#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ৫
শহরে তুষারপাত চলছে জোরেসোরেই। তাই আর শপিং মল যাওয়া হলো না অবনীর। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে সেটা। তাই সকাল বেলা গুগলে নিউজ আপডেট দেখেই জায়েদ রহমান সেদিকে যেতে নিষেধ করে দিলেন। অবনী কাজ না পেয়ে ঘরে বসে আছে। কাঁচ দেয়ালের পর্দাটা টেনে বাইরে তাকিয়ে আছে স্থিরভাবে। কি দেখছ সেটা নিজের মনেই নিজে ঠাওর করতে পারছে না। মনের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। জুনায়েদকে নিয়ে গত রাতে জায়েদ রহমানের সাথে কথা হলেও নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো যথেষ্ট ছিল না সেসব। জুনায়েদের এমন উগ্র আচরণ শুধু তার সাথে হলে হয়তো মেনে নিত। কিন্তু ছেলেটা তো তেমন না। বাড়িতে ঠিক মত খাচ্ছে না। এমনকি রাতেও আসছে না। কিন্তু সে তো জানতো যে এই বাড়িতে আসার পর জুনায়েদ এসব করবে। এটাই স্বাভাবিক। না করাটাই অস্বাভাবিক ছিলো। তাহলে তার এতো সমস্যা হচ্ছে কেনো? সাভাবিক ভাবে কেনো নিতে পারছে না সে। দরজায় টোকা দিতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো অবনী। দরজা খুলে জায়েদ রহমান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
— বাবা ভেতরে আসুন।
জায়েদ রহমান মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন
— একা একা কি করছো ঘরে?
অবনী নরম কণ্ঠে বললো
— কিছু না। এমনি শুয়ে ছিলাম।
জায়েদ রহমান মুচকি হেসে বললেন
— বাইরের ওয়েদার এখন মোটামুটি ভালো। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি কাজে। তুমি বাসায় বসে না থেকে একটা কাজ করতে পারো। জুনায়েদের অফিসে চলে যেতে পারো। দুপুরের খাবার টা দুজন বাইরে খেলে নাহয়।
অবনী শান্ত চোখে তাকাল। মলিন মুখে বলল
— অফিসে যাওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না বাবা? আপনার ছেলে কি মনে করবে কে জানে? আর তাছাড়াও আমি অফিসে গেলে আপনার ছেলে আর দুপুরে খাবে না। তাই আমি বাড়িতেই ঠিক আছি বাবা। আপনি ঘুরে আসুন।
জায়েদ রহমান গম্ভীর চেহারা নিয়ে তাকালেন। অবনীর কথাটা তার পছন্দ হয়নি। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন
— অধিকার আদায় করতে হলে তার পেছনে লেগে থাকতে হয়। এমনি এমনি অধিকার তুমি পাবে না। আর জুনায়েদ কি ভাবছে। কিভাবে নিচ্ছে এসব ভাবতে গেলে তোমাদের সম্পর্ক এই জীবনে কখনো ঠিক হবে না। সময় দেয়া মানে এভাবে ঘরে বসে থাকা নয় মামনি। তুমি জুনায়েদের সামনা সামনি থাকার চেষ্টা করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। খুব বেশি সময় লাগবে না।
অবনী উত্তর দিলো না। জায়েদ রহমান বললেন
— রেডি হয়ে নাও। আমি যাওয়ার পথে তোমাকে নামিয়ে দেবো।
অবনী আর কথা বাড়ালো না। জায়েদ রহমান ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই গভীর ভাবে ভাবলো। কি করবে সে? বাংলাদেশের সাথে সময়টা মিলিয়ে নিয়ে তিশা কে ফোন দিলো। তিশা ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ঝকঝকে স্ক্রিনে হাস্যজ্বল তিশাকে দেখতে পেয়ে চোখ দুটো কিছুটা সস্তি পেলো অবনীর। মলিন মুখে হেসে বললো
— কি করছিস? ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি?
তিশা ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে বলল
— এখনই ঘুম? মাত্র তো ডিনার করলাম। তুই কি করছিস?
অবনী নরম কণ্ঠে বললো
— কিছু না।
তিশা গলার সর শুনেই কিছু একটা আঁচ করলো। বলল
— অবনী কি হয়েছে? তোর মন খারাপ কেনো?
অবনীর ভেতরে চেপে রাখা কষ্টটা এবার দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো। খুব কাছের মানুষের মাঝে তিশা একজন। একদম ছোট বেলার বন্ধু দুজন। তিশার কাছে মিথ্যে বলে লাভ নেই। কোন না কোন ভাবে সে বুঝেই যায়। তাই হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
— আমি কিছুতেই বিষয়টা সহজভাবে নিতে পারছি না তিশা। আমার জন্য জুনায়েদ বাড়িতে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না। এমনকি কাল রাতে তো বাসাতেই আসে নি। আমার শুধু বারবার মনে হচ্ছে আমি ওর সাথে জোর করছি। ওর তো নিজের একটা ব্যাক্তিগত মতামত আছে। আর সেই ব্যাক্তিগত জায়গাটা থেকে সে আদৌ আমাকে পছন্দ করে কিনা সেটা আমি কিভাবে বুঝবো? আমি আর পারছি না তিশা। আমি দেশে ফিরে যেতে চাই।
তিশা অবনীর কথা শুনে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলো। তারপর বলল
— এটা কোন সমাধান নয় অবনী। তুই ওই বাড়ির বউ। আর জুনায়েদ তোর স্বামী। সে হিসেবে ওর উপরে জোর করার অধিকার তোর আছে। এটা নিয়ে এভাবে ভাবার কিছু নেই। আমার মনে হয় জুনায়েদকে একটু সময় দেয়া দরকার। ওর মনে তোর জন্য অনুভূতি তৈরী হওয়ার জন্য একটা প্লেস দরকার অন্তত।
অবনী মনোযোগ দিলো। বলল
— কিভাবে?
তিশা হতাশ গলায় বলল
— অভিয়াসলী এভাবে আলাদা থেকে নয়। এরকম থাকলে তোর মাথায় এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতেই থাকবে আর জুনায়েদের মনে কোনদিনও জায়গা তৈরি হবে না। শোন তুই এখন চেষ্টা করবি যে করেই হোক জুনায়েদের সাথে বন্ধুত্ব করার। তারপর ধীরে ধীরে ওর ঘরে ঢুকে পড়বি। এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে। আপাতত বন্ধুত্ব করাটাই তোর মিশন।
অবনী হতাশ শ্বাস ছাড়লো। বলল
— ও তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না। আর বন্ধুত্ব করবে কিভাবে?
— কিসব ছোটো বাচ্চার মত কথা বলছিস? ঝগড়া করতে করতে প্রেম ভালোবাসা হয়ে বাচ্চার বাবা মা হয়ে যাচ্ছে। আর তুই তোর বিয়ে করা বরকে পটাতে পারছিস না? তুই কি ধরনের মেয়ে অবনী?
তিশার কথা শুনে অবনীর কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। আসলেই কি বিষয়টা এতটাই সহজ? একটা মানুষের মনে জায়গা করে নেয়া খুব সহজ কোন ব্যাপার না। আর জুনায়েদের মত ইন্ট্রোভার্ট একজনের মনে জায়গা করে নেয়া তো পাহাড় কেটে বাড়ি বানানোর মতই কঠিন ব্যাপার। কিছু সময় ভাবতেই অবনীর মনে পড়ে গেলো জায়েদ রহমানের কথা। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
— আমি তো ভুলেই গেছি। বাবার সাথে বের হবো। আমি ফিরে এসে তোকে ফোন দিবো তিশা।
তিশা উঠে বসলো। কৌতূহলী কণ্ঠে বললো
— কোথায় যাবি তুই?
অবনী বিশাল আলমারিটা খুলে কাপড় বের করতে করতে বলল
— জুনায়েদের অফিসে। দুপুরে ওর সাথেই লাঞ্চ করবো।
তিশা চিৎকার করে উঠলো। বলল
— ওহো! এতক্ষণ ধরে এতো কথা বললি আর গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলতে ভুলে গেছিস। তুই কেমন রে?
অবনী কাপড় বের করে এনে বলল
— মনটা খুব খারাপ ছিল তাই মাথাতেই ছিলনা বিষয়টা। আমি পরে ফোন দিবো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তিশা মুচকি হেসে বলল
— ঠিক আছে। কিন্তু কি বললাম সেটা মাথায় আছে তো? মনে রাখিস।
অবনী মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। বলল
— মাথায় আছে ম্যাডাম। মনে থাকবে। বাই।
ফোনটা কেটে দিয়ে রেডি হয়ে নিচে নেমে গেলো। জায়েদ রহমান নিচে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। অবনী এগিয়ে এসে অপরাধীর মতো বলল
— একটু দেরি হয়ে গেল বাবা।
জায়েদ রহমান হেসে উঠে দাড়ালেন। বললেন
— আরে তেমন দেরি হয়নি। ড্রাইভার গাড়ি বের করলো মাত্র। চলো তাহলে।
দুজনেই বের হয়ে গেলো। গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার হিটার অন করে দিলো। বাইরের ওয়েদার বেশ ঠাণ্ডা হলেও গাড়ির ভেতরে এখন অনেকটা আরাম। অবনী হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লো। বন্ধ জানালার ওপাশে তাকিয়ে রাস্তার আশেপাশে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। জায়েদ রহমান বিষয়টা খেয়াল করেই অবনীকে আশপাশটা পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো। অবনীও বেশ মনযোগ দিয়ে আয়ত্ব করে নিচ্ছে। যাতে এর পরের বার থেকে একাই বের হতে পারে। অবনী খেয়াল করলো এতক্ষণের মনের গুমোট ভাবটা কেটে গেছে। এখন একটু হলেও ভালো লাগছে। জুনায়েদের অফিসের সামনে এসে গাড়ি থেমে গেলো। জায়েদ রহমান অবনীর সাথেই গাড়ি থেকে নামলেন। কথা বলতে বলতে তাকে ভেতরে রিসিপশনে পৌঁছে দিয়ে বললেন
— তুমি জুনায়েদের সাথে বাড়ি চলে যেও। আমার কাজ শেষ হতে দেরি হবে।
বলেই তিনি চলে গেলেন। বাকিটা অবনী একাই সামলে নিতে পারবে। যথেষ্ট শিক্ষিত মেয়ে সে। রিসিপশনের মেয়েটা তাকে দেখে বলল
— হাউ মে আই হেল্প ইউ ম্যাম?
অবনী মেয়েটির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। কথা বলার ধরনটা ইংরেজদের মতো হলেও চেহারাটা কিন্তু তাদের মতো নয়। কিঞ্চিৎ বাঙ্গালীআনার ছোঁয়া আছে। মেয়েটা কি তাহলে বাঙালি? ইতস্তত করে বলল
— আই ওয়ান্ট টু মিট মিস্টার জুনায়েদ ইশতিয়াক।
মেয়েটি সৌজন্য হেসে বলল
— ডু ইউ হ্যাভ এনি এপয়েন্টমেন্ট?
অবনী মাথা নাড়লো। মেয়েটি হতাশা ভরা কণ্ঠে বললো
— আই এম সো সরি! আই কান্ট ডু এনিথিং ম্যাম।
অবনী আহত চোখে তাকাল। মাথা ঘুরে যাচ্ছে তার। জুনায়েদকে না জানিয়ে আসাটা একদম ঠিক হয়নি। এখন কি করবে? মেয়েটির দিকে তাকাল আবারও। মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কৌতূহলী দৃষ্টি তার। সেও অবনীর মতই বুঝতে চেষ্টা করছে সে কোন দেশের। দ্বিধা ফেলে অবনী জিজ্ঞেস করে বসলো
— আপনি কি বাঙ্গালী?
মেয়েটি কিছুটা অবাক হলো। বিস্ময়কর চাহুনি ফেলে তাকাল কয়েক মুহূর্ত। অতঃপর সকল বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল
— আমার বাড়ি কলকাতায়। আমিও বাংলা বলতে পারি। আপনাকে দেখে আমিও ঠিক এমনটাই ভাবছিলাম। আপনার চেহারা দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম যে আপনি বাঙ্গালী।
অবনী হেসে ফেললো। কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল দুজনের মাঝে। এক পর্যায়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো
— জুনায়েদ স্যারের সাথে কি দরকার আপনার? মানে সেটা বললে হয়তো আমি সাহায্য করতে পারি।
অবনী অসস্তি নিয়ে বলল
— আমি ওনার ওয়াইফ। আসলে ওনাকে না বলেই এসেছি তো তাই।
বিস্ময় নিয়ে তাকাল মেয়েটি। বলল
— সরি ম্যাম। আগে বললেই পারতেন। অপেক্ষা করতে হতো না। আসলে এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করার নিয়ম নেই তাই আমি স্যারকে জানাতে পারছিলাম না। আপনি আমার সাথে আসুন স্যার কনফারেন্স রুমে মিটিং করছেন। আমি ওনাকে ইনফর্ম করছি।
বলেই অবনীকে নিয়ে চলে গেলো সেদিকে। জুনায়েদ তখন কাঁচের দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ ঘরে একটা মিটিংয়ে ব্যস্ত। সেটা প্রায় শেষের দিকে। কিছু আনুষঙ্গিক কথাবার্তা চলছে। অবনীকে বাইরে দাঁড়িয়ে রেখেই মেয়েটি দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকে গেলো। জুনায়েদ একটু বিরক্ত হতেই মেয়েটি বলল
— অবনী নামে একজন এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে।
জুনায়েদ বেশ অবাক হলো। অবনী এখানে কেনো আসবে? কাঁচের দেয়ালের বাইরের দিকে তাকাল। অবনীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে। মুহূর্তেই চেহারা থমথমে হয়ে গেলো তার। আশ্চর্য! কখন এলো মেয়েটা? তাকে কিছু জানায়নি কেনো? এভাবে অফিস পর্যন্ত চলে এলো। অদ্ভুত মেয়ে তো! সেদিকে তাকিয়েই বলল
— আমার রুমে নিয়ে বসাও। আমি আসছি।
মেয়েটি বাইরে চলে গেলো। অবনীকে কিছু একটা বলতেই সে পেছনে পেছনে গেলো। জুনায়েদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সামনে বসে থাকা ইংরেজ সবটা খেয়াল করলো। জুনায়েদ এর দিকে ফিরে বললো
— হু ইজ শী?
জুনায়েদ সম্বিৎ ফিরে পেলো। লোকটির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। উৎফুল্লতার সাথে বলল
— শী ইজ মাই ওয়াইফ। মিসেস জুনায়েদ ইশতিয়াক!
চলবে….