মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব – ৩০

0
526

মেঘদিঘির পাড়ে – ৩০
মালিহা খান

৬৭.
মেঘদিঘির ঝোঁপের আড়ালে একটা বড় বাঁশঝাড় আছে। বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বাঁশঘুঘুর ডাক আসে। এখনো আসছে। ঊষাকালে যখন শীতের নরম রোদ পৃথিবীর গা ছোঁয়, বাঁশঘুঘু গুলো নিশ্চুপ হয়ে সেই রোদে গা পোঁড়ায়।
ইভা দাড়িয়ে আছে ঠাওর করতে পেরেও সায়ন তাকাতে পারলোনা। তার সামনে নেওয়াজ সাহেব বসে আছেন। আর সবার সামনে হলেও বাপের সামনে অন্তত মেয়ের দিকে বেহায়ায় মতোন তাকিয়ে থাকা যায়না। অতটুকু শোভনীয় ভদ্রতা তার মধ্য আছে। সায়ন মনে মনে খুব করে কপাল চাপড়ালো।
কপাল চাপড়ানোর ঠাস ঠাস আওয়াজগুলো সে কান অবধি শুনতেও পেলো।

কারো পায়ের পদচারণে ইভা দ্রুত পেছন ফিরলো। চোখ ডলার ভঙ্গি করে ভারী নির্বিকার গোছে একটা মিথ্যে হাই তুললো। ইউসুফ তন্দ্রার ঘর থেকে ফিরছিলো। ইভাকে সিঁড়ির কাছে দাড়িয়ে থাকতে
দেখে থেমে গেলো। কাছে যেয়ে মাথায় হাত রাখলো। ভারী আদর করে জিজ্ঞাসা করলো,

-“ঘুম হলো?”

মিথ্যে হাইটায় একটা মিথ্যে শব্দ হলো। ইভা মুখ থেকো হাত সরিয়ে দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো,

-“হলো ইউসুফ ভাই।”

-“এখনো হাই তুলছিস যে? কেও তোকে জাগিয়ে দিয়েছে নাকি? আমি মানা করেছিলাম তো..”ইউসুফের কন্ঠে রোষ প্রকাশ পায়। ইভা দ্রুত ধাতস্থ করলো তাকে।

-“না না কেউ জাগায়নি। ওই এমনি একটু…”তার কথা সম্পূর্ণ হলোনা। ভয়ার্ত নারীকণ্ঠের চিৎকারে কথা আটকে গেলো। তন্দ্রা ভাবীর কন্ঠ। ইউসুফের রুহ কেঁপে উঠলো। তন্দ্রার হাবভাব সে স্বাভাবিক দেখে আসেনি। ভাবি অনবরত ঘামছিলো। সরফরাজ বলেছিলো শরীর খারাপ একটু তাই সে তেমন ঘাটায়নি।

বিভা মাত্র ইভার ঘর থেকে বেরোচ্ছিলো।
তন্দ্রার চিৎকারে সে প্রায় দৌড়ে ঘরের দুয়ারে হাজির হলো। তন্দ্রা দাড়ানো, বসার মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। দাঁড়াতে গিয়ে সে পুরোপুরি দাড়াতে পারছেনা। বিভা দ্রুত যেয়ে ধরলো। পায়ের নিচে অকস্মাৎ কিছু দেখতে পেয়ে ভীত হয়ে উঠলো মন। ইভাকে দরজার কাছে আসতে দেখে ত্রস্ত গলায় বললো,

-“ইভা! আম্মা, চাচীকে আসতে বল গিয়ে, ভাবীর পানি ভাঙছে।”

বিয়ে বাড়ির হাসিঠাট্টাপূর্ণ কোলাহল মূহুর্তেই থমকে গেলো। তন্দ্রা অল্পতেই ভয় পায়। সরফরাজ সাথে না থাকায় সে আরো ঘাবড়ে গেলো। হু হু করে কেঁদে ফেললো। বিভা শত বুঝিয়েও শান্ত করতে পারলোনা তাকে। জাহানারারা এলেন। তন্দ্রার প্রসব বেদনা উঠছে। ব্যাথার চেয়ে দূর্নিবার ভয়েই তার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ইউসুফ আরো বারকয়েক ফোন করার চেষ্টা করলো সরফরাজকে। মরার উপর খরার ঘা হিসেবে সরফরাজের ফোন এবার বন্ধ পাওয়া গেলো।
ইউসুফ বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। নিচে নেমে গাড়ি বের করতেই আবার মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। ফুয়েল মিটারের কাঁটা মাঝামাঝি অবস্থানে। অভিজ্ঞতা বলছে এতোটুকুতে সদর হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়। মাঝে অবশ্য ফুয়েল পাম্প আছে। কিন্তু ভাবির অবস্থার অবনতি হলে মাঝপথে গাড়ি থামানো যাবে নাকি তাও সমস্যা। সায়ন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলো। ইউসুফ এসে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“সায়ন? তুমি গাড়ি নিয়ে এসেছো?”

-“জি ভাইয়া।”

-“কোথায়? উঠোন তো খালি।”

-“গেটের বাইরে পার্ক করা। উঠোনের ওখানে তখন ফুলের ঝাঁকি টাকি রাখা ছিলো।”

সায়নকে গাড়ি বের করতে বলে একদৌড়ে উপরে গেলো ইউসুফ। তন্দ্রা ভয়ে জবুথবু হয়ে গেছে। ব্যাথায় চাদর খামছে ধরেছে। জাহানারা ইউসুফকে দেখেই বললেন,”কই ছিলি তুই? গাড়ি বের করেছিস? বৌমাকে হাসপাতালে নিতে হবে তো।”

ইউসুফ মাথা দোলালো।

সায়ন ড্রাইভিং সিটে। পেছনে তন্দ্রা, বিভা আর জাহানারা। ইভা নেওয়াজ সাহেবের সাথে ওই গাড়িতে আসছে। তারা মাঝপথে তেল নিয়ে বাকিটা যেতে পারবে। ইকবাল বাড়িতেই থাকবেন৷ বিয়ের বাড়ি। একেবারে খালি করে যাওয়া যাবেনা। কারো তো থাকতে ই হবে। ইভার মা ভীষণ অসুস্থ মানুষ। তিনিও চলাফেরা বেশি একটা করতে পারেন না৷ তিনি সামলাতে পারবেননা সব। বাহাদুর ছোট। সেও বাসায়ই রইলো।

ইউসুফ ফ্রন্ট সিটে যেয়ে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। তন্দ্রা তখনো দূর্বল স্বরে সরফরাজের নাম আওড়াচ্ছে। ইউসুফ ফোন বের করলো। তুখর গরম মেজাজ নিয়ে অনবরত সরফরাজের ফোনে ডায়াল করতে লাগলো।

গাড়ি তখন মাঝামাঝি পথে। লাউডস্পিকারে রাখা ফোনটা রিং করলো। প্রথম রিংয়েই ফোন তুললো সরফরাজ। খানিক কেটে কেটে ভেসে এলো তার ভারি কন্ঠ,”হ্যালো? ইউসুফ? এদিকে নেটওয়ার্কের এতো সমস্যা। হ্যালো?”

আরাধ্য কন্ঠটা কর্ণগোচর হওয়ামাত্র ডুঁকরে উঠলো তন্দ্রা। ফোন অবধি পৌঁছালো আওয়াজটা। ওপাশে সঙ্গে সঙ্গে উৎকন্ঠা ছেঁয়ে গেলো,

-“হ্যালো? ইউসুফ? তোর ভাবী কাঁদছে? কি হয়েছে? হ্যালো?”

ফোনটা ধরে রেখে ইউসুফ থমথমে গলায় বললো,”ভাবির পেইন উঠেছে। হাসপাতালে যাচ্ছি।”

-“কিহ্?”সরফরাজ স্তম্ভিত।

ইউসুফ অবিচল গলায় বললো,
-“ভাবির সাথে কথা বল। ধর।”

তন্দ্রার কাছে ধরা হলো ফোন। সে কিচ্ছুটি বলতে পারলোনা। কেঁদে গেলো কেবল। সরফরাজ মৃদুক্ষণ তার কান্নাই শুনলো। তারপর নরম গলায় ডাকলো,”ইউসুফ? লাউডস্পিকার টা বন্ধ করে দে।”

ইউসুফ লাউডস্পিকার বন্ধ করে আবার তন্দ্রার কাছে দিলো ফোন। তন্দ্রা এপাশ থেকে বললোনা কিছু৷ ওপাশ থেকে পুরুষকন্ঠটি অনর্গল বিরতিহীন কি যেনো বলে গেলো। যার উদ্দেশ্য বলা হলো সে এপাশ থেকে চুপটি করে শুনলো। কিছুক্ষন পর লাইনটা কেটে গেলো। তন্দ্রা ফোন এগিয়ে দিয়ে মিনমিন করে বললো,

-“রেখে দিয়েছে, নাও।”

এরপর আর ভেঙে পড়তে দেখা গেলোনা প্রসববেদনা সহ্য করে যাওয়া ভয়ে জর্জরিত রমনীটিকে। সে চুপচাপ শান্ত হয়ে গেলো। ভয় যেনো কোথায় উবে গেছে।
সেই নিঝঝুম রাতে সায়ন আশ্চর্য হয়ে দেখলো নিরব অনূভুতির জোয়ার। ঠিক কতটা শক্তি থাকলে মাত্র কিছু সময়ের আলাপে নিজের সঙ্গীনীকে এত দূর থেকেও এতটা সাহস দেয়া যায়।
তার আর ইভারও কি এমন শক্তি হবে? এতোটা?

৬৮.
তন্দ্রার সিজার শেষ হলো রাত আড়াইটার দিকে। বেশ ভুগেছে মেয়েটা। জ্ঞান আসেনি এখনো। হাতে স্যালাইন চলছে। রক্ত দেয়া লেগেছে। অবশ্য রক্ত খুঁজতে অসুবিধা হয়নি। সায়নের সাথে মিলে যাওয়ায় সায়ন দিয়েছে।

নেওয়াজ সাহেব হাসপাতালে টাকা জমা করে ফিরে এলেন। সাদা টাওয়ালে মোড়ানো বাচ্চাটা জাহানারার কোলে আছে। তিনি তন্দ্রার বেডের পাশে বসে আছেন। বাড়ির সবাই ক্লান্ত।

ইভা ঘুমিয়ে পড়েছে সায়নের উপর। নার্স একজন কয়েকবার এসে বলে গিয়েছে সায়নকে একটু বিশ্রাম নিতে। সে রক্ত দিয়েছে। সায়ন শোনেনি। আলতো করে ঘুমন্ত ইভাকে ধরে কড়িডোরের চেয়ারে বসে বসেই চোখ বুজে রেখেছে। নেওয়াজ সাহেব দেখে চাপা হাসলেন। সে এসেছে ছেলেটা বুঝেনি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ।

নেওয়াজ সাহেব খানিক দুরত্ব রেখে পাশে বসলেন। সে পাশে বসতেই সায়ন আস্তে করে চোখ মেললো। পাশে উনাকে দেখে হঠাৎই কিছুটা বিচলিত বোধ করলো। ইভার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে পেটের দিকের শার্ট মুচরে ধরে আলুথালু হয়ে ঘুমাচ্ছে। সায়ন নড়লোনা। নিজ থেকেই বললো,

-“আপনার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা, নড়লে উঠে যাবে।”
নেওয়াজ সাহেব হাসলেন। সম্মতির ইঙ্গিত দিয়ে ছোট্ট করে বললেন,

-“নড়োনা তবে।”

~চলবে~

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল পাবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here