মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব – ২

0
623

মেঘদিঘির পাড়ে – ২
মালিহা খান

৫.
গ্রাম শুনসান, নিরিবিলি। সাঁঝের প্রভা ছেড়ে তিমির রাত্রির ঢল নেমেছে। দুটো হুতুম পেঁচা বুঁদ বুঁদ করে ডাকছে। কন্ঠস্বর ভিন্ন। পুকুরের নিষ্কম্প পানিতে একটু পরপর মৃদু তরঙ্গের আওয়াজ হচ্ছে, গুঁইসাপ হয়তো।
তন্দ্রার ঘর থেকে ফিরে এসেই ইভার প্রচন্ড মাথাব্যাথা উঠল। কপালের দু’পাশ টনটন করতে থাকল। আজেবাজে কুৎসিত কুঁচকুঁচে স্বৃতিতে মাথা ঠেসে উঠল। শেষমেষ ব্যাথায় টিকতে না পেরে পরপর তিনবার বমি করে কাহিল হয়ে পড়লো সে। রাতের খাবার খাওয়ার শক্তি হলোনা।
ন’টা বাজতে না বাজতেই বিছানাপত্তর ঝাঁট দিয়ে, হাল্কা বাতি জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লো ইভা। বাহাদুর সবুজাভ অন্ধকারে ঠাঁট হয়ে বসে রয়। বুবুর কি হলো? রাতে ইভার কাছেই ঘুমায় বাহাদুর। সবসময়, সেই ছোট থেকেই।
ইভা চোখ বুজতে পারেনা, বিশ্রি দৃশ্য ভেসে উঠে। চোখ খোলা রাখতে পারেনা, মাথাব্যাথা বাড়ে। দোটানায় অসহ্য হয়ে অনবরত পাশ বদলায় সে। বামকাত- ডানকাত ঘুরতে থাকে।
বুবুর ছটফটানি দেখে ভীতু বাহাদুর মিহি স্বরে বলে,

-“বুবু? চাচিমাকে ডাকবো?”

ইভা ব্যাথায় কাবু হওয়া কন্ঠে উওর দেয়,

-“না না, দরকার নেই। তুই খেয়ে ঘুমাস কিন্তু। চাচিমা ডাকতে এলে বলবি বুবুর মাথাব্যাথা। খাবেনা।”

দক্ষিনের জানলা দিয়ে ঝরঝরে হাওয়া আসছে। ইভা রুগ্ন স্বরে বাহাদুরকে জানলা আটকে দিতে বলে। বাতাস সহ্য হচ্ছেনা।
বাহাদুর জানলা আটকে আসে। ইভা চোখ বুজেছে তখন। হাল্কা সবুজ আলোয় কেমন পাংশুটে মলিন দেখাচ্ছে ধবধবে শেতাঙ্গ মেয়েটিকে।
দশটার দিকে জাহানারা খাবার জন্য ডাকতে আসেন। ইভা তখন গভীর ঘুম। তার ছোট্ট শরীরে দুটো কাঁথা জড়িয়ে দিয়েছে বাহাদুর। জাহানারা অবাক হন। এই অবেলায় কাঁথামুড়িয়ে মেয়ের কিসের ঘুম?
বাহাদুর ফিসফিস গলায় জানায়,” বুবুর মাথাব্যাথা। শব্দ করোনা।”
জাহানারা কিছুক্ষণ মৌন চেয়ে রইলেন। অত:পর বাহাদুরকে নিয়ে নিশব্দে বেড়িয়ে গেলেন ঘরের দরজা ভিড়িয়ে।

খাবার টেবিলে ইউসুফকে দেখা যায় আগে থেকেই। রোজ তাকে ডেকে ডেকে আনতে হয়। জাহানারা মিষ্টি করে হাসলেন। ইউসুফকে দেখামাত্রই চাচিমার হাত ছেড়ে ছুটে গেলো বাহাদুর, ইউসুফ বিস্তর হেসে ঝুপ করে ডানপায়ের উপর উঠিয়ে বসালো তাকে। মাথায় চুমু খেয়ে বললো,”তোকে তো দেখাই যায়না রে! থাকিস কই আব্বা?” বাহাদুর দাঁত বের করে হাসলো। ইউসুফ মাথায় আদর করে দেয়। জাহানারার দিকে চেয়ে বলে,

-“ইভা কোথায় আম্মা?”

জাহানারা ভাত বাড়তে বাড়তে উওর দেন,”খাবেনা, মাথাব্যাথা। ঘুমিয়ে পড়েছে।”

ইউসুফ ” ওহ” বলে মাথা নাড়ায়। গ্লাসে পানি ডালে। দু’চুমুক খেয়ে বলে,

-“বিভা?”

-“আসছে, ঘুমাচ্ছিলো তো। মাত্র ডেকে এলাম। ধর।” জাহানারা খাবারের প্লেট এগিয়ে দেন। আরেকটা প্লেট নিয়ে বিভার ভাত বাড়ে।

-“এসময় ঘুমাচ্ছিলো? শরীর খারাপ?”

-“না না এমনেই।”

ইউসুফ বিনা বিলম্বে খাওয়া শুরু করে। প্রথম লোকমাটা বাহাদুরের মুখে তুলে দেয়। বাহাদুর ছোট মানুষ।
ছ’ বছর চলছে মাত্র। একা হাতে খেতে পারেনা, মাখিয়ে ফেলে। সবসময় ইভা খাইয়ে দেয়, ইভা নেই বিধায় ইউসুফ খাইয়ে দিচ্ছে।
বাহাদুরের মুখে আরেক লোকমা তুলে দিতেই বিভা নামে। ঘুমে চোখমুখ ফুলে গেছে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,

-“বাহাদুর এদিক আয়, খাইয়ে দেই।”

-“আমি দিচ্ছি, তুমি খাও।”

-“আমি খাবোনা। ওকে খাওয়াতেই এসেছি।”

-“খাবেনা কেনো?”

জাহানারা রান্নাঘরে গেছেন। হলরুমে কেউ নেই। সরফরাজ রাত করে ফিরে। সে একা একাই খায়।
ইউসুফ উওরের অপেক্ষা করে। বিভা চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়। বলে,

-“আপনি খাইয়ে দিন তাহলে, আমি যাই।”

-“বিভা খেতে বলেছি। আম্মা ভাত বেড়েছে, খেয়ে যাও।”

বিভা ধপ করে বসে পড়ে। আস্তে করে প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নেয়।

৬.
অন্ধিকা গাঢ়। বিশালকায় জ্যোৎস্নানাথ অকৃপণ হাতে দীপ্তি বিলাচ্ছে। গাছের পাতা অশান্ত। দমকা সমীরণ সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে সবুজ পাতার কাগজী গায়ে। বাতাসের রসিকতায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে তারা। ঝিরঝির হাসির শব্দে জমাট নিরবতা কাটছে ক্রমশ। একাকী দেয়ালঘড়িটার কাঁটা যখন বারোটার ঘর ছাড়ালো ঠ ক তখনই একান্ত নিজস্ব নিষ্ঠুর মানবের দ্বারে এসে উপস্থিত হলো এক অভিমানী মানবী। মনের অভিমানগুলো লুকোতে সক্ষম হলেও চোখের অভিমানগুলো লুকোতে ব্যর্থ সেই অষ্টাদশী শ্যামময়ী।
বিভা সাবধানে দরজা ঠেললো। ইউসুফ ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। কালেভদ্রে এক দু’দিন জেগে থাকে। তবু নিজের কাজ নিয়ে। হাহ্! তার জন্য অপেক্ষাই বা করবে কেনো?
কে সে? প্রশ্নের উওর মিললো না। বিভা মনে মনেই হাতরে বেড়ালো। মনের হাতে ধরা পড়লো ফাঁকা টুকরো কাগজ। সাদা কাগজ। কিচ্ছুটি লেখা নেই সেখানে। কিচ্ছু না।
ইউসুফ জেগে ছিলো। বিছানার সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলো। বিভা ঢুকতেই থমকালো।
থমকানো দৃষ্টি ইউসুফের দিকে নিবদ্ধ হতেই চোখ মেললো ইউসুফ। চোখাচোখি হলো হঠাৎই। ইউসুফ স্হির চেয়ে রইলো বিভার কাজলরঙা পদ্মচোখে। ঘরে নীলাভ আলো।
মেয়েটার রোজকার কাজ। রাত গভীর হলেই নিশব্দে ঘরে আসবে, কতক্ষণ তার দিকে চেয়ে থাকবে, আবার নিশব্দে চলে যাবে। সে জেগে থাকলেও, ঘুমিয়ে থাকলেও। বিভা আসবেই। যদি ঘুমিয়ে থাকে, তবে ভোরবেলা জানলার টেনে দেয়া পর্দা দেখে বুঝে যায় বিভা এসেছিলো, এলোমেলো করে রাখা টেবিলের গোছানো কাগজ দেখে বুঝে যায় বিভা এসেছিলো, খালি জগটার ভরা পানি দেখে বুঝে যায় বিভা এসেছিলো, কনকনে শীতে গায়ে টেনে দেয়া কাঁথাটা দেখে বুঝে যায় বিভা এসেছিলো।
ইউসুফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার চোখে মগ্নতা নেই, স্নিগ্ধতা নেই, মানা নেই, বাঁধা নেই, সম্মতিও নেই। শূন্য নির্বিকার চাহনী। তবু কেমন চেয়ে আছে!
বিভা চোখ নামিয়ে নেয়। দরজা আটকে মৃদুপায়ে বিছানায় যেয়ে বসে। ইউসুফ চেয়েই আছে। বিভা দু’একবার তাকায়। ইউসুফকে একইভাবে চেয়ে থাকতে দেখে আবার মাথা নত করে। এত কঠিন কেনো লোকটা? এত পাষাণ, এতো নির্দয়, এতো নির্মম কেনো?
সময় যায়। মান বাড়ে। নিকটেও দুরত্ব বাড়ে। ক্লান্ত ইউসুফ আবার চোখ বুজে। হাত উঠিয়ে মাথার পিছে ঠেকায়। এই সর্বনাশা প্রণয়ীকে সে কিকরে বুঝ দিবে?
বিভা ওঠে জানলার ধারে গিয়ে দাড়ায়। মসৃণ বাতাসে অলকবন্ধন ছুঁটে যায়। ঢিলে খোঁপার কাঁটাটা মৃদু শব্দ তুলে মেঝেতে পড়ে যেতেই পেছন থেকে ভরাট কন্ঠ ভেসে আসে,

-“বিভা ঘরে যাও, রাত হয়েছে।”

বিভা একবার পিছে তাকায়। ইউসুফ চোখ বুজেই রেখেছে। ইউসুফের আদেশ উপেক্ষা করেই আবার আকাশের দিকে তাকায় বিভা। নীলচে তারার ঝকঝকে আকাশ।
ইউসুফ চোখ খোলে এবার, গলা হাল্কা বাড়িয়ে নরম স্বরে ডাকে,”বিভা?”

বিভা ফিরে তাকায়না। জানলার ধরে রাখা হাতটা শক্ত করে।
ইউসুফ ছোট্ট শ্বাস ফেলে আবার ডাকে,”বিভা ডাকছিনা?”
বিভা ঢোক গিলে। চোখ ভরা পানি নিয়ে অনবরত পলক ফেলে। অভিজ্ঞদের ন্যায় কান্না লুকিয়ে পেছনে ঘুরতে ঘুরতে নিচু স্বরে বলে,”বলেন।”

-“ঘরে যাও।”

-“আপনি ঘুমোবেন না?”

-“ঘুমাবো, তুমি যাও।”

বিভা চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলে,”আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কেনো?”

ইউসুফ উওর দেয়না। বিভার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। পিঠের পিছের বালিশটা ঠি ক করে রাখতে রাখতে নির্বিকার গলায় বলে,”ঘরে যাও বিভা।”

অপমানে জর্জরিত বিভা ঠোঁট চেপে অশ্রু আটকায়। ধরা গলায় বলে,

-“আপনি আমাকে কিছু বলেননা কেনো?”

-“আমি বললে শুনবে তুমি?”

-“আমি শুনিনা আপনার কথা?”

-“কই শুনছো? আমি যেতে বলছি, তুমি গিয়েছো?”

উওরে চুপ হয়ে যায় বিভা। চোখের পানি বারণ মানেনা। দু’ফোঁটা জল টুপ করে দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে যায়। খুব নিভৃতে, খুব নিরবে ভেতরে ভেতরে হাউমাউ করে ডুঁকরে উঠে বিভা।

ইউসুফ শান্ত চোখে দেখে কৃষ্ণময়ীর কান্না। কিছু বলেনা। বিভা ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। আস্তে করে বলে,

-“মৃত্যুর আগে আমার শেষ ইচ্ছে কি জানেন? আপনার মুখ থেকে ভালোবাসি শোনা। একবার হলেও। মিথ্যে হলেও।”

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here