#মৃণালিনী
#পর্ব ৭
বিয়ের পরে কেটে গিয়েছে প্রায় মাস তিনেক, একটু একটু করে আলোকোজ্জ্বল কলকাতা শহরের মায়া ভুলে গ্রামের লণ্ঠনের আলোয় ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে মৃণাল। সৌম্য সারা সপ্তাহ থাকেনা, শনিবারে বাড়ি আসে, এই দিনগুলো সরমার সঙ্গেই গল্প করে কাটে ওর।
নিজের তাগিদেই ক্রমশ্ স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণের ধাপ পেরিয়ে বাক্য রচনায় পৌঁছে গিয়েছে সরমা। প্রথম কয়েকটা চিঠি মৃণাল লিখে দেবার পরে, ইদানিং নিজের চিঠি নিজেই লেখে সে, একটু আধটু সাহায্য যে সে নেয়না বৌদির কাছ থেকে তা নয়। যেমন দাদার বৌদির জন্যে নিয়ে আসা লাইব্রেরীর বই এর মধ্যেই বৌদি তার চিঠি পাঠিয়ে দেয় বিমল কে, বিমল বই পাল্টানোর অজুহাতে বার করে নেয় সে চিঠি। সৌম্য কে লাইব্রেরীতে বই পাল্টাতে যেতে হয়না বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে, বন্ধুর বই পাল্টে দেবার উৎসাহ কেনো তার খবর রাখতে সে একটুও আগ্রহী হয় না। তাই দাদার শনিবারে বাড়ি আসার পথ চেয়ে শুধু মৃণালিনী নয়, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সরমাও।
বউ দিদি, বড়মা তোমায় হেঁসেলে ডাকছে,
সরমার কথায় তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে বড়মা র পুজোর ফুল তোলে মৃণাল, ফুলগুলো ঠাকুর ঘরে রেখেই হেঁসেলে ঢুকতে হবে। এ ব্যাপারে বড়মা খুব কড়া, সময়ের একটু এদিক ওদিক উনি পছন্দ করেন না।
বড়মা ডাকছিলেন আমায়?
ফুল রেখে হাত ধুয়ে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় মৃণাল। হাত ধুয়ে আসতে দেখে পারুলবালা খুশি হলেন, মেয়েটি বেশ তাড়াতাড়ি শিখে ফেলছে সব কিছু, আগে তো এঁটো কাটা কিছুই বুঝতো না একদম। ইদানিং তাঁর কাছে থেকে থেকে গোছানো হয়ে উঠেছে অনেকটাই।
বসো বাছা, বড়ি দিতে তো পার না নিশ্চয়ই!
উত্তরের আশা না করেই বললেন পারুল বালা, মৃণাল করুন মুখে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লো। একপাশে বড়ো শিলে ডাল বাটছেন বামুন দিদি, অন্য দিকে সেই ডাল বড়ো একটা গামলায় ঢেলে একমনে ফেটিয়ে যাচ্ছেন তার শাশুড়ি, একটু অবাক চোখেই দেখলো মৃণাল। বড়ি সে খেয়েছে, কিন্তু তার বাড়িতে সেটা কে বানায় জানা হয়নি কখনো। এই এতো ডাল! এতো বড়ি দিতে তো রাত কাবার হয়ে যাবে! মনে মনে প্রমাদ গণে মৃণালিনী।
ছাদে বেছানো হলো পারুল বালার পুরনো পরিষ্কার কাচা শাড়ি, এবাড়িতে সাদা শাড়ি উনিই পড়েন। সাদা কাপড়ে বড়ি দিতে সুবিধা হয়। কড়া রোদ ছাদে, তাই ছায়া দেখে বসেছেন সবাই, নিচ থেকে বামুন দিদি আর হারুর মা বয়ে নিয়ে আসছে গামলা। সরমা আর মৃনালকেও বসতে হুকুম দিয়েছেন বড়মা, সরমারও শিক্ষা হচ্ছে, কিছুদিন পরেই তাকেও তো শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে।
সরমা যথেষ্টই পটু, বড়ি দিতে শুরু করার পর থেকেই বুঝতে পারছিল মৃণাল, এসব শিক্ষা সে ছোটো থেকেই পেয়েছে। মৃণাল এর বড়ি কিছুতেই কাপড়ে বসছে না, আবার হাতের সাথেই উঠে আসছে, যদিও বা বসছে মাথার দিক সরু হচ্ছে না। কথায় কথায় পারুল বালার বকুনি খাচ্ছিলো সে। এতোটা ডাল বাটা যে এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেতে পারে কল্পনাতেও ছিলনা মৃণালিনীর, সে বাদে বাকিদের হাত এতো দ্রুত চলছিলো যে, সে যতক্ষন ধরে গোটা পনেরো বড়ি দিলো, ততোক্ষনে বাকিদের হাতে দু গামলা ডাল বাটা শেষ হয়ে গেলো।
দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে আগেই তাই বড়ি পর্ব শেষ করে সবাই ছাদেই বসে ছিলো। আস্তে আস্তে আশে পাশের বাড়ির বউ ঝি রাও এসে গল্পে যোগ দিলো। গরমের দুপুরে, গাছের ঠান্ডা বাতাসে, ছায়ায় বসে চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো মৃণালের।
ঘুম পাচ্ছে কেনো গো বউ দিদি? আমাদের সৌম্য দাদা তো নেই এখানে, তাহলে রাতে কে জাগিয়ে রাখছে তোমায়!
তন্দ্রা ভেঙে চমকে উঠলো মৃণাল, বুকের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে গেল। গলাটা পাশের বাড়ির বিভার। সরমা র সই সে, পড়াশুনা না জানলেও চটুলতায় সে কারোর থেকে কম যায় না। তার রসিকতায় চারদিকে হাসির রোল পড়ে গেলেও, মৃণালের ভয়ার্ত মুখ কিন্তু নজর এড়ালো না একজনের, তিনি পারুল বালা। যে রসিকতায় সবাই হাসে সে রসিকতায় মৃণালিনী ভয় পায় কেনো!
সরমা আর মৃণাল দুজন দুজনের দিকে তাকালো, চোখ মুছে লজ্জা মাখা হাসি নিয়ে সোজা হয়ে বসলো মৃণালিনী।
আহ! ছুঁড়ি, থাম তো তুই!
কুমুদের ধমকে আপাতত এই প্রসঙ্গ চাপা পড়লেও পারুল বালা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন, এর রহস্য ভেদ না করা পর্যন্ত ওনার শান্তি নেই! হারুর মা র দিকে চোখের ইশারা করলেন তিনি, তাঁর ইশারা টুকুই যথেষ্ট, হারুর মা গোপন খবরের সন্ধানে নেমে পড়লো।
প্রায় সন্ধ্যে রাতেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটে যায় এখানে, পারুল বালা যথেষ্ট সংসারী মানুষ, কেরোসিন তেল এর অপচয় তিনি পছন্দ করেন না। কলকাতার হইচই থেকে এসে এখানের নিঝুম রাতকে খুব ভয় মৃণালের, গত মাস তিনেকেও সে ভয় সে কাটিয়ে উঠতে পারে নি, তাই দাদা না থাকলে বৌদির সঙ্গেই শোয় সরমা।
আজও প্রতিদিনের মতোই খাওয়া শেষ করে হেঁসেল বন্ধ হওয়ার পরে দুজনে ঢুকে এলো ঘরে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে খাটের নিচ থেকে বাপের বাড়ি থেকে সঙ্গে আনা কালো রঙের ট্রাংক টা যতটা সম্ভব শব্দ না করেই টেনে বার করলো মৃণালিনী, সরমা র তুলে ধরা লণ্ঠনের আলোয় চাবি ঘুরিয়ে খুলে ফেললো তালা। এরপরে আস্তে করে ডালাটা তুলে ভেতর থেকে বার করে নিয়ে এলো তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, বই। অষ্টমঙ্গলা তে গিয়ে বেশ কিছু নিয়ে এসেছিলো মৃণালিনী, বাকিগুলো সৌম্য পরে কিনে এনে দিয়েছে।
প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে মৃণালিনী, কিন্তু বাড়ির সবার অজান্তেই। লণ্ঠনের আলো যাতে খুব বেশি বাইরে না যায় তার জন্যে ইতিমধ্যেই চাদর ঢাকা দিয়েছে টেবিলের ওপরে সরমা। টেবিলের তলায় বসে পড়তে শুরু করলো মৃণালিনী, সরমা নিজের হাতের লেখা লিখতে শুরু করলো স্লেট এ। নিজেদের নিয়েই মত্ত দুজন তরুণী আর কিশোরী খেয়ালও করলো না, টেবিলের পেছনের জানলার গরাদের ফাঁকে চোখ ঠেকিয়ে গরাদ বেয়ে আসা লণ্ঠনের ওই মৃদু আলো টুকু লক্ষ্য রাখছে একজন, হারুর মা!
পরেরদিন সকালে সূর্য পূব আকাশে উঁকি দেওয়ার আগেই বিছানা ছাড়লো মৃণাল, বড়মার পুজোর ফুল তাকে তুলে দিতে হয়। সেই ফুল তো শুধু তুলে দিলেই হয়না, ঠাকুর ঘর মুছে, সেই ফুল দিয়ে মালা গেঁথে ঠাকুরের গলায় পরিয়ে, বাকি ফুল ঠাকুরের পায়ে সাজিয়ে দিয়ে, তবেই তার ছুটি। একাজে একটুও দেরি হওয়ার যো নেই, তাহলেই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবেন পারুল বালা।
চোখ জুড়িয়ে আসছে ঘুমে, প্রতিদিনই রাত হচ্ছে ঘুমোতে, কিন্তু এই রাতটুকু বাদে পারুল বালার চোখ কে ফাঁকি দেবার আর সুযোগ কোথায়! চোখ মুছে, মুখ হাত ধুয়ে, বাসি কাপড় ছেড়ে যখন সে বাগান থেকে ফুল তুলে এলো , তখন সূর্য উঠে গেছে। সবে মাত্র সব কাজ সেরে, ঠাকুর ঘরের দরজার শিকল লাগিয়ে ফিরে এসে নিজের ঘরের বিছানা তুলে, হেঁসেলে যাবার জন্যে তৈরী হচ্ছিলো, বড়ো মা র চিৎকারে ছুটে আবার নিচে নেমে এলো!
একই কতা আর কতো দিন বলতে হয় গো মা! বেস্পতিবারে যে আম ডাল লাগে, সে কতা কি আবার ভুলেচো? ভোর থেকে তাহলে নিজের কাজ ছেড়ে তোমার পেছনেই ঘুরে মরি আর কি! বড্ড ঢ্যাটা মেয়ে বাপু তুমি! কোনো কথাই কানে তোলো নে!
মনে মনেই লজ্জিত হলো মৃণালিনী, ইস! কেনো যে ওর বারবার ভুল হয়ে যায়! এতো করে মনে রাখার চেষ্টা করে, তাও কিছু না কিছু ভুল ও করেই ফেলছে সব সময়!
আমি এক্ষুনি তুলে এনে দিচ্ছি বড়ো মা, আমার ভুল হয়ে গেছে,
বলতে বলতেই বাগানের দিকে যাচ্ছিলো সে, পারুল বালা তাকে থামিয়ে দিলেন,
থাক বাছা, অনেক করেচো, আর তোমায় আমার উপকার করতে হবে নে!! আমারই ঘাট হয়েচে, তোমার মতো অকম্মার ঢেঁকি কে আমার ফুল তুলে দিতে কয়েচি!
মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে রইলো মৃণাল, এই মাস তিনেক ধরে জ্যেঠ শাশুড়ির কথা সে শুনে শুনে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাও কোনো কোনো সময় খুব খারাপ লাগে তার। বউ এর মুখ দেখে এগিয়ে এলেন কুমুদ,
আর একটু সময় দাও দিদি, ঠিক শিখে ফেলবে! বাচ্চা মেয়ে, আগে তো এসব করেনি,
ছোট জা কে এক ধমকে থামিয়ে দিলেন পারুল বালা,
তুই থাম দিকিনি ছোট! বাচ্চা মেয়ে! আমাদের সময় বে হলে তিন ছেলের মা হতো এতদিনে! বয়সের কোনো গাছ পাথর নেই গা! তুই আর তোর ছেলে, বউ কে মাথায় তুলে নাচ গা! আমার ওসব আদিখ্যেতা নেই!
আর কোনো কথা বলার সাহস পেলেন না কুমুদ, বউ এর পাশে তিনিও চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলেন। বামুন দিদির মন্দ কপাল, তখনই চা করে বাড়ির কর্তা শ্যাম সুন্দরের জন্যে নিয়ে, ওখান দিয়েই যাচ্ছিলেন তিনি, তাকে দেখেই পারুল বালা আরও বেশি রেগে গেলেন,
হ্যাঁগো, বলি বামুন মেয়ে, তোমায় কবে কয়েচি, তোমার ভাইঝি কে এনে দেওয়ার কতা? তা সেতো তুমি আর সময় করে তার বাড়ি গিয়ে উঠতে পারলে নে বাপু! একটা হাতের কাছে অন্য কেউ থাকলে, আজ মুখে ঝামা ঘষে দিতুম এই বউয়ের, তা আমার যা পোড়া কপাল! সে সুখ আর আমার হলো কই!
কর্তা মার প্রবল দাপটে অভ্যস্ত বামুন দিদি, টু শব্দটিও করার সাহস দেখালেন না, ওখানেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এই প্রবল বাক্যবাণের মধ্যেই হাতে আম্রপল্লব নিয়ে বারান্দায় উঠে এলো সরমা, তার হাতে আমের ডাল দেখে এতক্ষনে শান্ত হলেন পারুল বালা, আপাতত কিছুক্ষনের জন্যেও যে বাড়িতে শান্তি ফিরলো, তার জন্যে মনে মনেই সবাই ধন্যবাদ জানালো সরমা কে।
ক্রমশ