মেঘদিঘির পাড়ে – ১৩
মালিহা খান
২৭.
অরুণের ছটা নিভন্ত। জগতে অন্ধকারারম্ভ। পশ্চিমের কোল ঘেঁষে ডুবন্ত সুর্যের পিছু ফেলে যাওয়া লালচে মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সায়ন। কিছুসময় সেদিকেই চেয়ে রইলো নিমেষহীন, অনড়চোখে। অত:পর তার ঠি ক মুখোমুখি বসে থাকা ব্যক্তির দিকে খানিক ঝুঁকে চোখা গলায় বললো,
-” আপনি তাহলে বিয়ে দিবেন না?”
সরফরাজ টেবিলের রাখা চায়ের কাপটা তুলে নিলো। ছোট্ট চুমুক দিয়ে নামিয়েও রাখলো। এরপর মৃদু কেঁশে সায়নের অগ্নিশোধিত চোখদুটোয় চেয়ে অত্যন্ত নির্বিকার কন্ঠে উওর দিলো,
-“না।”
সায়ন নিশ্চুপ। সরফরাজ অপরিবর্তিত কন্ঠে বলে,”আর কিছু বলবে? আমার যেতে হবে।”
সায়ন নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে। এই লোকের হেলাফেলা তার সহ্য হচ্ছেনা। ইভা যে কেনো একে এতো ভক্তি করে। বা’হাতে টেবিলের উপর বাড়ি দিয়ে তীব্র ক্রোধানলে সে বলে,
-“আমি কিন্তু আপনার বোনকে তুলে নিয়ে যেতে পারি। আমি করছিনা কারণ আপনাকে, আপনাদের পরিবারকে এবং আপনার বোনকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। ওকে তুলে নিলে সেটা নিশ্চয়ই খুব সম্মানজনক কিছু হবেনা?”
-“আমার বোনকে কেও তুলে নিতে পারেনা।”
-“আমি পারি। একশবার পারি।”
সরফরাজ মৃদু হাসে। বিন্দু বিন্দু জলীয়বাষ্পে বাহির ভিজে ওঠা ঠান্ডা পানির গ্লাসটা পাশ থেকে টেনে সায়নের সামনে দিয়ে বলে,
-“মাথা ঠান্ডা করো। পানি খাও। অহেতুক উত্তেজিত হয়ে পড়ছো।”
সায়ন গ্লাস ছোঁয়না। চোখ নামিয়ে নিচু গলায় বলে,”আপনি উওর দিন।”
-“ওকে তুলে কি করবে তুমি? জোর করে বিয়ে করবে? তুমি বোধহয় জানোনা মেয়ের অভিভাবকের অমতে বিয়ে করলে সেই বিয়ে বাতিল। বাবা- মা, নাহলে বড়ভাইয়ের বা পরিবারের বড় কারোর অনুমতি লাগবে।”
-“ওর বাবা- মা অনুমতি দিবে।”
-“আব্বা আম্মা আমার মত ছাড়া একপাও আগাবে না।”
সায়ন সিটের পিছে পিঠ এলিয়ে দেয়। কালো রঙ ধরা মেঘের পানে চেয়ে বলে,
-“তবে আর কি? তুলেই নিবো। তুলে নিয়ে বিয়ে করে এলে আপনারা এমনেই বাধ্য হবেন আবার বিয়ে দিতে।”
সরফরাজ স্হিরচিত্তে বলে,”তোমার সাহস আছে। ভাইয়ের সামনে বসে বোনকে তুলে নেয়ার হুমকি দিচ্ছো।”
-“আমি হুমকি দিচ্ছিনা, আপনাকে জানাচ্ছি কেবল।”
সরফরাজ চুপ করে রইলো। তারপর ধীরগলায় বললো,
-“আমি জানি তুমি ওর সাথে এমন কিছুই করবেনা সায়ন। ইভার সম্মানহানি হবে এমন কিছুই তুমি করবেনা। আমি লিখে দিতে পারি।”
-“জানেনই যখন তখন রাজি হচ্ছেন না কেন?”
সরফরাজ উঠে পড়লো। পান্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা বের করে দেখে আবার পকেটে ঢোকালো।
সায়ন দাড়িয়ে গম্ভীর গলায় ডাকলো,
-“আপনি তবে দেখতে চান আমি কি পারি না পারি?”
সরফরাজ নিরবে হাসলো। হাত বাড়িয়ে সায়নের কাঁধে কয়েকবার চাপড় মেরে বললো,
-“টগবগে যুবক। অল্পতেই রক্ত গরম হয়ে যায়। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে হবে। ফুপিকে নিয়ে বাড়িতে এসো। বাকি আমি দেখছি। এখন আমার সত্যি যেতে হবে। কাজ আছে।”
২৮.
আধখাওয়া ঝলসানো চাঁদের নরম আলোটা ভালোভাবেই রাজত্ব করছে বিভার কৃষ্ণমুখে। চাঁদের পিঠে অসংখ্য দাগ। সূর্যের দিকে চেয়ে থাকা যায়না, চাঁদের দিকে যায়। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা যায়। সে চাঁদের মতোন সুন্দর হলে ইউসুফও বোধহয় তার দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইতো। ঘরের পর্দা উড়ছে। বাইরে ক্ষুরধার বাতাস। গা শিরশির করে উঠে। বিভা গায়ের কাঁথাটা আরো একটু টেনেটুনে নিলো। মনে মনে বললো,
-“আপনি একটু ভালোবাসলেই হয়তো আমার ছোট্ট জীবনে আর কোনো দীর্ঘশ্বাস থাকতোনা।”
কথাটা বলেই একটা এলোমেলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। প্রায় সপ্তাহ কেটেছে ইউসুফের ঘরে যাওয়া তো দূর, মুখদর্শনও করেনি। ভালোবাসে বলে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করবে? সবসময়?
ঘরের আঁধার ছাঁপিয়ে লম্বাটে একটা কৃত্রিম আলো পড়ে। দরজার ফাঁক প্রসারিত হতে হতেও আলোও বাড়ে। ইভা উঁকি দিয়ে বলে,
-“এই আপা? ঘুমাচ্ছো নাকি?”
বিভা ঘাড় ফিরায়। ম্যাজম্যাজে ধরে আসা গলা ঝেড়ে বলে,
-“না আয়। ঘুমাচ্ছিনা।”
ইভা ঢুকেনা। উঁকি দেয়া মাথাটা একটু সামনে এগিয়ে নেয়,
-“খেতে আসো। সাড়ে দশটা বাজে।”
বিভা ভ্রু কুচকে বলে,”উনি টেবিলে নেই? খেতে আসেননি?” তার কন্ঠে সেই দুশ্চিন্তা। না চাইলেও ঠেসেঠুসে এসে পড়ে। কি যন্ত্রনা!
ইভা মিনমিন করে উওর দেয়,
-“এসেছে তো।”
উওরটা কানে যেতেই আগের মতো ফিরে শুয়ে পড়ে বিভা। ইভা হনহন করে ঘরে ঢুকে যায়। বিভার হাত ধরে মৃদু ধমকে বলে,
-“আপা তুমি সাতদিন ধরে আমাদের সাথে খাচ্ছোনা। চলো।”
বিভার উওর পাওয়া যায়না। সে নিরবে হাত ছাড়িয়ে নেয়। ইভা কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে উপায়ন্তর না পেয়ে অসন্তুষ্ট স্বরে বলে,
-“আচ্ছা আমি নিয়ে আসছি একটুপর। ঘুমিয়ে পড়ো না।”
ইভা চোখমুখ কালো করে ফিরে যায়। আরাম করে খেতে থাকা ইউসুফের উপর তার ভীষণ রাগ হয়।
ইচ্ছে করে তার মুখের থেকে খাবারটা নিয়ে নেয়। তাকেও না খাইয়ে রাখে। পারেনা। বয়সে বড় তো।
তাকে ওমন করে চেয়ে থাকতে দেখে ইউসুফ বাঁকা গলায় বলে,
-“কি হয়েছে? তাকিয়ে আছিস কেনো?”
ইভা চোখ নামিয়ে গমগম করে উওর দেয়,
-“কিছু হয়নি।”
~চলবে~