথেষ্টই দুঃখ পেয়েছিলো, মৃণাল কে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় আসতে দেখে তার দিকে ফিরে তাকালো।

কি হলো? মন খারাপ?

সৌম্য মাথা নাড়লো,

নাহ! বাবার কথায় কিছু মনে করি না, ছোটো থেকেই বাবা কে এরকম ভাবে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বাবা সব সময় নিজের কথাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন সব সময়।

তা হয়ত ঠিক! তবে বয়স তো বাড়ে সবারই। যখন ছোটো ছিলে তখন হয়ত প্রতিবাদ করতে পারোনি, কিন্তু এখন তো নিজের কথাটাও বলা উচিত।

তোমার কি মনে হয়, বললেই বাবা শুনবেন?

হয়ত শুনবেন না, কিন্তু তাই বলে ভুল টা কে ভুল বলে বলবে না? চুপ করে থাকলেই কি সমস্যার সমাধান হয় সব সময়? বাবাও তো আলোক দার কথা জানতেন! উনি কেনো সব জেনেও চুপ করে ছিলেন, সেটা জানতে চাওয়া কি অন্যায়?

মৃণাল এর কথায় সম্মতিসূচক মাথা হেলালো সৌম্য,

মানি অন্যায় নয়, কিন্তু আমি বিতর্ক পছন্দ করি না মৃণাল! তার থেকে যদি….

তার থেকে যদি অন্য কোনো উপায়ে কাজ উদ্ধার করা যায় তাই তো? মানে যা তুমি সব সময় বলো! যুধিষ্ঠিরও প্রয়োজনে মিথ্যে বলেছেন, সেখানে আমরা তো সাধারণ মানুষ! তাই না?

স্বামীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো মৃণালিনী, সৌম্য মাথা নিচু করে নিলো।

বাবা কে কিছু কথা বলে এলাম, হয়ত তুমি শুনলে রাগ করবে কিন্তু আমার মনে হলো কথাগুলো ওনা কে বলা উচিত। আমি জানি তুমি বিতর্ক পছন্দ করো না, তাই সব সমস্যা কে তুমি এড়িয়ে গিয়ে ঘুর পথে তার সমাধানের রাস্তা খোঁজো। কিন্তু সব সময় তোমার এই পলায়নপর মানসিকতা আমার পছন্দ নয়। আজ বাবা তোমার ওপর এতো রাগ দেখালেন কিন্তু তিনিও তো সবটাই জানতেন তাই না? সেটা জানা থাকা সত্বেও তুমি একবারও ওনার কথার প্রতিবাদ করলে না! আমি জানি তুমি বলবে যে এতকাল বড়ো মার কথার প্রতিবাদ আমি করিনি কেনো! কিন্তু বড়ো মা যত টা মুখে কড়া কথা বলেন, মনের দিক থেকে তিনি অতটা কড়া নন। তিনি আসলে সব দিক থেকে একজন হেরে যাওয়া মানুষ যিনি শুধু সবার কাছে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে চান সব সময়। সেটা আমি বুঝি, তাও যখন তিনি অহেতুক কোনো কোনো সময় মা কে অপমান করেছেন আমি তার প্রতিবাদও করেছি। কিন্তু বাবার সব আছে, তা সত্বেও তিনি শুধু নিজের মতামত কে প্রাধান্য দেবার জন্যে অন্য কে ব্যবহার করেছেন সব সময়, আর তুমি সেটা বুঝেও সহ্য করে এসেছো! অন্যায় যে করে আর যে সেটা জেনে শুনে সহ্য করে তারা দুজনেই যে সমান অপরাধী সেটা তুমি মানো নিশ্চয়ই।

সৌম্য চুপ করে থাকলো, মৃণাল কে দেওয়ার মতো কোনো উত্তর সত্যিই আজ তার কাছে ছিলো না। কিছুক্ষন চুপ থেকে সে বললো,

তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছো, আমার আরও অনেকদিন আগেই সরব হওয়া উচিত ছিলো। আমি পারিনি সেটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু এই মুহূর্তে কি করণীয় সত্যিই সেটা মাথায় আসছে না, ক্লাব টা তৈরি করা আটকানো বোধ হয় সত্যিই মুশকিল।

মৃণাল বেশ চিন্তিত ছিলো, আলোক যথেষ্টই বুদ্ধিমান, গ্রামের ছেলেদের খেপিয়ে তুলে ওই জায়গার দখল নিতে সে চেষ্টা করবেই। বিশেষ করে সে দুপুরে বাড়ি ফেরেনি মানে যে কোনো ভাবেই হোক তার কাছে খবর পৌঁছে গেছে। জমি নিয়ে শরিক দের মধ্যেই যথেষ্ট বিবাদ আছে, সেই সুযোগটাই আলোক নিতে চেষ্টা করবে। এমন কিছু যদি করা যায় যেখানে শরিকরা একজোট থাকবে তাহলেই এই জমি বাঁচানো সম্ভব।

আমার একটা প্রস্তাব ছিলো, তাতে সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না! এখানে এমন কোনো কিছু করতে হবে যাতে সবার সমান উৎসাহ থাকে, প্রত্যেকের স্বার্থ পূরণ হয়, তবেই তাঁরা জমি রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন।

মৃণাল এর কথায় অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সৌম্য,

অবনি কাকার স্ত্রী মাঝে মাঝেই বলতেন বিভার পড়াশুনা না জানার জন্যে পাত্রের সমস্যার কথা, এখন অনেকেই বলছেন। বিভা তো আমার কাছে পড়তে শুরুও করেছে। তাই আমি একটা কথা ভেবেছিলাম। ওই জমি যদি মেয়েদের পড়ানোর জন্যে দেওয়ার কথা বলা যায় তাহলে মনে হয় এব্যাপারে কারোরই কোনো আপত্তি থাকবে না, আর জমিটাও আমাদের নিজেদের গন্ডগোলের সুবিধা নিয়ে ক্লাব হতে পারবে না।

সৌম্য একদম অবাক হয়ে গেল! এটা তো খুব ভালো হয়। সত্যিই এখন সবাই তাঁদের মেয়েদের পড়াতে চাইছেন, সেখানে কোনো মেয়ে কে যদি শিক্ষিকা হিসাবে পাওয়া যায়, এর থেকে ভালো আর কিছুই হতে পারে না! আর ক্লাব তৈরির চেষ্টাও বন্ধ হবে!

ঠিক আছে, আমি কথা বলছি, তুমি খুব ভালো কথা ভেবেছো! তবে দলিল অনুযায়ী জমির বেশি অংশই অবনী কাকার, আমি বাবার সঙ্গে কথা বলার আগে ওনার সঙ্গে কথা বলে আসি। এমনিতেও সুভাষের ব্যাপারে সব খোঁজ খবর নিয়ে এসেছিলাম, ওনার বাড়িতে আমাকে যেতেই হতো সেগুলো বলতে, ভালোই হবে এক কাজে দুই কাজ হয়ে যাবে।

কথাগুলো বলতে বলতেই সৌম্য ব্যাগ খুলে একটা সাদা খাম বার করে ফেললো, সেটা তার হাতে দেখেই মৃণালের অনেকদিন আগের অবনী কাকার হাতে দেখা খামের কথা মনে পড়লো,

তুমি কি বিভার কুষ্টি সুভাষ কে দেখিয়েছো? ওটা এখনও তোমার ব্যাগে কেনো?

সৌম্য অবাক চোখে তাকালো, তারপরেই নিজেই হেসে ফেললো,

আরে! তুমিও ওটা কে কুষ্টি ভেবেছিলে নাকি? ওটা তো অবনী কাকার ছেলের চাকরির আবেদন পত্র, বিমলের এক সওদাগরী অফিসে কিছু চেনা জানা ছিলো, ও একবার এখানে এসে অবনী কাকা কে বলেছিলো। তাই তিনি আমার হাতে ওটা বিমলের কাছে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই চাকরিটা হয়ে গেছে, এটা ওর চাকরিতে যোগ দেওয়ার চিঠি। যাই, এটাও দিয়েই আসি একেবারে।

তুমি ওটা দেখিয়েই তখন বড়ো মা কে বিভার কুষ্টি বলে ছিলে না!

মৃণাল একদম অবাক হয়ে গেলো,

আরে, সেতো সরমার বিয়ের কথা পাড়ার জন্যে, তুমি তারপর থেকে আর কোনোদিনও আমাকে জিজ্ঞেস করো নি, আমারও বলা হয়ে ওঠেনি আর,

হাসতে হাসতে বললো সৌম্য। চিঠি হাতে নিয়ে সৌম্য বেরিয়ে যাওয়ার পরে নিজের ঘরেই বসেছিলো মৃণালিনী, আলোক যদি ফিরে আসে রাতের দিকে তাহলে শ্বশুর মশাই কি করতে পারেন তার এই কথার পরে সেসবই বসে বসে ভাবতে লাগলো।

অবনী কাকা, বাড়ি আছো নাকি!

বলতে বলতেই বিভা দের বাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়লো সৌম্য, সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো, বিভার মা তুলসিতলায় সন্ধ্যে প্রদীপ দেখিয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, সৌম্য কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সৌম্য যে সুভাষের খবর নিয়ে আসবে সে তাঁর জানা ছিলো, তাই তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তিনি,

আরে, ওখানে দাঁড়িয়ে কেনো, ভেতরে এসো বাবা! বসো এখানে,

তাড়াতাড়ি একটা পিঁড়ি সৌম্যর দিকে এগিয়ে দিলেন। সৌম্য পিঁড়ি টেনে বসতে বসতেই অবনী কাকা বেরিয়ে এলেন,

বলো বাবা, কি খবর! ছেলে কেমন? সব খবর ভালো তো?

সৌম্য মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ, কাকাবাবু সব ভালো, সুভাষ বেশ ভালো ছেলে, বাড়িও যথেষ্টই ভালো, তুমি নিশ্চিন্তে বিভার বিয়ে নিয়ে এগোতে পারো।

অবনী খুশি হলেন, তাড়াতাড়ি দু হাত কপালে ঠেকালেন বিভার মা,

দেখো ঠাকুর, সব কিছু যেনো ঠিক ঠাক হয়ে যায়!

সৌম্য এবার পকেট থেকে সাদা খাম টা বার করে অবনী কাকার হাতে দিলো,

আনন্দের খবর আরও আছে কাকাবাবু, এই নাও তোমার ছেলের চাকরির চিঠি। বিমল সব কিছু ব্যবস্থা করেই রেখেছে, ওকে সামনের সপ্তাহেই চলে যেতে বোলো, তাহলে সামনের মাস থেকেই যোগ দিতে পারবে চাকরিতে।

পর পর দুটো আনন্দের খবরে বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেলো, অবনী চিৎকার করে তাঁর ছেলেকে ডেকে নিয়ে এলেন। দু হাতে সৌম্যর হাত জড়িয়ে ধরে বললেন,

সারা জীবন তোমার ঋণী হয়ে থাকবো বাবা, যে কোনো কাজে তোমার দরকার হলে বোলো আমাকে,

সৌম্য এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো, তাড়াতাড়ি অবনী কাকার হাত জড়িয়ে ধরলো,

খুব বেশি কিছু চাইবো না কাকাবাবু, শুধু একটাই অনুরোধ করবো। ওই শরিকি জমিটার গন্ডগোল টা মিটিয়ে নাও, আমরা নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল না মেটালে ও জমি ধরে রাখা যাবে না কাকা। আলোক দা বিভাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওতে ক্লাব তৈরি করতে চেষ্টা করছে।

অবনী চুপ করে রইলেন, গ্রাম্য জটিলতায় তিনিও শ্যাম সুন্দরের থেকে কোনো অংশে কম যান না। জমিতে তাঁর অংশই বেশি তাই মিটমাট করতে গেলে তাঁর ক্ষতির সম্ভাবনা সব চেয়ে বেশি বুঝেই একটু দোনা মনা করতে লাগলেন তিনি, একটু ভেবে বললেন,

ও জমি তো পতিত বাবা, চাষ বাস তো হবে নি আর! ও জমির জট মেটা না মেটা সমান!

হ্যাঁ, কাকাবাবু সেটা জানি বলেই তো বলছি, পতিত জমি বলেই তো ক্লাবের দখলে যাচ্ছে! তাতে তো তোমার ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি তাই না?

কথাটা প্রায় লুফে নিয়ে বললো সৌম্য, এবার একটু থমকে গেলেন অবনী, চিন্তিত মুখে সৌম্যর দিকে তাকালেন,

তালে তুমি কি করতে বলো বাবা?

সৌম্য এর অপেক্ষা তেই ছিলো,

তাই তো বলছিলাম কাকাবাবু, জমি যখন পড়েই নষ্ট হচ্ছে তাহলে অন্তত এমন কিছু হোক, যাতে সবার উপকারেই লাগে, আর ক্লাব হওয়া থেকেও বাঁচানো যায়। এখন তো বিভার সমস্যা তোমার মিটলো কাকা, কিন্তু আরও কতো মেয়েরও তো পড়া শুনা না জানার জন্যে কতো সমস্যা হচ্ছে। আর ধরো না ছেলে তোমার চাকরি পেয়ে গেলো, এবার তো আজ বাদে কাল বিয়ে দেবে, তারও ছেলে মেয়ে হবে, তাই মেয়েদের একটা স্কুল কি তোমারও দরকার পড়বে না কাকা?

অবনী আর বেশি কিছু ভাবার আগেই তাঁর ছেলে আর বউ দৌড়ে এলো,

তুমি আর অতো ভেবো নি দিকি, আর অমত করো নি কো, এতো ভালো কাজ করছে, হ্যাঁ বলে দাও ছেলেটাকে!

  • তীক্ষ্ণ গলায় স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন বিভার মা, বউ আর ছেলের যৌথ উদ্যোগের কাছে হার মানলেন অবনী। তিনিও অবশ্য যথেষ্টই বুদ্ধি ধরেন, পাছে তাঁর জমি দিতে রাজি না হওয়ায় আবার ছেলের চাকরি বা মেয়ের বিয়ে সবটাই ভেস্তে যায় সেই ভয়ও তাঁকে তাড়া করছিলো বৈকি!
    ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here