#মৃণালিনী
#পর্ব ৪৩
সেই যে দুপুরের খাওয়ার পরে পারুল বালা নিজের ঘরে ঢুকলেন, আর বেরোলেন না। চৌধুরী বাড়ির বড়ো গিন্নি সম্ভবত প্রথম বার এতটা অপমানিত হলেন। সন্ধ্যে বেলায় দালানে পাতা চাটাই এ বসে চা খেতে খেতে সৌম্য তাঁর খোঁজ করলো। কুমুদ ছেলের কাছে সবিস্তারে দুপুরের ঘটনার বর্ণনা দিলেন। কিছুক্ষন পরে সৌম্য বড়ো মার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো, স্বামীর পিছু পিছু মৃণালিনীও উপস্থিত হলো।
কি হয়েছে তোমার বড়ো মা? শরীর খারাপ?
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো সৌম্য, দুজনকে একসঙ্গে দেখেই পারুল বালা বিছানায় উঠে বসলেন।
এতদিনের উঁচু মাথাখান এক্কেরে নুয়ে গেলো বাছা! পারুল বালা রে ঘরে ঢুকে নোকে কতা শুনিয়ে গেলো! কি কুক্ষণে যে ওই হতভাগা ছেলে রে ঘরে নে এয়ে ছিলুম!
অসহায় গলায় বলা বড়ো মার কথাগুলো সৌম্য কে নাড়িয়ে দিলো। পাশে বসে আস্তে করে বড়ো মার পিঠে হাত রাখলো সৌম্য,
বড়ো মা! দোষ তোমার নয়, তুমি তো ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিলে। দোষ তো তার যে ভালোবাসার যোগ্যই ছিলো না! মিছিমিছি মন খারাপ কোরো না, আমরা বরং করুণার একটা ভালো বিয়ে দেবার চেষ্টা করি।
পারুল বালা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
সে চেষ্টা কি আর করচি নে বাছা! কিন্তু সে গুড়েও যে বালি! এই তোমার বউরেই জিগিয়ে দ্যাকো! শিবুর মতো সেদিনের ছেলে! সেও কি আমায় কম কতা শুনিয়ে গেলো! কারে ছেড়ে কার কতা কই!! সবাই যেনো সব্বনাশ করতে উটে পড়ে নেগেচে গো!
বড়ো মা! দিন পাল্টাচ্ছে! শ্যাম সুন্দর চৌধুরীর কথাই যে আর শেষ কথা হবে না, এটা এবার মেনে নিতে হবে!
পারুল বালা ঘাড় নাড়লেন,
না, বাছা! আমি বেঁচে থাকতে এ মেনে নিতে পারবো নে কো!!
মৃণাল বড়ো মার হাতের ওপরে আলতো চাপ দিলো,
বড়ো মা! যুগ বদলায়, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও বদলে যেতে হয়। যে নিজেকে সময়ের সঙ্গে বদলাতে পারে না, সে পেছনে পড়ে থাকে। আপনিও তো নিজেকে কম বদলে নেননি বড় মা! যে আপনি একদিন সরমা কে পড়তে দেন নি সেই আপনিই তো মেয়েদের ইস্কুল করতে দিতে এগিয়ে এলেন!
সে আলাদা কতা! পড়াশুনা করা দরকার! তাই বলে শিবুর মতো ছেলে, চৌধুরী বাড়ির দাওয়ায় বসে আমারে কতা শুনিয়ে যাবে! যতোই বলো, এ তার হিংসের কতা। বিমলের মতো ভালো একখান পাত্তর যে আমার সরমার কপালে হবে, সে তো আর সে ভাবে নি কো! তাইতে তার যত জ্বালা!
মৃণাল হেসে ফেললো।
সে কথা যখন আপনি বুঝেই ফেলেছেন বড়ো মা, তাহলে আর মন খারাপ করছেন কেনো?
পারুল বালা স্মিত হাসলেন, তাঁর মুখ থেকে অপমানের ছাপ ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছিলো। শিবু ঘটক যে আসলে নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতেই করুণার পাত্র জোগাড়ে সম্মত হয়নি এই ধারণাই তাঁর মনের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছিলো। তিনি মুখে প্রশান্তির ছাপ নিয়ে শুয়ে পড়লেন। তাঁকে শুতে দেখে সৌম্য আর মৃণালিনী উঠে পড়লো। তারা দুজনে যখন বড়ো মার ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল, তখন তাদের হারুর সঙ্গে দেখা হলো। বউ দিদি কে দেখেই একটু অস্বস্তিতে পড়লো হারু।
তুই এই রাতে এখানে কি করছিস? বাইরের দোর বন্ধ করিস নি এখনো?
বউ দিদির প্রশ্নে ঘাড় কাত করলো হারু,
হ্যাঁ, বউ দিদি সে তো কখন করিচি! দোরে আজও তালা দেবো নাকি শুধতে এয়ে ছিলুম!
মৃণাল একটু অন্য মনস্ক হলো, সে কিছু ভাবার আগেই পাশ থেকে সৌম্য সম্মতি জানালো,
হ্যাঁ, তালা দিয়ে দে। এখন থেকে প্রতিদিনই দিবি, আর শুধু খিল দিলে হবে না। রাস্তা এখন পাকা হয়ে গেছে না, প্রায়ই বাইরের লোকজন ঢোকে দেখি গাঁয়ে।
হারু সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো, মৃণাল এবং সৌম্য নিজেদের ঘরে উঠে এলো। মনে মনেই মৃণালিনী একটু উদ্বিগ্ন হচ্ছিলো। বিয়ের পরে যখন সে এই বাড়িতে পা দিয়েছিলো, সেই সময়ের সেই গ্রাম্য পরিবেশে ক্রমশই বদলে যাচ্ছে। বাইরের লোকজনের যাতায়াত বাড়তে শুরু হয়েছিলো ছেলেদের ইস্কুল শুরু হবার পর থেকেই, এখন পিচ ঢালা রাস্তায় রিক্সার চলাচলও শুরু হয়েছে। ক্লাব তৈরির প্রচেষ্টা আপাতত থমকে গেলেও ভবিষ্যতে চেষ্টা যে আবার হবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। গ্রাম ক্রমশই তার কৌলীন্য হারিয়ে শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সৌম্য লণ্ঠনের আলোয় বই খুলে বসেছিলো, দ্বিতীয় লন্ঠন আর না থাকায়, মৃণাল বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েই হারু কে দরজায় তালা লাগিয়ে দালানের দিকে আসতে দেখলো সে। হারু দালানে উঠেই নিচের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো, করুণা না বড় মা কার ঘরে সে ঢুকলো, দোতলার বারান্দা থেকে বেশ কিছুটা ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করেও সফল হলো না মৃণালিনী।
খানিকক্ষন অপেক্ষার পরেও হারু যখন বেরোলো না তখন খানিকটা অধৈর্য্য হয়েই সে নিচে নেমে এলো। করুণার ঘরের দরজা খোলা ছিলো, ভেতর থেকে করুণা এবং হারুর কথোপকথন শুনেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মৃণাল। করুণার ওপরে তার অসম্ভব রাগ হচ্ছিলো, সরল ছেলেটা কে একা পেয়েই যে সে তার মস্তক চর্বণ এর চেষ্টা করছে, এ বিশ্বাসই তার মনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিলো।
আমি বে করতেই চাইনি কাও রে! আমি কলকেতা চলি যাবো! বউ দিদি আমারে হোথায় থুয়ে আসবে কয়েছে,
ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা করুণার গলা শুনে চমকে গেলো মৃণালিনী। হারু তার উত্তরে প্রায় কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। মৃণালের অবাক লাগছিলো, করুণার এই পরিবর্তনে সে মনে মনে যথেষ্টই খুশি হলো। ধীরে ধীরে সে নিজের ঘরে ফিরে গেলো। তাকে ঘরে ঢুকে আসতে দেখে সৌম্য বই থেকে মুখ তুলে তাকালো,
কোথায় গিয়েছিলে?
দালানে। হারু কে করুণার ঘরে ঢুকতে দেখলাম মনে হলো তাই!
সৌম্যর মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হলো,
আবার! করুণা কে সত্যিই এখানে রাখা মুশকিল!
না না, এবার দোষ কিন্তু হারুরই! ওই বারবার যাচ্ছে! করুণা কিন্তু এবার কিছু করেনি। ও বরং বারবার আপত্তিই জানাচ্ছিল।
তাড়াতাড়ি বললো মৃণাল, সৌম্য মাথা নাড়লো,
যাক! তাও ভালো!
পরের দিন সকালেও সুরেশ এলো। ইদানিং সৌম্য এখানে থাকলেই সে উপস্থিত হয়। সকালের দিকটায় বৈঠকখানায় বসে চা জল খাবার সহযোগে তাদের আড্ডা চলে। বন্ধুর ডাকে সৌম্য নিচে চলে যাবার পরে, মৃণালিনী ঘর পরিষ্কার করতে লাগলো। হেঁসেল থেকে আজও বামুন দিদির টুকটাক বিলাপের শব্দ ভেসে আসছিলো, তার সাথে বড়ো মার বকুনির আওয়াজ। বড়মার গলার আওয়াজ শুনে নিচে নামার আগে আলমারি খুলে বড়ো মার গয়নার পুঁটলিটা হাতে নিলো মৃণালিনী, সেই থেকেই সেটা ওর কাছেই রয়ে গিয়েছে, বড়ো মা কে ফেরত দেওয়া হয়ে ওঠেনি আর!
সে যখন হেঁসেলে এলো তখন, সেখানে কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ করুণার অনুপস্থিতে হারুর মা মসলা বাটছে, আর বামুন দিদি কড়া তে রান্না চাপিয়ে বসে বসে সমানে চোখ মুছছেন। তাঁকে ভাইঝির জন্যে তাঁর দাদার কাছে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে, অনেক বড়ো মুখ করে তিনি এবাড়িতে এনে ছিলেন তাকে। তাকে চোখের জল মুছতে দেখেই বিরক্ত হচ্ছিলেন পারুল বালা,
থামো দিকি বাছা! সকাল বেলায় কেঁদে আর গেরোস্তের অমঙ্গল কোরোনে। তোমার ভাইঝি কি জলে পড়ে আছে! তার ব্যবস্তা না করে এ পারুল বালা মরবে নে!
কর্তা মার কথাতেও ভরসা করতে পারছিলেন না বামুন দিদি, আলোকের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া তাঁর কাছেও এক বিরাট ধাক্কা ছিলো। তার সঙ্গে গত কালের শিবু ঘটকের কথাও তিনি ভোলেন নি। হারুর মাও একই বাড়িতে বহুদিন থাকার সুবাদে বামুন দিদির প্রতি যথেষ্টই সংবেদনশীল, মসলা বাটা থামিয়ে রেখে সে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো,
আহা! কেঁদোনি দিদি! কিছু একটা ব্যবস্তা হবে ঠিক! কত্তা মা আচেন তো!
সব কতা তে তোর কতা! কাজের কাজ যদি কিচু হয়! পাত্তরের তো কোনো অভাব নেই কো! তা দরকারের সময় তারা কোতা গে বসে থাকেন কে জানে!
আর কোনো কথা না বলেই তাড়াতাড়ি মসলা বাটা শেষ করে ঝাঁটা হাতে তুলে নিল হারুর মা, পারুল বালার মুখ কে বড্ড ভয় তার! গয়নার পুঁটলি হাতে ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো মৃণালিনী, কথায় কথায় পাত্রের অভাব নেই বলার মতো সাহস বড়ো মা পাচ্ছেন কোথায় এটা জানার ইচ্ছে তার প্রবল হচ্ছিলো। ইতিমধ্যেই বড়ো মার গলা বৈঠকখানা অবধি পৌঁছে গিয়েছিলো, অসুস্থ বড়ো মা যাতে বেশি চেঁচামেচি না করেন সেটা বলতেই সৌম্য সুরেশ কে সঙ্গে নিয়েই উঠে এসেছিলো।
আহ! বড়ো মা! এতো উত্তেজিত হয়ো না। তোমার শরীর খারাপ। যাও ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।
অন্য কেউ হলে হয়ত ছাড়তেন না, কিন্তু এ নিয়ম তিনি সৌম্যর বেলায় খাটান না, মুখে হাসি এনে বললেন,
দাঁড়াও বাছা! মে টার একখান ব্যবস্তা করে যাই, তার পিসি যে কেঁদে ককিয়ে মরচে!
সবাই অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকালো, এই মুহূর্তে কোথা থেকে পাত্র পাওয়া যাবে এটা সবার কাছেই খুব কৌতূহলের বিষয় হওয়ার দাঁড়াচ্ছিল। চিৎকার করে হারু কে ডাকলেন পারুল বালা, সে এসে মুখ নিচু করে দাঁড়ালো।
এ পাত্তর কেমন! সারা দিন শুধু পেছন পেছন ঘুরে মরে, তা বে দে দিলেই তো হয়!
সবাই অবাক হয়ে হারুর দিকে তাকিয়ে ছিলো, মৃণালিনী বিস্মিত হলো, বড়ো মার চোখ কি কিছুই এড়ায় না! নাকি হারুই গিয়ে বলার সাহস করেছে বড়ো মা কে!
এতক্ষন বামুন দিদির সমব্যথী হারুর মা, করুণা কে শেষে তার ছেলের ঘাড়েই চাপানো হচ্ছে দেখেই তাড়াতাড়ি ঝাঁটা রেখে এগিয়ে এলো,
এ কি কতা কত্তা মা! হারু আমার ছোটো ছেলে, সে এসবের কি বোজে! সে কি বলতে কি বলে! তার কতা কেউ ধরে নাকি!
তাই নাকি! ছোটো ছেলে! কিচু বোজে নে! তা ভালো কতা! কিন্তু তুই তো সব বুজিস! ঘর খান তো সেই তে বাঁধা পড়ে আচে, ওটুকু ছাড়িয়ে নিতে হবে নে? আর এট্টু বাড়াতেও তো হবে নাকি? ছেলের বে দে তুলবি কোতা? দু কাটা জমি কি তোকে এমনি দেবো নাকি! ছেলের বউ নিয়ে ঘর তুলবি তবে তো!
হারুর মায়ের মুখ বন্ধ করার এর থেকে বেশী ভালো উপায় বোধহয় কেউ আবিষ্কার করতে পারতো না। হারু কে ডেকে কত্তা মার পায়ের ধুলো নিতে একটুও দেরি করলো না সে। বড়মা কিভাবে জানলেন সেটা ভেবেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো সৌম্য, স্বামীর সঙ্গে চোখা চোখি হলো মৃণালিনীর, দুজনের দৃষ্টি বিনিময় নজর এড়ালো না পারুল বালার।
এদিক পানে এট্টু এগিয়ে এসো তো মা গো! তকন থেকে সেই এক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আচে! কুটি ভেঙে তো দুটি করো নে! তুমি নাকি চালাবে ইস্কুল! ওই পোঁটলা থেকে মটর মালাখান বের করে দাও দিকি! আর করুণারে ডেকে নে এসো গে। ওটা তার ভারী পছন্দের, ওটা দিয়েই তারে আশিববাদ করি!
মৃণাল এর হাতে ধরা পুঁটলির দিকে ইশারা করলেন পারুল বালা, তাঁর মটর মালা যে করুণার খুব পছন্দ ছিলো, সেটা তিনি বিলক্ষণ জানেন। মৃণাল চমকে উঠলো, তবে কি বড়ো মা করুণার গয়নার পুঁটলি সরাবার কথা জানতেন!!
ক্রমশ