#মৃণালিনী
#পর্ব ৮
আজ থেকে ওদের লণ্ঠনে তেল কম দিবি,
পানের বাটা টা বন্ধ করে পাশে রেখে, পান টা মুখে পুরে, ঠান্ডা গলায় নিচু স্বরে হারুর মা র দিকে তাকিয়ে বললেন পারুল বালা। লণ্ঠনের কাঁচ মুছতে মুছতে মাথা নিচু করেই ঘাড় নাড়লো হারুর মা, যার খবরের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত। গত কাল রাতে নজরদারি চালিয়েও অনেক রাত পর্যন্ত লন্ঠন জ্বলে, এই টুকু ছাড়া আর নতুন কোনো খবর তাঁকে দিতে পারে নি হারুর মা।
কিন্তু শুধু এই খবর টুকুই যে মৃণালিনীর মতো শিক্ষিত মেয়ে কে জব্দ করার জন্যে যথেষ্ট নয়, সেটা পারুল বালা জানেন, তাই আপাতত সম্পূর্ণ খবর না পাওয়া পর্যন্ত ঘুঁটি সাজাচ্ছেন তিনি। লন্ঠন না জ্বললে মৃণালিনী কি করে এটা দেখাই এখন তাঁর উদ্যেশ্য। সরমা কে নিয়েও বেশ ধন্দে আছেন তিনি, তার ওপরেও ঠিক ভরসা রাখতে পারছেন না আর, অষ্টমঙ্গলা তে সঙ্গে করে কলকাতা পাঠিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু ফেরত এসে সেরকম কোনো বিশেষ খবর সরমা তাঁকে দেয় নি। তাই বাপের বাড়িতে একা পেয়ে কলকাতার চালাক চতুর শিক্ষিত বউ, সৌম্য কে ঠিক কতখানি হাত করতে পেরেছে সে খবর তাঁর কাছে আসেনি। উল্টে সরমা র বৌদি প্রীতি তাঁকে চিন্তায় রেখেছে যথেষ্ট।
কুমুদ খুব সংসারী নন, বলা ভালো তিনিই হতে দেননি তাকে, কিন্তু মৃণালিনী যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠছে খুব তাড়াতাড়ি, শিক্ষিত বলে টুকটাক প্রয়োজনে শ্বশুর মশাই ও ডেকে পাঠান ইদানিং, তাই নিজের আঁকড়ে ধরা সংসার কে অন্যের হাতে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর পারুল বালা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন মৃণালিনীর ওপরে। কিন্তু মৃণালিনী অবাধ্য বা মুখরা নয়, তাঁর কথায় খুব বেশি প্রতিবাদ করে না, তাই উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে শাসন করতেও পারছেন না তিনি।
ঠাকুর ঘরে মাটিতে আসন পেতে বসে লক্ষী র ঘটে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিন্হ আঁকছেন কুমুদ, পাশে বসে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করছে মৃণাল। এখন তার শিক্ষানবিশি চলছে, পারুল বালা তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন শাশুড়ির কাছ থেকে লক্ষী পুজো করা শিখে নেওয়ার। এমনিতেও বৃহস্পতিবার দিন টা এলেই মন টা ক্রমশ ভালো হতে থাকে মৃণালের, আর একদিন পরেই বাড়ি আসবে সৌম্য, তাই লক্ষী বার আক্ষরিক অর্থেই তার জীবনে শুভ দিন হয়েই আসে প্রতিবার।
আর কত কাল পাশে বসে থেকে দিন কাটাবে, এবার একটু নিজে হাতে করো বাছা,
দূর থেকে বড়মা র গলা শুনেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো মৃণাল, কুমুদও তাড়াতাড়ি হাত চালাতে শুরু করলেন। বড়ো জা র মুখ কে বড়ো ভয় পান শান্ত শিষ্ট কুমুদ! চট করে হাতে ধরা ঘট টা এগিয়ে দিলেন বউ এর দিকে, মৃণাল যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, স্বস্তিক আঁকা ঘটে জল দিয়ে আমপাতা বসানো তার কাছে আর খুব বেশি দূরহ ব্যাপার নয়।
পাঁচালি পড়তে শুরু করছিলেন কুমুদ, এতক্ষনে বড়ো মা ও এসে বসেছেন। ওনার সুর করে পড়া পাঁচালি শুনে মুগ্ধ হয় মৃণাল। একজন অশিক্ষিতা মহিলা কি সুন্দর মুখস্থ বলেন!
আজ তুমি পড় বাছা,
কুমুদের হাত থেকে পাঁচালি নিয়ে মৃণালের হাতে দিয়ে দিলেন পারুল বালা, অনেক কিছুতে ভয় পেলেও মুখস্ত করার ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার। যেকোনো পড়ার জিনিস সে পড়ার বই ই হোক বা গল্পের, পড়তে কোনো ক্লান্তি নেই মৃণালের, পাঁচালি সে এখানে এসে কিছুদিনের মধ্যেই মুখস্ত করে ফেলেছিলো। তার ঝরঝরে মুখস্ত সুর করে পড়া পাঁচালি কিছুটা হলেও পারুল বালার মন কে নরম করে ফেললো, আজ কাল কিছুতেই খুব বেশি খুঁত খুঁজে পান না তিনি মেয়েটার!
রাতের খাওয়া মিটলে অন্যান্য দিনের মতোই ঘরে ঢুকলো ননদ বৌদি, টেবিলের তলায় সবে মাত্র বই , স্লেট গুছিয়ে বসেছিলো দুজনে, হটাৎ করেই বার দুয়েক দপ দপ করে উঠে নিভে গেলো লন্ঠন খানা। প্রথম প্রথম বিয়ের পরে অন্ধকার কে খুব ভয় পেতো মৃণাল, কিন্তু এখন আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেছে অনেকটাই।
কি হলো বলো তো বউ দিদি! হারুর মা আজ কম তেল ঢেলে ফেলেছে গো! দাঁড়াও কালই ব্যবস্থা করছি ওর!
ননদের কথা ঠিক মতো কানে পৌঁছালো না মৃণালের, সে তখন অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছে। যে হারুর মা এতো বছর হিসাব করে তেল ঢালছে সে আজ ভুল করলো! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার!
হারুর মা কে কিছু বোলো না সরমা, ও বেচারি বড়ো মা র কাছে বকুনি খাবে, একদিন ভুল তো হতেই পারে তাই না!
ননদ কে থামিয়ে দিয়ে বললো মৃণাল, সরমা কে কিছু বলতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই, তাহলে রাতে লন্ঠন জ্বলছিলো কেনো, তার কৈফিয়ত ও দিতে হবে ওদের। এই মুহূর্তে লক্ষ্য রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই!
জমিদারী আর নেই, কিন্তু জমি জমা যথেষ্টই আছে শ্যাম সুন্দরের, তাই আশ্রিত, আশ্রিতাও আছে দু একজন। নিজে ওকালতি করলেও জমি জমার দেখাশোনা এতকাল নিজে হাতেই করতেন তিনি, বেশ কয়েক বছর হলো ওকালতির পশার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারুল বালার একটি দূর সম্পর্কের ভাইপো আলোককে এনে রেখেছেন।
একদম আত্মীয় কোনো ছেলেকে জমি জমার দায়িত্ব দেবার খুব বেশি ইচ্ছা তাঁর ছিলো না, কিন্তু নিজের ছেলেটি এ বিষয়ে একটুও উৎসাহী নয়। তাঁরও বয়স হচ্ছে, সর্বোপরি পারুল বালা এসে ধরে ছিলেন তাঁকে, বৌদি কে খুব বেশি চটাতে চান না তিনি পাছে জমি জমা আলাদা করতে চান। তাই সব দিক ভেবে একে রেখে দেওয়া মনস্থ করেছিলেন, ছেলেটি যথেষ্ট করিৎকর্মা, এই কয়েক বছরেই সব কিছুই দ্রুত আয়ত্ব করে ফেলেছে।
অনেকদিন ধরেই জমি জমার হিসেব সংক্রান্ত কাগজ পত্র নিজে দেখার একদমই সময় পান না শ্যাম সুন্দর, আজ কোর্টে কোনো মামলা ছিলো না, তাই পুরনো কিছু হিসাব নিকাশ নিয়ে বসেছিলেন। এমন সময় বউমা চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকলো, টেবিলের ওপর রাখা চায়ের কাপ টা অন্য মনস্ক ভাবে তুলে চুমুক দিতে গিয়ে একটু চমকে গেলেন তিনি, এই হিসাবটা যেনো একটু গরমিল ঠেকছে!
চায়ের কাপ রেখে ঘর ছেড়ে সবে বেরিয়েছিল মৃণালিনী, শ্বশুরমশাই পেছন থেকে ডাকলেন,
বউমা, একটু এখানে এসো তো,
কিছু বলবেন বাবা?
ঘরে ঢুকে এসে শ্বশুর মশাইয়ের সামনে দাঁড়ালো মৃণাল, ঘাড় নাড়লেন তিনি,
হ্যাঁ, দেখোতো এটা! বয়স হচ্ছে তো, কেমন যেনো মাঝে মাঝেই গুলিয়ে ফেলছি আজকাল, যোগ বিয়োগে ভুল হচ্ছে খুব! হিসেব গুলো মিলছে না কিছুতেই!
শ্বশুরের বাড়িয়ে দেওয়া কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো মৃণাল, বেশ বড় একটা লেনদেনের হিসেব। মেলাতে গিয়ে নিজেরও গরমিল ঠেকতে লাগলো তার,
বাবা, আপনার বয়সের ভুল নয়, এটাতে কিছু ভুল সত্যিই আছে,
মৃদু গলায় বলা বৌমার কথা একটু হলেও আশ্বস্ত করলো শ্বশুর মশাই কে, যাক! তাহলে তিনি ঠিকই দেখেছেন। আলোকের ওপর একটু নজর রাখার প্রয়োজন আছে এবার।
বউমা, তোমার সময় মতো মাঝে মাঝে একটু এসো তো এঘরে,
এটুকু বলেই আবার নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন তিনি, সব কিছু এক্ষুনি তিনি খোলসা করতে চান না, শুধু মাঝে মাঝে বউমা কে দিয়ে মিলিয়ে নিতে হবে আলোকের করা হিসাবগুলো।
শ্বশুরের ঘর থেকে নেমে নিচে আসতেই বড়ো মার মুখোমুখি হলো মৃণালিনী, সামান্য চা দিতে গিয়ে তার এতো দেরি কেনো সেটা জানতেই নিচে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, বউ কে বেশিক্ষন চোখের আড়াল হতে দিতে চান না তিনি।
বাবা একটা হিসাব দেখতে দিয়েছিলেন, তাই দেরি হয়ে গেল,
বড়ো মার কথার উত্তরে মৃদু গলায় বললো মৃণালিনী, পারুল বালা কুপিত হলেন,
কতো বার কয়েচি তোমায়, এসব ব্যাপারে বেশি মাতা গলিও নে, তা তুমি তো শুনবে নে বাছা!
আমি নিজে যাইনি বড়ো মা, বাবাই দেখে দিতে বললেন,
একটু কুণ্ঠিত গলায় বললো মৃণাল,
হ্যাঁ, সেই! তুমি তো ধোওয়া তুলসীপাতা মা গো! যত দোষ সবই তোমার শ্বশুরের, তাই তো! তাহলে এবার তাঁরই বিচের করি আর কি!
পারুল বালার কথা ঘোরানোর ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেলো মৃণালিনী, সে এসব জটিলতায় একটুও অভ্যস্ত নয়। সমস্ত দোষ টাই তার ঘাড়ে ঠেলে দিলেন পারুল বালা, সে অবাক হয়ে বড়ো মার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ক্রমশ