মেঘদিঘির পাড়ে – ৩১
মালিহা খান
৬৯.
হাসপাতালটা দোতলা। দোতলার শেষপ্রান্তের দিকে প্রসূতি মায়েদের ইউনিট। সেখানের লম্বা করিডোর শেষে গোলাকার খোলা জায়গা। হাসপাতালের পেছনদিকটা দেখা যায় ওদিকে দাঁড়ালে। বিভা ধীরলয়ে হেঁটে সামনের খোলা জায়গায় গিয়ে দাড়ালো। এদিকটা নিরিবিলি। অবশ্য সারা হাসপাতালই প্রায়নিরব। রাত তিনটা বাজে কিসের কোলাহল-ই বা হবে। ইউসুফকে দেখেনি অনেকক্ষণ। ভেবেছিলো কোনো কাজে হয়তে নিচতলায় গেছে। কিন্তু না, নিষ্ঠুরটা এককোঁণায় দাঁড়িয়ে ফোন চালাচ্ছে। বিভা পাতলা জর্জেটের ওড়না টেনেটুনে ঠিক করলো। এদিকটায় ঠান্ডা হিমেল হাওয়া। সামনের জঙ্গলের মতো গাছগাছালি একটু পরপর দুলে উঠছে। নির্মমটার ঠান্ডা লাগেনা? জ্যাকেটের বুক খুলে দাঁড়িয়ে আছে? হাহ্।
বিভা পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকটা সময় চুপচাপ দাড়িয়ে থেকেও যখন কোনরূপ সাড়া-ই পেলোনা তখন নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাইজানকে জানিয়েছেন?”
-“জানিয়েছি।”ইউসুফের কাটকাট সংক্ষিপ্ত উওর। সে যেনো খুব দেখেও এক্কেবারেই দেখতে চাইলোনা মেয়েটাকে।
বিভা দাড়িয়েই রইলো। ইউসুফ দীর্ঘক্ষণ পর লক্ষ্য করে বললো,
-“কি দরকার?”
-“আপনি রেগে আছেন কেনো?”
-“রেগে নেই।”
-“আছেনতো। তখনও আমাকে বকলেন। কিসব বললেন যেনো!”
ইউসুফ খপ করে বিভার হাত চেপে ধরলো। কবজি মুঁড়ে বললো,”জানোনা কেনো রাগ করেছি? অবুঝ সাজছো?”
বিভা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। ইউসুফ নিচু স্বরেই ধমকালো,
-“তুমি সব বলেছো কেনো?”
-“বেশ করেছি বলেছি।”
ইউসুফ হাতে আরো চাপ দিলো। বিভা কুঁকিয়ে উঠলো,
-“আঃ ব্যাথা পাচ্ছি।”
ইউসুফ সজোরে ঝামটা মেরে হাত ছেড়ে দিলো। বিভা হাতের কবজি ধরে ইউসুফের দিকে তাকালো। লোকটার চেহারা মায়া মায়া হলে কি হবে? মনে একটু মায়া নেই। এতটুকুও না। অথচ এ মানুষটার জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মায়া যেন তার ভেতর ঢেলে দিয়েছে কেউ। একদম কেঁচেকুচে। অল্পএকটুও বাকি রাখেনি অন্যকারো জন্য।
ইউসুফ ফোনের দিকে চেয়ে বললো,
-“তুমি বলেছো, আমিও রেগে আছি। ব্যস! কথা শেষ। যাও এখান থেকে।”
-“যাবোনা।”
-“যেওনা।”
বিভা আচমকা রেগে ধাক্কা দিলো ইউসুফকে। ইউসুফ কোনোমতে সামলে নিলো নিজেকে। বিভার দিকে চেয়ে কিড়মিড় করে বললো,
-“ঠাঁটিয়ে চড় লাগাবো একটা।”
বিভা গাল বাড়িয়ে দিলো।
-“দিন।”
ইউসুফ একনজর চেয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
-“বিরক্ত করবেনা, যাও।”
শত রাগ হোক। কপালের রগ ফুলে ফেঁটে যাক। তবু কি সে পারবে চড় লাগাতে? জানেতো। জানে বলেই তো সুবিধা নেয়। যতদিন না জানতো কেঁদেকুটে একাকার করতো। সেই ভালো ছিলো।
দৈবাৎ একটা প্রভন্জন হানা দিলো। বিভা দু’বাহু আড়াআড়িকরে জড়িয়ে ধরলো। মনে হলো এই সামনেই হিমালয় পর্বত। হিমালয় পর্বতের সবচেয়ে ঠান্ডা বাতাসটাই এটা।
-“মার সাথে কথা বলবো, আপনার ফোনটা দিন।”
-“এখানে আরো মানুষ আছে, অন্যকারোটা থেকে করো। চাচার ফোন দিয়ে করো গিয়ে। আমি কাজ করছি। দেয়া যাবেনা..
বিভা ঝুপ করে ফোনটা টেনে নিলো। মাঝখানের বাটন চেপে ইউসুফের সমস্ত কাজকর্ম সরিয়ে দিলো। মায়ের নাম্বারে ডায়াল করলো। রিসিভ হলো। ইউসুফ হাতমুঠো করে ফেললো। রাগে তার মাথার রগগুলো দপদপ করে জ্বলতে শুরু করলো।
মায়ের সাথে কথা বলে যেইনা ফোনটা কেটেছে বিভা তক্ষুনি একজোড়া হাত তাকে শক্ত করে ধরে ফেললো। মিনিটের ব্যবধানে তুমুল ধস্তাধস্তি করে মোটা জ্যাকেট পরিয়ে সশব্দে সামনের চেইনটা গলা পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো। ধস্তাধস্তির অবশ্য প্রয়োজন ছিলোনা। সে অহেতুক বুকে থাপড়াথাপড়ি করেছে বলেই জোর করতে হয়েছে।
ইউসুফ বাহুতে কপালের ঘাম মুছে বললো,
-“শরীরটাতো মরা মানুষের মতো ঠান্ডা বানিয়ে রেখেছো। ভালো জিনিস ভালোলাগেনা না? আর একবার এটা খোলার চেষ্টা করলে এখানেই মেরে মর্গে লাশ রেখে যাবো।”
বিভা থমথমে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। গটগট করে হেঁটে বাবার পাশে যেয়ে বসে পড়লো। জ্যাকেটটা তার ঢোলা হয়। নেওয়াজ সাহেব আদুরে গলায় বললেন,
-“ভাইয়ের জ্যাকেট নিয়ে এসেছো কেনো মা? বেশি ঠান্ডা করছে?”
-“জোর করে পরিয়ে দিয়েছেন।”
ইউসুফ ততক্ষণে এসে দাড়িয়েছে সেখানে। নেওয়াজ সাহেব তার দিকে জিজ্ঞাসু হয়ে চাইলেন। ইউসুফ বিভার ঠিক বরাবর দেয়ালটায় হেলান দিয়ে একগাল হেসে বললো,”শীতে কাঁপছিলো চাচা। তাই পরিয়ে দিলাম। বড় হচ্ছে আর ঘাড়ত্যাড়া হচ্ছে তো। জোর করতে হয়েছে একটু।”
বিভা কিছু বললোনা। পাশে তাকিয়ে সায়নের দিকে তাকালো। কি সুন্দর অবসন্ন শ্রান্ত চোখেও কেমন করে ইভার তাকিয়ে আছে। একটু আগেই তো একফাঁকে তাকে ডেকে ভীষণ চিন্তিত হয়ে বললো,”বিভা? তোমার বোনের কি জ্বর এলো দেখোতো? শরীরটা এতো গরম লাগছে কেনো? হলুদের পর ওকে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করিয়েছিলো নাকি? ইশ!”
সে ইভার কপাল ছুঁয়ে পরখ করে হেসে উওর দিলো,”জ্বর আসেনি। সামান্য গরম। ঘুমিয়ে আছে তো।”
বিভা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইভা কেমন লতাপাতার মতো পেঁচিয়ে ধরে শুয়েছে। কই? সায়ন তো বিন্দুমাত্র বিরক্ত হচ্ছেনা।
আর সে একটু কথা বলতেই ইউসুফের বিরক্তি লেগে গেলো?
৭০.
সরফরাজের সাথে তন্দ্রার সাক্ষাৎ হলো ভোরের প্রথমপ্রহরে। তন্দ্রার তখন মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। সে আধো আধো মস্তিষ্কে কপালের উপর সেই শক্ত হাতটার বিচরণ পেলো। পেলো গায়ের সেই চেনা গন্ধটা। আরে! ডানহাতটাও তো ধরে রাখা শক্ত করে। তন্দ্রা খুবকষ্টে তাকালো। সরফরাজ ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকলো। ক্ষীণ গলা ডাকলো,
-“তনু? তন্দ্রাবতী? এইতো আমি।”
তন্দ্রা নিচু মুমূর্ষ কন্ঠে কি যেনো বললো। সরফরাজ পরিষ্কার শুনতে পেলোনা। কানটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে বললো,
-“কি বলছো তনু?”
তন্দ্রার কন্ঠ ভেঙে গেলো আবার, সে কোনরকমে বললো,
-“কেনো এসেছেন আপনি? কেন আসলেন?”
সরফরাজ দমবন্ধ করে কথাটা শুনলো। তাকালো তন্দ্রার যন্ত্রনায় বিধস্ত বিবর্ণ মুখটার দিকে। জাহানারা চাচি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। আশেপাশে আরো প্রসূতিরা আছেন। নয়তো সে এক্ষুনি মেয়েটাকে খুবকরে আদর করে দিতো। সব অভিমান নিজের ভেতর শুঁষে নিতো। একটুকুও অবশিষ্ট রাখতোনা।
সরফরাজকে অমন করে চেয়ে থাকতে দেখে তন্দ্রা শান্ত হলো। দুঃখী গলায় প্রশ্ন করলো,
-“মেয়েকে দেখেছেন? কার মতোন হয়েছে? আমি দেখিনি। আবছাভাবে শুনেছি মেয়ে হয়েছে।”
সরফরাজ তার মাথার উষ্কখুষ্ক চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“দেখেছি তন্দ্রাবতী, তোমার মতো হয়েছে। অবিকল তোমার মতো। দেখি উঠিয়ে বসাই, কোলে নিয়ে দেখো কার মতো হয়েছে।”
সরফরাজ তন্দ্রাকে সাবধানে উঠিয়ে বসালো। সেলাই কাঁচা। তন্দ্রাকে ধরতেও অজান্তে তার পা কাঁপলো।মেয়েকে কোলে দিতেই তন্দ্রা হা করে বললো,
-“আল্লাহ! আপনার মতো হয়েছে তো। মিথ্যে বললেন কেনো?”
সরফরাজ হাসলো। মেয়ের মুখে তাকালো। একটু আগেই তো তন্দ্রার মতো লাগছিলো এখন আবার তার মতো দেখাচ্ছে কেনো? অদ্ভুত!
মেয়েকে তন্দ্রার কোলে রেখেই সরফরাজ বেরিয়ে গেলো। সায়ন ইভা দুজনেই গভীর ঘুম। সায়নের গালটা ইভার মাথার তালুর উপর হেলে রয়েছে। সরফরাজ নেওয়াজ সাহেবকে খুঁজলো। মাগরিবের পর ইভার বিয়ে। মানুষজন দাওয়াত দেয়া বিশাল অনুষ্ঠান। পেছানো অসম্ভব। অন্তত মেয়েগুলোকে নিয়ে কারো একজনের বাসায় যাওয়া দরকার।
~চলবে~