মেঘদিঘির পাড়ে – ১৫
মালিহা খান
খোলা জানালার পাল্লায় ভারি বাতাস আঘাত করলো। বিকট আওয়াজটা নির্জন নিশীথে বজ্রপাতের মতোন শোনালো।
বিভার গাঢ় তন্দ্রা বিঘ্নিত হয়। বিকেলের নরম হাওয়ার সান্নিধ্যে এলে তিরতির করে কেঁপে ওঠা কিশলয়ের মতোন মৃদু নড়েচড়ে ওঠে সে। ইউসুফ চকিতে মাথা থেকে হাত উঠিয়ে নেয়।
নিজেরমেলে রাখা হাতটা গুঁটিয়ে গালের নিচে দিয়ে ফের ঘুমিয়ে যায় বিভা।
নিশ্চল রাত। অন্তকরণে টুকরো কয়েক মুগ্ধতা কুঁড়িয়ে উঠে পড়লো ইউসুফ। জানলা আটকে দিলো। বেরিয়ে যাবার আগে আরেকবার এলো বিভার কাছে। বিভা অনবরত ঠোঁট নাড়াচ্ছে। আমতা আমতা করছে। স্বপ্নে কিছু খাচ্ছে হয়তো। ইউসুফের ইচ্ছে হয় একটুখানি আঙুল ছুঁইয়ে ঠোঁটের কম্প স্হির করে দেয়। ইচ্ছের কেবল ইচ্ছেতেই মৃত্যু ঘটে।
ইউসুফ মনে মনে আওড়ায়,”গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা গোলাপেরও ক্ষমতা নেই এই একটা কালোগোলাপের সৌন্দর্যের টক্কর দেয়ার।”
পরপরই বিরবির করে বলে,
-“আমি তোমাকে সব বলে দিবো বিভারানী। সব বলে দিবো। আর কষ্ট দিবোনা। এইযে কথা দিচ্ছি।”
কথা দিতে বিভার মাথার থেকে সামান্য উপরে হাত রাখে ইউসুফ। চুল স্পর্শ করেনা। পাছে বিভা চোখ মেলে ফেলে! তার ভয় হয়। খুব ভয়। বুক ঠাসা প্রণয় প্রকাশে তার মতোন ভয় বোধহয় আর কোনো প্রেমিক পায়নি।
৩১.
বাহাদুরকে কোলের উপর বসিয়ে রুটি ভাজি খাইয়ে দিচ্ছিলো ইভা। বাচ্চাটা সকালের নাস্তা করতেই চায়না। স্কুলে যাবে। খালিপেটে গেলে হয়? কতগুলো ঘন্টা।
ভাবতে ভাবতেই আবার তার মুখে রুটি তুলে দিলো ইভা। মুখভর্তি খাবার চিবোতে চিবোতে বাহাদুর কাতর হয়ে বললো,
-“বুবু, আর খাবোনা। হলোতো। এই দেখো। কতবড় পেট হয়ে গেছে। তনা ভাবির থেকেও বড়।” বেচারা তন্দ্রার নাম উচ্চারণ করতে পারেনা। তাই সামান্য সহজ করে তনা ডাকে।
ইভা মনে মনে ফিক করে হেসে ফেললেও বাইরে জোরালো গলায় বলে,”পুরোটা খাওয়া অবধি তোর নিস্তার নেই বাহাদুর। ভাইজান কিন্তু পিছেই বসে আছে। জলদি চিবা।”
বাহাদুর ভয় পেয়ে তাকায়। ডাইনিং টেবিলে তারা যে পাশে বসেছে তার ঠি ক পিছনেই সোফায় বসে কাঁচের টেবিলভর্তি কাগজপত্র ঘাটছে সরফরাজ। বাবা, চাচা, ইউসুফ ভাইও আছে। কিসব গম্ভীর কথাবার্তা চলছে কখন থেকে।
বাহাদুর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,
-“বুবু! তুমিও আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?”
ইভা অনড় হয়ে বলে,”মুখ খোল দুষ্ট। কেঁদেকেটে লাভ নেই।”
বাইরে বিচ্ছিরি রোদ উঠেছে। রান্নাঘরের ভ্যাপসা গরমে তন্দ্রার ঘেমে উঠা সবুজ ব্লাউজের দিকে বারবার কড়া চোখে তাকাচ্ছে সরফরাজ। আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। হাতের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে। বাবার কথায় মনোযোগ দিচ্ছে। আবার দু’তিনসেকেন্ড যেতেই আড়চোখে তাকাচ্ছে রান্নাঘরে এদিকে পিঠ দিয়ে গাঢ় বেগুনি শাড়ি পড়ে দাড়িয়ে থাকা তন্দ্রার দিকে। মেয়েটাকে সে হাজারবার বলেছে টইটই করতে না। ন’মাস চলছে। এখন একটু সাবধানে থাকো। ঘরে থাকো। এই গলাফাঁটা গরমে ওর কি দরকার রান্নাঘরে যাবার? ও কি রান্না করবে? চাচি তো কিছু ধরতেও দিচ্ছেনা। ওর দরকার টা কি দাড়িয়ে দাড়িয়ে রান্না দেখার? যদি মাথা ঘুরে যায়? যদি ক্লান্ত হয়ে সিঁড়ি বাইতে যেয়ে পা পিছলে যায়?
তন্দ্রা একবারো এদিকে তাকাচ্ছেনা। সরফরাজ মনে মনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। তাকাবেনা তো। জানে তাকালেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে যাবে। চোখে চোখে একটা কড়া ধমক দিলেই সুড়সুড় করে ঘরে যেতে বাধ্য।
আরেকবার তাকাতেই জাহানারার দেখে ফেলেন। সরফরাজ দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয়। জাহানারা মৃদুস্বরে করে তন্দ্রাকে বলেন,
-“তন্দ্রা, ছেলেটা রাগ করবে। উপরে যাও না মা। ঘরে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসো গিয়ে। তোমারও তো কষ্ট হচ্ছে। কেমন ঘেমে গেছো দেখেছো একবার?”
তন্দ্রা প্রতিবাদ করে বলে,
-“সারাদিন ঘরে বসে থাকতে আমার ভালোলাগেনা চাচি। আমিতো কাজ করছিনা। চুপ করে দাড়িয়ে আছি শুধু।”
তন্দ্রা মুখে হাসি নিয়ে চুপটি করে থাকে। জাহানারা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে যান। কিছুক্ষণ যেতেই বেখেয়ালিতে একবার ওদিকে তাকিয়ে ফেলে তন্দ্রা। সরফরাজের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। সরফরাজ চোখ বড় বড়করে করে তাকে উপরে যাবার নির্দেশ দেয়। তন্দ্রা শোনেনা। বরং মৃদুগতিতে এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বোঝায়,”আমি যাবোনা।”
বাহাদুরের খাওয়া শেষ তাকে নামাতে নামাতেই এই সুন্দর দৃশ্য চোখে ধরা দেয় ইভার। ভাইজান আর যাই করুক। তন্দ্রা ভাবির কথা এলেই একদম নরম হয়ে যান। তার কঠিন ভাব হাওয়ায় উবে যায়।
তন্দ্রা মুখ ফিরিয়ে আবার এদিকে পিঠ দিয়ে দাড়িয়েছে। মেয়েটা এতো অবাধ্য। সরফরাজ হাঁক ছাড়ে,”ইভা?”
ইভা কাছে যায়। সরফরাজ হাতের ইশারায় কাছে ঝুঁকতে বলে তাকে। ইভা ঝুঁকে। সরফরাজ হিমঠান্ডা গলায় ফিসফিস করে বলে,
-“তোর ভাবিকে যেয়ে বল, ভাইজান এক্ষুনি ঘরে যেতে বলেছে। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।”
~চলবে~
[খুব ছোট হলো। লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়ছি বারবার। আর লিখা সম্ভব হচ্ছেনা। আজকের দিনটা একটু মানিয়ে নিন। আগামীতে বড় করে দিবো।]