মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব – ২২

0
403

মেঘদিঘির পাড়ে – ২২
মালিহা খান

৪২.
নেওয়াজ সাহেব বসার ঘরের সোফায় বসে ব্যবসার কাগজপত্র দেখছিলেন। ইকবাল গরম চায়ের কাপ নিয়ে ভাইয়ের মুখোমুখি বসে আছে। একটু পরপর নেওয়াজ সাহেব এটা ওটা জিজ্ঞেস করলে আস্তেধীরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ইকবাল ইভার ছোটচাচা। ইউসুফের বাবা।
ইভা খাবার টেবিলে বসে আছে। সামনের প্লেটে গুড় নারকেলে ভরা ধোঁয়া ওঠা ভাপাপিঠা। কোলের উপর বাহাদুর। নিজে খাচ্ছে সাথে অভ্যাসবশত বাহাদুরকেও খাইয়ে দিচ্ছে ইভা। বাহাদুর ধীরেসুস্থে খাবার চিবাতে চিবাতে অভ্যস্তহাতে ইভার ছেড়ে দেয়া ওড়নার আচঁল নিয়ে দুষ্টামি করছে। এই ঘূর্নিপাকের মতো ঘোরাচ্ছে আবার ইভার নাকপর্যন্ত ঘোমটা টেনে দিচ্ছে।

তন্দ্রা মাথায় লেপ নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। সরফরাজ যেয়ে আস্তে করে লেপ সরিয়ে দিলো। হাতের ধরা উল, উলের কাঁটা, ছোট্ট সোয়াটারের আধবোনা অংশটা একমূহুর্ত দেখে নিয়ে পাশে সরিয়ে রাখলো। তাদের প্রথম বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছিলো। চারমাসে পড়তে না পড়তেই তন্দ্রার হঠাৎ মিসক্যারেজ হয়ে যায়। তন্দ্রা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিলো। রাতদিন শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়তো। থামানো যেত না। হাসিহীন তন্দ্রাকে সামলে রাখার সময়টা বেশ বিভৎস্য একটা অধ্যায় হয়ে সেঁটে আছে সরফরাজের ভেতর।
তারপর যখন আবার অন্তসত্তা হলো তখন থেকে মেয়েটা একটু একটু স্বাভাবিক হলো। কথাবার্তা এলো মুখে। হাসলো।
এইযে এখন তার সাথে কত দুষ্টামি করে, সে কখনো থামায়?

সরফরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্দ্রাকে একহাতে আগলে ধরলো। পিঠের পিছের বালিশটা বিছানায় নামিয়ে শুইয়ে দিতে দিতেই চোখ পিটপিট করে আড়মোড়া দিলো তন্দ্রা। ঘুমজড়ানো কন্ঠে সরফরাজকে বললো,

-“কি হয়েছে?”

সরফরাজ মৃদুস্বরে বললো ,”কিছু হয়নি। দেখি তনু, ঠি ক করে শোও, ঘাড় সোজা করো।”

তন্দ্রা ঘাড় সোজা করেনা, আরো কাত করে বলে,

-“আপনি জেগে আছেন কেনো?”

সরফরাজ সাঁয় দিয়ে বললো, “এইতো আমিও ঘুমাবো। চোখটা বন্ধ করো দেখি তো তন্দ্রাবতী।”

তন্দ্রা চোখ বুজে। মিনিট পনেরোর মাঝে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সে ঘুমোতেই ঘর অন্ধকার করে নিচে নেমে আসে সরফরাজ। ইকবাল কিজন্য যেনো উপরে গিয়েছে, নেওয়াজ সাহেব একাই বসে আছেন কাঁচের টেবিলে কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সরফরাজ ভ্রু কুঁচকে বলো,

-“কিছু হয়েছে আব্বা?”

নেওয়াজ সাহেব মাথা তুলে তাকান। ছেলেকে দেখে মাথা নাড়িয়ে স্মিত হেসে বলে,”কিছু হয়নি বাবা। চিন্তার কিছু নেই।”

ইভা তখনো পিঠা খাচ্ছে। ভাপাপিঠা তার খুব পছন্দের। শীতটা জেঁকে বসেছে খুব। সারাক্ষণ ঘুম ঘুম লাগে। অলস লাগে। বাহাদুর আর খাবেনা বলে তার গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুঁজে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও গেছে। সরফরাজ এসে চেয়ারে বসলো। কিন্চিৎ গলা বাড়িয়ে বললো,

-“চাচী, ভাত দিও তো টেবিলে। ক্ষুধা লেগেছে।”

জাহানারা রান্নাঘর থেকে,”এইতো দিচ্ছি বাবা।” বলতেই ইভার দিকে তাকালো সে। বলল,”তুই খেয়েছিস? ভাত খাবার সময় পিঠা খাচ্ছিস কেনো?”

-“আমি আগেই ভাত খেয়েছি ভাইজান। আপনি ঘড়ি দেখেন, এগারোটা বাজে।”

সরফরাজ ঘড়ি দেখলো,”সবাই খেয়ে নিয়েছে? আমিই বাকি শুধু?”

-“না, শুধু আমি আর বাহাদুর খেয়েছি। আর কেও খায়নি। ভাইজান? আপাদের আসতে কি খুব দেরি হবে?”

সরফরাজ মাথা নাড়িয়ে বললো,

-“বারোটা, সাড়ে বারোটা বাজতে পারে। দূরের রাস্তা তো।”

তারপর নেওয়াজ সাহেবের দিকে চেয়ে বললো,”আব্বা? আপনিও খেয়ে নিন। চাচা কোথায়?”

নেওয়াজ সাহেব কাগজপত্র রেখে টেবিলে এসে বসলেন। জাহানারা খাবার নিয়ে এসেছে। ভাত- তরকারি সাজিয়ে রাখছে।
বাহাদুর সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে এখনই শুইয়ে দেয়া দরকার। এখন উঠে গেলে আর ঘুমোতে চাইবে না। ইভা পিঠা শেষ করে তাড়াতাড়ি করে পানির গ্লাস টেনে নিলো। নেওয়াজ সাহেব আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ইভা একটু হাসলো। নেওয়াজ সাহেব কি যেনো ভাবলেন। তারপর ধীরগতিতে হাত বুলিয়ে দিলেন ঘুমন্ত বাহাদুরের মাথায়ও।

৪৩.
গায়ের ওড়নাটা শালের মতো জড়িয়ে নিয়েছে বিভা। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া তাতেই সারা গা ঢেকে আছে। চাঁদের পূর্ণিমা জোরদার হয়েছে।
গাড়ি এঁকেবেঁকে দুলছে। এমন ভাঙা রাস্তা এদিকে। বিভা নড়েচড়ে বসলো। পাশের লৌহমানবের দিকে একবার তাকালো। চাঁদের আলোতেও রাস্তাটা খুব অন্ধকার। চওড়া রাস্তা, তবু এমন ভাঙা কেনো?
আশেপাশেই কোথায় যেনো শিয়ালের দল ডেকে উঠলো। এমন কাছ থেকে শিয়ালের ডাক শুনে অন্তরাত্মা অবধি জমে গেলো বিভার। স্টেয়ারিং ঘোরাতে থাকা বলিষ্ঠ হাত দুটোর একটা খপ করে টেনে ধরে বললো,

-“আপনি একহাতে গাড়ি চালান, এটা আমি ধরবো।”

ইউসুফ নিরব সম্মতি দিলো হয়তো। বিভার কথার আপত্তি করলোনা।

অন্ধকার পথ মাড়িয়ে এগিয়ে চলা ধবধবে সাদা গাড়িটা থমকে গেলো অকস্যাৎ। বিভাকে হতভম্ব করে দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো ইউসুফ। বিভার পাশের দরজা খুলে জলদগম্ভীর গলায় বললো,

-“বেরিয়ে এসো।”

~চলবে~

[রিচেক হয়নি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here