#মৃণালিনী
#পর্ব ৬
মেস বাড়ির দোতলা়র ঘরের তক্তপোষে শুয়ে শুয়ে একমনে বই পড়ছিলো বিমল। ভীষণ গরম, অনেকক্ষন চেষ্টার পরেও একটুও ঘুম না আসায় বই নিয়ে শুয়েছিলো সে। মাথার ওপরের পাখাটা একদম আস্তে আস্তে ঘুরছে, গরম যেনো আরও বেড়ে যাচ্ছে সেই হাওয়ায়। তাও এই ঘর টা একদম একপাশে বলে জানলা দিয়ে অন্তত কিছু হাওয়া আসে। যদিও এতো বড়ো আলো পাখা সমেত ঘরের ভাড়া দেওয়া তার পক্ষে কোনো দিনও সম্ভব হতো না যদি না বন্ধু সৌম্য তার বেশির ভাগটাই দিয়ে দিতো।
এই জন্যেই সব সময় খুব লজ্জিত থাকে বিমল, কিন্তু সৌম্য অন্য ধরনের, সে এসব নিয়ে অতো মাথা ঘামায় না। বস্তুত পক্ষে পড়াশুনা ছাড়া জাগতিক জ্ঞান তার বেশ কম। তাই এতদিন ধরেও বিমলের সঙ্গে বোন সরমা র সম্পর্কটা সে বুঝে উঠতে পারে নি।
কিন্তু বিমল নিজে খুব বিব্রত থাকে, সে খুব গরীব বাড়ির ছেলে, পিতৃ মাতৃহীন, দূর সম্পর্কের পিসির আশ্রয়ে ছিলো। শুধু পড়াশোনায় ভালো বলে নিজের যোগ্যতায় জলপানি নিয়ে কলকাতায় পড়তে আসতে পেরেছে। পড়া শেষে এখন এক সরকারি অফিসে সদ্য চাকরি পেয়েছে সে। সৌম্য কে বন্ধু হিসাবে পাওয়া তার কাছে আরো বেশি করে সুযোগ এনে দিয়েছে, কিন্তু তার বোনের সঙ্গে সম্পর্কটা সে কিভাবে নেবে এটা বিমল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
তাই প্রথম বার বন্ধুর বাড়িতে তার বোন কে দেখেও যথেষ্ট সংযত ছিলো বিমল। কিন্তু বার দুয়েক যাতায়াতের পর ইচ্ছেটা দু তরফ থেকে হওয়ায় নিজেকে আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। কিন্তু ইচ্ছে করেই একটু দুরত্ব রাখতে চায় বিমল সরমার কাছ থেকে, নিজে প্রতিষ্ঠা পাবার আগে সৌম্য দের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেবার মতো ধৃষ্টতা তার ছিলো না। এখন সে চাকরি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সৌম্য দের বাড়ির তুলনায় তার চাকরি নগন্য। তাই যখনই সে সৌম্যর কাছে শুনেছিলো সরমাও এসেছে ওদের সাথে তখন থেকেই সে আপাতত খুব প্রয়োজন না হলে স্যার এর বাড়িতে যাবে না বলেই ঠিক করেছে।
ঘরের হলুদ টিমটিমে আলোয় বইয়ের প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না দেখে এবার বই বন্ধ করে উঠে বসলো বিমল। সন্ধ্যে হয়ে গেছে অন্যদিন সৌম্য এই সময় চলে আসে গল্প করতে কিন্তু আজ আসছে না দেখে একটু চিন্তা করছিলো ও, এমন সময় জানলা দিয়ে স্যার এর বাড়ির চাকর ব্রজ দা কে আসতে দেখতে পেলো। বাড়ির নিচের দরজা সব সময় খোলা থাকে, একটু পরেই ব্রজ দা উপরে উঠে এলো। হাতে একটা বড় থলে, তার থেকে বেশ কয়েকটা টিফিন কৌটো বার করে মেঝেয় রাখলো ব্রজ,
দিদিমণি পাঠিয়ে দিলেন,
বিমলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে শুধু এই টুকু বলেই চলে গেলো ব্রজ, বিমল খুব অবাক হচ্ছিলো, দিদিমণি মানে যে মৃণালিনী সেটা সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তার জন্যে হটাৎ খাবার পাঠালো কেনো সে!
কৌতুহল বশত কৌটো গুলো খুলতে খুলতে একটা কৌটোর ভেতরে চিঠিটা দেখতে পেলো বিমল। চিঠিটা পড়ে খুব বিপদে পড়লো সে, মৃণালিনীর হাতের লেখা না চিনলেও লেখা এবং ভাষা দুটোই যে তারই সেটা সে বুঝতেই পারছিলো। সরমা কে সে খুব ভালো করেই চেনে, সে যে লিখতে জানে না সেটা ভালো করেই জানে বিমল, আর এই কথাগুলো তার মুখের কথাও নয়, ভাষার ওপর এতো দক্ষতা সরমার নেই! কিন্তু তার কি যাওয়া উচিত! সে নিজে যেমন যেতে চায় নি তেমনি সৌম্যও তাকে একবারের জন্যও যেতে বলেনি ওখানে!
কিন্তু প্রেম অতি বিষম বস্তু, চিঠির ভাষাও এতটাই সুন্দর যে খুব বেশিক্ষন আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না বিমল। রান্না খুবই সুন্দর, কিন্তু ধৈর্য্য ধরে সেগুলো খেতে পারছিলো না ও, কোনো রকমে খেয়ে উঠেই বাসন ফেরত দেবার অছিলায় গিয়ে সৌম্যর শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হলো। ওকে দেখেই সৌম্য একটু চমকালো, ও একটুও চাইছিলো না সরমার উপস্থিতিতে বিমল এখানে এসে মৃণালিনীর সঙ্গে কথা বলুক।
তুমি আজ এলে না গল্প করতে তাই আমিই চলে এলাম,
বিমলের কথা শুনে আর কিছু বলতে পারলো না সৌম্য, অগত্যা ঘরে আসতে বললো তাকে। সরমা আর মৃণাল ছাদে দাঁড়িয়ে বিমল কে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলো, এবার দুজনেই সৌম্যর ঘরে এসে উপস্থিত হলো। সরমা কে মৃণালের সঙ্গে দেখেই সৌম্যর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো, বাড়ির বউ হয়ে সে বিমলের সঙ্গে কথা বলবে এটা কিছুতেই বড়মা মেনে নেবেন না।
একটু চায়ের ব্যবস্থা করো, বিমল এসেছে,
মৃণাল কে এখান থেকে সরানোর জন্যে বললো সৌম্য, কিন্তু মৃণাল সব গুছিয়েই এসেছে,
ব্রজ দা কে বলে এসেছি চা হয়ে গেলেই দিয়ে যাবে
বলেই সরমা র হাত টেনে নিয়ে বিছানার এক পাশে গুছিয়ে বসলো সে। আর কোনো উপায় না দেখে আপাতত চুপ করে গেলো সৌম্য।
বিমল দা, সরমা কলকাতা দেখতে এসেছে কিন্তু, ওকে বেড়াতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন!
মুচকি হেসে বললো মৃণাল, বিমল একটু অপ্রস্তুত হলো, সৌম্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, ওর এই ব্যাপারে আদৌ কিছু বলা উচিত কিনা বুঝতে পারছিল না।
বিমল যথেষ্ট ব্যস্ত থাকে তার নিজের কাজে, ওকে এসবের মধ্যে এনো না!
এবার বেশ একটু বিরক্ত গলায় বললো সৌম্য, বউ বা বোন কাওকেই অবিবাহিত বিমলের সঙ্গে পাঠাতে একটুও ইচ্ছুক ছিলনা সে। তাছাড়া বড়ো মা বারবার করে সরমা কে দেখে রাখার কথা বলে দিয়েছেন তাকে, সেই আদেশ অমান্য করার ক্ষমতাও তার নেই। সরমা খুব আশাহত হলো, বৌদির দিকে প্রায় অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকালো,
শুধু বিমল দা কেনো! তুমিও যাবে তো আমাদের সঙ্গে?
তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলো মৃণাল, ননদ কে বিমলের সঙ্গে বেড়াতে পাঠানোর এতো বড় সুযোগ প্রায় হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো তার। সৌম্য যে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো না বিমলের, তার কলকাতায় থাকা খাওয়ার অনেকটাই সৌম্যর দৌলতে। সামান্য কারণে সে বন্ধুর বিরাগভাজন হতে চাইলো না,
আমি কদিন সত্যিই ব্যস্ত থাকবো, এ যাত্রায় আপনাদের সঙ্গী হতে পারবো না, আমাকে মাফ করে দিন,
মৃদু হেসে মৃণালের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করলো বিমল, আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো বন্ধুর মুখে স্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। মৃণাল নিজেও বুদ্ধি ধরে, স্বামীর বিরক্ত মুখ তারও নজরে পড়ছিলো, তাই আর এ ব্যাপারে খুব বেশি জোর করলো না বিমল কে। কিন্তু সরমা খুব দুঃখ পেলো, সে খুব আশা করেছিলো তার কলকাতা ভ্রমণের সঙ্গী হবে বিমল। কিন্তু মন্দের ভালো এটুকুই যে বৌদির লেখা চিঠি অন্তত বিমল কে এখান পর্যন্ত টেনে এনেছে। কি এমন লিখেছে বৌদি, সেটা জানার প্রবল কৌতুহল হতে লাগলো তার।
বলো না বউ দিদি কি এমন লিখলে তুমি যে উনি ছুটে চলে এলেন?
বিমল চলে যাবার পরে ঘরে এসে জানতে চাইলো সরমা, মুচকি হাসলো মৃণাল,
সেটা জানতে গেলে যে তোমাকে পড়তে শিখতে হবে সরমা, আমি শিখিয়ে দেবো, তারপর না হয় নিজেই বিমল দার কাছ থেকে চিঠিটা চেয়ে নিয়ে পড়ে নিও একবার!
সরমা সম্মত হলো, সত্যি তাকে পড়তে শিখতেই হবে, তার নিজেরও তো বিমল কে কতো কিছু বলার থাকে, যা সে কিছুতেই মুখে উচ্চারণ করতে পারে না লজ্জায়। সেগুলো চিঠিতে লিখে ফেলা কতো সহজ! মনের কথা জানানোর এমন উপায় সে কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চায় না।
ক্রমশ
(আমার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার জন্যে এতদিন পোস্ট করতে পারিনি 🙏)