#মৃণালিনী
#পর্ব ৯
সকালে জল খাবারের পর্ব শেষ করেই সেই যে ভাইঝি কে আনতে বাড়ি গিয়েছেন বামুন দিদি, সেই থেকেই ঘর বার করছেন বড়ো মা, লক্ষ্য করছিলো মৃণালিনী। অনেকদিন ধরেই বউ কে জব্দ করার জন্যে একজন অল্পবয়সী মেয়ে চাইছিলেন তিনি, এই বয়সে আর নিজে বেশি কিছু করে উঠতে পারেন না।
শান্তি করে যে সন্ধ্যার সময় মালা টুকু জপবেন, সেটুকুও আজ ধৈর্য্য নেই তাঁর। একমনে বামুন দিদির আসার পথের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন।
এই নাও গো কর্তা মা, তোমার জন্যে নিয়ে এলুম করুণা কে, এবার নিজের মনের মতো করে গড়ে পিঠে নাও তো!
বলতে বলতে বামুন দিদি একটি প্রায় বছর সতেরোর মেয়ে কে নিয়ে ঢুকলেন,
এনেচো! এসো বাছা, এদিকে এসো, তোমার কতাই তো সেই সকাল থেকে ভাবচি গো! তা কাজ কম্ম তো পারো নিশ্চয়ই!
পারুল বালার কথায় মাথা হেলালো করুণা, সে তার পিসির কাছ থেকে সব জেনে শুনেই এসেছে। কাজ কর্মে খুব বেশি পারদর্শী না হয়ে উঠলেও হাতে হাতে টুক টাক এগিয়ে দিয়ে বামুন দিদি কে সাহায্য করতে যে ও পারবে, সেটুকু পারুল বালা বুঝতে পারলেন। সেটুকুই তাঁর জন্যে যথেষ্ট, কারণ বামুন মেয়ের কাজে সাহায্য করার জন্যে তো উনি ওকে এখানে আনেন নি।
তা জানবে নে কেনো বাছা, গরীব ঘরের মেয়ে, গতরে খেটেই তো বড়ো হয়েচো, নেকা পড়া করে বিলাস করার আর সময় কোতা বলো!
খুশির গলায় বললেন পারুল বালা, মৃণালিনী সিঁড়ির দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, শেষের কথাগুলো যে তারই উদ্যেশ্যে বলা সেটা ওখানে উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলো।
এতো বড়ো মেয়ে! এর তো বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে গো বামুন মেয়ে! আর কদিনই বা থাকবে এখানে!
একটু বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন কুমুদ, প্রথম থেকেই অবিবাহিতা মেয়ে কে বাড়িতে রাখায় তাঁর আপত্তি ছিলো। বড় জা বিরক্ত হলেন তাঁর ওপর, সেটা তাঁর মুখ দেখে বুঝতে পারা মাত্রই থেমে গেলেন কুমুদ,
বিয়ে না হয় তোমরাই দেবে গো, আমার দাদার আর সে খ্যমতা কোথায়!
বামুন দিদি নিজেও বুদ্ধি ধরে, একবার ভাইঝি কে এখানে এনে ফেলতে পারলে যে বাকি ব্যবস্থাও এখান থেকেই হবে সেটা সে জানে! মেয়েটি যে যথেষ্ট চালাক চতুর, সেটা সে মুখে না প্রকাশ করলেও মৃণালিনী বুঝতে পারলো, এবাড়ির গিন্নি যে পারুল বালা, এখবর তাকে নিশ্চয়ই তার পিসি দিয়েছে। পারুল বালা কে হাত করতে পারলে এ বাড়িতে টিকে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হবে না।
বেচারা কুমুদ, নিজের শাশুড়ি কে দেখে কষ্ট হচ্ছিলো মৃণালের, ভীষণ ভালো মানুষ এই মহিলাটি জীবনের পুরোটাই বড়ো জা র দাপটের নিচে ম্রিয়মাণ থেকেছেন। ক্রমশ এই বাড়ির সবার সাথে থাকতে থাকতে এসব বিষয় নজরে আসছে মৃণালের, পারতপক্ষে এইসব বিষয়ে সে ঢুকতে চায় না। কিন্তু আজ তার খুব খারাপ লেগেছিলো, সকাল থেকে শাশুড়ি কে প্রায় সব রান্নাই নিজের হাতে করতে হয়েছে, সরমা যাও বা রান্না কিছুটা পারে, সেতো সেভাবে কেটে কুটে দেওয়া ছাড়া কোনো সাহায্যই করে উঠতে পারেনি। তাই তাকে লক্ষ্য করে বলা কথাগুলো কে একটুও পাত্তা না দিয়ে সে বামুন দিদির দিকে ঘুরে তাকালো,
আজ সকাল থেকে মায়ের ওপরে খুব চাপ পড়ে গেছে বামুন দিদি, তুমি তো শুধু জল খাবার করেই চলে গিয়েছ! দুপুরের রান্না কিছুটা এগিয়ে দিয়ে যেতে পারতে তো! বাড়ি তো কাছেই!
বামুন দিদি হতভম্ব মুখে কর্তা মার দিকে তাকালেন, কর্তা মা নিজেই তাকে পাঠিয়েছিলেন তাই ফিরে এসে কোনো রকম অভিযোগের মুখোমুখি তাকে হতে হতে পারে, সেটা তার কল্পনাতেও আসেনি। পারুল বালাও বউয়ের ধৃষ্টতায় এতটাই অবাক হলেন যে কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁর মুখ থেকে কোনো কথাই বেরোলো না।
কুমুদ তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন, এই কথার উত্তরে বড়ো জা যে ঠিক কি কি করতে পারেন তা তিনি সবটাই জানেন,
আহা! আবার ওসব কথা কেনো! যাও মা তুমি নিজের ঘরে যাও,
প্রায় ঠেলেই দোতলার সিঁড়ির দিকে মৃণাল কে পাঠাচ্ছিলেন তিনি, পারুল বালা থামিয়ে দিলেন,
তা তুমি কি করছিলে বাছা? শাউড়ির হাতে হাতে করে দাও নি কেনো?
করেচে তো দিদি, ওরাই তো করলো আমার হাতে হাতে,
মৃণাল কিছু বলার আগেই কুমুদ পাশ থেকে বলে উঠলেন, পারুল বালা আরও রেগে গেলেন,
শাওড়ি, বউয়ে জোট বেঁধেচিস বুঝি! তা ভালো, তবে এখানে আর আমার কাজ কি! এবার থেকে সবাই ওদের অনুমতিই নিও গো!
কথাগুলো বলেই অপমানিত মুখে জায়গা ছাড়লেন পারুল বালা, ব্যাপারটা যে এখানেই মিটে যাবে না সেটা মৃণালিনী না বুঝলেও কুমুদ ভালোই বুঝতে পারছিলেন। কিছুক্ষন পরেই স্বামীর ঘর থেকে বড়ো জায়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো, তড়িঘড়ি ওপরে ছুটলেন কুমুদ, সরমা আর মৃণালিনী ও পেছন পেছন উঠে এলো।
একবেলা রান্না করতে তোমার শরীর ক্ষয়ে যায় বুঝি?
এমনিতেও ওকালতি, সম্পত্তি সব দেখতে গিয়ে যথেষ্টই ব্যস্ত থাকেন শ্যাম সুন্দর, তার ওপরে সন্ধ্যে বেলায় বৌদির এই কান্নাকাটি তাঁর বিরক্ত লাগছিলো। বিরক্তির গলায় শ্বশুর মশাইয়ের বলা কথাগুলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে কানে এলো মৃণালের। আজ তার নির্বুদ্ধিতার জন্যেই যে শাশুড়ি কে কথা শুনতে হচ্ছে সেটা বুঝেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো ওর। ইচ্ছাকৃত ভাবে বড়মা, বামুন দিদি কে কাজ না করতে দিয়েই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা বুঝেই সেটার প্রতিবাদ করতে যাওয়া যে এতো বড়ো ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে সেটা সে একটুও ভাবে নি।
বাবা! মা কিছু বলেন নি, আমিই বামুন দিদি কে বলেছি,
আর থাকতে না পেরে মৃণালিনী, শ্বশুর মশাইয়ের ঘরে ঢুকে এলো।
আসলে এতগুলো মানুষের রান্না তো! বামুন দিদিই তো একা পারেন না বলে সবাই তাঁকে হাতে হাতে জোগাড় করে দেয়। মায়েরও তো বয়স হয়েছে, তাই বলেছিলাম, উনি কিছুটা এগিয়ে দিয়ে গেলে একটু সুবিধা হতো,
বউমা র যুক্তিপূর্ণ কথায় একটু থমকে গেলেন শ্যাম সুন্দর, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন তিনি, কুমুদ এরও যে বয়স হচ্ছে এটা বোধহয় এতক্ষনে খেয়াল হলো তাঁর,
আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমিও হয়ত ঠিকই বলেছো, তবে বড়োমা তো তোমাদের আরও সুবিধার জন্যেই লোক আনতে পাঠিয়েছিলেন। আর বৌদি এবার থেকে কাউকে কোথাও পাঠালে না হয় অন্যদের সুবিধা দেখেই পাঠিও একটু,
তড়িঘড়ি সব দিকই বজায় রাখার চেষ্টা করলেন তিনি, দেওরের এই দুদিকে তাল দেওয়া একটুও পছন্দ হলো না পারুল বালার। তিনি যতটা আশা করে বিচার চাইতে এসেছিলেন সেটা পূরণ না হওয়ায়, পরের দিন সৌম্য আসার জন্যে বাকিটা তুলে রেখে, আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেন।
সে রাতে আর খেতে উঠলেন না পারুল বালা, কিছুতেই তাঁকে আনতে না পেরে কুমুদ তাঁর খাবার নিয়ে ঘরে গেলেন। সেখানে তিনি কিভাবে বড়ো জা র রাগ ভাঙলেন সেটা কেউ বুঝতে না পারলেও খালি থালা হাতে তাঁকে ঘর থেকে বেরোতে দেখে সবাই শান্তি পেল।
পরের দিন সকাল থেকেই করুণার শিক্ষা নবিশি শুরু হলো, মৃণালের প্রায় সব কাজই তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে করুণা কে দিয়ে দিলেন পারুল বালা, শুধু ফুল তোলার কাজটা বন্ধ করলেন না। তিনি উদ্যেশ্য ছাড়া কোনো কাজ করেন না, ফুল তোলা না থাকলে যে বউয়ের ভোর বেলায় ওঠার আর কোনো প্রয়োজন পড়বে না সেটা তিনি ভালোই জানেন, তাই বউ কে ভোরে উঠে ফুল তুলতে না দিয়ে তার সুবিধা তিনি কিছুতেই করবেন না।
ফলে সকাল থেকেই মৃণালিনী কোনো কাজ ছাড়াই বসে থাকলো, যে কাজই সে করতে যায়, করুণা তার হাত থেকে নিয়ে চলে যায়। বড়ো মা তার ওপরে নজর রাখছেন সে বুঝতে পারলো, তাকে কিছু করতে না দিয়ে বসিয়ে রেখে পারুল বালা এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি করলেন যেখানে মৃণালিনীর নিজেকে অপাংক্তেয়, বাইরের অতিথির মতো মনে হতে লাগলো।
এ বাড়িতে সে যে বাইরের লোক, যার কাজ শুধু মাত্রই বসে বসে খাওয়া, পড়াশুনা বাদে আর কোনো কিছু না জানায় যে, তার ওপরে ভরসা করা সম্ভব নয় একটুও, সেটা পারুল বালা তাঁর আচরণে, হুল ফোটানো কথায়, এবং করুণার অত্যধিক প্রশংসার মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। কিছুক্ষন এই ভাবে বসে থাকার পরে আস্তে আস্তে দোতলায় নিজের ঘরে উঠে এলো মৃণালিনী। বাবার আদুরে কন্যা মৃণাল এতো টা অপমানিত আগে কোনোদিনও হয় নি, দু চোখ জলে ভরে আসছিলো তার। আর এক মুহূর্তের জন্যেও এই বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না, কলকাতা ফিরে যাবার জন্যে তার মন আনচান করতে লাগলো।
ক্রমশ
(কেমন লাগছে আপনাদের মৃণালিনী কে?)