মৃণালিনী পর্ব ৪৪

0
950

#মৃণালিনী
#পর্ব ৪৪
বড়ো মা! আপনি কি করে জানলেন?

পারুল বালা সবে করুণার সমস্যার সমাধান করে, নিজের ঘরে পা দিয়েছিলেন, মৃণাল আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরেই পেছন পেছন ঢুকে এলো। স্মিত হাসলেন পারুল বালা,

চুলগুলো কি আর এমনি পেকেচে মা গো! হারু কে নে বাপ মরে যাওয়ার পর যকন তার মা একেনে এলো, তকন সে উদোম হয়ে আমার পেছন পেছন বেড়াতো! তারে আমি জন্মাতে দেকিচি! তার মুক শুকনো করে ঘুরে বেড়ানো কি আমি দেকিনি! চেপে ধরতেই সব উগরে দেলো!

বড়ো মা! একটা কথা বলার ছিলো! হারু আমাকে বলেছিলো সে করুণা কে বিয়ে করতে চায়, আমি রাজি হই নি।

বউমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন পারুল বালা,

আসলে আমার মনে হয়েছিলো ও শুধুই হারু কে ব্যবহার করেছে এতদিন! ভালোবাসে নি!

মৃণাল এর কথায় সম্মতি জানালেন পারুল বালা,

শুনলুম তোমার আপত্তি ছেল, হারু কয়েলো আমায়। কিন্তু একখান কতা! সে একখান ভুল করেচে তাই কি তার সব আটকে তাকবে মা? আমার ভাইপো কি বে না করে বসে তাকবে? তার তো মে র অভাব হবে নে কো! এ বরং ভালো হলো, সিককে তো সে পেয়েচে, আর ভুল সে করবে নে কো! আর হারু আমাদের সাদাসিদে ছেলে, ওর জন্যি এইরম মে দরকার, নাইলে নোকে ঠকিয়ে নেবে!

মৃণাল হেসে ফেললো, সে আর কিছু বলার আগেই হঠাৎ করেই নিজের থেকেই বলে উঠলেন পারুল বালা,

গয়নার পুঁটলিখান তোমার কাচেই থাকুক একন, আমার দরকার পড়লে চে নেবোখন। দোষ আমারই, কাঙাল কে শাকের ক্ষেত দেকালে, সে তো যাবেই!

মৃণাল চুপ করে গেলো, পারুল বালা নিজেও আর ওই প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে যেতে চাইলেন না। করুণার বিয়ের তোড়জোড় চলতে লাগলো। করুণার মুখের খুশি সবারই চোখে পড়ছিলো, সে যে আলোকের সঙ্গে হওয়া সম্পর্ক ভুলে নতুন করে এগিয়ে যেতে চাইছে, সেটা বাড়ির সবাইকেই যথেষ্ট স্বস্তি দিচ্ছিলো।

হারুর সঙ্গে করুণার বিয়ে হয়ে গেলো। অসুস্থ শরীরেই পারুল বালা যথেষ্টই ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দিলেন। বিয়ে উপলক্ষ্যে বিমল সরমা কে নিয়ে কলকাতা থেকে উপস্থিত হলো। সৌম্য এবং মৃণাল সরমা কে ইস্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করলো। তাদের দুজনের কারোরই এই প্রস্তাবে আপত্তি ছিলো না, তবে কোনো প্রথাগত শিক্ষা না থাকায় সরমা একা দায়িত্ব নিতে ইতস্তত বোধ করতে লাগলো।

তাদের আলোচনা চলাকালীনই বিভা সরমা র সঙ্গে দেখা করতে উপস্থিত হলো। দুই সই এ অনেকদিন পরে দেখা হলো, নতুন প্রাপ্তি ছিলো বিভার বিয়ের খবর, সেই সব নিয়েই মৃণাল, সরমা এবং বিভার মধ্যে উচ্ছসিত আলোচনা চলতে লাগলো। কথায় কথায় ইস্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার কথা উঠলো, সরমা একা দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছে সেটা জানিয়ে মৃণাল বিভা কে তাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিলো। দুজনেরই প্রথাগত শিক্ষা ছিলো না, কিন্তু মেয়েদের শুধু মাত্র বর্ণ পরিচয় করানো টুকু তাদের পক্ষে খুব কঠিন ছিলো না, বিভা সহজেই সম্মত হলো।

মৃণাল নিশ্চিন্ত হলো, এর পরের ধাপ ছিলো বড়ো মা র কাছে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া। বিয়ে পর্ব সমাধা হবার পরে একদিন সৌম্যর সঙ্গে আলোচনা করলো মৃণালিনী। সৌম্যর কলকাতা ফিরে যাবার সময় এসে গিয়েছিলো, সে ফিরে যাওয়ার আগেই, একদিন রাতের খাবার নিয়ে বড়ো মার ঘরে গিয়ে কথা তুললো মৃণাল।

বড়ো মা, একটা কথা বলার ছিলো!

পারুল বালা মুখ তুলে তাকালেন,

আমি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চাই বড়ো মা! মাস চারেক পরেই আমার পরীক্ষা! আগের বার আপনাকে না জানিয়েই পরীক্ষা দিয়েছিলাম! এবার আর করতে চাই না! আপনি অনুমতি দেবেন তো?

মৃদু হাসলেন পারুল বালা,

জানি আমি, বেয়াই মশায় আমারে কলকেতায় থাকতে কয়েছিলেন! তিনি বোধ করি সত্যি টা জানতেন না! তুমি নিজে থেকে কবে কও, সে আশায় ছিলেম!! আর পরিককে তো দিতেই হবে, নিজে না শিকলে অন্য কে শেকাবে কি করে?

মৃণাল স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। বড়ো মার এতো সহজে রাজি হয়ে যাওয়ার আশা তার ছিলো না। দিন কাটছিলো, সৌম্য কলকাতায় ফিরে গেলো। আবার তার সাপ্তাহিক যাতায়াত শুরু হলো। শরিকি জমি দখলে এনে মৃণাল এর আটচালার ইস্কুল শুরু হলো। সরমা কলকাতা ফিরে গিয়েছে বউ দিদির পরীক্ষার সময় এসে ইস্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, তাই আপাতত বিভার সাহায্যেই ইস্কুল কে চালিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছিলো মৃণালিনী।

পড়াশুনা মেয়েদের জন্যে কতটা প্রয়োজনীয় সেটা সম্ভবত সবাই অনুধাবন করছিলেন, তাই ক্রমশই ছাত্রী সংখ্যা বাড়ছিলো। শুধু এই গ্রাম নয়, আশে পাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মধ্যেও সবেধন নীলমণি বলতে এটিই মেয়েদের একমাত্র ইস্কুল হওয়ায় সেই সব গ্রাম থেকেও ক্রমশই ছাত্রীরা এই ইস্কুলে ভিড় করছিলো। এতো ছাত্রীর ভিড় সামলাতে মৃণাল এবং বিভা দুজনেই হিমশিম খাচ্ছিলো। বিভার বিয়েও প্রায় এগিয়ে আসছিলো, তাই তাকে একটু চাপ মুক্ত রাখার চেষ্টায় মৃণালিনী নিজের কাঁধেই ইস্কুলের দায়িত্বের বেশির ভাগটাই তুলে নিয়েছিলো।

এই রকম সময়ে একদিন ইস্কুল থেকে ফিরেই মৃণাল তার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যে হয়ে গেলেও যখন সে তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বালাতে উঠলো না, তখন কুমুদ করুণা কে ওপরে পাঠালেন। করুণা ওপরে গিয়ে মৃণাল কে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে নিচে ছুটে গিয়ে খবর দিলো। তার খবর শুনে অশক্ত শরীরেই পারুল বালা বেরিয়ে এলেন। নিচে বেশ হৈ চৈ শুরু হলো। নিচের থেকে আসা হৈ চৈ এর আওয়াজে মৃণাল বিছানা ছেড়ে উঠে, উদ্বিগ্ন মুখে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

হবে নে! শরীলের আর দোষ কি!! এতো খাটুনি কি আর সজ্জ হয়! কতো বার কোয়েচি, এট্টু কম করো মা গো! তা তিনি শুনলে তো!

তাকে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াতে দেখেই উঠোনে দাঁড়িয়েই চিৎকার করলেন পারুল বালা, এতক্ষনে বড়ো মার উদ্বেগের কারণ যে আসলে সেই, সেটা বুঝেই লজ্জিত হলো মৃণালিনী।

আমার কিছু হয়নি বড়ো মা! খুব ক্লান্ত লাগছিলো, তাই একটু শুয়ে ছিলাম। আমি সন্ধ্যে দেখিয়ে দিচ্ছি!

থাক বাছা! আমারে আর মিছে কতা কইতে হবে নে! তোমার কিচু হয়েছে কিনা সে তোমার মুক দেকেই বোজা যাচ্ছে!

ধমকের সুরে বলে উঠলেন পারুল বালা, হারুর মাও তাতে সঙ্গত করলো।

হ্যাঁ গো কত্তা মা! কদিন ধরেই বউমা রে কেমন যেনো শুকনো শুকনো দেকচি গো! একবার ডাগদার বাবুরে খপর করো দিকি।

তখনই শ্যাম সুন্দর সদর থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আলোকের যাবার পর থেকে, তিনি একাই যাতায়াত করেন। তাঁর নতুন চালক বাড়িতে গাড়ি ঢোকানোর আগেই কুমুদ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন,

ও গো শুনছো! বউমার শরীল টা কেমন যেনো ঠিক মনে হচ্ছে নে! একবার ডাক্তারখানায় নে গেলে হতো নে!

শ্যাম সুন্দর উদ্বিগ্ন হলেন, তবে তাঁর বাড়ির বউ নিজে ডাক্তারের কাছে যাবে, এটা তাঁর মনঃপূত হলো না। তিনি গাড়িতে করে ডাক্তার বাবু কে নিয়ে আসার জন্যে চালক কে পাঠিয়ে দিলেন। মৃণাল বারবার আপত্তি জানাতে লাগলো, সে যে এমন কিছু অসুস্থ নয় সেটা বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা তার ব্যর্থ হলো। যদিও ডাক্তার বাবু আসার আগেই হারুর মা তার রোগ নির্ণয় করলো।

ওমা! বউমা যে পোয়াতি গো! কেমন ধারা শাওড়ি তোমরা মা গো! কিচুই বোজনে! তাই তো বলি বউমা দিন দিন এরকম শুইকে যায় কেনে!

পারুল বালা এবং কুমুদ দুজনেই একটু সংশয়ের দৃষ্টিতে বউমার দিকে তাকালেন, মৃণাল লজ্জিত হলো। বামুন দিদিও হারুর মার কথাতেই সহমত প্রকাশ করলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই শ্যাম সুন্দরের পাঠানো গাড়িতে পাশের গ্রামের একমাত্র ডাক্তার বাবু তড়িঘড়ি উপস্থিত হলেন। তাঁর চিকিৎসার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না, হারুর মা যে ডাক্তারেরও কান কাটে সেটা ক্রমশই বোঝা যাচ্ছিলো। সন্তানসম্ভবা থাকাকালীন বিভিন্ন রকম সাবধানতা অবলম্বনের উপায় বলে যাওয়ার সময়, পারুল বালার দেওয়া গোটা কয়েক নারকেল, এবং ব্যাগ ভর্তি আম সহযোগে তিনি বিদায় নিলেন।

চৌধুরী বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেলো। শনিবারে যখন সৌম্য বাড়িতে ফিরলো তার আগেই হারুর মায়ের সৌজন্যে গোটা গ্রামেই চৌধুরী বাড়িতে বংশধর আসার খবর রটে গিয়েছিলো। সৌম্য ট্রেন থেকে নামতেই তার সঙ্গে সুরেশের দেখা হলো, সে কোনো কাজে সদরে গিয়েছিলো। তার কাছ থেকেই সৌম্য নিজের পিতৃত্বের সুখবর পেলো। খবরটি তার জন্যে এতটাই আনন্দের ছিলো যে নিজের উচ্ছাস বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত চেপে রাখা তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠছিলো।

বাড়িতে ঢুকতেই সে মা এবং বড়ো মা দুজনেরই মুখোমুখি হলো, তাঁরা অধীর আগ্রহে ছেলে কে সুখবর দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। মৃণাল দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৌম্য র আসার প্রতীক্ষা করছিলো। কিন্তু পারুল বালা এবং কুমুদ কিছু বলে উঠবার আগেই হারুর মা ধৈর্য্য রাখতে না পেরেই সৌম্য কে বউমার পোয়াতি হবার খবর দিয়ে ফেললো। সৌম্য সে খবর ইতিমধ্যেই পেয়েছিলো, তার মুখে কোনো বিস্ময় ফুটলো না, কিন্তু কুমুদ এই সুযোগ না পেয়ে রাগ করলেন,

সব তাতেই তোমার এতো কতা কিসের হারুর মা! এট্টু নিজের মতো থাকতে পারো নে! গেরস্থের নিজের কতা কিচু থাকবে নে!

হারুর মা মুখ গোমড়া করে কত্তা মা র দিকে তাকালো। কিন্তু পারুল বালা নিজেও বিরক্ত হয়েছিলেন, তিনি হারুর মায়ের গোমড়া মুখ ধর্তব্যের মধ্যেই আনলেন না। সৌম্য কে উদ্যেশ্য করে বললেন,

সবই তো শুনলে বাছা! এরকম সময়ে বেশি ছোটা ছুটি চলে নে কো! তুমি বরং তারে পরীক্ষা দেতে নে গে ওখানেই রেকে এসো। একেবারে সব মিটিয়ে এনো। একেনে তো ডাক্তার বদ্যি নেই কো! যাদের উপায় নেই তারা বাধ্য হয়েই তাকে, তবে তার তো সেরকম নয়। যার বাপ কলকেতা তে আচে, তার আবার চিন্তে কিসের!

কুমুদ সহমত পোষণ করলেন, এমনকি এই ব্যাপারে শ্যাম সুন্দর নিজেও কোনো অমত করলেন না। শেষ পর্যন্ত সন্তান প্রসবের সময়টুকু পর্যন্ত মৃণালিনীর কলকাতায় গিয়ে বাপের বাড়িতে থাকা সাব্যস্ত হলো।
ক্রমশ
(আজকের পর্বে সবাই খুশি হয়েছেন নিশ্চয়ই, আজ সবার মতামত চাই কিন্তু ❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here